কাদম্বরী (তারাশঙ্কর তর্করত্ন, ১৮৯২)/কথারম্ভ-১
কথারম্ভ
অবন্তি দেশে উজ্জয়িনী নামে নগরী আছে। যে স্থানে ভুবনত্রয়ের সর্গস্থিতিসংহারকারী মহাকালাভিধান ভগবান্ দেবাদিদেব মহাদেব অবস্থিতি করেন। যে স্থানে শিপ্রানদী তরঙ্গরূপ ভ্রুকুটি বিস্তার পূর্ব্বক ভাগীরথীর প্রতি উপহাস করিয়া বেগবতী হইয়া প্রবাহিত হইতেছে। তথায় তারাপীড় নামে মহাযশস্বী তেজস্বী প্রবলপ্রতাপ নরপতি ছিলেন। তিনি অর্জ্জুনের ন্যায় নিজভুজবলে অখণ্ড ভূমণ্ডল জয় ও প্রজাগণের ক্লেশ দূর করিয়া সুখে রাজ্য ভোগ করেন। তাঁহার গুণে বশীভূত হইয়া লক্ষ্মী কমলবন তুচ্ছ করিয়া, নারায়ণবক্ষঃস্থল পরিত্যাগ করিয়া, তাঁহাকেই গাঢ় আলিঙ্গন করিয়াছিলেন; সরস্বতী চতুর্ম্মুখের মুখপরম্পরায় বাস করা ক্লেশকর বোধ করিয়া তাঁহারই রসনামণ্ডলে সুখে অবস্থিতি করিয়াছিলেন। তাঁহার অমাত্যের নাম শুকনাস। শুকনাস ব্রাহ্মণকুলে জন্ম গ্রহণ করেন। তিনি সকল শাস্ত্রের পারদর্শী, নীতিশাস্ত্রপ্রয়োগকুশল, ভূভারধারণক্ষম, অগাধবুদ্ধি, ধীরপ্রকৃতি, সত্যবাদী ও জিতেন্দ্রিয়। তাঁহার পত্নীর নাম মনোরমা। ইন্দ্রের বৃহস্পতি, নলের সুমতি, দশরথের বশিষ্ঠ ও রামচন্দ্রের বিশ্বামিত্র যেরূপ উপদেষ্টা ছিলেন; শুকনাসও সেইরূপ রাজকার্য্য পর্য্যালোচনাবিষয়ে রাজাকে যথার্থ সদুপদেশ দিতেন। মন্ত্রীর বুদ্ধি এরূপ তীক্ষ্ণ যে জটিল ও দুরবগাহ কোন কার্য্যসঙ্কট উপস্থিত হইলেও বিচলিত বা প্রতিহত হইত না। শৈশবাবধি অকৃত্রিম প্রণয় সঞ্চার হওয়াতে রাজা তাঁহাকে কোন বিষয়ে অবিশ্বাস করিতেন না। তিনিও বিশুদ্ধ অন্তঃকরণে নৃপতির হিত কার্য্য অনুষ্ঠানে তৎপর ছিলেন। পৃথিবীতে তুল্য প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল না এবং প্রজাদিগের উৎপাত ও অসুখ আকাশকুসুমের ন্যায় অলীক পদার্থ হইয়াছিল, সুতরাং সকল বিষয়ে নিশ্চিন্ত হইয়া শুকনাসের প্রতি রাজ্যশাসনের ভার সমর্পণ পূর্ব্বক রাজা যৌবনসুখ অনুভব করিতেন। কখন জলবিহার, কখন বনবিহার, কখন বা নৃত্য, গীত, বাদ্যের আমোদে সুখে কাল হরণ করেন। শুকনাস সেই অসীম সাম্রাজ্যকার্য্য অনায়াসে সুশৃঙ্খলরূপে সম্পন্ন করিতেন। তাঁহার অপক্ষপাতিতা ও সদ্বিচারগুণে প্রজারা অত্যন্ত বশীভূত ও অনুরক্ত হইয়াছিল।
