কন্‌গ্রেস

শ্রীযুক্ত অমিয়চন্দ্র চক্রবর্তী কল্যাণীয়েষু

অত্যন্ত উদ্‌বেগ নিয়ে তোমাকে চিঠি লিখতে বসেছি।

 কিছুকাল আগেই দেশের মন ছিল মরুময়। দিগন্তব্যাপী অনুর্বরতা তার ভিন্ন ভিন্ন অংশের মধ্যে পণ্যবিনিময়ের সম্বন্ধ অবরুদ্ধ করে বহু যুগকে দরিদ্র করে রেখেছিল।

 এমন সময় আশ্চর্য অল্প কালেই বৃহৎ শূন্যতার মাঝখানে কন্‌গ্রেস মাথা তুলে উঠল দূর ভবিষ্যতের অভিমুখে মুক্তির প্রত্যাশা বহন করে, বহুশাখায়িত বিপুল বনস্পতির মতো। বিরাট জনসাধারণের মন আশ্চর্য দ্রুত বেগে বদলে গেল; সেই মন আশা করতে শিখল, ভয় করতে ভুলে গেল, বন্ধনমোচনের সংকল্প করতে তার সংকোচ আর রইল না।

 কিছুদিন আগেই দেশ যা অসাধ্য বলেই হাল ছেড়ে বসে ছিল এখন তা আর অসম্ভব বলে মনে হল না। ইচ্ছা করবার দৈন্য আজ ঘুচেছে। এক প্রান্ত থেকে আর-এক প্রান্ত পর্যন্ত সমস্ত দেশের এত বড়ো পরিবর্তন ঘটতে পেরেছে কেবল একজন মাত্র মানুষের অবিচলিত ভরসার জোরে, সেই ইতিহাসের বিস্ময়কর হয়তো ক্ষণে ক্ষণে স্থানে স্থানে অস্বীকৃত হতেও পারবে এমনতরো অকৃতজ্ঞতার আশঙ্কা মনে জাগছে।

 সফল ভবিতব্যতার আশ্বাস নিয়ে আজ যে কন্‌গ্রেস অসামান্য ব্যক্তি-স্বরূপের প্রতিভার উপরে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কালে কালে তার সংস্কার-সাধনের, তার সীমাপরিবর্ধনের প্রয়োজন নিশ্চয় ঘটবে তা জানি। কিন্তু চঞ্চল হয়ে বর্তমানের সঙ্গে হঠাৎ তার সামঞ্জস্যে আঘাত করে একটা নাড়াচাড়া ঘটাতে গেলে মন্দিরের ভিত হবে বিদীর্ণ। প্রাণবান সৃষ্টির ধারাকে বাঁচিয়ে রেখেও বড়ো-রকম বিপর্যয় সাধন করবার যোগ্য অসামান্য চারিত্রশক্তি এ দেশে সম্প্রতি কোথাও দেখা যাচ্ছে না, সে কথা স্বীকার করতেই হবে। দেশের যে-একটা মস্ত মিলনতীর্থ মহাত্মাজির শক্তিতে গড়ে উঠেছে এখনো সেটাকে তাঁরই সহযোগিতায় রক্ষা করতে ও পরিণতি দান করতে হবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

 তুমি জান আমার স্বভাবটা একেবারেই সনাতনী নয়— অর্থাৎ খুঁটিগাড়া মত ও পদ্ধতি অতীত কালে আড়ষ্ট ভাবে বদ্ধ হয়ে থাকলেই যে শ্রেয়কে চিরন্তন করতে পারবে, এ কথা আমি মানি নে। বর্তমান কন্‌গ্রেস যত বড়ো মহৎ অনুষ্ঠানই হোক-না কেন, তার সমস্ত মত ও লক্ষ্য যে একেবারে দৃঢ়নির্দিষ্ট ভাবে নির্বিকার নিশ্চল হয়ে গেছে তাও সত্য হতেই পারে না। কোনোদিনই তা না হোক, এই আকাক্ষা করি। কিন্তু এই কন্‌গ্রেসের পরম মূল্য যখন উপলব্ধি করি এবং এ কথাও যখন জানি এই কন্‌গ্রেস একটি মহৎ ব্যক্তিস্বরূপের সৃষ্টি, তখন হঠাৎ এ'কে সজোরে নাড়া দেবার উপক্রম দেখলে মন উৎকণ্ঠিত না হয়ে থাকতে পারে না। তখন এই কথাই মনে হয় এর পরিণতি ও পরিবর্তনের প্রক্রিয়া এর ভিতর থেকেই সঞ্চারিত করতে হবে। বাইরে থেকে কাটা-ছেড়া করে নয়।

