কাব্যগ্রন্থ (পঞ্চম খণ্ড)/কথা ও কাহিনী/অপমান-বর

অপমান-বর

(ভক্তমাল)

ভক্ত কবীর সিদ্ধপুরুষ খ্যাতি রটিয়াছে দেশে,
কুটীর তাহার ঘিরিয়া দাঁড়াল লাখাে নরনারী এসে।
কেহ কহে, মাের রােগ দূর করি মন্ত্র পড়িয়া দেহ,—
সন্তান লাগি করে কাঁদাকাটি বন্ধ্যা রমণী কেহ।
কেহ বলে, তব দৈবক্ষমতা চক্ষে দেখাও মােরে,
কেহ কয়, ভবে আছেন বিধাতা বুঝাও প্রমাণ করে'।

কাঁদিয়া ঠাকুরে কাতর কবীর কহে দুই জোড়করে—
দয়া করে’ হরি জন্ম দিয়েছ নীচ যবনের ঘরে,
ভেবেছিনু কেহ আসিবে না কাছে অপার কৃপায় তব,
সবার চোখের আড়ালে কেবল তােমায় আমায় র’ব।
একি কৌশল খেলেছ মায়াবী, বুঝি দিলে মােরে ফাঁকি!
বিশ্বের লােক ঘরে ডেকে এনে তুমি পালাইবে না কি?

ব্রাহ্মণ যত নগরে আছিল উঠিল বিষম রাগি'
লােক নাহি ধরে যবন জোলার চরণধূলার লাগি।
চারিপােওয়া কলি পূরিয়া আসিল পাপের বােঝায় ভরা,
এর প্রতিকার না করিলে আর রক্ষা না পায় ধরা।

ব্রাহ্মণদল যুক্তি করিল নষ্ট নারীর সাথে,
গােপনে তাহারে মন্ত্রণা দিল, টাকা দিল তা'র হাতে।

বসন বেচিতে এসেছে কবীর একদা হাটের বারে,
সহসা কামিনী সবার সামনে কাঁদিয়া ধরিল তা'রে।
কহিল, রে শঠ নিঠুর কপট, কহিনে কাহারাে কাছে
এমনি করে’ কি সরলা নারীরে ছলনা করিতে আছে?
বিনা অপরাধে আমারে ত্যজিয়া সাধু সাজিয়াছ ভালাে,
অন্নবসনবিহনে আমার বরণ হয়েছে কালাে।

কাছে ছিল যত ব্রাহ্মণদল করিল কপট কোপ—
ভণ্ড তাপস, ধর্ম্মের নামে করিছ ধর্ম্মলােপ!
তুমি সুখে বসে' ধূলা ছড়াইছ সরল লােকের চোখে,
অবলা অখলা পথে পথে আহা ফিরিছে অম্নশােকে।
কহিল কবীর—অপরাধী আমি, ঘরে এস, নারী, তবে,
আমার অন্ন রহিতে কেন বা তুমি উপবাসী র’বে?

দুষ্টা নারীরে আনি গৃহমাঝে বিনয়ে আদর করি
কবীর কহিল—দীনের ভবনে তােমারে পাঠাল হরি।
কাঁদিয়া তখন কহিল রমণী লাজে ভয়ে পরিতাপে-
লােভে পড়ে' আমি করিয়াছি পাপ, মরিব সাধুর শাপে।
কহিল কবীর, ভয় নাই মাতঃ, লইব না অপরাধ;—
এনেছ আমার মাথার ভূষণ অপমান অপবাদ।

ঘুচাইল তা'র মনের বিকার, করিল চেতনা দান,
সঁপি দিল তা'র মধুর কণ্ঠে হরিনামগুণগান।
রটি গেল দেশে কপট কবীর, সাধুতা তাহার মিছে।
শুনিয়া কবীর কহে নতশির—আমি সকলের নীচে।
যদি কূল পাই, তরণী-গরব রাখিতে না চাহি কিছু,
তুমি যদি থাক আমার উপরে, আমি র’ব সব-নীচু।

রাজার চিত্তে কৌতুক হ’ল শুনিতে সাধুর গাথা,
দূত আসি তাঁরে ডাকিল যখন, সাধু নাড়িলেন মাথা।
কহিলেন, থাকি সবা হ'তে দূরে, আপন হীনতা মাঝে;
আমার মতন অভাজনজন রাজার সভায় সাজে?
দূত কহে, তুমি না গেলে ঘটিবে আমাদের পরমাদ,—
যশ শুনে তব হয়েছে রাজার সাধু দেখিবার সাধ।

রাজা বসে' ছিল সভার মাঝারে, পারিষদ সারি সারি,
কবীর আসিয়া পশিল সেথায় পশ্চাতে ল’য়ে নারী।
কেহ হাসে কেহ করে ভুরুকুটী, কেহ রহে নতশিরে,
রাজা ভাবে এটা কেমন নিলাজ, রমণী লইয়া ফিরে!
ইঙ্গিতে তাঁর, সাধুরে, সভার বাহির করিল দ্বারী,
বিনয়ে কবীর চলিল কুটীরে সঙ্গে লইয়া নারী।

পথমাঝে ছিল ব্রাহ্মণদল, কৌতুকভরে হাসে;
শুনায়ে শুনায়ে বিরূপবাণী কহিল কঠিন ভাষে

তখন রমণী কাঁদিয়া পড়িল সাধুর চরণমূলে-
কহিল, পাপের পক্ষ হইতে কেন নিলে মােরে তুলে?
কেন অধমারে রাখিয়া দুয়ারে সহিতেছ অপমান?
কহিল কবীর, জননী তুমি যে, আমার প্রভুর দান।

২৮শে আশ্বিন, ১৩০৬