তারাপীড় এইরূপে সকল সুখের পার প্রাপ্ত হইয়াও সন্তানমুখাবলোকনরূপ সুখলাভ না হওয়াতে মনে মনে অতিশয় দুঃখিত থাকেন। সন্তান না হওয়াতে সংসারে অরণ্য জ্ঞান, জীবনে বিড়ম্বনা জ্ঞান ও শরীর ভারমাত্র বলিয়া বোধ হইয়াছিল এবং আপনাকে অসহায়, অনাশ্রয় ও হতভাগ্য বিবেচনা করিতেন। ফলতঃ তাঁহার পক্ষে সংসার অসার ও অন্ধকার রূপে প্রতীয়মান হইয়াছিল। নৃপতির বিলাসবতীনাম্নী পরমরূপবতী পত্নী ছিলেন। কন্দর্পের রতি ও শিবের পার্ব্বতী যেরূপ পরমপ্রণয়িনী, বিলাসবতীও সেইরূপ রাজার পরমপ্রণয়াস্পদ ছিলেন। একদা মহিষী অতিশয় দুঃখিত অন্তঃকরণে অন্তঃপুরে বসিয়া আছেন, এমন সময়ে নরপতি তথায় উপস্থিত হইয়া দেখিলেন, মহিষী বামকরতলে কপোলদেশ সংস্থাপিত করিয়া বিষণ্ণ বদনে রোদন করিতেছেন; অঙ্গের ভূষণ অঙ্গ হইতে উন্মোচন করিয়া ফেলিয়া দিয়াছেন; অঙ্গরাগ বা অঙ্গসংস্কার কিছুমাত্র নাই। সখীগণ নিঃশব্দে ও দুঃখিত চিত্তে পার্শ্বে বসিয়া আছে। অন্তঃপুরবৃদ্ধারা অনতিদূরে উপবিষ্ট হইয়া প্রবোধবাক্যে আশ্বাস প্রদান করিতেছে। রাজা গৃহের মধ্যে প্রবেশ করিলে মহিষী আসন হইতে উঠিয়া সম্ভাষণ করিলেন। রাজাকে দেখিয়া তাঁহার দুঃখ দ্বিগুণতর হইল ও দুই চক্ষু দিয়া অশ্রুধারা পড়িতে লাগিল। মহিষীর আকস্মিক শোক ও রোদনের কারণ কিছু বুঝিতে না পারিয়া নরপতি মনে মনে কত ভাবনা, কত শঙ্কা ও কল্পনা করিতে লাগিলেন। পরে আসনে উপবিষ্ট হইয়া বসন দ্বারা চক্ষুর জল মুছাইয়া দিয়া মধুর বাক্যে জিজ্ঞাসা করিলেন, প্রিয়ে! কি নিমিত্ত বামকরে বামগণ্ড সংস্থাপন করিয়া বিষণ্ণবদনে ও দীননয়নে রোদন করিতেছ? তোমার দুঃখের কারণ কিছু জানিতে না পারিয়া আমার অন্তঃকরণ অতিশয় ব্যাকুল ও বিষণ্ণ হইতেছে। আমি কি কোন অপরাধ করিয়াছি? অথবা অন্য কেহ প্রজ্বলিত অনলশিখায় হস্তক্ষেপ করিয়া থাকিবেক? যাহা হউক শোকের কারণ বর্ণন করিয়া আমার উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা দূর কর।
রাজা এত অনুনয় করিলেন, বিলাসবতী কিছুই উত্তর দিলেন না—বরং আরও শোকাকুল হইয়া রোদন করিতে লাগিলেন। রাজ্ঞীর তাম্বুলকরঙ্কবাহিনী বদ্ধাঞ্জলি হইয়া নিবেদন করিল, মহারাজ! আপনি কোন অপরাধ করেন নাই এবং রাজমহিষীর নিকটে অন্যে অপরাধ করিবে এ কথাও অসম্ভব। মহিষী যে নিমিত্ত রোদন করিতেছেন তাহা শ্রবণ করুন। সন্তানের মুখাবলোকনরূপ সুখ লাভে বঞ্চিত হইয়া রাণী বহুদিবসাবধি শোকাকুল ছিলেন। কিন্তু মহারাজের মনঃপীড়া হইবে বলিয়া এত দিন দুঃখ প্রকাশ করেন নাই; মনের