কর্ম্মফল/অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ
অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ।
সতীশ। বড় সাহেব হিসাবের খাতাপত্র কাল দেখবেন। মনে করেছিলেম ইতিমধ্যে “গানির” টাকাটা নিশ্চয় পাওয়া যাবে তহবিল পূরণ করে রাখব—কিন্তু বাজার নেমে গেল। এখন জেল ছাড়া গতি নেই। ছেলেবেলা হতে সেখানে যাবারই আয়োজন করা গেছে!
কিন্তু অদৃষ্টকে ফাঁকি দেব! এই পিস্তলে দুটি গুলি পুরেচি—এই যথেষ্ট! নেলি—না না ও নাম নয়, ও নাম নয়—আমি তাহলে মরতে পারব না। যদি বা সে আমাকে ভালবেসে থাকে, সে ভালবাসা আমি ধূলিসাৎ করে দিয়ে এসেচি। চিঠিতে আমি তার কাছে সমস্তই কবুল করে লিখেছি। এখন পৃথিবীতে আমার কপালে যার ভালবাসা বাকি রইল সে আমার এই পিস্তল! আমার অন্তিমের প্রেয়সী, ললাটে তোমার চুম্বন নিয়ে চক্ষু মুদব! মেসোমশায়ের এ বাগানটি আমারই তৈরি। যেখানে যত দুর্ল্লভ গাছ পাওয়া যায় সব সংগ্রহ করে এনেছিলেম। ভেবে ছিলেম এ বাগান এক দিন আমারই হবে। ভাগ্য কার জন্য আমাকে দিয়ে এই গাছগুলো রোপণ করে নিচ্ছিল, তা আমাকে তখন বলে নি—তা হোক্, এই ঝিলের ধারে এই বিলাতি ষ্টিফানোটিস্ লতার কুঞ্জে আমার “এ জন্মের হাওয়া খাওয়া শেষ করব—মৃত্যুর দ্বারা আমি এ বাগান দখল করে নেব—এখানে হাওয়া খেতে আসতে আর কেউ সাহস করবে না!
মেসোমশায়কে প্রণাম করে পায়ের ধূল নিতে চাই। পৃথিবী হতে ঐ ধূলটুকু নিয়ে যেতে পারলে আমার মৃত্যু সার্থক হত। কিন্তু এখন সন্ধ্যার সময় তিনি মাসীমার কাছে আছেন—আমার এ অবস্থায় মাসীমার সঙ্গে দেখা করতে আমি সাহস করিনে! বিশেষতঃ পিস্তল ভরা আছে!
মরবার সময় সকলকে ক্ষমা করে শান্তিতে মরবার উপদেশ শাস্ত্রে আছে। কিন্তু আমি ক্ষমা করতে পারলেম না। আমার এ মরবার সময় নয়। আমার অনেক সুখের কল্পনা, ভোগের আশা ছিল—অল্প কয়েক বৎসরের জীবনে তা একে একে সমস্তই টুকরা টুক্রা হয়ে ভেঙেচে। আমার চেয়ে অনেক অযোগ্য অনেক নির্ব্বোধ লোকের ভাগ্যে অনেক অযাচিত সুখ জুটেছে, আমার জুটেও জুটল না—সে জন্য যারা দায়ী তাদের কিছুতেই ক্ষমা করতে পারব না- কিছুতেই না। আমার মৃত্যুকালের অভিশাপ যেন চিরজীবন তাদের পিছনে পিছনে ফেরে—তাদের সকল সুখকে কানা করে দেয়। তাদের তৃষ্ণার জলকে বাষ্প করে দেবার জন্য আমার দগ্ধ জীবনের সমস্ত দাহকে যেন আমি রেখে যেতে পারি!
হায়! প্রলাপ! সমস্তই প্রলাপ! অভিশাপের কোনো বলই নেই! আমার মৃত্যু কেবল আমাকেই শেষ করে দেবে—আর কারো গায়ে হাত দিতে পারবে না! আঃ-তারা আমার জীবনটাকে একেবারে ছারখার করে দিলে আর আমি মরেও তাদের কিছুই করতে পারলেম না। তাদের কোন ক্ষতি হবে না—তারা সুখে থাকবে তাদের দাঁতমাজা হতে আরম্ভ করে মশারি-ঝাড়া পর্যন্ত কোন তুচ্ছ কাজটিও বন্ধ থাকবে না—অথচ আমার সূর্য্য চন্দ্র নক্ষত্রের সমস্ত আলোক এক ফুৎকারে নিবল—আমার নেলি—উঃ ও নাম নয়!
