কাদম্বরী (তারাশঙ্কর তর্করত্ন, ১৮৯২)/কথারম্ভ-৪
কিছু দিনের পর যুবরাজ দিগ্বিজয়ের নিমিত্ত যাত্রা করিলেন। ঘনঘটার ঘোর ঘর্ঘর ঘোষের ন্যায় দুন্দুভিধ্বনি হইল। সৈন্যগণের কলরবে চতুর্দ্দিক্ ব্যাপ্ত হইল। রাজকুমার স্বর্ণালঙ্কারে ভূষিত করেণুকায় আরোহণ করিলেন। পত্রলেখাও ঐ হস্তিনীর উপর উঠিয়া বসিল। বৈশম্পায়ন আর এক করিণীপৃষ্ঠে আরোহণ করিয়া রাজকুমারের পার্শ্ববর্ত্তী হইলেন। ক্ষণ কালের মধ্যে মহীতল তুরঙ্গময়, দিঙ্মণ্ডল মাতঙ্গময়, অন্তরীক্ষ আতপত্রময়, সমীরণ মদগন্ধময়, পথ সৈন্যময় ও নগর জয়শব্দময় হইল। সেনাগণ সুসজ্জিত হইয়া বহির্গত হইলে তাহাদিগের পাদবিক্ষেপে মেদিনী কাঁপিতে লাগিল। শাণিত অস্ত্র শস্ত্রে দিনকরের করপ্রভা প্রতিবিম্বিত হওয়াতে বোধ হইল যেন, শিখিকুল গগনমণ্ডলে শিখাকলাপ বিস্তীর্ণ করিয়া রহিয়াছে, সৌদামিনী প্রকাশ পাইতেছে, ইন্দ্রধনু উদিত হইয়াছে। করীদিগের বৃংহিত, অশ্বদিগের হেষারব, দুন্দুভির ভীষণ শব্দ, সৈন্যদিগের কলরবে বোধ হইল যেন, প্রলয়কাল উপস্থিত। ধূলি উত্থিত হইয়া গগনমণ্ডল অন্ধকারাবৃত করিল। আকাশ ও ভূমির কিছুই বিশেষ রহিল না। বোধ হইল যেন, সৈন্যভার সহ্য করিতে না পারিয়া ধরা উপরে উঠিতেছে। এক এক বার এরূপ কলরব হয় যে কিছুই শুনা যায় না।
কতক দূর যাইয়া সন্ধ্যার পূর্ব্বে যুবরাজ এক রমণীয় প্রদেশে উপস্থিত হইলেন। সেই দিন তথায় বাসস্থান নিরূপিত হইল! সেনাগণ আহারাদি করিয়া পটগৃহে নিদ্রা গেল। রাজকুমারও শয়ন করিলেন। প্রত্যূষে সেনাগণ পুনর্ব্বার শ্রেণীবদ্ধ হইয়া চলিল। যাইতে যাইতে বৈশম্পায়ন রাজকুমারকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, যুবরাজ! মহারাজ যে দেশ জয় করেন নাই, যে দুর্গ আক্রমণ করেন নাই এরূপ দেশ ও দুর্গই দেখিতে পাই না। আমরা যে দিকে যাইতেছি, দেখিতেছি সকলই তাঁহার রাজ্যের অন্তর্গত। মহারাজের বিক্রম ও ঐশ্বর্য্য দেখিয়া আশ্চর্য্য বোধ হইতেছে। তিনি সমুদায় দেশ জয় করিয়াছেন, সকল রাজাকে আপন অধীনে রাখিয়াছেন, সমুদায় রত্ন সংগ্রহ করিয়াছেন।
অনন্তর যুবরাজ পরাক্রান্ত ও বলশালী সৈন্য দ্বারা পূর্ব্ব, দক্ষিণ, পশ্চিম, উত্তর ক্রমে ক্রমে অবশিষ্ট সকল দেশ জয় করিয়া কৈলাসপর্ব্বতের নিকটবর্ত্তী হেমজটনামক কিরাতদিগের সুবর্ণপুরনাম্নী নগরীতে উপস্থিত হইলেন। সংগ্রামে কিরাতদিগকে পরাজিত করিয়া পরিশ্রান্ত ও একান্ত ক্লান্ত সেনাগণকে কিঞ্চিৎ কাল বিশ্রাম করিতে আদেশ দিলেন। আপনিও তথায় আরাম করিতে লাগিলেন।
