কাব্যগ্রন্থ (প্রথম খণ্ড)/প্রভাত-সঙ্গীত/প্রতিধ্বনি

প্রতিধবনি


অয়ি প্রতিধবনি,
বুঝি আমি তোরে ভালবাসি,
বুঝি আর কারেও বাসি না!
আমারে করিলি তুই আকুল ব্যাকুল,
তোর লাগি কাঁদে মোর বীণা।
তোর মুখে পাখীদের শুনিয়া সঙ্গীত,
নির্ঝরের শুনিয়া ঝর্ঝর,
গভীর রহস্যময় অরণ্যের গান,
বালকের মধুমাখা স্বর,
তোর মুখে জগতের সঙ্গীত শুনিয়া
তোরে আমি ভাল বাসিয়াছি;
তবু কেন তোরে আমি দেখিতে না পাই,
বিশ্বময় তোরে খুজিয়াছি!
যখনি পাখীটি গেয়ে উঠে
অমনি শুনিরে তোর গান,
চমকিয়া চারিদিকে চাই,
কোথা—কোথা—কাঁদেরে পরাণ।



তখনি খুঁজিতে যাই কাননে কাননে,
ভ্রমি আমি গুহায় গুহায়,
ছুটি আমি শিখরে শিখরে,
হেরি আমি হেথায় হোথায়।
যখনি ডাকিরে তোরে কাতর হইয়া
দূর হতে দিস্ তুই সাড়া,
অমনি সে দূরপানে যাই আমি ছুটে,
কিছু নাই মহাশূন্য ছাড়া।
অয়ি প্রতিধ্বনি,
কোথা তোর ঘুমের কুটীর,
কোথা তোর স্বপনের পাড়া!

চিরকাল—চিরকাল—তুই কিরে চিরকাল
সেই দূরে র'বি,
আধ সুরে গাবি শুধু গীতের আভাস,
তুই চির-কবি?
দেখা তুই দিবি না কি? না হয় না দিলি,
একটি কি পূরাবি না আশ,
কাছে হতে একবার শুনিবারে চাই
তোর গীতোচ্ছাস।
অরণ্যের, পর্বর্বতের, সমুদ্রের গান,
ঝটিকার বজ্রগীতস্বর,



দিবসের, প্রদোষের, রজনীর গীত,
চেতনার, নিদ্রার মর্ম্মর,
বসন্তের, বরষার, শরতের গান,
জীবনের মরণের স্বর,
আলোকের পদধ্বনি মহা অন্ধকারে
ব্যাপ্ত করি বিশ্বচরাচর,
পৃথিবীর, চন্দ্রমার, গ্রহ-তপনের,
কোটি কোটি তারার সঙ্গীত,
তোর কাছে জগতের কোন্ মাঝখানে
না জানিরে হতেছে মিলিত।
সেইখানে একবার বসাইবি মোরে;
সেই মহা আঁধার নিশায়
শুনিবরে আঁখি মুদি বিশ্বের সঙ্গীত
তোর মুখে কেমন শুনায়।


তোরে আমি দেখিনি কখনো,
তবুও অতুল রূপরাশি
তোর আধ কণ্ঠস্বর সম
প্রাণে আধ বেড়াইছে ভাসি।
তারে দেখিবারে চাই—তারে ধরিবারে চাই,
সেই মোরে করেছে পাগল,



তারি তরে চরাচরে সুখ শান্তি নাই
তারি তরে পরাণ বিকল।

জোছনায় ফুলবনে একাকী বসিয়া থাকি,
আঁখি দিয়া অশ্রবারি ঝরে,
বল্ মোরে বল্ অয়ি মোহিনী ছলনা,
সে কি তোরি তরে?
বিরামের গান গেয়ে সায়াহ্নের বায়
কোথা বহে যায়,
তারি সাথে কেন মোর প্রাণ হুহু করে
সে কি তোরি তরে?
বাতাসে সৌরভ ভাসে, আঁধারে কত না তারা,
আকাশে অসীম নীরবতা,
তখন প্রাণের মাঝে কত কথা ভেসে যায়,
সে কি তোরি কথা?
ফুলের সৌরভ গুলি আকাশে খেলাতে এসে
বাতাসেতে হয় পথহারা,
চারিদিকে ঘুরে হয় সারা,
মা’র কোলে ফিরে যেতে চায়,
ফুলে ফুলে খুজিয়া বেড়ায়;
তেমনি প্রাণের মাঝে অশরীরী আশাগুলি,