ও কেও! হরেন! সন্ধ্যার সময় বাগানে বার হয়েচ যে! বাপমাকে লুকিয়ে চুরি করে কাঁচা পেয়ারা পাড়তে এসেচে। ওর আকাঙ্ক্ষা ঐ কাঁচা পেয়ারার চেয়ে আর অধিক উচ্চে চড়ে নি—ঐ গাছের নীচু ডালেই ওর অধিকাংশ সুখ ফলে আছে। পৃথিবীতে ওর জীবনের কি মূল্য! গাছের একটা কাঁচা পেয়ারা যেমন এ সংসারে ওর কাঁচা জীবনটাই বা তার চেয়ে কি এমন বড়। এখনি যদি ছিন্ন করা যায়, তবে জীবনের কত নৈরাশ্য হতে ওকে বাঁচানো যায় তা কে বলতে পারে? আর মাসীমা-ইঃ! একেবারে লুটাপুটি করতে থাকবে। আঃ!
ঠিক সময়টি, ঠিক স্থানটি, ঠিক লোকটি! হাতকে আর সামলাতে পাচ্চিনে! হাতটাকে নিয়ে কি করি! হাতটাকে নিয়ে কি করা যায়।
(ছড়ি লইয়া সতীশ সবেগে চারা গাছগুলিকে ক্রমাগত আঘাত করিতে লাগিল। তাহাতে তাহার উত্তেজনা ক্রমশঃ আরো বাড়িয়া উঠিতে লাগিল। অবশেষে নিজের হাতকে সে সবেগে আঘাত করিল; কিন্তু কোন বেদনা বোধ করিল না। শেষে পকেটের ভিতর হইতে পিস্তল সংগ্রহ করিয়া লইয়া সে হরেনের দিকে সবেগে অগ্রসর হইতে লাগিল)।
হরেন। (চমকিয়া উঠিয়া) এ কি! দাদা না কি! তোমার দুটি পায়ে পড়ি দাদা, তোমার দুটি পায়ে পড়ি—বাবাকে বলে দিয়ো না!
সতীশ। (চীৎকার করিয়া) মেসোমশায়— মেসোমশায়—এই বেলা রক্ষা কর—আর দেরি কোরো না-তোমার ছেলেকে এখনো রক্ষা কর?
শশধর। (ছুটিয়া আসিয়া) কি হয়েছে সতীশ! কি হয়েছে!
সুকুমারী। (ছুটিয়া আসিয়া) কি হয়েছে আমার বাছার কি হয়েছে!
হরেন। কিছুই হয় নি মা—কিছুই না-দাদা তোমাদের সঙ্গে ঠাট্টা করছেন।
সুকুমারী। এ কি রকম বিশ্রী ঠাট্টা! ছি ছি, সকলি অনাসৃষ্টি! দেখ দেখি! আমার বুক এখনো ধড়াস্ ধড়াস্ করচে! সতীশ, মদ ধরেচে বুঝি! সতীশ। পালাও—তোমার ছেলেকে নিয়ে এখনি পালাও! নইলে তোমাদের রক্ষা নেই! (হরেনকে লইয়া ত্রস্তপদে সুকুমারীর পলায়ন)
শশধর। সতীশ, অমন উতলা হয়ে না! ব্যাপারটা কি বল! হরেনকে কার হাত হতে রক্ষা করবার জন্য ডেকেছিলে?
সতীশ। আমার হাত হতে। (পিস্তল দেখাইয়া) এই দেখ মেসোমশায়!
দ্রুতপদে বিধুমুখীর প্রবেশ।
বিধু। সতীশ, তুই কোথায় কি সর্ব্বনাশ করে এসেছিস বলদেখি! আপিসের সাহেব পুলিশ সঙ্গে নিয়ে আমাদের বাড়িতে খানাতল্লাসি করতে এসেচে। যদি পালাতে হয় ত এই বেলা পালা! হায় ভগবান, আমি ত কোন পাপ করিনি আমারি অদৃষ্টে এত দুঃখ ঘটে কেন?
সতীশ। ভয় নেই—পালাবার উপায় আমার হাতেই আছে।
শশধর। তবে কি তুমি-
সতীশ। তাই বটে মেসোমশায়—যা সন্দেহ করচ তাই! আমি চুরি করে মাসীর ঋণ শোধ করেচি। আমি চোর! মা, শুনে খুসি হবে, আমি চোর, আমি খুনী! এখন আর কাঁদতে হবে না—যাও যাও আমার সম্মুখ হতে যাও! আমার অসহ্য বোধ হচ্চে!
শশধর। সতীশ, তুমি আমার কাছেও ত কিছু ঋণী আছ, তাই শোধ করে যাও!
সতীশ। বল, কেমন করে শোধ করব! কি আমি দিতে পারি! কি চাও তুমি!
শশধর। ঐ পিস্তলটা দাও!
সতীশ। এই দিলাম! আমি জেলেই যাব! না গেলে আমার পাপের ঋণশোধ হবে না!
