গড্‌ডলিকা/শ্রীশ্রীসিদ্ধেশ্বরী লিমিটেড

শ্রী শ্রী সিদ্ধেশ্বরী লিমিটেড

  মাঘ মাস, ১৩২৬ সাল। এইমাত্র আর্ম্মানি গির্জ্জার ঘড়িতে বেলা এগারটা বাজিয়াছে। শ্যামবাবু চামড়ার ব্যাগ হাতে ঝুলাইয়া জুডাস্ লেনের একটি তেতলা বাটীতে প্রবেশ করিলেন। বাড়ীটি বহু পুরাতন,—ক্রমাগত চূণ ও রংএর প্রলেপে লোলচর্ম্ম কলপিতকেশ বৃদ্ধের দশা প্রাপ্ত হইয়াছে। নীচের তলায় অন্ধকারময় মালের গুদাম। উপরতলায় সম্মুখভাগে অনেকগুলি ব্যবসায়ীর অফিস, পশ্চাতে বিভিন্ন জাতীয় কয়েকটি পরিবার পৃথক-পৃথক অংশে বাস করেন। প্রবেশ-দ্বারের সম্মুখেই তেতলা পর্যন্ত বিস্তৃত কাঠের সিঁড়ি। সিঁড়ির পাশের দেওয়াল আগাগোড়া তাম্বুলরাগচর্চ্চিত,—যদিও নিষেধের নোটিস লম্বিত আছে। কতিপয় নেংটে ইঁদুর ও আরসোলা পরস্পর অহিংসভাবে স্বচ্ছন্দে ইতস্ততঃ বিচরণ করিতেছে। ইহারা আশ্রম-মৃগের ন্যায় নিঃশঙ্ক,— সিঁড়ির যাত্রিগণকে গ্রাহ্য করে না। অন্তরালবর্ত্তী সিন্ধি পরিবারের রান্নাঘর হইতে নির্গত হিংএর তীব্র গন্ধের সহিত নরদামার গন্ধ মিলিত হইয়া সমস্ত স্থান আমোদিত করিয়াছে। অফিস-সমূহের মালিকগণ তুচ্ছ বিষয়ে নির্লিপ্ত থাকিয়া, কেনা-বেচা, তেজী-মন্দী, আদায়উসুল, ইত্যাদি মহৎ ব্যাপারে ব্যতিব্যস্ত হইয়া দিন যাপন করিতেছেন।

 শ্যামবাবু তেতলায় উঠিয়া একটি ঘরের তালা খুলিলেন। ঘরের দরজার পাশে কাষ্ঠফলকে লেখা আছে—‘ব্রহ্মচারী এণ্ড ব্রাদার-ইন্‌-ল, জেনারেল মার্চ্চেণ্টস্।’ এই কারবারের স্বত্বাধিকারী স্বয়ং শ্যামবাবু (শ্যামলাল গাঙ্গুলী) এবং তাঁহার শ্যালক বিপিন চৌধুরী, বি-এস্‌সি। ঘরে কয়েকটি পুরাতন টেবিল, চেয়ার, আলমারী, প্রভৃতি অফিস-সরঞ্জাম। টেবিলের উপর নানা প্রকার খাতা, বিতরণের জন্য ছাপানো বিজ্ঞাপনের স্তূপ, একটি পুরাতন থ্যাকার্স ডিরেক্টরি, একখণ্ড ইণ্ডিয়ান কোম্পানিজ য়্যাক্ট্, কয়েকটি বিভিন্ন কোম্পানির নিয়মাবলি বা articles, এবং অন্যবিধ কাগজপত্র। দেওয়ালে সংলগ্ন তাকের উপর কতকগুলি ধূলি-ধূসর কাগজমোড়া শিশি এবং শূন্যগর্ভ মাদুলী। একালে শ্যামবাবু পেটেণ্ট ও স্বপ্নাদ্য ঔষধের কারবার করিতেন, এগুলি তাহারই নিদর্শন।

 শ্যামবাবুর বয়স, পঞ্চাশের কাছাকাছি,—গাঢ় শ্যামবর্ণ, কাঁচা-পাকা দাড়ি,—আকণ্ঠলম্বিত কেশ, স্থূল লোমশ বপু। অল্পবয়স হইতেই তাঁহার স্বাধীন ব্যবসায়ে ঝোঁক; কিন্তু এ পর্য্যন্ত নানাপ্রকার কারবার করিয়াও বিশেষ সুবিধা করিতে পারেন নাই। ই-বি-রেলওয়ে অডিট অফিসে চাকরীই তাঁহার জীবিকা-নির্বাহের প্রধান উপায়। দেশে কিছু দেবোত্তর সম্পত্তি এবং একটি জীর্ণ কালীমন্দির আছে; কিন্তু তাহার আয় সামান্য। চাকরীর অবকাশে ব্যবসায়ের চেষ্টা করেন,— এ বিষয়ে শ্যালক বিপিনই তাঁহার প্রধান সহায়। সন্তানাদি নাই, কলিকাতার বাসায় পত্নী এবং শ্যালকসহ বাস করেন। ব্যবসায়ের কিছু উন্নতি হইলেই চাকরী ছাড়িয়া দিবেন, এইরূপ সঙ্কল্প আছে। সম্প্রতি ছয় মাসের ছুটি লইয়া, নূতন উদ্যমে ‘ব্রহ্মচারী এণ্ড ব্রাদার-ইন্‌-ল’ নামে অফিস প্রতিষ্ঠা করিয়াছেন।

 শ্যামবাবু ধর্ম্মভীরু লোক, পঞ্জিকা দেখিয়া জীবনযাত্রা নির্ব্বাহ করেন এবং অবসর-মত তান্ত্রিক সাধনা করিয়া থাকেন। বৃথা—অর্থাৎ ক্ষুধা না থাকিলে— মাংস-ভোজন, এবং অকারণে কারণ পান করেন না। কোন্ সন্ন্যাসী সোণা করিতে পারে, কাহার নিকট বামাবর্ত্ত শঙ্খ বা একমুখী রুদ্রাক্ষ আছে, কে পারদ ভস্ম করিতে জানে, এ সকল সন্ধান প্রায়ই লইয়া থাকেন। কয়েক মাস হইতে বাটীতে গৈরিক বাস পরিধান করিতেছেন এবং কতকগুলি অনুরক্ত শিষ্যও সংগ্রহ করিয়াছেন। শ্যামবাবু আজকাল মধ্যে-মধ্যে নিজেকে ‘শ্রীমৎ শ্যামানন্দ ব্রহ্মচারী’ আখ্যা দিয়া থাকেন, এবং অচিরে এই নামে সর্ব্বত্র পরিচিত হইবেন এরূপ আশা করেন।

 শ্যামবাবু তাঁহার অফিস-ঘরে প্রবেশ করিয়া, একটি সার্দ্ধ-ত্রিপাদ ইজিচেয়ারে কিছুক্ষণ বিশ্রাম করিয়া ডাকিলেন—“বাঞ্ছা, ওরে বাঞ্ছা।” বাঞ্ছা শ্যামবাবুর অফিসের বেহারা,—এতক্ষণ পাশের গলিতে টুলে বসিয়া ঢুলিতেছিল,—প্রভুর ডাকে তাড়াতাড়ি উঠিয়া আসিল। শ্যামবাবু বলিলেন, “গঙ্গাজলের বোতলটা আন্—আর খাতাপত্রগুলো একটু ঝেড়ে-মুছে রাখ্, যা ধূলো হয়েচে।” বাঞ্ছা একটা তামার কুপী আনিয়া দিল। শ্যামবাবু তাহা হইতে কিঞ্চিৎ গঙ্গোদক লইয়া মন্ত্রোচ্চারণপূর্ব্বক গৃহমধ্যে ছিটাইয়া দিলেন। তারপর টেবিলের দেরাজ হইতে একটি সিন্দুরচর্চ্চিত রবার ষ্ট্যাম্পের সাহায্যে ১০৮ বার দুর্গানাম লিখিলেন। ষ্ট্যাম্পে ১২ লাইন ‘শ্রীশ্রীদুর্গা’ খোদিত আছে; সুতরাং ৯বার ছাপিলেই কার্যোদ্ধার হয়। এই শ্রমহারক যন্ত্রটির আবিষ্কর্ত্তা শ্রীমান বিপিন। তিনি ইহার নাম দিয়াছেন—‘দি অটোম্যাটিক শ্রীদুর্গাগ্রাফ’ এবং পেটেণ্ট লইবার চেষ্টায় আছেন।

 উক্ত প্রকার নিত্যক্রিয়া সমাধা করিয়া, শ্যামবাবু প্রসন্নচিত্তে ব্যাগ হইতে ছাপাখানার একটি ভিজা প্রুফ বাহির করিয়া লইয়া সংশোধন করিতে লাগিলেন। কিছুক্ষণ পরে জুতার মশ্-মশ্ শব্দ করিতে করিতে অটলবাবু ঘরে আসিয়া বলিলেন—“এই যে শ্যাম-দা, অনেকক্ষণ এসেচেন বুঝি? বড় দেরী হয়ে গেল,—কিছু মনে করবেন না,—হাইকোর্টে একটা মোশন ছিল। ব্রাদার-ইন্-ল কোথায়?”

