কর্ম্মফল/নবম পরিচ্ছেদ



নবম পরিচ্ছেদ।


 বিধু। আমার উপর রাগ কর যা কর ছেলের উপর কোরো না। তোমার পায়ে ধরি এবারকার মত তার দেনাটা শোধ করে দাও!

 মন্মথ। আমি রাগারগি করচিনে, আমার যা কর্ত্তব্য তা আমাকে করতেই হবে! আমি সতীশকে বার বার বলেচি দেনা করলে শোধবার ভার আমি নেব না। আমার সে কথার অন্যথা হবে না!

 বিধু। ওগো এত বড় সত্যপ্রতিজ্ঞ যুধিষ্টির হলে সংসারে চলে না! সতীশের এখন বয়স হয়েচে তাকে জলপানি যা দাও তাতে ধার না করে তাহার চলে কি করে বল দেখি।

 মন্মথ। যার যেরূপ সাধ্য তার চেয়ে চাল বড় করলে কারোই চলে না, ফকিরেরও না বাদসারও না।

 বিধু। তবে কি ছেলেকে জেলে যেতে দেবে?  মন্মথ। সে যদি যাবার আয়োজন করে এবং তোমরা যদি তার যোগাড় দাও তবে আমি ঠেকিয়ে রাখব কি করে? (প্রস্থান)

শশধরের প্রবেশ।

 শশধর। আমাকে এ বাড়ীতে দেখলে মন্মথ ভয় পায়। ভাবে কালো কোর্ত্তা ফরমাস দেবার জন্য ফিতা হাতে তার ছেলের গায়ের মাপ নিতে এসেছি। তাই ক’দিন আসিনি আজ তোমার চিঠি পেয়ে সুকু কান্নাকাটি করে আমাকে বাড়ী ছাড়া করেচে।

 বিধু। দিদি আসেন নি?

 শশধর। তিনি এখনি আসবেন। ব্যাপারটা কি?

 বিধু। সবই ত শুনেছ। এখন ছেলেটাকে জেলে না দিলে ওঁর মন সুস্থির হচ্ছে না। র‍্যাঙ্কিন হার্ম্মানের পোষাক তাঁর পছন্দ হল না, জেলখানার কাপড়টাই বোধ হয় তাঁর মতে বেশ সুসভ্য।

 শশধর। আর যাই বল, মন্মথকে বোঝাতে যেতে আমি পারব না। তার কথা আমি বুঝি নে আমার কথাও সে বোঝে না, শেষকালে—  বিধু। সে কি আমি জানি নে? তোমরা ত তাঁর স্ত্রী নও যে মাথা হেঁট করে সমস্তই সহ্য করবে! কিন্তু এখন এ বিপদ ঠেকাই কি করে?

 শশধর। তোমার হাতে কিছু কি  বিধু। কিছুই নেই—সতীশের ধার শুধ্‌তে আমার প্রায় সমস্ত গহনাই বাঁধা পড়েছে হাতে কেবল বালাজোড়া আছে।

সতীশের প্রবেশ।

 শশধর। কি সতীশ, খরচপত্র বিবেচনা করে কর না এখন কি মুস্কিলে পড়েছ দেখ দেখি!

 সতীশ। মুস্কিল ত কিছুই দেখি নে।

 শশধর। তবে হাতে কিছু আছে বুঝি! ফাঁস কর নি।

 সতীশ। কিছু ত আছেই।

 শশধর। কত?

