কালান্তর (২০১৮)/মহাজাতি-সদন

মহাজাতি-সদন

আমার বিশ্বাস, য়ুরোপীয় সংস্কৃতি ভারতবর্ষে সর্বপ্রথমে বাংলাদেশের অন্তঃকরণ গভীরভাবে স্পর্শ করেছিল, নানা দিক থেকে বিচলিত করেছিল তার মন। মুক্তির বেগ লাগল তার জীবনে, তার মননশক্তি জাগরিত হয়ে উঠল পূর্বযুগের অজগরনিদ্রা থেকে। বুদ্ধির সর্বজনীনতা, দৃষ্টির সর্বব্যাপকতা, সর্বমানবের পরিপ্রেক্ষণিকায় মানবত্বের উপলব্ধি বাংলাদেশেই রামমোহন রায়ের মতো মহামনীষীদের চিত্তে অপূর্ব প্রভাবে অকস্মাৎ আবির্ভূত হল। আচার ধর্ম ও রাষ্ট্রীয়-বন্ধনের মুক্তি বাংলাদেশেই সর্বপ্রথমে উদ্যত হয়ে উঠেছিল। অতি অল্পকালের মধ্যে চলৎশক্তিমতী হয়ে উঠল বাংলাভাষা, তার আড়ষ্টতা ঘুচে গেল নব-যৌবনসঞ্চারে, সাহিত্য দেখা দিতে লাগল অভূতপূর্ব সফলতার আশা বহন করে, পৃথিবীর আদিযুগে যেমন করে দ্বীপ উঠেছিল সমুদ্রগর্ভ থেকে নব নব প্রাণের অন্নদায়িনী আশ্রয়ভূমি হয়ে। চিত্রকলা বাংলাদেশে সর্বপ্রথমে অনুকরণের জাল ছিন্ন করে ভারতীয় স্বরূপের বিশিষ্টতালাভের সন্ধানে বিদেশীয় চরণচারণ-চক্রবর্তীদের তীব্র বিদ্রুপের বিরুদ্ধে জয়ী হল। গীতকলা আজ এই বাংলাদেশেই গতানুগতিকতার প্রভুত্ব কাটিয়ে, কুলত্যাগের কলঙ্ক স্বীকার করে, নৃতন প্রকাশের অভিসারে চলেছে— তার আশু ফলের বিচার করবার সময় হয় নি, কিন্তু পণ্ডিতেরা যাই বলুন, নবনবোন্মেষের পথে প্রতিভার মুক্তি কামনা এর মধ্যে যা দেখা যাচ্ছে তার থেকেই বাংলাদেশের যথার্থ প্রকৃতির নিরূপণ হতে পারে। প্রাণের স্পর্শশক্তি যেখানে প্রবল সেখানে প্রাণের সাড়া পেতে দেরি হয় না। যতদূর থেকেই আহ্বান আসুক, নবযুগের সাড়া দিতে বাংলাদেশ প্রথম হতেই জড়তা দেখায় নি— বাংলাদেশের এই গৌরব এবং এই তার সত্য পরিচয়। এ কথা কারো অগোচর নেই যে, একদা রাষ্ট্রযুক্তিসাধনার সর্বপ্রথম কেন্দ্রস্থল ছিল এই বাংলাদেশ এবং যে দুর্যোগের দিনে এই প্রদেশের নেতারা কারাপ্রাচীরের নেপথ্যে ছিলেন তখন তরুণের দল দেশের অপমান দূর করবার জন্যে বধবন্ধনের মুখে যেমন নির্বিচারে ঝাঁপ দিয়ে পড়েছিল ভারতবর্ষের অন্য কোনো প্রদেশে কখনোই এরকম ঘটে নি। এ ঘটনাকেও ফলের দ্বারা বা শান্ত সুবুদ্ধির আদর্শে বিচার করব না, বিচার করব মুক্তির জন্যে দুঃসহ বেদনার মূল্য-অনুসারে। বাংলাদেশে সহস্রাধিক তরুণপ্রাণ সুদীর্ঘকাল কারানির্বাসনে আপন দীপ্তি নির্বাপিত করেছে— জানি, সেইজন্যে আজ বাংলাদেশের আকাশ অনুজ্জ্বল; কিন্তু সেইসঙ্গে এও জানি, যে মাটিতে এদের জন্ম সেই মাটিতে দুঃখজয়ী বীরসন্তান আবার জন্মাবে, তারা পূর্ব অভিজ্ঞতার শিক্ষায় সমাহিত হয়ে ভাঙনের ব্যর্থ কাজে আপন শ্রেষ্ঠ শক্তির অপব্যয় না করে গড়নের কাজে প্রবৃত্ত হবে।