 শ্যামবাবু। বিপিন গেছে বাগবাজারে তিনকড়ি বাঁড়ুয্যের কাছে। আজ পাকা কথা নিয়ে আসবে। এই এল বলে।

 অটলবাবু চাপকান-চোগাধারী সদ্যোজাত এটর্নি। পিতার অফিসে সম্প্রতি জুনিয়ার পার্ট্‌নার-রূপে যোগ দিয়াছেন। গৌরবর্ণ, সুপুরুষ,—বিপিনের বাল্যবন্ধু। বয়সে নবীন হইলেও চাতুর্য্যে পরিপক্ব। জিজ্ঞাসা করিলেন—“বুড়ো রাজি হ’ল? আচ্ছা ওকে ধরলেন কি করে?”

 শ্যাম। আরে তিনকড়িবাবু হলেন গে শরতের খুড়শ্বশুর। বিপিনের মাস্তুতো ভাই শরৎ। ঐ শরতের সঙ্গে গিয়ে তিনকড়িবাবুকে ধরি। সহজে কি রাজি হয়? বুড়ো যেমন কঞ্জুষ, তেম্‌নি সন্দিগ্ধ। বলে—আমি হলুম রায়-সাহেব, রিটায়ার্ড ডেপুটি, গবরমেণ্টের কাছে কত মান। কোম্পানির ডিরেক্টর হয়ে কি শেষে পেন্‌শন্ খোয়াব? তখন নজীর দিয়ে বোঝালুম-কত রিটায়ার্ড বড় বড় অফিসার ত ডিরেক্টরি কচ্ছেন,—আপনার কিসের ভয়? শেষে যখন শুনলে যে, প্রতি মিটিংএ ৩২ টাকা ফি পাবে, তখন একটু ভিজ্‌ল।

 অটল। কত টাকার শেয়ার নেবে?

 শ্যাম। তাতে বড় হুঁসিয়ার। বলে—তোমার ব্রহ্মচারী কোম্পানি যে লুঠ করবে না, তার জামিন কে? তোমরা শালা-ভগ্নিপতি মিলে ম্যানেজিং এজেণ্ট হয়ে কোম্পানিকে ফেল করলে, আমার টাকা কোথায় থাকবে? বল্লুম—মশায়, আপনার মত বিচক্ষণ সাবধানী ডিরেক্টর থাকতে কার সাধ্য লুঠ করে। খরচপত্র ত আপনাদের চোখের সামনেই হবে। ফেল হতে দেবেন কেন? মন্দটা যেমন ভাবচেন, ভালর দিকটাও দেখুন। কি রকম লাভের ব্যবসা। খুব কম করেও যদি ৫০ পার্সেণ্ট ডিভিডেণ্ড পান, তবে দু’বছরের মধ্যেই ত আপনার ঘরের টাকা ঘরে ফিরে এল। শেষে অনেক তর্কাতর্কির পর বল্লে—আচ্ছা, আমি শেয়ার নোবো, কিন্তু বেশী নয়; ডিরেক্টর হতে হ’লে যে টাকা দেওয়া দরকার, তার বেশী দোবো না। আজ মত স্থির করে জানাবেন; তাই বিপিনকে পাঠিয়েচি।

 অটল। অমন খুঁতখুঁতে লোক নিয়ে ভাল করলেন না শ্যাম-দা। আচ্ছা, মহারাজাকে ধল্লেন না কেন?

 শ্যাম। মহারাজাকে ধরতে বড় শিকারী চাই,— তোমার আমার কর্ম্ম নয়। তা’ ছাড়া, পাঁচ ভূতে তাঁকে শুষে নিয়েচে,—কিছু আর পদার্থ রাখে নি।

 অটল। খোট্টাটা ঠিক আছে ত? আস্‌বে কখন?

 শ্যাম। সে ঠিক আছে, এই রকম দাঁও মারতেই ত সে চায়। এতক্ষণ তার আসা উচিত ছিল। প্রস্‌পেক্টস্‌টা তোমাদের শুনিয়ে আজই ছাপাতে দিতে চাই। তিনকড়িবাবুকে আসতে বলেছিলুম,—বাতে ভুগচেন, আস্‌তে পারবে না জানিয়েচেন।


রাম রাম বাবুসাহেব!

 আগন্তুক মধ্যবয়স্ক, শ্যামবর্ণ, পরিধানে সাদা ধুতি, লম্বা কাল বনাতের কোট, পায়ে বার্ণিস-করা জুতা, মাথায় পীতবর্ণ ভাঁজ-করা মল্‌মলের পাগড়ি, হাতে অনেকগুলি আংটি, কাণে পান্নার মাকড়ি, কপালে ফোঁটা।

 শ্যামবাবু বলিলেন—“আসুন, আসুন— ওরে বাঞ্ছা, আর একটা চেয়ার দে। এই ইনি হচ্চেন অটলবাবু
‘রাম রাম বাবুসাহেব’
আমাদের সলিসিটর দত্ত কোম্পানির পার্টনার। আর ইনি হলেন আমার বিশেষ বন্ধু—বাবু গণ্ডেরীরাম বাট্‌পারিয়া।”

 গণ্ডেরী। নোমোস্কার, আপনের নাম শুনা আছে, জান পহ্‌চান হয়ে বড় খুশ্ হ’ল।

 অটল। নমস্কার, এই আপনার জন্যই আমরা বসে আছি। আপনার মত লোক যখন আমাদের সহায়, তখন কোম্পানির আর ভাবনা কি?

 গণ্ডেরী। হেঁ হেঁ—সোকোলি ভগবানের হিঞ্ছা। হামি একেলা কি করতে পারি? কুছু না।

 শ্যাম। ঠিক, ঠিক। যা করেন মা তারা দীনতারিণী। দেখ অটল, গণ্ডেরীবাবু যে কেবল পাকা ব্যবসাদার, তা মনে কোরো না। ইংরিজি ভাল না জানলেও, ইনি বেশ শিক্ষিত লোক, আর শাস্ত্রেও বেশ দখল আছে।

 অটল। বাঃ, আপনার মত লোকের সঙ্গে আলাপ হওয়ায় বড় সুখী হলুম। আচ্ছা মশায়, আপনি এমন সুন্দর বাংলা বল্‌তে শিখলেন কি করে?

 গণ্ডেরী। বহুত বঙ্গালীর সঙে হামি মিলা মিশা করি। বংলা কিতাব ভি অন্‌হেক পঢ়েচি। বঙ্কিমচন্দ রবীন্দরনাথ, আউর ভি সব।

 এমন সময় বিপিনবাবু আসিয়া পৌঁছিলেন। ইনি একটু সাহেবী মেজাজের লোক,—এককালে বিলাত যাইবার চেষ্টা করিয়াছিলেন। পরিধানে সাদা প্যাণ্ট, কাল কোট, লাল নেকটাই, হাতে সবুজ ফেল্ট্ হ্যাট। উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ, ক্ষীণকায়, গোঁফের দুই প্রান্ত কামানো। শ্যামবাবু ব্যস্ত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন—“কি হল?”