 ইতিপূর্বে কন্‌গ্রেসনামধারী যে প্রতিষ্ঠান ভারতবর্ষে আন্দোলন জাগিয়েছিল তার কথা তো জানা আছে। তার আন্দোলন ছিল বাইরের দিকে। দেশের জনগণের অন্তরের দিকে সে তাকায় নি, তাকে জাগায় নি; স্বদেশের পরিত্রাণের জন্যে সে করুণ দৃষ্টিতে পথ তাকিয়ে ছিল বাইরেকার উপরওয়ালার দিকে। পরবশতার ধাত্রীক্রোড়েই তার স্বাধীনতা আশ্রয় নিয়ে আছে, এই স্বপ্ন তার কিছুতে ভাঙতে চায় নি। সেদিনকার হাতজোড়-করা দোহাই-পাড়া মুক্তিফৌজের চিত্তদৈন্যকে বার বার ধিক্কার দিয়েছি; সে তুমি জান। হঠাৎ সেই তামসিকতার মধ্যে দেশের সুপ্ত প্রাণে কে ছুঁইয়ে দিলে সোনার কাঠি, জাগিয়ে দিলে একমাত্র আত্মশক্তির ৩৭৩ প্রতি ভরসাকে, প্রচার করলে অহিংস্র সাধনাকেই নির্ভীক বীরের সাধনারূপে। নব জীবনের তপস্যার সেই প্রথম পর্ব আজও সম্পূর্ণ হয় নি, আজও এ রয়েছে তারই হাতে যিনি একে প্রবর্তিত করেছেন। শিবের তপোভূমিতে নন্দী দাঁড়িয়ে ছিলেন ওষ্ঠাধরে তর্জনী তুলে, কেননা তপস্যা তখনো শেষ হয় নি— বাইরের অভিঘাতে তাকে ভাঙতে গিয়ে অগ্নিকাণ্ড হয়েছিল।

 এই তো গেল এক পক্ষের কথা, অপর পক্ষের সম্বন্ধেও ভাবনার কারণ প্রবল হয়ে উঠেছে। কন্‌গ্রেস যতদিন আপন পরিণতির আরম্ভ-যুগে ছিল ততদিন ভিতর দিক থেকে তার আশঙ্কার বিষয় অল্পই ছিল। এখন সে প্রভূত শক্তি ও খ্যাতি সঞ্চয় করেছে, শ্রদ্ধার সঙ্গে তাকে স্বীকার করে নিয়েছে সমস্ত পৃথিবী। সে কালের কন্‌গ্রেস যে রাজদরবারের রুদ্ধ দ্বারে বৃথা মাথা খোঁড়াখুঁড়ি করে মরত আজ সেই দরবারে তার সম্মান অবারিত, এমন-কি, সেই দরবার কনগ্রেসের সঙ্গে আপস করতে কুণ্ঠা বোধ করে। কিন্তু মনু বলেছেন, সম্মানকে বিষের মতো জানবে। পৃথিবীতে যে দেশেই যে-কোনো বিভাগেই ক্ষমতা অতিপ্রভূত হয়ে সঞ্চিত হয়ে ওঠে সেখানই সে ভিতরে ভিতরে নিজের মারণবিষ উদ্ভাবিত করে। ইম্পিরিয়ালিজ্‌ম বললা, ফাসিজ্‌ম বললা, অন্তরে অন্তরে নিজের বিনাশ নিজেই সৃষ্টি করে চলেছে। কন্‌গ্রেসেরও অন্তঃসঞ্চিত ক্ষমতার তাপ হয়তো তার অস্বাস্থ্যের কারণ হয়ে উঠেছে বলে সন্দেহ করি। যাঁরা এর কেন্দ্রস্থলে এই শক্তিকে বিশিষ্ট ভাবে অধিকার করে আছেন, সংকটের সময় তাদের ধৈর্য্যচ্যুতি হয়েছে, বিচারবুদ্ধি সোজা পথে চলে নি। পরস্পরের প্রতি যে শ্রদ্ধা ও সৌজন্য— যে বৈধতা রক্ষা করলে যথার্থ ভাবে কন্‌গ্রেসের বল ও সম্মান রক্ষা হত, তার ব্যভিচার ঘটতে দেখা গেছে; এই ব্যবহার-বিকৃতির মূলে আছে শক্তিস্পর্ধার প্রভাব। খৃস্টান শাস্ত্রে বলে, স্ফীতকায়া সম্পদের পক্ষে স্বর্গরাজ্যের প্রবেশপথ সংকীর্ণ। কেননা ধনাভিমানী ক্ষমতা আনে তামসিকতা। কন্‌গ্রেস আজ বিপুল সম্মানের ধনে ধনী, এতে তার স্বর্গরাজ্যের পথ করছে বন্ধুর। মুক্তির সাধনা তপস্যার সাধনা। সেই তপস্যা সাত্ত্বিক, এই জানি মহাত্মার উপদেশ। কিন্তু এই তপঃক্ষেত্রে যাঁরা রক্ষকরূপে একত্র হয়েছেন তাঁদের মন কি উদারভাবে নিরাসক্ত? তাঁরা পরস্পরকে আঘাত করে যে বিচ্ছেদ ঘটান সে কি বিশুদ্ধ সত্যেরই জন্যে? তার মধ্যে কি সেই উত্তাপ একেবারেই নেই যে উত্তাপ শক্তিগর্ব ও শক্তিলোভ থেকে উদ্‌ভূত? ভিতরে ভিতরে কন্‌গ্রেসের মন্দিরে এই-যে শক্তিপূজার বেদি গড়ে উঠছে তার কি স্পর্ধিত প্রমাণ এবারে পাই নি যখন মহাত্মাজিকে তাঁর ভক্তেরা। মুসোলীনি ও হিট্‌লারের সমকক্ষ বলে বিশ্বসমক্ষে অসম্মানিত করতে পারলেন? সত্যের যজ্ঞে যে কন্‌গ্রেসকে গড়ে তুলেছেন তপস্বী তার বিশুদ্ধতা কি তাঁরা রক্ষা করতে পারবেন— শক্তিপূজায় নরবলি-সংগ্রহের কাপালিক মুসোলীনি ও হিটার যাঁদের আদর্শ? আমি সর্বান্তঃকরণে শ্রদ্ধা করি জওহরলালকে; যেখানে ধন বা অন্ধ ধর্ম বা রাষ্ট্রপ্রভাব ব্যক্তিগত সংকীর্ণ সীমায় শক্তির ঔদ্ধত্য পুঞ্জীভূত করে তোলে সেখানে তার বিরুদ্ধে তাঁর অভিযান। আমি তাঁকে প্রশ্ন করি, কন্‌গ্রেসের দুর্গদ্বারের দ্বারীদের মনে কোথাও কি এই ব্যক্তিগত শক্তিমদের সাংঘাতিক লক্ষণ দেখা দিতে আরম্ভ করে নি? এতদিন পরে অন্তত আমার মনে সন্দেহ প্রবেশ করেছে। কিন্তু আমি পোলিটিশিয়ান নই, এই প্রসঙ্গে সে কথা কবুল করব।