ভ্রমে কেন হেথায় হোথায়,
সে কি তোরে চায়?
আঁখি যেন কার তরে পথপানে চেয়ে আছে,
দিন গণি গণি,
মাঝে মাঝে কারো মুখে সহসা দেখে সে যেন
অতুল রূপের প্রতিধ্বনি;
কাছে গেলে মিলাইয়া যায়,
নিরাশের হাসিটির প্রায়।—
সৌন্দর্য্যের মরীচিকা এ কাহার মায়া?
এ কি তোরি ছায়া!

জগতের গানগুলি দূর দূরান্তর হতে
দলে দলে তোর কাছে যায়,
যেন তারা, বহ্নি হেরি পতঙ্গের মত,
পদতলে মরিবারে চায়!
জগতের মৃত গানগুলি
তোর কাছে পেয়ে নব প্রাণ
সঙ্গীতের পরলোক হতে
গায় যেন দেহমুক্ত গান!
তাই তার নব কণ্ঠধ্বনি
প্রভাতের স্বপনের প্রায়,



কুসুমের সৌরভের সাথে
এমন সহজে মিশে যায়।


আমি ভাবিতেছি বসে গানগুলি তোরে
না জানি কেমনে খুঁজে পায়,
না জানি কোথায় খুঁজে পায়!
না জানি কি গুহার মাঝারে
অস্ফুট মেঘের উপবনে,
স্মৃতি ও আশায় বিজড়িত
আলোক-ছায়ার সিংহাসনে,
ছায়াময়ী মূর্ত্তিখানি আপনে আপনি মিশি
আপনি বিস্মিত আপনায়,
কার পানে শূন্যপানে চায়!
সায়াহ্নে প্রশান্ত রবি স্বর্ণময় মেঘমাঝে
পশ্চিমের সমুদ্রসীমায়
প্রভাতের জন্মভূমি শৈশব-পূরবপানে
যেমন আকুল নেত্রে চায়,
পুরবের শূন্যপটে প্রভাতের স্মৃতিগুলি
এখনো দেখিতে যেন পায়,
তেমনি সে ছায়াময়ী কোথা যেন চেয়ে আছে
কোথা হতে আসিতেছে গান;



এলানো কুন্তলজালে সন্ধ্যার তারকাগুলি
গান শুনে মুদিছে নয়ান।
বিচিত্র সৌন্দর্য্য জগতের
হেথা আসি হইতেছে লয়।
সঙ্গীত, সৌরভ, শোভা, জগতে যা কিছু আছে,
সবি হেথা প্রতিধ্বনিময়।
প্রতিধ্বনি, তব নিকেতন,
তোমার সে সৌন্দর্য্য অতুল,
প্রাণে জাগে ছায়ার মতন,
ভাষা হয় আকুল ব্যাকুল।
আমরণ চিরদিন কেবলি খুঁজিব তোরে,
কখন কি পাব না সন্ধান?
কেবলি কি র'বি দূরে অতি দূর হতে
শুনিবরে ওই আধ গান?
এই বিশ্বজগতের মাঝখানে দাঁড়াইয়া
বাজাইবি সৌন্দর্য্যের বাঁশি,
অনন্ত জীবনপথে খুঁজিয়া চলিব তোরে
প্রাণমন হইবে উদাসী।
তপনেরে ঘিরি ঘিরি যেমন ঘুরিছে ধরা,
ঘুরিব কি তোর চারিদিকে?
অনন্ত প্রাণের পথে বরষিবি গীত-ধারা
চেয়ে আমি রব অনিমিখে।



তোরি মোহময় গান শুনিতেছি অবিরত
তোরি রূপ কল্পনায় লিখা,
করিসনে প্রবঞ্চনা সত্য করে বল দেখি
তুই ত নহিস্ মরীচিকা?
কতবার আর্ত্তস্বরে শুধায়েছি প্রাণপণে
অয়ি তুমি কোথায়—কোথায়-—
অমনি স্থদূর হতে কেন তুমি বলিয়াছ,
“কে জানে কোথায়?”
আশাময়ী, ওকি কথা, তুমি কি আপনাহারা,
আপনি জান না আপনায়?