 বিপিন। ডিরেক্টর হবেন বলেচেন; কিন্তু মাত্র দু’হাজার টাকার শেয়ার নেবেন। তোমাকে, অটলকে, আমাকে পরশু সকালে ভাত খাবার নিমন্ত্রণ করেচেন। এই নাও চিঠি।

 অটল। তিনকড়িবাবু হঠাৎ এত সদয় যে?

 শ্যাম। বুঝলুম না। বোধ হয় ফেলো ডিরেক্টরদের একবার বাজিয়ে যাচাই করে নিতে চান।

 অটল। যাক্, এবার কাজ আরম্ভ করুন। আমি মেমোরাণ্ডম্ আর আর্টিকেল্‌সের মুসবিদা এনেচি। শ্যাম-দা প্রস পেক্টস টা কি রকম লিখলেন পড়ুন।

 শ্যাম। হাঁ, সকলে মন দিয়ে শোনো। কিছু বদলাতে হয় ত এই বেলা। দুর্গা—দুর্গা—

জয় সিদ্ধিদাতা গণেশ।

১৯১৩ সালের ৭ আইন অনুসারে রেজিষ্টৃত।

শ্রীশ্রীসিদ্ধেশ্বরী লিমিটেড।

 মুলধন—দশ লক্ষ টাকা, ১০৲ হিসাবে ১০০,০০০ অংশে বিভক্ত। আবেদনের সঙ্গে অংশ-পিছু ২৲ প্রদেয়। বাকী টাকা ৪ কিস্তিতে তিন মাসের নোটিসে প্রয়োজন-মত দিতে হইবে।

অনুষ্ঠান-পত্র

 ধর্মই হিন্দুগণের প্রাণস্বরূপ। ধর্মকে বাদ দিয়া এ জাতির কোন কর্ম্ম সম্পন্ন হয় না। অনেকে বলেন— ধর্ম্মের ফল পরলোকে লভ্য। ইহা আংশিক সত্য মাত্র। বস্তুতঃ ধর্ম্মবৃত্তির উপযুক্ত প্রয়োগে ইহলৌকিক ও পারলৌকিক উভযবিধ উপকার হইতে পারে। এতদর্থে সদ্য সদ্য চতুর্ব্বর্গ লাভের উপায়- স্বরূপ এই বিরাট্ ব্যাপারে দেশবাসীকে আহ্বান করা হইতেছে।

 ভারতবর্ষের বিখ্যাত দেবমন্দিরগুলির কিরূপ বিপুল আয়, তাহা সাধারণে জ্ঞাত নহেন। রিপোর্ট হইতে জান গিয়াছে যে, বঙ্গদেশের একটি দেবমন্দিরের দৈনিক যাত্রীসংখ্যা গড়ে ১৫ হাজার। যদি লোক-পিছু চারআনা মাত্র আয় ধরা যায়, তাহা হইলে বাৎসরিক আয় প্রায় সাড়ে তের লক্ষ টাকা ঠড়ায়। খরচ যতই হউক, যথেষ্ট টাকা উদ্বৃত্ত থাকে। কিন্তু সাধারণে এই লাভের অংশ হইতে বঞ্চিত।

 দেশের এই মহৎ অভাব দুরীকরণার্থ “শ্রীশ্রী সিদ্ধেশ্বরী লিমিটেড” নামে একটি জয়েণ্ট ষ্টক কোম্পানি স্থাপিত হইতেছে। ধর্ম্মপ্রাণ শেয়ার-হোল্ডার-গণের অর্থে একটি মহা তীর্ঘক্ষেত্রের প্রতিষ্ঠা হইবে, এবং জাগ্রত দেখী সম্বিত বৃহৎ মন্দির নির্ম্মিত হইবে। উপযুক্ত ম্যানেজিং এজেণ্টের হস্তে কার্য্য-নির্ব্বাহের ভার ন্যস্ত হইয়াছে। কোনো প্রকার অপবায়ের সম্ভাবনা নাই। শেয়ার-হোল্ডারগণ আশাতীত দক্ষিণা বা ডিভিডেণ্ড পাইবেন এবং একাধারে ধর্ম্ম, অর্থ, মোক্ষ লাভ করিয়া ধন্য হইবেন।

 ডিরেক্টরগণ।—(১) অবসরপ্রাপ্ত প্রবীণ বিচক্ষণ ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট রায় সাহেব শ্রীযুক্ত তিনকড়ি বন্দ্যোপাধ্যায়। (২) বিখ্যাত ব্যবসাদার ও ক্রৌরপতি শ্রীযুক্ত গণ্ডেরীরাম বাট্‌পারিয়া। (৩) সলিসিটল দত্ত এণ্ড কোম্পানির অংশীদার শ্রীযুক্ত অটলবিহারী দত্ত, M.A., B.L. (৪) বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক মিস্টার বি, সি চৌধুরী, B. Sc., A. S. S. (U.S.A) (৫) কালী-পদাশ্রিত সাধক ব্রহ্মচারী শ্রীমৎ শ্যামানন্দ (ex-officio)।

 অটলবাবু বাধা দিয়া বলিলেন—“বিপিন আবার নূতন টাইটেল পেলে কবে?”

 শ্যাম। আরে বল কেন। পঞ্চাশ টাকা খরচ করে আমেরিকা না কামস্কাট্‌কা কোত্থেকে তিনটে হরফ আনিয়েচে।

 বিপিন। বা, আমার কোয়ালিফিকেশন না জেনেই বুঝি তারা শুধু শুধু একটা ডিগ্রি দিলে? ডিরেক্টর হতে গেলে একটা পদবী থাকা ভাল নয়?

 গণ্ডেরী। ঠিক বাত। ভেক বিনা ভিখ মিলে না। শ্যামবাবু, অপ্‌নিও এখন্‌সে ধোতি উতি ছোড়ে লঙোটি পিন্‌হুন।

 শ্যাম। আমি ত আর নাগা সন্ন্যাসী নই। আমি হলুম শক্তিমন্ত্রের সাধক,— পরিধেয় হল রক্তাম্বর। বাড়ীতে ত গৈরিকই ধারণ করি। তবে অফিসে প'রে আসি না; কারণ, ব্যাটারা সব হা ঁকরে চেয়ে থাকে। আর একটু লোকের চোখ-সহা হয়ে গেলে, সর্ব্বদাই গৈরিক পর্‌ব। যাক্, পড়ি শোনো—

মেসার্স ব্রহ্মচারী এণ্ড ব্রাদার-ইন্-ল এই কোম্পানির ম্যানেজিং এজেন্সি লইতে স্বীকৃত হইয়াছেন—ইহা পরম সৌভাগ্যের বিষয় তাঁহারা লাভের উপর শতকরা দুই টাকা মাত্র কমিশন লইবেন, এবং যতদিন না—

 অটলাবু বলিলেন—“কমিশনের রেট অত কম ধরলেন কেন? দশ পার্সেণ্ট অনায়াসে ফেলতে পারেন।”

 গণ্ডেরী। কুছু দরকার নেই। শ্যামবাবুর পর্‌বস্তি অপ্‌নেসে হোয়ে যাবে। কমিশনের ইরাদা থোড়াই করেন।

 এবং যতদিন না কমিশনে মাসিক ১০০০ টাকা পোষায়, ততদিন শেষোক্ত টাকা এলাউন্স রূপে পাইবেন।

 গণ্ডেরী! শুনেন, অটলবাবু, শুনেন। আপনি শ্যামবাবুকে কি শিখ্লাবেন?