 এই উপলক্ষে একটা কথা বলা দরকার। গত কন্‌গ্রেস-অধিবেশনের ব্যবহারে বাঙালি জাতির প্রতি অবজ্ঞা প্রকাশ করা হয়েছে, এই অভিযোেগ বাংলাদেশে ব্যাপ্ত। এই নালিশটাকে বিশ্বাস করে নেওয়ার মধ্যে দুর্বলতা আছে। চার দিকে সকলেই বিরুদ্ধ চক্রান্ত করছে, সর্বদা মনের মধ্যে এইরকম সংশয়কে আলোড়িত হতে দেওয়া মনোবিকারের লক্ষণ। দুর্ভাগ্যক্রমে দেশে মিলনকেন্দ্ররূপে কন্‌গ্রেসের প্রতিষ্ঠা হওয়া সত্ত্বেও ভারতবর্ষে এক প্রদেশের সঙ্গে আর-এক প্রদেশের বিচ্ছেদের সাংঘাতিক লক্ষণ নানা আকারেই থেকে থেকে প্রকাশ পাচ্ছে। ভারতবর্ষে হিন্দু ও মুসলমানের অনৈক্য শোচনীয় এবং ভয়াবহ সে কথা বলা বাহুল্য। যে বিচ্ছেদের বাহন স্বয়ং ধর্মমত তার মতো দুর্লঙ্ঘ্য আর-কিছু হতে পারে। কিন্তু এক প্রদেশের সঙ্গে আর-এক প্রদেশের যে আত্মীয়বুদ্ধির ক্ষীণতা তার কারণ পরস্পরের মধ্যে পরিচয়ের অভাব ও আচারের পার্থক্য। এই দুর্ভাগ্য ভারতবর্ষে আচার ও ধর্ম এক সিংহাসনের শরিক হয়ে মানুষের বুদ্ধিকে আবিল করে রেখেছে। যে দেশের আচার অন্ধজিদ-ওয়ালা নয়, যে দেশের ধর্মভেদ সামাজিক জীবনকে খণ্ড খণ্ড করে নি, সেই দেশে রাষ্ট্রিক ঐক্য স্বতঃই সম্ভবপর হয়েছে। আমাদের দেশে কন্‌গ্রেস সেই সাধারণ সামাজিক ঐক্যের ভিতর থেকে আপনি সজীব ভাবে বেড়ে ওঠে নি। তাকে স্থাপন করা হয়েছে এমন একটা সামাজিক অনৈক্যের উপরে, যে অনৈক্য প্রত্যেক পাঁচ-দশ ক্রোশ অন্তর অতলস্পর্শ গর্ত খুঁড়ে রেখেছে। এবং সেই গর্তগুলোকে দিনরাত আগলে রয়েছে ধর্মনামধারী রক্ষক-দল।