দুঃখ মনেই গোপন করিয়া রাখিয়াছিলেন। অদ্য চতুর্দ্দশী, মহাদেবের পূজা দিতে মহাকালের মন্দিরে গিয়াছিলেন, তথায় মহাভারত পাঠ হইতেছিল, তাহাতেই শুনিলেন সন্তানবিহীন ব্যক্তিদিগের সদ্গতি হয় না; পুত্ত্র না জন্মিলে পুন্নাম নরক হইতে উদ্ধারের উপায়ান্তর নাই, পুত্ত্রহীন ব্যক্তির ইহলোকে সুখ ও পরলোকে পরিত্রাণ পাইবার সম্ভাবনা নাই; তাহার জীবন, ধন, ঐশ্বর্য্য, সকলই নিষ্ফল। মহাভারতের এই কথা শুনিয়া অবধি রাজ্ঞী অতিশয় উন্মনা ও উৎকণ্ঠিতা হইলেন। বাটী আসিলে সকলে নানাপ্রকার প্রবোধ বাক্যে সান্ত্বনা করিল ও আহার করিতে অনুরোধ করিল; কোন ক্রমেই শান্ত হইলেন না ও আহার করিলেন না। সেই অবধি কাহারও কোন কথার উত্তর দেন না, কাহারও সহিত আলাপ করেন না। কেবল বিষণ্ণবদনে অনবরত রোদন করিতেছেন। এক্ষণে যাহা কর্ত্তব্য করুন।
তাম্বুলকরঙ্কবাহিনীর কথা শুনিয়া রাজা ক্ষণকাল নিস্তব্ধ ও নিরুত্তর হইয়া রহিলেন। পরে দীর্ঘ নিশ্বাস পরিত্যাগ করিয়া কহিলেন, দেবি! দৈবায়ত্ত বিষয়ে শোক ও অনুতাপ করা কোন ক্রমেই বিধেয় নহে। মনুষ্যেরা যত যত্ন ও যত চেষ্টা করুক না কেন, দৈব অনুকূল না হইলে কোন প্রকারে মনোরথ সফল হয় না। পুত্ত্রের আলিঙ্গনে শরীর শীতল হইবে, মুখারবিন্দদর্শনে নেত্র পবিত্র হইবে, অপরিস্ফুট মধুর বচন শ্রবণে কর্ণ জুড়াইবে এমন কি পুণ্য কর্ম্ম করিয়াছি! জন্মান্তরে কত পাপ করিয়া থাকিব, সেই জন্যে এত মনস্তাপ উপস্থিত হইতেছে। দৈব অনুকূল না হইলে কোন অভীষ্টসিদ্ধির সম্ভাবনা নাই। অতএব দৈব কর্ম্মে অত্যন্ত অনুরক্ত হও। মনোযোগপূর্ব্বক গুরুভক্তি, দেবপূজা ও মহর্ষিদিগের পরিচর্য্যা কর। অবিচলিত ও অকৃত্রিম ভক্তিপূর্ব্বক ধর্ম্মকর্ম্মের অনুষ্ঠান কর। পুরাণে শুনিয়াছি, মগধদেশের রাজা বৃহদ্রথ সন্তানলাভের আশয়ে চণ্ডকৌশিকের আরাধনা করেন এবং তাঁহার বরপ্রভাবে জরাসন্ধনামে প্রবলপরাক্রান্ত এক পুত্ত্র প্রাপ্ত হন। রাজা দশরথ মহর্ষি ঋষ্যশৃঙ্গকে প্রসন্ন করিয়া রাম, লক্ষ্মণ, ভরত, শত্রুঘ্ন নামে মহাবলপরাক্রান্ত চারি পুত্ত্র লাভ করেন। ঋষিগণের আরাধনা কখন বিফল হয় না, অবশ্যই তাহার ফল দর্শে, সন্দেহ নাই। দৃঢ়ব্রত ও একান্ত অনুরক্ত হইয়া ভক্তিসহকারে দেব ও দেবর্ষিদিগের অর্চ্চনা কর তাহাতেই মনোরথ সফল হইবেক। হায়! কত দিনে সেই শুভ দিনের উদয় হইবে, যে দিনে স্নেহময় ও প্রীতিময় সন্তানের