 হুগলী জেলার অন্তঃপাতী গোবিন্দপুর গ্রামে ৺সিদ্ধেশ্বরী দেবী বহু শতাব্দী যাবৎ প্রতিষ্ঠিতা আছেন। দেবীমন্দির ও তৎসংলগ্ন দেবোত্তর সম্পত্তির স্বত্বাধিকারিণী শ্রীমতী নিস্তারিণী দেবী সম্প্রতি স্বপ্নাদেশ পাইয়াছেন যে, উক্ত গোবিন্দপুর গ্রামে অধুনা সর্ব্বপীঠের সমন্বয় হইয়াছে এবং মাতা তাঁহার মাহাত্ম্যের উপযোগী সুবৃহৎ মন্দিরে বাস করিতে ইচ্ছা করেন। শ্রীমতী নিস্তারিণী দেবী অবলা বিধায়, এবং উক্ত দৈবাদেশ স্বয়ং পালন করিতে অপারগা বিধায়, উক্ত দেবোত্তর সম্পত্তি মায় মন্দির, বিগ্রহ, জমি, আওলাত আদি এই লিমিটেড কোম্পানিকে সমর্পণ করিতেছেন।

 অটল। নিস্তারিণী দেবী আবার কোত্থেকে এলেন? সম্পত্তি ত আপনার বলেই জান্‌তুম।

 শ্যাম। উনি আমার স্ত্রী। সেদিন তাঁর নামেই সব লেখাপড়া করে দিয়েচি। আমি আর এ সব বৈষয়িক ব্যাপারে লিপ্ত থাকতে চাই না।

 গণ্ডেরী। ভাল বন্দ্‌বস্ত্‌ কিয়েচেন। অপনেকো কোই দুস্‌বে না। নিস্তার্নী দেবীকো কোন্‌ পহ্‌চানে। দাম কেতো লিচ্চেন?

 অতঃপর তীর্থ-প্রতিষ্ঠা, মন্দির-নির্মাণ. দেবসেবাদি কোম্পানি কর্ত্তৃক সম্পন্ন হইবে; এবং এতদর্থে কোম্পানি মাত্র ১৫,০০০৲ টাকা পণে সমস্ত সম্পত্তি খরিদার্থে বয়ান করিয়াছেন।

 গণ্ডেরী। হদ্দ্‌ কিয়া শ্যামবাবু। জঙ্গল কি ভিতর পুরানা মন্দিল, উস্‌মে দো চার শোও ছুছুন্দর, ছটাক ভর জমীন, উস্‌পর দোঁ—চার বাঁশ ঝাড়,— বস্‌, ইসিকা দাম পন্দ্র হাজার!

 শ্যাম। কেন, অন্যায়টা কি হল? স্বপ্নাদেশ, একান্ন পীঠ এক ঠাঁই, জাগ্রত দেবী,—এ সব বুঝি কিছু নয়? গুড্‌-উইল হিসেবে পনর হাজার টাকা খুবই কম।

 গণ্ডেরী। অচ্ছা। যদি কোই শেয়ার—হোল্ডার হাইকোট মে দরখাস্ত্‌ পেশ করে—সপন উপন জব ঝুট্‌, ছকলায়কে রুপেয়া লিয়া,—তব্‌?

 অটল। সে একটা কথা বটে, কিন্তু এ সব আধিদৈবিক ব্যাপার বোধ হয় অরিজিনেল সাইডের জুরিসুডিক্‌শনে পড়ে না। আইন বলে— caveat emptor অর্থাৎ ক্রেতা, সাবধান! সম্পত্তি কেনবার সময় যাচাই করনি কেন? যা হোক একবার expert opinion নোবো।

 শীঘ্রই নূতন দেবালয় আরম্ভ হইবে। তৎসংলগ্ন প্রশস্ত নাটমন্দির, নহবৎখানা, ভোগশালা, ভাণ্ডার প্রভৃতি আনুষঙ্গিক গৃহাদিও থাকিবে। আপাততঃ দশ হাজার যাত্রীর উপযোগী অতিথিশালা নির্ম্মিত হইবে। শেয়ার হোল্ডারগণ বিনা খরচায় সেখানে সপরিবারে বাস করিতে পারিবেন। হাট, বাজার, যাত্রা, থিয়েটার, বায়োস্কোপ ও অন্যান্য আমোদ-প্রমোদের আয়োজন যথেষ্ট থাকিবে। যাহারা দৈবাদেশ বা ঔষধপ্রাপ্তির জন্য হত্যা দিবেন, তাঁহাদের জন্য বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থা থাকিবে। মোট কথা, তীর্থযাত্রী আকর্ষণ করিবার সর্ব্বপ্রকার উপায়ই অবলম্বিত হইবে। স্বয়ং শ্রীমৎ শ্যামানন্দ ব্রহ্মচারী ৺সেবার ভার লইবেন।

 যাত্রিগণের নিকট হইতে যে দর্শনী ও প্রণামী আদায় হইবে, তাহা ভিন্ন আরও নানা উপায়ে অর্থাগম হইবে। দোকান, হাট, বাজার, অতিথিশীলা, মহাপ্রসাদ বিক্রয়, প্রভৃতি হইতে প্রচুর আয় হইবে। এতদ্‌ভিন্ন by-product recovery-র ব্যবস্থা খাকিবে। ৺সেবার ফুল হইতে সুগন্ধি তৈল প্রস্তুত হইবে, এবং প্রসাদী বিল্বপত্র মাদুলীতে ভরিয়া বিক্রীত হইবে। চরণামৃতও বোতলে প্যাঁক করা হইবে। বলির জন্য নিহত ছাগসমূহের চর্ম্ম ট্যান করিয়া উৎকৃষ্ট কিড-স্কিন্‌ প্রস্তুত হইবে এবং বহুমূল্যে বিলাতে চালান যাইবে। হাড় হইতে বোতাম হইবে। কিছুই ফেলা যাইবে না।

 গণ্ডেরী। বকড়ি মারবেন? হামি ইস্‌মে নেহি, রামজি কিরিয়া। হামার নাম কাটিয়ে দিন।

 শ্যাম। আপনি ত আর নিজে বলি দিচ্চেন না। আচ্ছা, না হয় কুম্‌ড়ো-বলির ব্যবস্থা করা যাবে।

 অটল। কুমড়োর চামড়া ত ট্যান হবে না। আয় কমে যাবে। কিহে বৈজ্ঞানিক, কুমড়োর খোসার একটা গতি করতে পার?

 বিপিন। কষ্টিক পটাশ দিয়ে বয়েল কল্লে বোধ হয় ভেজিটেব্‌ল্‌ শু হ’তে পারে। এক্সপেরিমেণ্ট করে দেখ্‌ব।

 গণ্ডেরী। যো খুশী করে। হামার কি আছে। হামি থোড়া রোজ বাদ অপ্‌না শেয়ার বিলকুল বেচে দিব।

 হিসাব করিয়া দেখা হইয়াছে যে, কোম্পানির লাভ বাৎসরিক অন্ততঃ ১২ লক্ষ টাকা হইবে; এবং অনায়াসে ১০০ পার্সেণ্ট ডিভিডেণ্ড দেওয়া যাইবে। ৩০ হাজার শেয়ারের আবেদন পাইলেই allotment হইবে। সত্বর শেয়ারের জন্য আবেদন করুন। নইলে এই স্বর্ণ-সুযোগ হইতে বঞ্চিত হইবেন।

 গণ্ডেরী। লিখে লিন—ঢাঁই লাখ টাকার শেয়ার বিক্রি হয়ে গেছে। হামি এক লাখ লিব, বাকী দেড় লাখ শ্যামবাবু, বিপিনবাবু, অটলবাবু সমান হিসসা লিবেন।

 শ্যাম। পাগল আর কি। আমি আর বিপিন কোথা থেকে পঞ্চাশ-পঞ্চাশ হাজার বার করব? আপনারা না-হয় বড় লোক আছেন।

 গগুেরী। হামি শালা রুপেয়া ডালবো আর তুমি লোগ্ মৌজ করবে? সো হোবে না। সব্‌কো ঝোঁখি লেনা পড়েগা। শ্যামবাবু মতলব সমঝলেন না? টাকা কোই দিব না। সবু হাওলাতি থাকবে। মানেজিং এজিণ্ট মহাজন হোবে।

 অটল। বুঝলেন শ্যাম-দা? আমরা সকলে যেন ম্যানেজিং এজেণ্টস্‌দের কাছ থেকে কর্জ্জ করে নিজের নিজের শেয়ারের টাকা কোম্পানিকে দিচ্চি; আবার কোম্পানি ঐ টাকা ম্যানেজিং এজেণ্টসের কাছে গচ্ছিত রাখচে। গাঁট থেকে এক পয়সাও কেউ দিচ্ছেন না, টাকাটা কেবল খাতাপত্রেই জমা থাকবে।

 শ্যাম। তারপর তাল সামলাবে কে? কোম্পানি ফেল হ'লে আমি মারা যাই আর কি! বাকী কলের টাকা দোবো কোথা থেকে?