 কারণ যাই হোক, প্রদেশে প্রদেশে জোড় মেলে নি। মনে পড়ছে আমার কোনো-এক লেখায় ছিল, যে জীর্ণ গাড়ির চাকাগুলো বিশ্লিষ্ট, মড় মড় ঢল্‌ঢল্‌ করে যার কোচ্‌বাক্স, জোয়ালটা খসে পড়বার মুখে, তাকে যতক্ষণ দড়ি দিয়ে বেঁধেসেঁধে আস্তাবলে রাখা হয় ততক্ষণ তার অংশ-প্রত্যংশের মধ্যে ঐক্য কল্পনা করে সন্তোষ প্রকাশ করতে পারি, কিন্তু যেই ঘোড়া জুতে তাকে রাস্তায় বের করা হয় অমনি তার আত্মবিদ্রোহ মুখর হয়ে ওঠে।

 ভারতবর্ষের মুক্তিযাত্রাপথের রথখানাকে আজ কন্‌গ্রেস টেনে রাস্তায় বের করেছে। পলিটিকসের-দড়ি-বাঁধা অবস্থায় চলতে যখন শুরু করলে তখন বার বারে দেখা গেল তার এক অংশের সঙ্গে আর-এক অংশের আত্মীয়তার মিল নেই। অবস্থাটা যখন তখন কন্‌গ্রেস-কর্তৃপক্ষদের অত্যন্ত সতর্ক হয়ে চলা কর্তব্য। কেননা, সন্ধিগ্ধ মন সকলপ্রকার আঘাত ও অবৈধতাকে অতিমাত্র করে তোলে। তাই ঘটেছে আজ। সমস্ত বাংলাদেশের সঙ্গে কন্‌গ্রেসের বন্ধনে টান পড়েছে ছেঁড়বার মুখে। এর অত্যাবশ্যকতা ছিল না। সমগ্র একটা বড়ো প্রদেশের এরকম মনশ্চাঞ্চল্যের অবস্থায় বাংলাদেশের নেতাদের ঠিক পথে চলা দুঃসাধ্য হবে।