 সতীশ। আফিম কেনবার মত।

 বিধু। (কাঁদিয়া উঠিয়া) সতীশ, ও কি কথা তুই বলিস, আমি অনেক দুঃখ পেয়েছি, আমাকে আর দগ্ধাসনে।  শশধর। ছি ছি সতীশ। এমন কথা যদিবা কখনো মনেও আসে তবু কি মার সামনে উচ্চারণ করা যায়? বড় অন্যায় কথা।

সুকুমারীর প্রবেশ।

 বিধু। দিদি সতীশকে রক্ষা কর। ও কোন্‌ দিন কি করে বসে আমি ত ভয়ে বাঁচি নে। ও যা বলে শুনে আমার গা কাঁপে।

 সুকুমারী। ও আবার কি বলে।

 বিধু। বলে কিনা আফিম কিনে আনবে।

 সুকুমারী। কি সর্ব্বনাশ! সতীশ আমার গা ছুঁয়ে বল এমন কথা মনেও আনবি নে! চুপ করে রইলি যে! লক্ষী বাপ আমার! তোর মা মাসীর কথা মনে করিস্‌।

 সতীশ। জেলে বসে মনে করার চেয়ে এ সমস্ত হাস্যকর ব্যাপার জেলের বাইরে চুকিয়ে ফেলাই ভাল!

 সুকুমারী। আমরা থাকতে তোকে জেলে কে নিয়ে যাবে?

 সতীশ। পেয়াদা।  সুকুমারী। আচ্ছা সে দেখব কত বড় পেয়াদা; ও গো এই টাকাটা ফেলে দাও না, ছেলে মানুষকে কেন কষ্ট দেওয়া!

 শশধর। টাকা ফেলে দিতে পারি কিন্তু মন্মথ আমার মাথায় ইঁট ফেলে না মারে।

 সতীশ। মেশোমশায়, সে ইঁট তোমার মাথায় পৌঁচ্‌বে না, আমার ঘাড়ে পড়বে। একে একজামিনে ফেল করেছি, তার উপরে দেন, এর উপরে। জেলে যাবার এত বড় সুযোগটা যদি মাটি হয়ে যায় তবে বাবা আমার সে অপরাধ মাপ করবেন না।

 বিধু। সত্যি দিদি। সতীশ মেসোর টাকা নিয়েচে শুনলে তিনি বোধ হয় ওকে বাড়ী হতে বার করে দেবেন।

 সুকুমারী। তা দিন না! আর কি কোথাও বাড়ি নাই না কি! ও বিধু সতীশকে তুই আমাকেই দিয়ে দে না! আমার ত ছেলেপুলে নেই, আমি না হয় ওকেই মানুষ করি! কি বলগো!

 শশধর। সে ত ভালই। কিন্তু সতীশ যে বাঘের বাচ্ছা, ওকে টানতে গেলে তার মুখ থেকে প্রাণ বাঁচান দায় হবে!  সুকুমারী। বাঘ মশায় ত বাচ্ছাটিকে জেলের পেয়াদার হাতেই সমর্পণ করে দিয়েছেন আমরা যদি তাকে বাঁচিয়ে নিয়ে যাই এখন তিনি কোন কথা বলতে পারবেন না।

 শশধর। বাঘিনী কি বলেন, বাচ্ছাই বা কি বলে!

 সুকুমারী। যা বলে সে আমি জানি সে কথা আর জিজ্ঞাসা করতে হবে না! তুমি এখন দেনাটা শোধ করে দাও!

 বিধু। দিদি!

 সুকুমারী। আর দিদি দিদি করে কাঁদতে হবে না! চল্‌ তোর চুল বেঁধে দিই গে! এমন ছিরি করে তোর ভগ্নীপতির সাম্‌নে বাহির হতে লজ্জা করে না! (শশধর ব্যতীত সকলের প্রস্থান)

মন্মথর প্রবেশ।

 শশধর। মন্মথ ভাই তুমি একটু বিবেচনা করে দেখ—

 মন্মথ। বিবেচনা না করে ত আমি কিছুই করি না।  শশধর। তবে দোহাই তোমার, বিবেচনা একটু খাট কর! ছেলেটাকে কি জেলে দেবে? তাতে কি ওর ভাল হবে?