 গণ্ডেরী। ডরেন কেনো? শেয়ার পিছ্ তো অভি দো টাকা দিতে হবে। ঢাই লাখ টাকার শেয়ারে স্রিফ্ পঁচাশ হাজার দেনা হোয়। প্রিমিয়ম্ মে সব্ বেচে দিব—সুবিস্তা হোয় ত, আউর ভি শেয়ার ধরে রাখবো। বহুত মুনাফা মিল্‌বে। চিম্‌ড়িমল্ ব্রোকারসে হামি বন্দোবস্ত কিয়েছি। দো চার দফে হম্ লোগ অপ্‌না অপ্‌নি
‘ঐসী গতি সন্‌সারমে’
শেয়ার লেকে খেল্‌বো, হাঁথ বদ্‌লাবো, দাম চঢ়বে০, বাজার গরম হোবে। তখন সব্‌ কোই শেয়ার মাংবে, দাম কা বিচার করবে না। কবীরজি কি বচন শুনিয়ে—

ঐসী গতি সন্‌সারমে যো গাড়র কি ঠাট।
এক পড়া যব্ গাড়মে সবৈ যাত তেহি বাট॥

মানি হচ্ছে—সন্‌সারের লোক সব্ যেন ভেড়ার পাল। এক ভেড়া যদি খাদ্দেমে গির্ পড়ে তো সব্ কোই উসিমে ঘুসে।

 শ্যামবাবু দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়িয়া বলিলেন—“তারা ব্রহ্মময়ি, তুমিই জান। আমি ত নিমিত্ত মাত্র। তোমার কাজ তুমিই উদ্ধার ক’রে দাও মা—অধম সন্তানকে যেন মের না।”

 গণ্ডেরী। শ্যামবাবু, মন্দিল উন্দিল কা কোম্পনি যো কর্‌ণা হ্যায় কিজিয়ে। উস্‌কি সাথ ঘই-এর কারবার ভি লাগায় দিন। টাকায় টাকা লাভ।

 অটল। ঘই কি চিজ্?

 গণ্ডেরী। ঘই জানেন না? ঘিউ হোচ্ছে অস্‌লি চিজ,—যো গায় ভইস বকড়িকা দুধসে বনে। আউর নক্‌লি যো হ্যায় সো ঘই কহ্‌লাতা চর্ব্বি, চীনাবাদাম তেল ওগায়রহ মিল কর্ বনায়া যাতা। পর্ সাল হামি ঘই-এর কামে পচিশ হাজার লাগাই, সাঢ়ে চৌত্রিশ হাজার মুনাফা মিলে।

 অটল। উঃ বিস্তর সাপ মেরেছিলেন বলুন!

 গণ্ডেরী। আরে সাঁপ কাঁহাসে মিল্‌বে? উ সব ঝুট বাত।

 অটল। আচ্ছা গণ্ডারজি—

 গণ্ডেরী। গণ্ডার নেহি, গণ্ডেরী।

 অটল। হাঁ হাঁ, গণ্ডেরীজি। বেগ্‌ ইওর পার্ডন। আচ্ছা, আপনি ত নিরামিষ খান, ফোঁটা কাটেন, ভজনপূজনও করেন।

 গণ্ডেরী। কেনো করবো না? হামি হর্ রোজ গীতা আউর রাম-চরিত-মানস পঢ়ি, রাম-ভজনভি করি।

 অটল। তবে অমন পাপের ব্যবসাটা করলেন কি বলে? .  গণ্ডেরী। পাঁপ? হামার কেনো পাঁপ হোবে? বেব‍্সা ত করে কাসেম আলি। হামি রহি কলকত্তা, ঘই বনে হাথরস‍্মে! হামি ন আঁখ‍্সে দেখি—ন নাকসে শুংখি—হলুমানজি কিরিয়া। হামি ত স্রিফ্ মহাজন আছি—রুপেয়া দে কর্ খালাস। সুদ লি, মুনাফার আধা হিস্সা ভি লি। যদি হামি টাকা না দি, কাসেম আলি দুসরা ধনিসে লিবে। পাঁপ হোবে ত শালা কাসেম আলিকা হোবে। হামার কি? যদি ফিন্ কুছ দোষ লাগে,—জানে রণ‍্ছোড়জি—হামার গ‍ুণ‍্ভি থোড়া বহুত জমা আছে। একাদ‍্সি, শিউরাত, রামনওমীমে উপবাস, দান-খয়রাত ভি কুছু করি। আট আটঠো ধরমশালা বানোআয়া,—লিলুয়ামে, বালিমে, শেওড়াফুলিমে—

 অটল। লিলুয়ার ধর্ম্মশালা ত আসর্ফিলাল ঠুনঠুনওয়ালা করেচে।

 গণ্ডেরী। কিয়েছে ত কি হইয়েছে। সভিত ওহি কিয়েছে। লেকিন্ বানিয়ে দিয়েছে কোন্? তদারক কোন্ কিয়েছে? ঠিকাদার কোন লাগিয়েছে? সব হামি। আসর্ফি হামার চাচেরা ভাই লাগে। হামি সলাহ্, দিয়েছি তব না রুপেয়া খরচ কিয়েছে।

 অটল। মন্দ নয়,—টাকা ঢাললে আসর্ফি, পুণ্য হ’ল গণ্ডেরীর।

 গণ্ডেরী। কেনো হোবে না? দো দো লাখ রুপেয়া হর্ জগেমে খরচ কিয়া। জোড়িয়ে ত কেত‍্না হোয়। উস্ পর কম্‌সে কম্ সয়কড়া পাঁচ রুপেয়া দস্তুরী ত হিসাব কিজিয়ে। হাম্ ত বিলকুল ছোড় দিয়া। আসর্ফিলালক। পুণ্ যদি সোলহ্ লাখকা হোয়, মেরাভি অস্সি হজার মোতাবেক হোনা চাহ‍্তা।

 অটল। চমৎকার ব্যবস্থা! পুণ্যেরও দেখচি দালালী পাওয়া যায়। আমাদের শ্যাম-দা গণ্ডেরী-দা যেন মাণিকজোড়।

 গণ্ডেরী। অটলবাবু, আপ‍্নি দো চার কিতাব পঢ়িয়ে হামাকে ধরম কি শিখ‍্লাবেন? বঙ্গালি ধরম জানে না। কিস রুপেয়ার নোকরি করবে, পাঁচ পইসার হরিলুঠ দিবে। হামার জাত রুপেয়া ভি কামায় হিসাব‍্সে, পুণ্ ভি করে হিসাব‍্সে। অপ‍্নেদের রবীন্দরনাথ কি লিখচেন—

বৈরাগ্ সাধন মুক্তি সো হমার নেহি।

হামি এখন চল্‌তি, বেস খেল্‌নে। কোণ্ট্রি গেরিল ঘোড়ে পর্ আজ দো চারশও লাগাওয়েঙ্গে।

 অটল। আমিও উঠি শ্যাম-দা। আর্টিকেলের মুসবিদ রেখে যাচ্ছি, দেখে রাখবেন। প্রস‍্পেক্টস্ ত দিব্বি হয়েচে। একটু-আধটু বদলে দেবো এখন। পরশু আবার দেখা হবে। নমস্কার!