 বুঝতে পারছি স্বদেশকে স্বাতন্ত্রদানের উদ্দেশ্যে মহাত্মাজির মনে একটা বিশেষ সংকল্প বাঁধা রয়েছে। মনে মনে তার পথের একটা ম্যাপ তিনি এঁকে রেখেছেন। অতএব পাছে কোনো বিপরীত মতবাদের অভিঘাতে তার সংকল্পকে ক্ষুন্ন করে, এ আশঙ্কা তার মনে থাকা স্বাভাবিক। তিনিই দেশকে এত দিন এত দূর পর্যন্ত নানা প্রমাদের মধ্যে দিয়েও চালনা করে এনেছেন; সেই চালনার ব্যবস্থাকে শিথিল হতে দিতে যদি তিনি শঙ্কিত হন তা হলে বলব না যে সেই শঙ্কা একাধিপত্যপ্রিয়তার লোভে। প্রতিভাসম্পন্ন পুরুষমাত্রেরই নিজের ক্ষমতার প্রতি বিশ্বাস দৃঢ় না থাকলে তাঁদের জীবনের উদ্দেশ্য বিফল হয়। এই বিশ্বাসকে তারা ভগবানের প্রতি বিশ্বাসের সঙ্গে বেঁধে দিয়ে ধ্রুব করে রাখেন। মহাত্মাজির সেই বিশ্বাস যে সার্থক, মোটের উপর তার প্রমাণ পেয়েছেন গুরুতর ভুলচুক সত্ত্বেও। এবং তার মনে যে পরিকল্পনা আছে সেটাকে যথাসম্ভব সম্পূর্ণ করতে তিনি ছাড়া আর-কেউ পারবে না, সেও তিনি বিশ্বাস করেন। সকল প্রভাবসম্পন্ন ব্যক্তিরই এইরকম বিশ্বাসে অধিকার আছে। বিশেষত তখন তার কৃত অসমাপ্ত সৃষ্টি গড়ে ওঠবার মুখে। হয়তো মহাত্মাজির সৃজনশালায় আরো অনেক মূল্যবান নূতন উপকরণ যোগ করবার প্রয়োজন আছে। এই যোগ করা যদি ধৈর্যের সঙ্গে শ্রদ্ধার সঙ্গে তার সহযোগিতায় না ঘটে তা হলে সমগ্রেরই হবে ক্ষতি। এ অবস্থায় মূল। সৃষ্টিকর্তার উপর নির্ভর রাখতেই হবে। আমি নিজের সম্বন্ধে এ কথা স্বীকার করব যে, মহাত্মাজির সঙ্গে সকল বিষয়ে আমার মতের ঐক্য নেই। অর্থাৎ আমি যদি তাঁর মতো চারিত্রপ্রভাবসম্পন্ন মানুষ হতেম তা হলে অন্য রকম প্রণালীতে কাজ করতুম। কী সে প্রণালী, আমার অনেক পুরাতন লেখায় তার বিবরণ দিয়েছি। আমার মননশক্তি যদি বা থাকে কিন্তু আমার প্রভাব নেই। এই প্রভাব আছে জগতের অল্প লোকেরই। দেশের সৌভাগ্যক্রমে দৈবাৎ যদি সেরকম শক্তিসম্পন্ন পুরুষের আবির্ভাব হয় তবে তাঁকে তাঁর পথ ছেড়ে দিতেই হবে, তার কর্মধারাকে বিক্ষিপ্ত করতে পারব না। সময় আসবে যখন ক্রমে অভাবক্রটির মোচন হবে এবং সেই অভাবমোচন আমরা সকলেই আপন আপন ইচ্ছাকে আপন যোগ্যতা অনুসারে প্রবৃত্ত করতে পারব। সামনের যে ঘাট লক্ষ্য করে আজ কর্ণধার নৌকো চালিয়েছেন সে দিকে তাকে যেতে দেওয়া হোক। দূরদৃষ্টিহীন ভক্তদের মতো বলব না, তার উর্ধ্বে আর ঘাট নেই। আরো আছে এবং তার জন্যে আরো মাঝির দরকার হবে।

 আমার মনে যে পরিকল্পনার উদয় হয়েছিল তার কথা পূর্বেই বলেছি। আমি জানি রাষ্ট্রব্যাপার সমাজের অন্তর্গত; কোনো দেশেরই ইতিহাসে তার অন্যথা হয় নি; সামাজিক ভিত্তির কথাটা বাদ দিয়ে রাষ্ট্রিক ইমারতের কল্পনায় মুগ্ধ হয়ে কোনো লাভ নেই। সমুদ্রের ও পারে দেখা যাচ্ছে নানা আকারের— নানা আয়তনের— জয়তোরণের চূড়া, কিন্তু তাদের কোনোটারই ভিত গাড়া হয় নি বালির উপরে। যখন লুব্ধ মনে তাদের উপরতলার অনুকরণে প্ল্যান আঁকব তখন দেশের সামাজিক চিত্তের মধ্যে নিহিত ভিত্তির রহস্যটা যেন বিচার করি।

 কিছুদিন হল একটি বিরল-বসতি পাহাড়ে এসে আশ্রয় নিয়েছি। আছি সদ্য-উন্মথিত রাষ্ট্রিক উত্তেজনা থেকে দূরে। অনেক দিন পরে ভারতবর্ষকে এবং আপনাকে শান্তমনে দেখবার অবকাশ পাওয়া গেল। দেখছি চিন্তা করে— মানবজগতে দুই প্রবল শক্তি নিয়ে পলিটিকসের ব্যবহার। একটার প্রয়োগ বাহিরের দিকে, সেটা যন্ত্রশক্তি; আর-একটার কাজ মানুষের মন নিয়ে, সেটাকে বলতে পারি মন্ত্রশক্তি। আজ য়ুরোপের সংকটের দিনে এই দুই শক্তির হিসাব গণনা করে প্রতিদ্বন্দ্বীরা কখনো এগিয়ে কখনো পিছিয়ে পদচারণা করছে।