সুধাময় মুখচন্দ্র অবলোকন করিয়া জীবন ও নয়ন চরিতার্থ করিব; পরিজনেরা আনন্দে পূর্ণপাত্র গ্রহণ করিবে; নগর উৎসবময় হইয়া নৃত্য, গীত, বাদ্যের কোলাহলে পরিপূর্ণ হইবেক, শশিকলা উদিত হইলে গগনমণ্ডলের যেরূপ শোভা হয়, কত দিনে দেবী পুত্ত্র ক্রোড়ে করিয়া সেইরূপ শোভিত হইবেন; নিরপত্যতা এক্ষণে অতিশয় ক্লেশ দিতেছে। সংসার অরণ্য ও জগৎ শূন্য দেখিতেছি; রাজ্য ও ঐশ্বর্য্য নিষ্ফল বোধ হইতেছে। কিন্তু অপ্রতিবিধেয় বিষয়ে শোক ও দুঃখ করা বৃথা বলিয়াই ধৈর্য্যাবলম্বনপূর্ব্বক যথাকথঞ্চিৎ সংসারযাত্রা নির্ব্বাহ করিতেছি। এইরূপ নানা প্রবোধবাক্যে আশ্বাস দিয়া স্বহস্তে মহিষীর নেত্রজল মোচন করিয়া দিলেন। অনেক ক্ষণ অন্তঃপুরে থাকিয়া পরে বহির্গত হইলেন।
রাজা অন্তঃপুর হইতে বহির্গত হইলে বিলাসবতী প্রবোধবাক্যে কিঞ্চিৎ শান্ত হইয়া স্নান ভোজনাদি সমাপন করিলেন। যে সকল আভরণ ফেলিয়া দিয়াছিলেন তাহা পুনর্ব্বার অঙ্গে ধারণ করিলেন। তদবধি দেবতার আরাধনা, ব্রাহ্মণের সেবা ও গুরু জনের পরিচর্য্যায় অতিশয় অনুরক্ত হইলেন। দৈবকর্ম্মে অনুরক্ত হইয়া চণ্ডিকার গৃহে প্রতিদিন ধূপ গুগ্গুল প্রভৃতি সুগন্ধ দ্রব্যের গন্ধ বিস্তার করেন। দিবসবিশেষে তথায় কুশাসনে শয়ন করিয়া থাকেন। প্রতিদিন প্রাতঃকালে ব্রাহ্মণদিগকে স্বর্ণপাত্র দান করেন। কৃষ্ণপক্ষীয় চতুর্দ্দশী রজনীতে চতুষ্পথে দেবতাদিগকে বলি উপহার দেন। অশ্বত্থ প্রভৃতি বনস্পতিদিগকে প্রদক্ষিণ করেন। ষোড়শোপচারে ষষ্ঠীদেবীর পূজা দেন। ফলতঃ যে যেরূপ ব্রতের অনুষ্ঠান করিতে কহে, অতিশয় ক্লেশসাধ্য হইলেও অপত্যতৃষ্ণায় উহার অনুষ্ঠান করেন, কিছুতেই পরাঙ্মুখ হয়েন না। গণক অথবা সিদ্ধপুরুষ দেখিলে সমাদর পূর্ব্বক সন্তানের গণনা করান। রাত্রিতে যে সকল স্বপ্ন দেখেন, প্রভাতে পুরন্ধ্রীদিগকে তাহার ফলাফল জিজ্ঞাসা করেন।
এই রূপে কিছুদিন অতীত হইলে, একদা রাত্রিশেষে রাজা স্বপ্নে দেখিলেন, বিলাসবতী সৌধশিখরে শয়ন করিয়া আছেন, তাঁহার মুখমণ্ডলে পূর্ণচন্দ্র প্রবেশ করিতেছে। স্বপ্নদর্শনানন্তর অমনি জাগরিত হইয়া শীঘ্র শয্যা হইতে উঠিলেন। অনন্তর শুকনাসকে আহ্বান করিয়া তাঁহার সাক্ষাতে স্বপ্নবৃত্তান্ত বর্ণন করিলেন। শুকনাস শুনিয়া অতিশয় আহ্লাদিত হইলেন ও প্রীতিপ্রফুল্ল বদনে কহিলেন, মহারাজ! বুঝি অনেক কালের পর আমাদিগের মনোরথ পূর্ণ হইল। অচিরাৎ আপনি