বাগবাজারে গলির ভিতর রায়-সাহেব তিনকড়িবাবুর বাড়ী। নীচের তলায় রাস্তার সম্মুখে নাতিবৃহৎ বৈঠকখানা ঘরে গৃহকর্ত্তা বং নিমন্ত্রিতগণ গল্পে নিরত; —অন্দর হইতে কখন্ ভোজনের ডাক আসিবে, তাহারই প্রতীক্ষা করিতেছেন। আজ রবিবার তাড়া নাই, বেলা অনেক হইয়াছে।

 তিনকড়িবাবুর বয়স ষাট বৎসর, ক্ষীণ দেহ, দাড়ি কামানো। শীর্ণ গোঁফে তামাকের ধোঁয়ায় পাকা খেজুরের রং ধরিয়াছে,—কথা কহিবার সময় আরসোলার দাড়ার মত নড়ে। তিনি দৈব-ব্যাপারে বড়-একটা বিশ্বাস করেন না। প্রথম পরিচয়ে শ্যামবাবুকে বুজরুক সাব্যস্ত করিয়াছিলেন, কেবল লাভের কোম্পানিতে যোগ দিয়াছেন। কিন্তু আজ কালীঘাট হইতে প্রত্যাগত সদ্যঃ স্নাত শ্যামবাবুর অভিনব মুর্ত্তি দেখিয়া কিঞ্চিৎ আকৃষ্ট হইয়াছেন। শ্যামবাবুর পরিধানে লাল চেলী, গেরুয়া রংএর আলোয়ান, পায়ে বাঘের চামড়ার শিং-তোলা জুতা। দাড়ি এবং চুল সাজিমাটি দ্বারা যথাসম্ভব ফাঁপানো্, এবং কপালে মস্ত একটি সিন্দুরের ফোঁটা।

 তিনকড়িবাবু তামাক-টানার অন্তরালে বলিতেছিলেন—“দেখুন স্বামিজি, হিসেবই হল ব্যবসার সব। ডেবিট ক্রেডিট যদি ঠিক থাকে, আর ব্যালান্স যদি মেলে, তবে সে বিজ‍্নেসের কোনো ভয় নেই।”

 শ্যামবাবু। আজ্ঞে, বড় যথার্থ কথা বলেচেন। সে জন্যই তা আমরা আপনাকে চাই। আপনাকে আমরা মধ্যে মধ্যে এসে বিরক্ত করব, হিসেব সম্বন্ধে পরামর্শ নোবো—

 তিনকড়ি। বিলক্ষণ, বিরক্ত হব কেন। আমি সমস্ত accounts ঠিক করে দোবো। মিটিংগুলো একটু ঘন ঘন করবেন। না হয় ডিরেক্টর‍্স্ ফি বাবদ কিছু বেশী খরচ হবে। দেখুন, অডিটার ফডিটার আমি বুঝি না। আরে বাপু, নিজের জমা-খরচ যদি নিজে না বুঝলি, তবে বাইরের একটা অর্ব্বাচীন ছোকরা এসে তার কি বুঝবে? ভারি আজকাল সব বুক-কিপিং শিখেছেন। সে কি জানেন,—একটা গোলকধাঁধাঁ, কেউ যাতে না বোঝে তারই চেষ্টা। আমি বুঝি— রোজ কত টাকা এল, কত খরচ হল, আর আমার মজুদ রইল কত। আমি যখন আমড়াগাছি সবডিভিশনের ট্রেজারির চার্জে, তখন এক নতুন কলেজে-পাশ গোঁফ-কামানো ডেপুটি এলেন আমার কাছে কাজ শিখতে। সে ছোকরা কিছুই বোঝে না, অথচ অহঙ্কারে আমার কাজে গলদ ধরবার আম্পর্দ্ধা। শেষে ভরা। লিখলম কোল্ডহ্যাম সাহেবকে, যে হুজুর, তোমরা রাজার, জাত, দু’ঘা দাও তাও সহ্য হয়, কিন্তু দিশি ব্যাঙাচির লাথি বরদাস্ত করব না। তখন সাহেব 'নিজে এসে, সমস্ত বুঝে নিয়ে, আড়ালে ছোকরাকে ধমকালেন। আমাকে পিঠ চাপড়ে হেঁসে বল্লেন—ওয়েল তিনকড়িবাবু, তুমি হলে কত কালের সিনিয়র অফিসর, একজন ইয়ং চ্যাপ তোমার কদর কি বুঝবে? তারপর দিলেন আমাকে নওগাঁয়ে গাঁজা-গোলার চার্জে বদলী করে। যাক্ সে কথা। দেখুন, আমি বড় কড়া লোক। জবরদস্ত হাকিম বলে আমার নাম ছিল। মন্দির-টন্দির আমি বুঝি না,—কিন্তু একটি আধলাও কেউ আমাকে ফাঁকি দিতে পারবে না। রক্ত-জল-করা টাকা আপনার জিম্মায় দিচ্ছি, দেখবেন যেন—

 শ্যাম। সে কি কথা! আপনার টাকা আপনারই থাকবে, আর শতগুণ বাড়বে। এই দেখুন না—আমি আমার যথাসর্ব্বস্ব পৈত্রিক পঞ্চাশ হাজার টাকা এতে ফেলেচি। আমি না হয় সর্ববত্যাগী সন্ন্যাসী,—অর্থে প্রয়োজন নেই, —লাভ যা হবে মায়ের সেবাতেই ব্যয় করব। বিপিন, আর এই অটল ভায়াও প্রত্যেকে পঞ্চাশ হাজার ফেলেচেন। গণ্ডেরী এক লাখ টাকার শেয়ার নিয়েচে। সে মহা হিসেবী লোক, —লাভ নিশ্চিত না জান‍্লে কি নিত?

 তিনকড়ি। বটে, বটে? শুনে আশ্বাস হচ্চে। আচ্ছা, একবার কোল্ডহ্যাম সাহেবকে কনসল্ট্ করলে হয় না? অমন সাহেব আর হয় না।

 “ঠাঁই হয়েচে”—চাকর আসিয়া খবর দিল।

 “উঠতে আজ্ঞা হোক ব্রহ্মচারী মশায়, আসুন অটলবাবু, চলহে বিপিন।” তিনকড়িবাবু সকলকে অন্দরের বারান্দায় আনিলেন।

 শ্যামবাবু বলিলেন —“ক’রছেন কি রায় সাহেব, এযে রাজসূয় যজ্ঞ। কই, আপনি বস‍্লেন না?”

 তিনকড়ি। বাতে ভুগ‍্চি, ভাত খাইনে, দুখান সুজির রুটি বরাদ্দ।

 শ্যাম। আমি একটি ফেৎকারিণী তন্ত্রোক্ত কবচ পাঠিয়ে দোবো, ধারণ করে দেখবেন। শাক-ভাজা, কড়াইএর ডাল—এটা কি দিয়েছ ঠাকুর, এঁচোড়ের ঘণ্ট? বেশ, বেশ। শোধন করে নিতে হবে। সুপক্ক কদলী আর গবাঘৃত বাড়াতে হবে কি? আয়ুর্ব্বেদে আছে—পনসে কদলং কদলে ঘৃতং। কদলী ভক্ষণে পনসের দোষ নষ্ট হয়, আবার ঘৃতের দ্বারা কদলীর শৈত্যগুণ দূর হয়। পুঁটিমাছ—ভাজা,—বাঃ। রোহিতাদপি, রোচকাঃ, পুণ্টিকা: সদ্যভজ্জিতাঃ ওটা কিসের অম্বল বল্লে,—কামরাঙা? সর্বনাশ, তুলে নিয়ে যাও। গত বৎসর শ্রীক্ষেত্রে গিয়ে ঐ ফলটি জগন্নাথ প্রভুকে, দান করেচি। অম্বল জিনিষটা আমার সয়ও না, — শ্লেষ্মার ধাত কি না। উস‍্প, উস‍্প, উস‍্প। প্রাণায় অপানায় সোপানায় স্বাহা। শয়নে পদ্মনাভঞ্চ ভোজনেতু জনার্দ্দনঃ। আরম্ভ কর হে অটল।

 অটল। (জনান্তিকে) আরম্ভের ব্যবস্থা যা দেখচি, তাতে বাড়ী গিয়ে ক্ষুন্নিবৃত্তি করতে হবে।

 তিনকড়ি। আচ্ছা ঠাকুর-মশায়, আপনাদের তন্ত্রশাস্ত্রে এমন কোনো প্রক্রিয়া নেই, যার দ্বারা লোকের —ইয়ে—মানমর্য্যাদা বৃদ্ধি পেতে পারে?

