কাব্যগ্রন্থ (পঞ্চম খণ্ড)/কথা ও কাহিনী/হোরিখেলা
হোরিখেলা
(রাজস্থান)
পত্র দিল পাঠান কেসর্ খাঁরে
কেতুন্ হ’তে ভূনাগ রাজার রাণী,—
লড়াই করি আশ মিটেছে মিঞা?
বসন্ত যায় চোখের উপর দিয়া,
এস তোমার পাঠান সৈন্য নিয়া
হোরি খেল্ব আমরা রাজপুতানী।—
যুদ্ধে হারি কোটা সহর ছাড়ি
কেতুন্ হ’তে পত্র দিল রাণী।
পত্র পড়ি কেসর উঠে হাসি,
মনের সুখে গোঁফে দিল চাড়া।
রঙীন্ দেখে’ পাগ্ড়ি পরে মাথে,
সুর্ম্মা আঁকি দিল আঁখির পাতে,
গন্ধভরা রুমাল নিল হাতে
সহস্রবার দাড়ি দিল ঝাড়া।
পাঠান সাথে হোরি খেল্বে রাণী
কেসর হাসি গোঁফে দিল চাড়া।
ফাগুন মাসে দখিন হ’তে হাওয়া
বকুলবনে মাতাল হ’য়ে এল।
বোল্ ধরেছে আম্র বনে বনে,
ভ্রমরগুলো কে কার কথা শোনে,
গুন্গুনিয়ে আপন মনে মনে
ঘুরে ঘুরে বেড়ায় এলোমেলো।
কেতুনপুরে দলে দলে আজি
পাঠান সেনা হোরি খেলতে এল
কেতুনপুরে রাজার উপবনে
তখন সবে ঝিকিমিকি বেলা।
পাঠানের দাঁড়ায় বনে আসি,
মূলতানেতে তান ধরেছে বাঁশি,
এল তখন একশো রাণীর দাসী
রাজপুতানী কর্তে হোরি-খেলা।
রবি তখন রক্তরাগে রাঙা,
সবে তখন ঝিকিমিকি বেলা।
পায়ে পায়ে ঘাগরা উঠে দুলে
ওড়না ওড়ে দক্ষিণে বাতাসে।
ডাহিন্ হাতে বহে ফাগের থারি,
নীবিবন্ধে ঝুলিছে পিচ্কারী,
বামহস্তে গুলাব্-ভরা ঝারী
সারি সারি রাজপুতানী আসে।
পায়ে পায়ে ঘাগরা উঠে দুলে,
ওড়না ওড়ে দক্ষিণে বাতাসে।
আঁখির ঠারে চতুর হাসি হেসে—
কেসর তবে কহে কাছে আসি,—
বেঁচে এলেম অনেক যুদ্ধ করি’—
আজকে বুঝি জানে-প্রাণে মরি।–
শুনে রাজার শতেক সহচরী
হঠাৎ সবে উঠল অট্ট হাসি।
রাঙা পাগড়ি হেলিয়ে কেসর খাঁ
রঙ্গভরে সেলাম করে আসি।
সুরু হ’ল হোরির মাতামাতি,
উড়তেছে ফাগ্ রাঙা সন্ধ্যাকাশে।
নব-বরণ ধরল বকুল ফুলে,
রক্তরেণু ঝর্ল তরুমূলে,
ভয়ে পাখী কূজন গেল ভুলে
রাজপুতানীর উচ্চ উপহাসে।
কোথা হ’তে রাঙা কুজ্ঝটিকা
লাগল যেন রাঙা সন্ধ্যাকাশে।
চোখে কেন লাগচেনাকো নেশা?—
মনে মনে ভাবচে কেসর খাঁ।
বক্ষ কেন উঠ্চেনাকো দুলি?
নারীর পায়ে বাঁকা নূপুরগুলি
কেমন যেন বল্চে বেসুর বুলি,
তেমন করে’ কাঁকণ বাজে না।
চোখে কেন লাগচেনাকো নেশা?
মনে মনে ভাবচে কেসর খাঁ।
পাঠান কহে—রাজপুতানীর দেহে
কোথাও কিছু নাই কি কোমলতা?
বাহুযুগল নয় মৃণালের মত,
কণ্ঠস্বরে বজ্র লজ্জাহত,
বড় কঠিন শুস্ক স্বাধীন যত
মঞ্জরীহীন মরুভূমির লতা।—
পাঠান ভাবে দেহে কিম্বা মনে
রাজপুতানীর নাইক কোমলতা।
তান ধরিয়া ইমন্ ভূপালিতে।
বাঁশি বেজে উঠ্ল দ্রুত তালে।
কুণ্ডলেতে দোলে মুক্তামালা,
কঠিন হাতে মোটা সোনার বালা,
দাসীর হাতে দিয়ে ফাগের থালা
রাণী বনে এলেন হেনকালে।
তান ধরিয়া ইমন্ ভূপালিতে
বাঁশি তখন বাজচে দ্রুত তালে
কেসর কহে—তোমারি পথ চেয়ে
দুটি চক্ষু করেছি প্রায় কানা।—
রাণী কহে—আমারো সেই দশা!—
একশো সখী হাসিয়া বিবশা,—
পাঠানপতির ললাটে সহসা
মারেন রাণী কাঁসার থালাখানা।
রক্তধারা গড়িয়ে পড়ে বেগে
পাঠানপতির চক্ষু হ’ল কানা।
বিনা মেঘে বজ্ররবের মত
উঠল বেজে কাড়া-নাকাড়া।
জ্যোৎস্নাকাশে চম্কে ওঠে শশী,
ঝন্ঝনিয়ে ঝিকিয়ে ওঠে অসি,
সানাই তখন দ্বারের কাছে বসি
গভীর সুরে ধর্ল কানাড়া।
কুঞ্জবনের তরু তলে তলে
উঠল বেজে কাড়া-নাকাড়া।
বাতাস বেয়ে ওড়না গেল উড়ে,
পড়ল খসে ঘাগরা ছিল যত।
মন্ত্রে যেন কোথা হ’তে কেরে
বাহির হ’ল নারী-সজ্জা ছেড়ে,
এক শত বীর ঘিরল পাঠানেরে
পুষ্প হ’তে একশো সাপের মত।
স্বপ্ন সম ওড়না গেল উড়ে,
পড়ল খসে’ ঘাগরা ছিল যত।
যে পথ দিয়ে পাঠান এসেছিল
সে পথ দিয়ে ফিরলনাকে তা’রা।
ফাগুন রাতে কুঞ্জবিতানে
মত্ত কোকিল বিরাম না জানে,
কেতুনপুরে বকুল বাগানে
কেসর খাঁয়ের খেলা হ’ল সারা।
যে পথ দিয়ে পাঠান এসেছিল
সে পথ দিয়ে ফিরলনাকো তা’রা।