পুত্ত্রমুখ নিরীক্ষণ করিয়া আনন্দিত হইবেন, সন্দেহ নাই। আমিও আজি রজনীতে স্বপ্নে প্রশান্তমূর্ত্তি, দিব্যাকৃতি এক ব্রাহ্মণকে মনোরমার উৎসঙ্গে বিকসিত পুণ্ডরীক নিক্ষেপ করিতে দেখিয়াছি। শাস্ত্রকারেরা কহেন, শুভ ফলোদয়ের পূর্ব্বে শুভ লক্ষণ সকল দেখিতে পাওয়া যায়। যদি আমাদিগের চিরপ্রার্থিত মনোরথ সম্পন্ন হয়, তাহা হইলে, ইহা অপেক্ষা আহ্লাদের বিষয় কি আছে? রাত্রিশেষে যে স্বপ্ন দেখা যায় তাহা প্রায় বিফল হয় না। রাজমহিষী বিলাসবতী অচিরাৎ পুত্ত্রসন্তান প্রসব করিবেন, সন্দেহ নাই। রাজা মন্ত্রীর স্বপ্নবৃত্তান্ত শ্রবণে অধিকতর আহ্লাদিত হইলেন এবং তাঁহার হস্তধারণ পূর্ব্বক অন্তঃপুরে প্রবেশিয়া উভয়েই আপন আপন স্বপ্নবৃত্তান্ত বর্ণন দ্বারা রাজমহিষীর আনন্দোৎপাদন করিলেন।
কিছু দিন পরে বিলাসবতী গর্ভবতী হইলেন। শশধরের প্রতিবিম্ব পতিত হইলে সরোবর যেরূপ উজ্জ্বল হয়, পারিজাত কুসুম বিকসিত হইলে নন্দনবনের যেরূপ শোভা হয়, বিলাসবতী গর্ভ ধারণ করিয়া সেইরূপ অপূর্ব্বশ্রী প্রাপ্ত হইলেন। দিন দিন গর্ভের উপচয় হইতে লাগল। সলিলভারাক্রান্ত মেঘমালার ন্যায় বিলাসবতী গর্ভভারে মন্থরগতি হইলেন। মুখে বারংবার জৃম্ভিকা ও জল উঠিতে লাগিল। শরীর অলস ও পাণ্ডুবর্ণ হইল। এই সকল লক্ষণ নিরীক্ষণ করিয়া পরিজনেরা অনায়াসেই বুঝিতে পারিল রাণী গর্ভিণী হইয়াছেন।
একদা প্রদোষ সময়ে শুকনাস ও রাজা রাজভবনে বসিয়া আছেন এমন সময়ে কুলবর্দ্ধনানাম্নী প্রধান পরিচারিকা তথায় উপস্থিত হইয়া রাজার কর্ণে মহিষীর গর্ভসঞ্চারের সংবাদ কহিল। নরপতি শুভ সংবাদ শুনিয়া আনন্দের পরাকাষ্ঠা প্রাপ্ত হইলেন। আহ্লাদে কলেবর রোমাঞ্চিত ও কপোলমূল বিকসিত হইয়া উঠিল। তখন হর্ষোৎফুল্ল লোচনে শুকনাসের প্রতি দৃষ্টিপাত করাতে তিনি রাজার ও কুলবর্দ্ধনার আকৃতি দেখিয়াই অনুমান করিলেন রাজার অভীষ্ট সিদ্ধ হইয়াছে। তথাপি সন্দেহনিবারণের নিমিত্ত জিজ্ঞাসা করিলেন, মহারাজ! স্বপ্নদর্শন কি সফল হইয়াছে? রাজা কিঞ্চিৎ হাস্য করিয়া কহিলেন, যদি কুলবর্দ্ধনার কথা মিথ্যা না হয় তাহা হইলে স্বপ্ন সফল বটে। চল, আমরা স্বয়ং গিয়া জানিয়া আসি। এই কথা বলিয়া গাত্র হইতে উন্মোচন করিয়া শুভ সংবাদের পারিতোষিকস্বরূপ বহুমূল্য অলঙ্কার কুলবর্দ্ধনাকে দিয়া বিদায় করিলেন। আপনারাও মহিষীর বাসভবনে চলিলেন। যাইতে যাইতে রাজার দক্ষিণ লোচন স্পন্দিত হইল।
