কাব্যগ্রন্থ (পঞ্চম খণ্ড)/কথা ও কাহিনী/পূজারিণী

পূজারিণী

( অবদানশতক)

 নৃপতি বিম্বিসার
নমিয়া বুদ্ধে মাগিয়া লইলা
 পাদ-নখ-কণা তাঁর।
স্থাপিয়া নিভৃত প্রাসাদ-কাননে
তাহারি উপরে রচিলা যতনে
অতি অপরূপ শিলাময় স্তূপ
 শিল্পশােভার সার।
সন্ধ্যাবেলায় শুচিবাস পরি
 রাজবধূ রাজবালা
আসিতেন, ফুল সাজায়ে ডালায়,
স্তূপপদমূলে সােনার থালায়
আপনার হাতে দিতেন জ্বালায়ে
 কনকপ্রদীপমালা।

অজাতশত্রু রাজা হ’ল যবে,
 পিতার আসনে আসি
পিতার ধর্ম্ম শােণিতের স্রোতে
মুছিয়া ফেলিল রাজপুরী হ’তে,

৩৩৭
5-22

সঁপিল যজ্ঞ-অনল-আলােতে
 বৌদ্ধ-শাস্ত্ররাশি।
কহিলা ডাকিয়া অজাতশত্রু
 রাজপুরনারী সবে,—
“বেদ ব্রাহ্মণ রাজা ছাড়া আর
কিছু নাই ভবে পূজা করিবার
এই ক’টি কথা জেনাে মনে সার-
 ভুলিলে বিপদ হবে।”


সেদিন শারদ-দিবা-অবসান,—
 শ্রীমতী নামে সে দাসী
পুণ্যশীতল সলিলে নাহিয়া
পুষ্পপ্রদীপ থালায় বাহিয়া
রাজমহিষীর চরণে চাহিয়া
 নীরবে দাঁড়াল আসি।
শিহরি সভয়ে মহিষী কহিলা-
 “এ কথা নাহি কি মনে
অজাতশত্রু করেছে রটনা-
স্তূপে যে করিবে অর্ঘ্যরচনা
“শূলের উপরে মরিবে সে জনা
 অথবা নির্ব্বাসনে।”

সেথা হ’তে ফিরি গেল চলি ধীরি
 বধূ অমিতার ঘরে।
সমুখে রাখিয়া স্বর্ণ-মুকুর
বাঁধিতেছিল সে দীর্ঘ চিকুর
আঁকিতেছিল সে যত্নে সিঁদুর
 সিঁথির সীমার পরে।
শ্রীমতীরে হেরি বাঁকি গেল রেখা
 কাঁপি গেল তা’র হাত,—
কহিল, “অবােধ, কি সাহস-বলে
এনেছিস্ পূজা, এখনি যা চলে',
কে কোথা দেখিবে, ঘটিবে তাহ'লে
 বিষম বিপদপাত।”

অস্ত-রবির রশ্মি-আভায়
 খােলা জানালার ধারে
কুমারী শুক্লা বসি একাকিনী
পড়িতে নিরত কাব্য-কাহিনী,
চমকি উঠিল শুনি কিঙ্কিণী
 চাহিয়া দেখিল দ্বারে।
শ্রীমতীরে হেরি পুঁথি রাখি ভূমে
 দ্রুতপদে গেল কাছে।
কহে সাবধানে তা'র কানে কানে
“রাজার আদেশ আজি কে না জানে,

এমনি করে' কি মরণের পানে
 ছুটিয়া চলিতে আছে?”
দ্বার হ'তে দ্বারে ফিরিল শ্রীমতী
 লইয়া অর্ঘ্যথালি।
“হে পুরবাসিনী” সবে ডাকি কয়,—
“হয়েছে প্রভুর পূজার সময়”-
শুনি ঘরে ঘরে কেহ পায় ভয়
 কেহ দেয় তা'রে গালি।


দিবসের শেষ আলােক মিলাল
 নগর-সৌধপরে।
পথ জনহীন আঁধারে বিলীন,
কলকোলাহল হ'য়ে এল ক্ষীণ,
আরতিঘণ্টা ধ্বনিল প্রাচীন
 রাজ-দেবালয় ঘরে।
শারদ নিশির স্বচ্ছ তিমিরে
 জ্বলে অগণ্য তারা।
সিংহদুয়ারে বাজিল বিষাণ,
বন্দীরা ধরে সন্ধ্যার তান,
“মন্ত্রণসভা হ’ল সমাধান"
 দ্বারী ফুকারিয়া বলে।

এমন সময়ে হেরিলা চমকি
 প্রাসাদে প্রহরী যত-
রাজার বিজন কানন মাঝারে
স্তূপপদমূলে গহন আঁধারে
জ্বলিতেছে কেন, যেন সারে সারে
 প্রদীপমালার মত।

মুক্তকৃপাণে পুররক্ষক।
 তখনি ছুটিয়া আসি
শুধাল—“কে তুই ওরে দুর্ম্মতি,
মরিবার তরে করিস্ আরতি?”
মধুর কণ্ঠে শুনিল “শ্রীমতী
 আমি বুদ্ধের দাসী।”
সেদিন শুভ্র পাষাণ-ফলকে
 পড়িল রক্ত-লিখা।
সেদিন শারদ স্বচ্ছ নিশীথে
প্রাসাদ-কাননে নীরবে নিভৃতে
পপদমূলে নিবিল চকিতে
 শেষ আরতির শিখা।

১৮ই আশ্বিন, ১৩০৬।