একদা তথা হইতে মৃগয়ার্থ নির্গত হইয়া একটী কিন্নর ও একটী কিন্নরী বনে ভ্রমণ করিতেছে দেখিলেন। অদৃষ্টপূর্ব্ব কিন্নরমিথুন দর্শনে অত্যন্ত কৌতুকাক্রান্ত হইয়া ধরিবার আশয়ে সেই দিকে অশ্ব চালনা করিলেন। অশ্ব বায়ুবেগে ধাবিত হইল। কিন্নরমিথুনও মানুষ দর্শনে ভীত হইয়া দ্রুত বেগে পলায়ন করিতে লাগিল। শীঘ্র গমনে কেহই অপারগ নহে। ঘোটক এরূপ দ্রুতবেগে দৌড়িল যে, কিন্নরমিথুন এই ধরিলাম বলিয়া রাজকুমারের ক্ষণে ক্ষণে বোধ হইতে লাগিল। এ দিকে কিন্নরমিথুনও প্রাণপণে দৌড়িয়া গিয়া এক পর্ব্বতের উপরি আরোহণ করিল। ঘোটক তথায় উঠিতে পারিল না। রাজকুমার পর্ব্বতের উপত্যকা হইতে ঊর্দ্ধ দৃষ্টে দেখিতে লাগিলেন। উহারা পর্ব্বতের শৃঙ্গে আরোহণ পূর্ব্বক ক্রমে ক্রমে দৃষ্টিপথের অগোচর হইল।
কিন্নরমিথুনগ্রহণে হতাশ হইয়া মনে মনে কহিলেন, কি দুষ্কর্ম্ম করিয়াছি; কিন্নরমিথুন কিরূপে ধরিব, ধরিয়াই বা কি হইবে, একবারও বিবেচনা হয় নাই। বোধ হয় সেনানিবেশ হইতে অধিক দূর আসিয়াছি। এক্ষণে কি করি, কিরূপে পুনর্ব্বার তথায় যাই। এ দিকে কখন আসি নাই, কোন্ পথ দিয়া যাইতে হয় কিছুই জানি না। এই নির্জ্জন গহনে মানবের সমাগম নাই। কোন ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসা করিয়া যে, পথের নিদর্শন পাইব তাহারও উপায় নাই। শুনিয়াছি সুবর্ণপুরের উত্তরে নিবিড় বন, বন পার হইলেই কৈলাসপর্ব্বত। কিন্নরমিথুন যে পর্ব্বতে আরোহণ করিল বোধ হয়, উহা কৈলাসপর্ব্বত। দক্ষিণ দিকে ক্রমাগত প্রতিগমন করিলে স্কন্ধাবারে পঁহুছিবার সম্ভাবনা। অদৃষ্টে কত কষ্ট আছে বলিতে পারি না। আপনি কুকর্ম্ম করিয়াছি, কাহার দোষ দিব? কেই বা ইহার ফলভোগ করিবে, যে রূপে হউক যাইতে হইবেক। এই স্থির করিয়া ঘোটককে দক্ষিণ দিকে ফিরাইলেন। তখন বেলা দুই প্রহর। দিনকর গগনমণ্ডলের মধ্যবর্ত্তী হইয়া অতিশয় উত্তাপ দিতেছেন। পক্ষিগণ নীরব, বন নিস্তব্ধ, ঘোটক অতিশয় পরিশ্রান্ত ও ঘর্ম্মাক্তকলেবর। আপনিও তৃষ্ণাতুর হইয়াছেন দেখিয়া তরুতলের ছায়ায় অশ্ব বাঁধিলেন এবং হরিদ্বর্ণ দুর্ব্বাদলের আসনে উপবেশন পূর্ব্বক ক্ষণকাল বিশ্রামের পর জলপ্রাপ্তির আশয়ে ইতস্ততঃ দৃষ্টিপাত করিতে লাগিলেন। এক পথে হস্তীর পদচিহ্ন ও মদচিহ্ন রহিয়াছে এবং কুমুদ, কহ্লার ও মৃণাল ছিন্ন ভিন্ন হইয়া পতিত আছে দেখিয়া স্থির করিলেন, গিরিচর করিযূথ এই পথে জলপান করিতে যায়, সন্দেহ নাই। এই পথ দিয়া যাইলে অবশ্য জলাশয় পাইতে পারিব।