 বাহির থেকে একটা কথা আমরা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, এই শক্তির কোনোটাই সহজসাধ্য নয়, অনেক তার দাম, সুদীর্ঘ তার প্রয়োগশিক্ষাচর্চা। বহু কাল ধরে আমরা পরের অধীনে আছি, যন্ত্রশক্তির আঘাত কী রকম তা জানি কিন্তু তার আয়ত্তের উপায় আমাদের স্বপ্নের অগোচর। অত্যাবশ্যক বোধ করলে বাহিরের কোনো পালোয়ান জাতির সঙ্গে দেনা চরবার কারবার ফেঁদে বন্ধুত্ব পাতানো যেতে পারে। সেটা দেউলে হবার রাস্তা। সেরকম মহাজনরা আজও এই গরিব জাতের আনাচে-কানাচে ঘুরে বেড়ায়। ইতিহাসে দেখা গেছে, প্রবলের সঙ্গে অসমকক্ষের মিতালি খাল কেটে কুমির ডেকে আনা। তাতে কুমিরের পেট ভরে অবিবেচক খাল-কাটিয়ের খরচায়। তা ছাড়া অমঙ্গল-প্রতিরোধের যোগ্য জনমনঃশক্তি বহু কালের অব্যাবহারে গিয়েছে মরচে পড়ে। ভরসা হারিয়েছে। কোনো-একটা নেশার ঝেকে মরিয়া হয়ে যদি ভরসা বাঁধি বুকে, তবে সে গিয়ে দাঁড়াবে তিতুমীরের বাঁশের কেল্লায়। একদিন ছিল যখন সাহস ও বাহুবলের যোগে চলত লড়াই। এখন এসেছে সায়ান্স, শিক্ষিত বুদ্ধির ’পরে ভর করে। শুধু বুদ্ধি নয়, তার প্রধান সহায় প্রভূত অর্থবল। অথচ আমাদের লড়তে হবে শূন্য তহবিল এবং এমন জনসংঘ নিয়ে যাদের মন কর্মবিধানে দৃঢ় নয়, যারা অশাসিত— যাদের শক্তি হয় অচেতন হয়ে থাকে নয় অন্ধ হয়ে ছোটে। দেশের পলিটিকসের আরম্ভ হয়েছিল এই দুরূহ সমস্যা নিয়ে। সেইজন্যে প্রথম যুগের নেতারা অগত্যা নৌকো বানিয়েছিলেন দরখাস্তের পার্চমেণ্ট দিয়ে। সেটা দাঁড়িয়েছিল খেলায়। এই রিক্ততার সমস্যা নিয়েই একদিন মহাত্মা এসে দাঁড়ালেন বিপুল শক্তিমান প্রতিদ্বন্দ্বীর সামনে; দুঃখ সয়েছিলেন, মাথা হেঁট করেন নি। বিনা যন্ত্রশক্তিতে লড়াই যে চলতে পারে এইটে প্রমাণ করতে তাঁরা আসা। একটা একটা উপলক্ষ নিয়ে তিনি লড়াই শুরু করে দিলেন; কোনোটাতে যে শেষ পর্যন্ত জিতেছেন তা বলতে পারি নে, কিন্তু পরাভবের মধ্য দিয়ে জেতবার ভূমিকা সৃষ্টি করেছেন। ক্রমে ক্রমে সেই মন তৈরি করছেন যে মন তাঁর সংকল্পিত অস্ত্র যথাযোগ্য সংযম ও সাহসের সঙ্গে ব্যবহার করতে পারে। এই অস্ত্র ছাড়া কেবল যে আমাদেরই উপায়ান্তর নেই তা নয়, সমস্ত পৃথিবীরই এই দশা। হিংস্র যুদ্ধ নিরন্ত; সে একই কেন্দ্রের চারি দিকে ধ্বংসসাধনের ঘুরপাক খাওয়ায়, তার সমাপ্তি সর্বনাশে।

 হিংস্র যুদ্ধের ফৌজ তৈরি করা সহজ, বছরখানেকের কুচকাওয়াজে তাদের চালিয়ে দেওয়া যায় রণক্ষেত্রে। কিন্তু অহিংস্র যুদ্ধের মনকে পাকা করে তুলতে সময় লাগে। অশিক্ষিত লোক নিয়ে ভিড় জমাননা অনেক দেখা গেল; তাদের নিয়ে দক্ষযজ্ঞ ভাঙা চলে, এমন সিদ্ধিলাভ চলে না যা মূল্যবান। এমনকি পাশব শক্তির রীতিমত ধাক্কা খেলে তারা আপনাকে সামলাতে পারে না, ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

 পৃথিবীতে আজ যে-সব জাতি যে-কোনো রকম লড়াই চালাচ্ছে তাদের সকলেরই জোর সর্বজনীন জনশিক্ষায়। বর্তমান যুগ শিক্ষিত বুদ্ধির যুগ, স্পর্ধিত মাংসপেশীর যুগ নয়। জাপানের তো কথাই নেই— বড়ো বড়ো অন্য সকল প্রাচ্য জাতিই সর্বত্র জনশিক্ষাসত্র খুলেছেন। আজকের দিনে আমরা দেশের বহু কোটি চোখ-বাঁধা মোহের বাহন নিয়ে এগোতে পারব না। মহাত্মাজি অসহযোগ আন্দোলন স্থগিত রেখে জনশিক্ষায় মন দিয়েছেন। বোধ করি প্রমাণ পেয়েছেন, ভিড় জমিয়ে অসহযোগ দেখতে দেখতে অসহ্য হয়ে ওঠে।