তথায় গিয়া দেখিলেন, মহিষী গর্ভোচিত কোমল শয্যায় শয়ন করিয়া আছেন, গর্ভে সন্তানের উদয় হওয়াতে মেঘাবৃতশশিমণ্ডলশালিনী রজনীর ন্যায় শোভা পাইতেছেন। শিরোভাগে মঙ্গলকলস রহিয়াছে, চতুর্দ্দিকে মণির প্রদীপ জ্বলিতেছে এবং গৃহে শ্বেত সর্ষপ বিকীর্ণ আছে। রাণী রাজাকে দেখিয়া সসম্ভ্রমে শয্যা হইতে উঠিবার চেষ্টা করিতেছিলেন, রাজা বারণ করিয়া কহিলেন, প্রিয়ে! আর কষ্ট পাইবার প্রয়োজন নাই। বিনা অভ্যুত্থানেই যথেষ্ট আদর প্রকাশ হইয়াছে। এই বলিয়া শয্যার এক পার্শ্বে বসিলেন। শুকনাস স্বতন্ত্র এক স্থানে উপবেশন করিলেন। রাজা মহিষীর আকার প্রকার দেখিয়াই গর্ভলক্ষণ জানিতে পারিলেন; তথাপি পরিহাস পূর্ব্বক কহিলেন, প্রিয়ে! শুকনাস জিজ্ঞাসা করিতেছেন, কুলবর্দ্ধনা যাহা কহিয়া আসিল সত্য কি না? মহিষী লজ্জায় নম্রমুখী হইয়া কিঞ্চিৎ হাস্য করিলেন। বারংবার জিজ্ঞাসা ও অনুরোধ করাতে কহিলেন, কেন আর আমাকে লজ্জা দাও, আমি কিছুই জানি না; এই বলিয়া পুনর্ব্বার অধোমুখী হইলেন। এইরূপ অনেক পরিহাসকথার পর শুকনাস আপন আলয়ে প্রস্থান করিলেন।
ক্রমে ক্রমে গর্ভের উপচয় হওয়াতে মহিষীর যে কিছু গর্ভদোহদ হইতে লাগিল রাজা তৎক্ষণাৎ সম্পাদন করিতে লাগিলেন। প্রসবসময় সমাগত হইলে মহিষী শুভ দিনে শুভ লগ্নে এক পুত্ত্র সন্তান প্রসব করিলেন। নরপতির পুত্ত্র হইয়াছে শুনিয়া নগরবাসী লোকের আহ্লাদের পরিসীমা রহিল না। রাজবাটী মহোৎসবময়, নগর আনন্দময় ও পথ কোলাহলময় হইল। গৃহে গৃহে নৃত্য, গীত, বাদ্য, আরম্ভ হইল। নরপতি সানন্দ চিত্তে দীন, দুঃখী, অনাথ প্রভৃতিকে অর্থ দান করিতে লাগিলেন। যে যাহা আকাঙ্ক্ষা করিল তাহাকে তাহাই দিলেন। কারাবদ্ধকে মুক্ত ও ধনহীনকে ঐশ্বর্য্যশালী করিলেন।
গণকেরা গণনা দ্বারা শুভলগ্ন স্থির করিয়া দিলে নরপতি পুত্ত্রমুখ নিরীক্ষণ করিবার নিমিত্ত মন্ত্রীর সহিত গৃহে গমন করিলেন। দেখিলেন, সূতিকাগৃহের দ্বারদেশে দুই পার্শ্বে সলিলপূর্ণ দুই মঙ্গলকলস, স্তম্ভের উপরিভাগে বিচিত্র কুসুমে গ্রথিত মঙ্গলমালা। পুরন্ধ্রীবর্গ কেহ বা ষষ্ঠীদেবীর পূজা করিতেছে, কেহ বা মাতৃকাগণের বিচিত্র মূর্ত্তি চিত্রপটে লিখিতেছে। ব্রাহ্মণেরা মন্ত্র পাঠ পূর্ব্বক সূতিকাগৃহের অভ্যন্তরে শান্তিজল নিক্ষেপ করিতেছেন। পুরোহিতেরা নারায়ণের সহস্র নাম পাঠ করিয়া শুভ স্বস্ত্যয়ন করিতেছেন। রাজা