অনন্তর সেই পথে চলিলেন। পথের ধারে উন্নত পাদপ সকল বিস্তৃত শাখা প্রশাখা দ্বারা গগন আকীর্ণ করিয়া রহিয়াছে। বোধ হয় যেন, বাহু প্রসারণ পূর্ব্বক অঙ্গুলি সঙ্কেত দ্বারা তৃষ্ণার্ত্ত পথিকদিগকে জল পান করিবার নিমিত্ত ডাকিতেছে। স্থানে স্থানে কুঞ্জবন ও লতামণ্ডপ, মধ্যে মধ্যে মসৃণ ও উজ্জ্বলশিলা পতিত রহিয়াছে। নানাবিধ রমণীয় প্রদেশ ও বিচিত্র উপবন দেখিতে দেখিতে কতক দূর যাইয়া বারিশীকরসম্পৃক্ত সুশীতল সমীরণস্পর্শে বিগতক্লম হইলেন। বোধ হইল যেন, তুষারে অবগাহন করিতেছেন। সরোবর নিকটবর্ত্তী হওয়াতে মনে মনে অতিশয় আহ্লাদ জন্মিল। অনন্তর মধুপানমত্ত মধুকর ও কেলিপর কলহংসের কোলাহলে আহূত হইয়া সরোবরের সমীপবর্ত্তী হইলেন। চতুর্দ্দিকে শ্রেণীবদ্ধ তরুমধ্যে ত্রৈলোক্যলক্ষ্মীর দর্পণস্বরূপ বসুন্ধরাদেবীর স্ফটিকগৃহস্বরূপ, অচ্ছোদননামক সরোবর নেত্রগোচর করিলেন। সরোবরের জল অতি নির্ম্মল। জলে কমল, কুমুদ, কহ্লার প্রভৃতি নানাবিধ কুসুম বিকসিত হইয়াছে। মধুকর গুন্ গুন্ ধ্বনি করিয়া এক পুষ্প হইতে অন্য পুষ্পে বসিয়া মধুপান করিতেছে। কলহংস সকল কলরব করিয়া কেলি করিতেছে। কুসুমের সুরভিরেণু হরণ করিয়া শীতল সমীরণ নানা দিকে সুগন্ধ বিস্তার করিতেছে। সরোবরের শোভা দেখিয়া মনে মনে চিন্তা করিলেন, কিন্নরমিথুনের অনুসরণ নিষ্ফল হইলেও এই মনোহর সরোবর দেখিয়া আমার নেত্রযুগল সফল ও চিত্ত সফল হইল। এতাদৃশ রমণীয় বস্তু কখন দেখিও নাই, দেখিবও না; বোধ হয়, ভগবান্ ভবানীপতি এই সরোবরের শোভায় মোহিত হইয়া কৈলাসনিবাস পরিত্যাগ করিতে পারেন না। অনন্তর সরোবরের দক্ষিণ তীরে উপস্থিত হইয়া অশ্ব হইতে অবতীর্ণ হইলেন। পৃষ্ঠ হইতে পর্য্যাণ উপনীত হইলে ইন্দ্রায়ুধ এক বার ক্ষিতিতলে বিলুণ্ঠিত হইল। পরে ইচ্ছাক্রমে স্নান ও জলপান করিয়া তীরে উঠিলে রাজকুমার উহার পশ্চাদ্ভাগের পদদ্বয় পাশ দ্বারা আবদ্ধ করিয়া দিলেন। সে তীরপ্ররূঢ় নবীন দূর্ব্বা ভক্ষণ করিতে লাগিল। রাজকুমারও সরোবরে অবগাহন পূর্ব্বক মৃণাল ভক্ষণ ও জল পান করিয়া তীরে উঠিলেন। এক লতামণ্ডপমধ্যবর্ত্তী শিলাতলে নলিনীপত্রের শয্যা ও উত্তরীয় বস্ত্রের উপাধান প্রস্তুত করিয়া শয়ন করিলেন।