 আজকের দিনে কোন্ জননায়ক পলিটিক্‌স্‌কে কোন্ পথে নিয়ে যাবেন তা নিয়ে অনেক আলোচনা চলছে। মনে নানা সংশয় জাগে, স্পষ্ট বুঝতে পারি নে এ-সকল পথযাত্রার পরিণাম। কিন্তু নিশ্চিত বিচার করা আমার পক্ষে কঠিন; আমি পলিটিক্‌সে প্রবীণ নই। এ কথা জানি, যাঁরা শক্তিশালী তাঁরা নতুন পথে অসাধ্য সাধন করে থাকেন। মহাত্মাজিই তার প্রমাণ। তবু, তাঁর স্বীকৃত সকল অধ্যবসায়ই চরমতা লাভ করবে এমন কথা শ্রদ্ধেয় নয়। অন্য কোনো কর্মবীরের মনে নতুন সাধনার প্রেরণা যদি জাগে তা হলে দোহাই পাড়লেও সে বীর হাত গুটিয়ে বসে থাকবেন না। সেজন্য হয়তো অভ্যস্ত পথে যূথভ্রষ্ট হয়ে অনভ্যস্ত পথে তাকে দল বাঁধতে হবে, সে দলের সম্পূর্ণ পরিচয় পেতে ও তাকে আয়ত্ত করতে সময় লাগবে। কন্‌গ্রেসের অভিমুখে যদি কোনো কৃতী নূতন পথ খুলতে বেরোন, আমি অনভিজ্ঞ, তাঁর সিদ্ধি কামনা করব, দেখব তাঁর কামনার অভিব্যক্তি— কিন্তু দূরের থেকে। কেননা দেশের জননায়কতার দায়িত্ব অত্যন্ত বৃহৎ— তার ভালো মন্দ ফলাফল বহুদূরব্যাপী, অনেক সময়েই তা অভাবনীয়। নিজের উপরে যাঁর স্থির বিশ্বাস আছে তিনিই তা বহন করতে পারেন, কিন্তু এ-সকল পোলিটিক্যাল প্রয়াস আমার পক্ষে স্বাভাবিক বলে আমি অনুভব করি নে। পরধর্মো ভয়াবহঃ। আমার নিজের এতদিনের অভ্যস্ত পথেই আমি সান্ত্বনা পাই। গণদেবতার পূজা সকল পূজার আরম্ভে, আমাদের শাস্ত্রে এই কথা বলে। স্বদেশসেবায় সেই প্রথম পূজার পদ্ধতি হচ্ছে এমন-সকল অনুষ্ঠানে প্রবৃত্ত হওয়া যাতে জনগণ সুস্থ হয়, সবল হয়, শিক্ষিত হয়, আনন্দিত হয়, আত্মসম্মানে দীক্ষিত হয়, সুন্দরকে নির্মলকে আবাহন করে আনে আপন প্রাত্যহিক জীবিকার ক্ষেত্রে, এবং যাতে আত্মরক্ষায় আত্মকল্যাণসাধনে পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা রক্ষা করে সকলে সম্মিলিত হতে পারে। আমার সামান্য শক্তিতে ক্ষুদ্র পরিধির মধ্যে এই কাজে মন দিয়েছি প্রায় চল্লিশ বৎসর ধ’রে। মহাত্মাজি যখন স্বদেশকে জাগাবার ভার নিয়েছিলেন তখন একান্তমনে কামনা করেছিলুম, তিনি জনগণের বিচিত্র শক্তিকে বিচিত্র পথে উদবোধিত করবেন। কেননা আমি জানি, দেশকে পাওয়া বলতে বোঝায় তাকে তার পরিপূর্ণতার মধ্যে পাওয়া। দেশের যথার্থ স্বাধীনতা হচ্ছে তাই যাতে তার সমস্ত অবরুদ্ধ শক্তি মুক্তিলাভ করে।