 শ্যাম। অবশ্য আছে! যথা কুলার্ণবে— অমানিনাং মানদেন। অর্থাৎ কুলকুণ্ডলিনী জাগ্রতা হলে অমানী ব্যক্তিকেও মান দেন। কেন বলুন ত?

 তিনকড়ি। হাঃ হাঃ, সে একটা তুচ্ছ কথা। কি জানেন, কোল্ডহ্যাম সাহেব বলেছিলেন, সুবিধা পেলেই লাট সাহেবকে ধরে আমায় বড় খেতাব দেওয়াবেন। বারবার ত রিমাইণ্ড করা ভাল দেখায় না, তাই ভাবছিলুম, যদি তন্ত্রে-মন্ত্রে কিছু হয়। মানিনে যদিও, তবু—

 শ্যাম। মানতেই হবে। শাস্ত্র মিথ্যা হতে পারে না। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, এ বিষয়ে আমার সমস্ত সাধনা নিয়োজিত করব। তবে সদ‍্গুরু প্রয়োজন, দীক্ষা ভিন্ন এ সব কাজ হয় না। গুরুও আবার যে সে হলে চলবে না। খরচ—তা আমি যথাসম্ভব অল্পেই নির্ব্বাহ করতে পারব।

 তিনকড়ি। হুঁ। দেখা যাবে এখন। আচ্ছা, আপনাদের অফিসে ত বিস্তর লোকজন দরকার হবে, তা—আমার একটি শালীপো আছে, তার একটা হিল্লে লাগিয়ে দিতে পারেন না? বেকার বসে-বসে আমার অন্ন ধ্বংস করচে,—লেখাপড়া শিখলে না,—কুসঙ্গে মিশে বিগ‍্ড়ে গেছে। একটা চাকরী জুটলে বড় ভাল হয়। ছোকরা বেশ চটপটে আর স্বভাব-চরিত্রও বড় ভাল।

 শ্যাম। আপনার শালীপো? কিছু বলতে হবে না। আমি তাকে মন্দিরের হেড পাণ্ডা করে দোবো। এখনি গোটা-পনর দরখাস্ত এসেছে— তার মধ্যে পাঁচজন গ্রাজুয়েট। তা আপনার আত্মীয়ের ক্লেম সবার ওপর।

 তিনকড়ি। আর একটি অনুরোধ। আমার বাড়ীতে একটি পুরানো কাঁসর আছে,—একটু ফেটে গেছে, কিন্তু আদত খাঁটি কাঁসা। এ জিনিসটা মন্দিরের কাজে লাগানো যায় না? সস্তায় দোবো।

 শ্যাম। নিশ্চয়ই নেবো। ওসব সেকেলে জিনিষ কি এখন সহজে মেলে?

* * * *

ণ্ডেরীর ভবিষ্যদ‍্বাণী সফল হইয়াছে। বিজ্ঞাপনের জোরে এবং প্রতিষ্ঠাতৃগণের চেষ্টায় সমস্ত শেয়ারই বিলি হুইয়া গিয়াছে। লোকে শেয়ার লইবার জন্য অস্থির, বাজারে চড়া দামে বেচা-কেনা হইতেছে।

 অটলবাবু বলিলেন—“আর কেন শ্যাম-দা, এইবার নিজের শেয়ার সব ঝেড়ে দেওয়া যাক। গণ্ডেরী ত খুব একচোট মারলে। আজকে ডবল দর। দুদিন পরে কেউ ছোঁবেও না।”

 শ্যাম। বেচতে হয় বেচ, মোদ্দা কিছু ত হাতে রাখতেই হবে, নইলে ডিরেক্টর হবে কি করে?

 অটল। ডিরেক্টরি আপনি করুন গে। আমি আর হাঙ্গামায় থাকতে চাইনে। সিদ্ধেশ্বরীর কৃপায় আপনার ত কার্য্যসিদ্ধি হয়েচে।

 শ্যাম। এই ত সবে আরম্ভ। মন্দির, ঘরদোর, হাট-বাজার সবই ত বাকী। তোমাকে কি এখন ছাড়া যায়!

 অটল। থেকে আমার লাভ? পেটে খেলে পিঠে সয়। এখন ত ব্রাদার-ইন্‌-ল কোম্পানির মরশুম চল্ল। আমাদের এইখানেই শেষ।

 শ্যাম। আরে ব্যস্ত হও কেন, এক যাত্রায় কি পৃথক
‘আ—আ—আমি জান্‌তে চাই’

ফল হয়? সন্ধ্যেবেলা যাব এখন তোমাদের বাড়ীতে, —গণ্ডেরীকেও নিয়ে যাব।

* * * *

 দেড় বৎসর কাটিয়া গিয়াছে। ব্রহ্মচারী এণ্ড ব্রাদার-ইন্‌-ল কোম্পানির অফিসে ডিরেক্টরগণের সভা বসিয়াছে।

 সভাপতি তিনকড়িবাবু টেবিলে ঘুসি মারিয়া বলিতেছিলেন—“আ—আ—আমি জান্‌তে চাই, টাকা সব গেল কোথা। আমার ত বাড়ীতেই টেকা ভার,—সবাই এসে তাড়া দিচ্চে। কয়লাগুলা বলে তার পঁচিশ হাজার টাকা পাওনা,—ইঁটখোলার ঠিকাদার বলে বারো হাজার,—তারপর ছাপাখানাওলা, শার্পার কোম্পানি, কুণ্ডু মুখুয্যে, আরো কত কে আছে। বলে আদালতে যাব। মন্দিরের কোথা কি তার ঠিক নেই—এর মধ্যে দু’লাখ টাকা ফুঁকে গেল? সে ভণ্ড জোচ্চোরটা গেল কোথা? শুন‍্তে পাই ডুব মেরে আছে, অফিসে বড় একটা আসে না।

 অটল। ব্রহ্মচারী বলেন, মা তাঁকে অন্য কাজে ডাকচেন, —এদিকে আর তেমন মন নেই। আজ ত মিটিংএ আসবেন বলেচেন।

 বিপিন বলিলেন—“ব্যস্ত হচ্ছেন কেন সার, এই ত ফর্দ্দ রয়েচে, দেখুন না— জমি কেনা, শেয়ারের দালালী, preliminary expense, ইঁট-তৈরি, establishment, বিজ্ঞাপন, অফিস-খরচ—

 তিনকড়ি। চোপরও ছোকরা। চোরের সাক্ষী গাঁটকাটা।

 এমন সময় শ্যামবাবু আসিয়া উপস্থিত হইলেন। বলিলেন—“ব্যাপার কি?”

 তিনকড়ি। ব্যাপার আমার মাথা। আমি হিসেক চাই।

 শ্যাম। বেশ ত, দেখুন না হিসেব। বরঞ্চ একদিন গোবিন্দপুরে নিজে গিয়ে কাজকর্ম্ম তদারক করে আসুন।

 তিনকড়ি। হ্যাঁঃ, আমি এই বাতের শরীর নিয়ে তোমার ধ্যাধ্যেড়ে গোবিন্দপুরে গিয়ে মরি আর কি। সে হবে না, —আমার টাকা ফেরৎ দাও। কোম্পানি ত যেতে বসেছে। শেয়ার-হোল্ডাররা মার-মার কাটকাট করচে।

 শ্যামবাবু কপালে যুক্তকর ঠেকাইয়া বলিলেন— “সকলি জগন্মাতার ইচ্ছা। মানুষ ভাবে এক, হয় আর এক। এতদিন ত মন্দির শেষ হওয়ারই কথা। গুলো অজ্ঞাতপূর্ব্ব কারণে খরচ বেশী হয়ে গিয়ে টাকার অনাটন হয়ে পড়ল,—তাতে আমাদের আর অপরাধ কি? কিন্তু চিন্তার কোনো কারণ নেই, ক্রমশঃ সব ঠিক হয়ে যাবে। আর একটা callএর টাকা তুললেই সমস্ত দেনা শোধ হয়ে যাবে, কাজও এগ্রেবে।”

 গণ্ডেরী বলিলেন—“আউর টাকা কোই দিবে না। আপনোকা থোড়াই বিশোয়াস্ করবে।”

 শ্যাম। বিশ্বাস না করে, নাচার্। আমি দায়মুক্ত,—মা যেমন করে পারেন নিজের কাজ চালিয়ে নিন। আমাকে বাবা বিশ্বনাথ কাশীতে টানচেন,সেখানেই আশ্রয় নোবো।

 তিনকড়ি। তবে কি বলতে চাও, কোম্পানি ডুব‍্লো?