ক্ষণ কাল বিশ্রামের পর সরসীর উত্তর তীরে বীণাতন্ত্রীঝঙ্কারমিশ্রিত সঙ্গীত শুনিলেন। ইন্দ্রায়ুধ শব্দ শুনিবামাত্র কবল পরিত্যাগ পূর্ব্বক সেই দিকে কর্ণপাত করিল। এই জনশূন্য অরণ্যে কোথায় সঙ্গীত হইতেছে জানিবার নিমিত্ত রাজকুমার যে দিকে শব্দ হইতেছিল সেই দিকে দৃষ্টিপাত করিলেন, কিন্তু কিছুই দেখিতে পাইলেন না। কেবল অস্ফুট মধুর শব্দ কর্ণকুহরে অমৃত বর্ষণ করিতে লাগিল। সঙ্গীতশ্রবণে কুতূহলাক্রান্ত হইয়া ইন্দ্রায়ুধে আরোহণ পূর্ব্বক সরসীর পশ্চিম তীর দিয়া শব্দানুসারে গমন করিতে আরম্ভ করিলেন। কতক দূর গিয়া, চতুর্দ্দিকে পরমরমণীয় উপবনমধ্যে কৈলাসাচলের এক প্রত্যন্ত পর্ব্বত দেখিতে পাইলেন। ঐ পর্ব্বতের নাম চন্দ্রপ্রভা; উহার নিম্নে এক মন্দিরের অভ্যন্তরে চরাচরগুরু ভগবান্ শূলপাণির প্রতিমূর্ত্তি প্রতিষ্ঠিত আছে। ঐ প্রতিমার সম্মুখে পাশুপতব্রতধারিণী নির্ম্মমা, নিরহঙ্কারা, নির্ম্মৎসরা অমানুষাকৃতি, অষ্টাদশবর্ষদেশীয়া এক কন্যা বীণাবাদন পূর্ব্বক তানলয়বিশুদ্ধ মধুরস্বরে মহাদেবের স্তুতিবাদ করিয়া গান করিতেছেন। কন্যার দেহপ্রভায় উপবন উজ্জ্বল ও মন্দির আলোকময় হইয়াছে। তাঁহার স্কন্ধে জটাভার, গলে রুদ্রাক্ষমালা ও গাত্রে ভস্মলেপ। দেখিবামাত্র বোধ হয় যেন, পার্ব্বতী শিবের আরাধনায় ভক্তিমতী হইয়াছেন।
রাজকুমার তরুশাখায় ঘোটক বাঁধিয়া ভক্তিপূর্ব্বক ভগবান্ ত্রিলোচনকে সাষ্টাঙ্গ প্রণিপাত করিলেন। নিমেষশূন্য লোচনে সেই অঙ্গনাকে নিরীক্ষণ করিয়া মনে মনে ভাবিলেন, কি আশ্চর্য্য? কত অসম্ভাবিত ও অচিন্তিত বিষয় স্বপ্নকল্পিতের ন্যায় সহসা উপস্থিত হয়, তাহা নিরূপণ করা যায় না। আমি মৃগয়ায় নির্গত ও যদৃচ্ছাক্রমে কিন্নরমিথুনের অনুসরণে প্রবৃত্ত হইয়া কত ভয়ঙ্কর ও কত রমণীয় প্রদেশ দেখিলাম। পরিশেষে গীতধ্বনিরব অনুসারে এই স্থানে উপস্থিত হইয়া এই এক অদ্ভুত ব্যাপার দেখিতেছি। কন্যার যেরূপ মনোহর আকার ও মধুর স্বর, তাহাতে কোন ক্রমে মানুষী বোধ হয় না, দেবকন্যা সন্দেহ নাই। ধরণীতলে কি সৌদামিনীর উদ্ভব হইতে পারে? যাহা হউক, যদি আমার দর্শনপথ হইতে সহসা অন্তর্হিত না হন, যদি কৈলাসশিখরে অথবা গগনমণ্ডলে হঠাৎ আরোহণ না করেন, তাহা হইলে, আমি ইঁহার নাম, ধাম ও তপস্যায় অভিনিবেশের কারণ, সমুদায় জিজ্ঞাসা করিয়া জানিব। এই স্থির করিয়া সেই মন্দিরের এক পার্শ্বে উপবেশন পূর্ব্বক সঙ্গীতসমাপ্তির অবসর প্রতীক্ষা করিয়া রহিলেন।