 আজ আমি জানি, বাংলাদেশের জননায়কের প্রধান পদ সুভাষচন্দ্রের। সমস্ত ভারতবর্ষে তিনি যে আসন গ্রহণের সাধনা করে আসছেন সে পলিটিকসের আসরে, আমি পূর্বেই বলেছি সেখানে আমি আনাড়ি। সেখানে দলাদলির ঝড়ে ধূলি উড়েছে, সেই ধূলিচক্রের মধ্যে আমি ভবিষ্যৎকে স্পষ্ট দেখতে পাই নে— আমার দেখার শক্তি নেই। আজকেকার এই গোলমালের মধ্যে আমার মন আঁকড়ে ধরে আছে বাংলাকে। যে বাংলাকে আমরা বড়ো করব সেই বাংলাকেই বড়ো করে লাভ করবে সমস্ত ভারতবর্ষ। তার অন্তরের ও বাহিরের সমস্ত দীনতা দূর করবার সাধনা গ্রহণ করবেন এই আশা করে আমি সুদৃঢ়-সংকল্প-সুভাষকে অভ্যর্থনা করি এবং এই অধ্যবসায়ে তিনি সহায়তা প্রত্যাশা করতে পারবেন আমার কাছ থেকে, আমার যে বিশেষ শক্তি তাই দিয়ে। বাংলাদেশের সার্থকতা বহন করে বাঙালি প্রবেশ করতে পারবে সসম্মানে ভারতবর্ষের মহাজাতীয় রাষ্ট্রসভায়। সেই সার্থকতা সম্পূর্ণ হোক সুভাষচন্দ্রের তপস্যায়।

মংপু
২০।৫।৩৯


 অপ্রাসঙ্গিক হলেও পুনশ্চ বক্তব্যে একটা কথা জানিয়ে রাখি। হিন্দুমুসলমানের চাকরির হার-বাঁটোয়ারা নিয়ে অবিচার হয়েছে। এই নিয়ে হিন্দুরা ভারতশাসন-দরবারে নালিশ জানিয়েছেন। সেই পত্রে নামস্বাক্ষর করতে আমার যথেষ্ট দ্বিধা ছিল। দীর্ঘকাল চাকরির অন্নে বাঙালির নাড়ী দুর্বল হয়ে গেছে, তা নিয়ে আর কাড়াকাড়ি করতে রুচি হয় না। হিন্দুর ভাগ্যে পরাধীন জীবিকার অসম্মানের দ্বারগুলো যদি বন্ধ হয় তো হোক— তা হলেই বুদ্ধি খাটাতে হবে, শক্তি খাটাতে হবে আত্মনির্ভরের বড়ো রাস্তা খুঁজে বের করতে; এই দুঃখের ধাক্কাতেই আনবে যুগান্তর। কিন্তু অনিচ্ছাসত্ত্বেও নালিশের পত্রে আমি সই দিয়েছি। তার একটিমাত্র কারণ আছে। স্বজাতির দুই শ্রেণীর মধ্যে পক্ষপাতের অন্যায় বিচার দেখলে শাসনকর্তাদের প্রতি অশ্রদ্ধা জন্মে, তার ফলাফল তারাই বিচার করবেন। কিন্তু দুই পক্ষের মধ্যে দুই অসমান বাটখারায় অনুবিভাগের শোচনীয় পরিণাম হচ্ছে সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধিকে নানা দৃষ্টান্তে কথায় কথায় তীব্র করে তোলা। তাকে শান্ত করবার অবকাশ থাকবে না। পৃথিবীতে হিলার-মুসোলীনির দল অন্যায় করবার অপ্রতিহত সুযোগ পেয়েছেন নিজের প্রবল শক্তির থেকে। তারও একটা ভীষণ মহিমা আছে। কিন্তু আমাদের দেশে নীচের তলার শাসনকর্তারা সুযোগ পেয়েছেন উপরতলার প্রশ্রয় থেকে এই অবিমিশ্র অন্যায়ে পৌরুষ নেই। তাই যারা অবিচার সহ্য করতে বাধ্য হয় তাদের মনে সম্রম জাগে না, অশ্রদ্ধা জাগে। দেশশাসনের ইতিহাসে এই স্মৃতিটা হেয়। কিন্তু আমাদের সমস্যা এই শাসনকর্তাদের নিয়ে নয়। কেননা শাসনকর্তাদের হাত-বদল হবেই; কিন্তু হিন্দু-মুসলমান চিরকাল পাশাপাশি থাকবেই, তারা ভারতভাগ্যের শরিক— অবিবেচক দণ্ডধারী তাদের সম্বন্ধের মধ্যে যদি গভীর করে কাটা বিধিয়ে দেয় তবে তার রক্তস্রাবী ক্ষত শীঘ্র নিরাময় হবে না। তাই আজ যে ব্যবস্থায় মুসলমানের জমার ঘরে ভুক্ত করছে সুবিধা, দীর্ঘকালের হিসাবে সেটা রয়ে যাবে নিয়ত ক্ষতির ছিদ্ররূপে। তা বলে এই চিন্তায় হিন্দুদের সান্ত্বনার কথা নেই, কেননা আমাদের ইতিহাসের তহবিল সাধারণ তহবিল।

 আষাঢ় ১৩৪৬