 গণ্ডেরী। বিশ হাঁথ পানি।

 শ্যাম। আচ্ছা তিনকড়িবাবু, আমাদের ওপর যখন লোকের এতই অবিশ্বাস, বেশ ত, আমরা না নয় ম্যানেজিং এজেন্সি ছেড়ে দিচ্চি। আপনার নাম আছে, সম্ভ্রম আছে, লোকেও শ্রদ্ধা করে; আপনিই ম্যানেজিং ডিরেক্টর হয়ে কোম্পানি চালান না?

 অটল। এইবার পাকা কথা বলেচেন।

 তিনকড়ি। হ্যাঁঃ, আমি বদ‍্নামের বোঝা ঘাড়ে নিই, আর ঘরের খেয়ে বুনো মোষ তাড়াই।

 শ্যাম। বেগার খাটবেন কেন? আমিই এই মিটিংএ প্রস্তাব করচি যে, রায়-সাহেব শ্রীযুক্ত তিনকড়ি ব্যানার্জি মহাশয়কে মাসিক ১০০০৲ পারিশ্রমিক দিয়ে কোম্পানি চালাবার ভার অর্পণ করা হোক। এমন উপযুক্ত কর্ম্মদক্ষ লোক আর কোথা? আর আমরা যদি ভুলচুক করেই থাকি, তার দায়ী ত আর আপনি হবেন না।

 তিনকড়ি। তা—তা—আমি এখন চট্ করে কথা দিতে পারি নে। ভেবে চিন্তে দেখব।

 অটল। আর দ্বিধা করবেন না রায়-সাহেব। আপনিই এখন ভরসা।

 শ্যাম। যদি অভয় দেন ত আর একটি নিবেদন করি। আমি বেশ বুঝেচি, অর্থ হচ্চে সাধনের অন্তরায়। আমার সমস্ত সম্পত্তিই বিলিয়ে দিয়েচি—কেবল এই কোম্পানির ষোলশ-খানেক শেয়ার আমার হাতে আছে। তাও সৎপাত্রে অর্পণ করতে চাই। আপনিই সেটা নিয়ে নিন। প্রিমিয়ম চাই না— আপনি কেনা দাম ৩২০০৲ মাত্র দিন।

 তিনকড়ি। হ্যাঁঃ, ভাল করে আমার ঘাড় ভাংবার মতলব।

 শ্যাম। ছি ছি। আপনার ভালই হবে। না হয় কিছু কম দিন,—চব্বিশ শ—দু’হাজার —হাজার—

 তিনকড়ি। এক কড়াও নয়।

 শ্যাম। দেখুন, ব্রাহ্মণ হতে ব্রাহ্মণের দান প্রতিগ্রহ নিষেধ, নৈলে আপনার মত লোককে আমার অমনিই দেবার কথা। আপনি যৎকিঞ্চিৎ মূল্য ধরে দিন। ধরুন—পাঁচশ টাকা। Transfer form আমার প্রস্তুতই আছে,—নিয়ে এস ত বিপিন।

 তিনকড়ি। আমি এ—এ—আশী টাকা দিতে পারি।

 শ্যাম। তথাস্তু। বড়ই লোকসান হল, কিন্তু সকলি মায়ের ইচ্ছা।

 গণ্ডেরী। বাহবা তিনকৌড়িবাবু, বহুৎ কিফায়ৎ হুয়া।

 তিনকড়িবাবু পকেট হইতে মনিব্যাগ বাহির করিয়া সদ্যোপ্রাপ্ত পেন্শনের টাকা হইতে আটখানা আন্‌কোরা দশ টাকার নোট সন্তর্পণে গণিয়া দিলেন। শ্যামবাবু পকেটস্থ করিয়া বলিলেন—“তবে এখন আমি আসি। বাড়ীতে সত্যনারায়ণের পূজা আছে। আপনিই কোম্পানির ভার নিলেন এই কথা স্থির। শুভমস্ত—মা দশভুজা আপনার মঙ্গল করুন।”

 শ্যামবাবু প্রস্থান করিলে, তিনকড়িবাবু ঈষৎ হাসিয়া বলিলেন—“লোকটা দোষে-গুণে মানুষ। এদিকে যদিও হম‍্বগ্, কিন্তু মেজাজটা দিলদরিয়া। কোম্পানির ঝক্কিটা ত এখন আমার ঘাড়ে পড়ল। ক’মাস বাতে পঙ্গু হয়ে পড়েছিলুম, কিছুই দেখতে পারি নি, —নৈলে কি কোম্পানির অবস্থা এমন হয়? যা হোক, উঠে পড়ে লাগতে হল, —আমি লেফাফা-দুরস্ত কাজ চাই, আমার কাছে কারো চালাকী চলবে না।”

 গণ্ডেরী। আপ‍্নের কুছু তক্‌লিফ করতে হোবে না কম্প‍্নি ত ডুব গিয়া। অপ্‌কোভি ছুট্টি।


‘কুছ্‌, ভি নেহি’

 তিনকড়ি। তা হলে কি বলতে চাও আমার মাসহারাটা—

 গণ্ডেরী। হাঃ হাঃ, তুম্‌ভি রূপেয়া লেওগে? কাঁহাসে মিল্‌বে বাত্‌লাও। তিনকৌড়িবাবু, শ্যামবাবুকে কার‍্বাই নহি সমঝা? নব্বে হজার রূপেয়া কম্পনিকা দেনা। রোজ বাদ লিকুইডিশন। লিকুইডেটর সিকিণ্ড কল আদায় করবে, তব্ দেনা শুধবে।

 তিনকড়ি। অ্যাঁ, বল কি? আমি আর পয়সাও দিচ্চি না।

 গণ্ডেরী। আলবৎ দিবেন। গবরমিণ্ট কাণ পকড়‍্কে আদায় করবে। আইন এইসি হ্যায়।

 তিনকড়ি। আরও টাকা যাবে? সে কত?

 অটল। আপনার একলার নয়। প্রত্যেক অংশীদারকেই শেয়ার-পিছু ফের দু’টাকা দিতে হবে। আপনার পূর্ব্বের ২০০ শেয়ার ছিল, আর শ্যাম-দার ১৬০০ আজ নিয়েচেন। এই ১৮০০ শেয়ারের উপর আপনাকে ছত্রিশ শ টাকা দিতে হবে। দেনা শোধ, লিকুইডেশনের খরচা—সমস্ত চুকে গেলে, শেষে সামান্য কিছু ফেরৎ পেতে পারেন।

 তিনকড়ি। তোমাদের কত গেল?

 গণ্ডেরী বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ সঞ্চালন করিয়া বলিলেন—“কুছ ভি নেহি, কুছ, ভি নেহি! আরে হামাদের ঝড়তি-পড়তি শেয়ার ত সব্ শ্যামবাবু লিয়েছিল—আজ আপনেকে বিক‍্করি কিয়েছে।”

 তিনকড়ি। চোর—চোর—চোর। আমি এখনি বিলেতে কোল্ডহ্যাম সাহেবকে চিঠি লিখচি।

 অটল। তবে আমরা এখন উঠি। আমাদের ত আর শেয়ার নেই, কাজেই আমরা এখন ডিরেক্টর নই। আপনি কাজ করুন। চল গণ্ডেরী।

 তিনকড়ি। অ্যাঁ—

 গণ্ডেরী। রাম রাম!