সঙ্গীত সমাপ্ত হইলে বীণা নিস্তব্ধ হইল। কন্যা গাত্রোত্থান পূর্ব্বক ভক্তিভাবে ভগবান্ ত্রিলোচনকে প্রদক্ষিণ করিয়া প্রণাম করিলেন। অনন্তর পবিত্র নেত্রপাত দ্বারা রাজকুমারকে পরিতৃপ্ত করিয়া সাদর সম্ভাষণে স্বাগত জিজ্ঞাসা করিলেন ও বিনীত ভাবে কহিলেন, মহাশয়! আশ্রমে চলুন ও অতিথিসৎকার গ্রহণ করিয়া চরিতার্থ করুন। রাজকুমার সম্ভাষণমাত্রেই আপনাকে পরিগৃহীত ও চরিতার্থ বোধ করিয়া ভক্তি পূর্ব্বক তাপসীকে প্রণাম করিলেন ও শিষ্যের ন্যায় তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ চলিলেন। যাইতে যাইতে চিন্তা করিলেন, তাপসী আমাকে দেখিয়া অন্তর্হিত হইলেন না; প্রত্যুত দাক্ষিণ্য প্রকাশ করিয়া অতিথিসৎকার গ্রহণ করিতে অনুরোধ করিলেন। বোধ হয়, জিজ্ঞাসা করিলে আত্মবৃত্তান্তও বলিতে পারেন।
কতক দূর যাইয়া এক গিরিগুহা দেখিলেন। উহার পুরোভাগ তমালবনে আবৃত, তথায় দিনমণি দৃষ্টিগোচর হয় না। পার্শ্বে নির্ঝরবারি ঝর্ঝর শব্দে পতিত হইতেছে। দূর হইতে উহার শব্দ কি মনোহর! অভ্যন্তরে বল্কল, কমণ্ডলু ও ভিক্ষাকপাল রহিয়াছে। দেখিবামাত্র মনে শান্তিরসের সঞ্চার হয়। তাপসী তথায় প্রবেশিয়া অর্ঘ্যসামগ্রী আহরণ পূর্ব্বক অর্ঘ্য আনয়ন করিলেন। রাজকুমার মৃদু মধুর সম্ভাষণে কহিলেন, ভগবতি! প্রসন্ন হউন, আপনকার দর্শনমাত্রেই আমি পবিত্র হইয়াছি এবং অর্ঘ্যও প্রদত্ত হইয়াছে। অত্যাদর প্রকাশ করার প্রয়োজন নাই। আপনি উপবেশন করুন। পরিশেষে তাপসীর অনুরোধ এড়াইতে না পারিয়া রাজকুমার যথাবিহিত অর্ঘ্য গ্রহণ করিলেন। দুই জন শিলাতলে উপবিষ্ট হইলেন। তাপসী রাজকুমারের পরিচয় জিজ্ঞাসা করিলে, তিনি আপনার নাম, ধাম ও দিগ্বিজয়ের কথা বিশেষ করিয়া কহিলেন এবং কিন্নরমিথুনের অনুসরণক্রমে আপন আগমনবৃত্তান্ত আদ্যোপান্ত বর্ণনা করিলেন।