শশধর। পাপের ঋণ শাস্তির দ্বারা শোধ হয় না সতীশ, কর্ম্মের দ্বারাই শোধ হয়! তুমি নিশ্চয় জেনো আমি অনুরোধ কল্লে তোমার বড় সাহেব তোমাকে জেলে দেবেন না। এখন হতে জীবনকে সার্থক করে বেঁচে থাক!
সতীশ। মেসোমশায়, এখন আমার পক্ষে বাঁচা যে কত কঠিন তা তুমি জান না—মরব নিশ্চয় জেনে পায়ের তলা হতে আমার শেষ সুখের অবলম্বনটা আমি পদাঘাতে ফেলে দিয়ে এসেচি— এখন কি নিয়ে বাঁচব। শশধর। তবু বাঁচতে হবে, আমার ঋণের এই শোধ—আমাকে ফাঁকি দিয়ে পালাতে পারবে না!
সতীশ। তবে তাই হবে।
শশধর। আমার একটা অনুরোধ শোন! তোমার মাকে আর মাসীকে অন্তরের সহিত ক্ষমা কর!
সতীশ। তুমি যদি আমাকে ক্ষমা করতে পার—তবে এ সংসারে কে এমন থাকতে পারে যাকে আমি ক্ষমা করতে না পারি! (প্রণাম করিয়া) মা, আশীর্ব্বাদ কর আমি সব যেন সহ্য করতে পারি—আমার সকল দোষগুণ নিয়ে তোমরা আমাকে যেমন গ্রহণ করেচ সংসারকে আমি যেন তেমনি করে গ্রহণ করি।
বিধু। বাবা, কি আর বলব! মা হয়ে আমি তোকে কেবল স্নেহই করেছি তোর কোন ভাল করতে পারিনি-ভগবান তোর ভাল করুন! দিদির কাছে আমি একবার তোর হয়ে ক্ষমাভিক্ষা করে নিইগে!
দ্রুতপদে নলিনীর প্রবেশ।
নলিনী। সতীশ!
সতীশ। কি নলিনী!
নলিনী। এর মানে কি? এ চিঠি তুমি আমাকে কেন লিখেচ?
সতীশ। মানে যেমন বুঝেছিলে সেইটেই ঠিক! আমি তোমাকে প্রতারণা করে চিঠি লিখি নি। তবে আমার ভাগ্যক্রমে সকলি উল্টা হয়। তুমি মনে করতে পার তোমার দয়া উদ্রেক করবার জন্যই আমি—কিন্তু মেসোমশায় সাক্ষী আছেন আমি অভিনয় করছিলেম না—তবু যদি বিশ্বাস না হয় প্রতিজ্ঞারক্ষা করবার এখনো সময় আছে!
নলিনী। কি তুমি পাগলের মত বকচ? আমি তোমার কি অপরাধ করেছি যে তুমি আমাকে এমন নিষ্ঠুর ভাবে—
সতীশ। যে জন্য আমি এই সংকল্প করেছি সে তুমি জান নলিনী—আমি ত একবর্ণও গোপন করিনি তবু কি আমার উপর তোমার শ্রদ্ধা আছে?
নলিনী। শ্রদ্ধা! সতীশ, তোমার উপর ঐ জন্যই আমার রাগ ধরে! শ্রদ্ধা ছি, ছি, শ্রদ্ধা ত পৃথিবীতে অনেকেই অনেককে করে! তুমি যে কাজ করেছ আমিও তাই করেছি—তোমাতে আমাতে কোন ভেদ রাখিনি। এই দেখ আমার গহনাগুলি সব এনেচি—এগুলো এখনো আমার সম্পত্তি নয়—এগুলি আমার বাপ মায়ের। আমি তাঁদিগকে না বলে এনেচি এর কত দাম হতে পারে আমি কিছুই জানিনে; কিন্তু এ দিয়ে কি তোমার উদ্ধার হবে না?
শশধর। উদ্ধার হবে এই গহনাগুলির সঙ্গে আরো অমূল্য যে ধনটি দিয়েচ তা দিয়েই সতীশের উদ্ধার হবে।
নলিনী। এই যে শশধর বাবু, মাপ করবেন, তাড়াতাড়িতে আপনাকে আমি-
শশধর। মা, সে জন্য লজ্জা কি! দৃষ্টির দোষ কেবল আমাদের মত বুড়োদেরই হয় না—তোমাদের বয়সে আমাদের মত প্রবীন লোক হঠাৎ চোখে ঠেকেনা! সতীশ, তোমার আপিশের সাহেব এসেচেন্ দেখ্চি। আমি তাঁর সঙ্গে কথাবার্ত্তা কয়ে আসি, ততক্ষণ তুমি আমার হ’য়ে অতিথিসৎকার কর। মা, এই পিস্তলটা এখন তোমার জিম্বাতেই থাকতে পারে।