 মন্মথ। ভালমন্দর কথা কেউই শেষ পর্য্যন্ত ভেবে উঠ্‌তে পারে না। কিন্তু আমি মোটামুটি এই বুঝি যে, বার বার সাবধান করে দেওয়ার পরও যদি কেউ অন্যায় করে তবে তার ফলভোগ হতে তাকে কৃত্রিম উপায়ে রক্ষা করা কারও উচিৎ। হয় না। আমরা যদি মাঝে পড়ে ব্যর্থ করে না দিতেম তবে প্রকৃতির কঠিন শিক্ষায় মানুষ যথার্থ মানুষ হয়ে উঠ্‌তে পারত।

 শশধর। প্রকৃতির কঠোর শিক্ষাই যদি একমাত্র শিক্ষা হত তবে বিধাতা বাপমায়ের মনে স্নেহটুকু দিতেন না। মন্মথ তুমি যে দিনরাত কর্ম্মফল কর্ম্মফল কর আমি তা সম্পূর্ণ মানি না। প্রকৃতি আমাদের কাছ হতে কর্ম্মফল কড়ায় গণ্ডায় আদায় করে নিতে চায় কিন্তু প্রকৃতির উপরে যিনি কর্ত্তা আছেন তিনি মাঝে পড়ে তার অনেকটাই মহকুপ দিয়ে থাকেন, নইলে কর্ম্মফলের দেনা শুধ্‌তে শুধ্‌তে আমাদের অস্তিত্ব পর্য্যন্ত বিকিয়ে যেত। বিজ্ঞানের হিসাবে কর্ম্মফল সত্য কিন্তু বিজ্ঞানের উপরেও বিজ্ঞান আছে সেখানে প্রেমের হিসাবে ফলাফল সমস্ত অন্য রকম। কর্ম্মফল নৈসর্গিক-্মার্জ্জনাটা তার উপরের কথা।

 মন্মথ। যিনি অনৈসর্গিক মানুষ তিনি যা খুসি করবেন, আমি অতি সামান্য নৈসর্গিক, আমি কর্ম্মফল শেষ পর্য্যন্তই মানি।

 শশধর। আচ্ছা আমি যদি সতীশের দেনা শোধ করে তাকে খালাস করি তুমি কি করবে?

 মন্মথ। আমি তাকে ত্যাগ করব। দেখ সতীশকে আমি যে ভাবে মানুষ করতে চেয়েছিলেম প্রথম হতেই বাধা দিয়ে তোমরা তা ব্যর্থ করেছ। একদিক হতে সংযম আর একদিক হতে প্রশ্রয় পেয়ে সে একেবারেই নষ্ট হয়ে গেছে। ক্রমাগতই ভিক্ষা পেয়ে যদি তার সম্মানবোধ এবং দায়িত্ববোধ চলে যায়, যে কাজের যে পরিণাম তোমরা যদি মাঝে পড়ে। কিছুতেই তাকে তা বুঝতে না দাও তবে তার আশা আমি ত্যাগ করলেম। তোমাদের মতেই তাকে মানুষ কর—দুই নৌকয়। পা দিয়েই তাহার বিপদ ঘটেছে।  শশধর। ও কি কথা বলছ মন্মথ—তোমার ছেলে—

 মন্মথ। দেখ শশধর নিজের প্রকৃতি ও বিশ্বাসমতেই নিজের ছেলেকে আমি মানুষ করতে পারি, অন্য কোন উপায় ত জানি না। যখন নিশ্চয় দেখছি তা কোন মতেই হবার নয় তখন পিতার দায়িত্ব আমি আর রাখব না। আমার যা সাধ্য তার বেশী আমি করতে পারব না!

মন্মথর প্রস্থান।

 শশধর। কি করা যায়! ছেলেটাকে ত জেলে দেওয়া যায় না! অপরাধ মানুষের পক্ষে যত সর্ব্বনেশেই হৌক্‌ জেলখানা তার চেয়ে ঢের বেশী।