অনন্তর তাপসী ভিক্ষাকপাল গ্রহণ করিয়া আশ্রমস্থিত তরুতলে ভ্রমণ করাতে তাঁহার ভিক্ষাভাজন, বৃক্ষ হইতে পতিত নানাবিধ সুস্বাদু ফলে পরিপূর্ণ হইল। চন্দ্রাপীড়কে সেই সকল ফল ভক্ষণ করিতে অনুরোধ করিলেন। চন্দ্রাপীড় ফল ভক্ষণ করিবেন কি, এই আশ্চর্য্য ব্যাপার দেখিয়া তাঁহার অতিশয় বিস্ময় জন্মিল। মনে মনে চিন্তা করিলেন, কি আশ্চর্য্য! এরূপ বিস্ময়কর ব্যাপার ত কখন দেখি নাই। অথবা তপস্যার অসাধ্য কি আছে! তপস্যাপ্রভাবে বশীভূত হইয়া অচেতনেরাও কামনা সফল করে, সন্দেহ নাই। অনন্তর তাপসীর অনুরোধে সুস্বাদু নানাবিধ ফল ভক্ষণ ও শীতল জল পান করিয়া পরিতৃপ্ত হইলেন। তাপসীও আহার করিলেন ও সন্ধ্যাকাল উপস্থিত হইলে যথাবিধ সন্ধ্যার উপাসনা করিয়া এক শিলাতলে উপবেশন পূর্ব্বক বিশ্রাম করিতে লাগিলেন।
চন্দ্রাপীড় অবসর বুঝিয়া বিনয় বাক্যে কহিলেন, ভগবতি! মানুষদিগের প্রকৃতি অতি চঞ্চল, প্রভুর কিঞ্চিৎ প্রসন্নতা দেখিলেই অমনি অধীর ও গর্ব্বিত হইয়া উঠে। আপনার অনুগ্রহ ও প্রসন্নতা দর্শনে উৎসাহিত হইয়া আমার অন্তঃকরণ কিছু জিজ্ঞাসা করিতে অভিলাষ করিতেছে। যদি আপনার ক্লেশকর না হয়, তাহা হইলে, আত্মবৃত্তান্ত বর্ণন দ্বারা আমার কৌতুকাক্রান্ত চিত্তকে পরিতৃপ্ত করুন। কি দেবতাদিগের কুল, কি মহর্ষিদিগের কুল, কি গন্ধর্ব্বদিগের কুল, কি অপ্সরাদিগের কুল—আপনি জন্মপরিগ্রহ দ্বারা কোন্ কুল উজ্জ্বল করিয়াছেন? কি নিমিত্ত কুসুমসুকুমার নবীন বয়সে আয়াসসাধ্য তপস্যায় প্রবৃত্ত হইয়াছেন? কি নিমিত্তই বা দিব্য আশ্রম পরিত্যাগ করিয়া এই নির্জ্জন বনে একাকিনী অবস্থিতি করিতেছেন? তাপসী কিঞ্চিৎ কাল নিস্তব্ধ থাকিয়া পরে দীর্ঘ নিশ্বাস পরিত্যাগ পূর্ব্বক রোদন করিতে আরম্ভ করিলেন। চন্দ্রাপীড় তাঁহাকে অশ্রুমুখী দেখিয়া মনে মনে চিন্তা করিলেন, এ আবার কি! শোক, তাপ কি সকল শরীরকেই আশ্রয় করিয়াছে? যাহা হউক, ইঁহার বাস্পসলিলপাতে আমার আরও কৌতুক জন্মিল। বোধ হয়, শোকের কোন মহৎ কারণ থাকিবেক। সামান্য শোক এতাদৃশ পবিত্র মূর্ত্তিকে কখন কলুষিত ও অভিভূত করিতে পারে না। বায়ুর আঘাতে কি বসুধা চালিত হয়? চন্দ্রাপীড় আপনাকে শোকোদ্দীপনহেতু ও তজ্জন্য অপরাধী বোধ করিয়া মুখপ্রক্ষালনের নিমিত্ত প্রস্রবণ হইতে জল আনিয়া দিলেন ও সান্ত্বনাবাক্যে নানাপ্রকার বুঝাইলেন। তাপসী চন্দ্রাপীড়ের সান্ত্বনাবাক্যে রোদনে ক্ষান্ত হইয়া মুখপ্রক্ষালন পূর্ব্বক কহিলেন, রাজপুত্ত্র! এই পাপীয়সী হতভাগিনীর অশ্রোতব্য বৈরাগ্যবৃত্তান্ত শ্রবণ করিয়া কি হইবে? উহা কেবল শোকানল ও দুঃখার্ণব। যদি শুনিতে নিতান্ত অভিলাষ হইয়া থাকে, শ্রবণ করুন।