কাব্যগ্রন্থ (প্রথম খণ্ড)/সন্ধ্যা-সঙ্গীত/পাষাণী
পাষাণী
জগতের বাতাস করুণা,
করুণা সে রবি শশী তারা,
জগতের শিশির করুণা,
জগতের বৃষ্টিবারিধারা।
জননীর স্নেহধারাসম
এই যে জাহ্নবী বহিতেছে,
মধুরে তটের কানে কানে
আশ্বাস-বচন কহিতেছে-
এও সেই বিমল করুণা-
হৃদয় ঢালিয়া বহে যায়,
জগতের তৃষা নিবারিয়া
গান গাহে করুণ ভাষায়।
কাননের ছায়া সে করুণা,
করুণা সে ঊষার কিরণ,
করুণা সে জননীর আঁখি,
করুণা সে প্রেমিকের মন;—
এমন যে মধুর করুণা,
এমন যে কোমল করুণা,
জগতের হৃদয়-জুড়ানো
এমন যে বিমল করুণা,
দিন দিন বুক ফেটে যায়,
দিন দিন দেখিবারে পাই—
যারে ভালবাসি প্রাণপণে
সে করুণা তার মনে নাই।
পরের নয়ন-জলে তার না হৃদয় গলে,
দুখেরে সে করে উপহাস,
দুখেরে সে করে অবিশ্বাস;
দেখিয়া হৃদয় মোর তরাসে শিহরি উঠে,
প্রেমের কোমল প্রাণে শত শত শেল ফুটে,
হৃদয় কাতর হয়ে নয়ন মুদিতে চায়,
কাঁদিয়া সে বলে “হায়! হায়,
এ ত নহে আমার দেবতা,
তবে কেন রয়েছে হেথায়?”
তুমি নও, সে জন ত নও,
তবে তুমি কোথা হতে এলে?
এলে যদি এস তবে কাছে,
এ হৃদয়ে যত অশ্রু আছে
একবার সব দিই ঢেলে,
তোমার সে কঠিন পরাণ
যদি তাহে এক তিল গলে,
কোমল হইয়া আসে মন
সিক্ত হয়ে অশ্রু জলে জলে।
কঁদিবারে শিখাই তোমায়,
পর-দুঃখে ফেলিতে নিশ্বাস,
করুণার সৌন্দর্য্যঅতুল
ও নয়নে করে যেন বাস।
প্রতিদিন দেখিয়াছি আমি
করুণারে করেছ পীড়ন,
প্রতিদিন ওই মুখ হতে
ভেঙে গেছে রূপের মোহন।
কুবলয় আঁখির মাঝারে
সৌন্দর্য্য পাই না দেখিবারে,
হাসি তব আলোকের প্রায়,
কোমলতা নাহি যেন তায়,
তাই মন প্রতিদিন কহে,
“নহে, নহে, এ জন সে নহে।”
শোন বঁধু শোন, আমি করুণারে ভালবাসি
সে যদি না কে তবে ধূলিময় রূপরাশি!
তোমারে যে পূজা করি, তোমারে যে দিই ফুল,
ভালবাসি বলে যেন কখনো কোরো না ভুল!
যে জন দেবতা মোর কোথা সে আছে না জানি,
তুমি ত কেবল তার পাষাণ-প্রতিমাখানি।
তোমার হৃদয় নাই, চোখে নাই অশ্রুধার,
কেবল রয়েছে তব, পাষাণ আকার তার!