জল ও অনল স্পর্শ পূর্ব্বক সূতিকাগৃহের অভ্যন্তরে প্রবেশ করিলেন। দেখিলেন, রাজকুমার মহিষীর অঙ্কে শয়ন করিয়া সূতিকাগৃহ উজ্জ্বল করিয়া রহিয়াছেন। দেহপ্রভায় দীপপ্রভা তিরোহিত হইয়াছে। এরূপ অঙ্গসৌষ্ঠব ও রূপলাবণ্য, যে হঠাৎ দেখিলে বোধ হয় যেন, সাক্ষাৎ কুমার রাজকুমাররূপে অবতীর্ণ হইয়াছেন। রাজা নিমেষশূন্য লোচনে বারংবার দেখিতে লাগিলেন, কিন্তু অন্তঃকরণ তৃপ্ত হইল না। যত বার দেখেন অদৃষ্টপূর্ব্ব ও অভিনব বোধ হয়। সস্পৃহ ও প্রীতিবিস্ফারিত নেত্র দ্বারা পুনঃপুনঃ অবলোকন করিয়া নব নব আনন্দ অনুভব করিতে লাগিলেন এবং আপনাকে চরিতার্থ ও পরমসৌভাগ্যশালী জ্ঞান করিলেন। শুকনাস সতর্কতা পূর্ব্বক বিস্ময়বিকসিত নয়নে রাজকুমারের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ বিলক্ষণ রূপে পরীক্ষা করিয়া কহিলেন, মহারাজ! দেখুন, কুমারের অঙ্গে চক্রবর্ত্তী ভূপতির লক্ষণ সকল লক্ষিত হইতেছে। করতলে শঙ্খচক্ররেখা, চরণতলে পতাকারেখা, প্রশস্ত ললাট, দীর্ঘ লোচন, উন্নত নাসিকা, লোহিত অধর এই সকল চিহ্ন দ্বারা মহাপুরুষলক্ষণ প্রকাশ পাইতেছে।
মন্ত্রী রাজকুমারের এইরূপ রূপ বর্ণনা করিতেছেন এমন সময়ে মঙ্গলকনামা এক পুরুষ প্রবেশিয়া রাজাকে নমস্কার করিল ও হর্ষোৎফুল্ললোচনে কহিল, মহারাজ! মনোরমার গর্ভে শুকনাসের এক পুত্ত্র সন্তান জন্মিয়াছে। নরপতি এই শুভ সংবাদ শ্রবণ করিয়া অমৃতবৃষ্টিতে অভিষিক্ত হইলেন এবং আহ্লাদিত চিত্তে কহিলেন, আজি কি শুভ দিন, কি শুভ সংবাদ শুনিলাম! বিপদ্ বিপদের ও সম্পদ সম্পদের অনুসরণ করে এই জনপ্রবাদ কখন মিথ্যা নহে। এই বলিয়া প্রীতিবিকসিত মুখে হাসিতে হাসিতে সমাগত পুরুষকে শুভ সংবাদের অনুরূপ পারিতোষিক দিয়া বিদায় করিলেন। পরে নর্ত্তক, বাদক ও গায়কগণ সমভিব্যাহারে শুকনাসের মন্দিরে গমন করিয়া মহামহোৎসবে প্রবৃত্ত হইলেন। দশম দিবসে পবিত্র মুহূর্ত্তে কোটি কোটি গাভী ও সুবর্ণ ব্রাহ্মণসাৎ করিয়া ও দীন দুঃখীকে অনেক ধন দিয়া নরপতি পুত্ত্রের নামকরণ করিলেন। স্বপ্নে দেখিয়াছিলেন, পূর্ণচন্দ্র রাজ্ঞীর মুখমণ্ডলে প্রবেশ করিতেছে, সেই নিমিত্ত পুত্ত্রের নাম চন্দ্রাপীড় রাখিলেন। মন্ত্রীও আপন ব্রাহ্মণোচিত সমস্ত ক্রিয়া সম্পাদন পূর্ব্বক রাজার অভিমতে আপন পুত্ত্রের নাম বৈশম্পায়ন রাখিলেন। ক্রমে চূড়াকরণ প্রভৃতি সমুদায় সংস্কার সম্পন্ন হইল।