 আজ এই মহাজাতি-সদনে আমরা বাংলাজাতির যে শক্তির প্রতিষ্ঠা করবার সংকল্প করেছি তা সেই রাষ্ট্রশক্তি নয়, যে শক্তি শত্রু মিত্র সকলের প্রতি সংশয়কণ্টকিত। জাগ্রত চিত্তকে আহ্বান করি, যার সংস্কারমুক্ত উদার আতিথ্যে মনুষ্যত্বের সর্বাঙ্গীণ মুক্তি অকৃত্রিম সত্যতা লাভ করে। বীর্য এবং সৌন্দর্য, কর্মসিদ্ধিমতী সাধনা এবং সৃষ্টিশক্তিমতী কল্পনা, জ্ঞানের তপস্যা এবং জনসেবার আত্মনিবেদন— এখানে নিয়ে আসুক আপন আপন বিচিত্র দান। অতীতের মহৎ স্মৃতি এবং ভবিষ্যতের বিপুল প্রত্যাশা এখানে আমাদের প্রত্যক্ষ হোক। বাংলাদেশের যে আত্মিক মহিমা নিয়তপরিণতির পথে নবযুগের নবপ্রভাতের দিকে চলেছে, অনুকূল ভাগ্য যাকে প্রশ্রয় দিচ্ছে এবং প্রতিকূলতা যার নির্ভীক স্পর্ধাকে দুর্গম পথে সম্মুখের দিকে অগ্রসর করছে সেই তার অন্তর্নিহিত মনুষ্যত্ব এই মহাজাতি-সদনের কক্ষে কক্ষে বিচিত্র মূর্তরূপ গ্রহণ করে বাঙালিকে আত্মোপলব্ধির সহায়তা করুক। বাংলার যে জাগ্রত হৃদয় মন আপন বুদ্ধির ও বিদ্যার সমস্ত সম্পদ ভারতবর্ষের মহাবেদীতলে উৎসর্গ করবে বলেই ইতিহাসবিধাতার কাছে। দীক্ষিত হয়েছে, তার সেই মনীষিতাকে এখানে আমরা অভ্যর্থনা করি। আত্মগৌরবে সমস্ত ভারতের সঙ্গে বাংলার সম্বন্ধ অচ্ছেদ্য থাকুক, আত্মাভিমানের সর্বনাশা ভেদবুদ্ধি তাকে পৃথক না করুক— এই কল্যাণ-ইচ্ছা এখানে সংকীর্ণচিত্ততার ঊর্ধ্বে আপন জয়ধ্বজা যেন উড্ডীন রাখে। এখান থেকে এই প্রার্থনামন্ত্র যুগে যুগে উচ্ছ্বসিত হতে থাক্—

বাঙালির পণ, বাঙালির আশা,
বাঙালির কাজ, বাঙালির ভাষা,
সত্য হউক- সত্য হউক- সত্য হউক হে ভগবান!
বাঙালির প্রাণ, বাঙালির মন,
বাঙালির ঘরে যত ভাইবােন,
এক হউক এক হউক এক হউক হে ভগবান!

 সেইসঙ্গে এ কথা যােগ করা হােক বাঙালির বাহু ভারতের বাহুকে বল দিক, বাঙালির বাণী ভারতের বাণীকে সত্য করুক, ভারতের মুক্তিসাধনায় বাঙালি স্বৈরবুদ্ধিতে বিচ্ছিন্ন হয়ে কোনাে কারণেই নিজেকে অকৃতার্থ যেন না করে।

কলিকাতা
২ ভাদ্র ১৩৪৬

 আশ্বিন ১৩৪৬