গল্পকল্প/অটলবাবুর অন্তিম চিন্তা
অটলবাবুর অন্তিম চিন্তা
শয্যাশায়ী অটল চৌধুরী বললেন, দেখ ডাক্তার, আমি তোমার ঠাকুরদার চেয়েও বয়সে বড়, আমাকে ঠকিও না। মুখ খুলে বল মেজর হালদার কি ব’লে গেলেন। আর কতক্ষণ বাঁচব?
ডাক্তারবাবু বললেন, কেন সার আপনি ও কথা বলছেন, মরণ-বাঁচন কি মানুষের হাতে? আমরা কতটুকুই বা জানি। ভগবানের যদি দয়া হয় তবে আপনি আরও অনেক দিন বাঁচবেন।
— বাঁচিয়ে রাখাই কি দয়ার লক্ষণ? তোমাদের কাজ শেষ হয়েছে, আর জ্বালিও না। এখন ডাক্তারী ধাপ্পাবাজি ছেড়ে দিয়ে সত্যি কথা বল। মরবার আগে আমি মনে মনে একটা বোঝাপড়া করতে চাই।
— বেশ তো, এখনই করুন না, দু-দশ বছর আগে করলেই বা দোষ কি।
— তুমি ডাক্তারিই শিখেছ, বিজনেস শেখ নি। আরে, বছর শেষ না হ’লে কি সাল-তামামী হিসেব-নিকেশ করা যায়? ঠিক মরবার আগেই জীবনের লাভ-লোকসান খতাতে চাই—অবশ্য যদি জ্ঞান থাকে।
এমন সময় পুরুতে ঠাকুর হরিপদ ভটচাজ এসে বললেন, কর্তাবাবু, প্রায়শ্চিত্তটা হয়ে যাক, মনে শান্তি পাবেন।
—কেন বাপু, আমি কি মানুষ খুন করেছি, না পরস্ত্রীহরণ করেছি, না চুরি-ডাকাতি জাল-জয়াচুরি আর মাদুলির ব্যবসা করেছি?
হরিপদ জিব কেটে বললেন, ছি ছি, আপনার মতন সাধুপুরুষ কজন আছেন? তবে কিনা সকলেরই অজ্ঞানকৃত পাপ কিছু কিছু থাকে, তার জন্যই প্রায়শ্চিত্ত।
— দেখ ভটচাজ, আমি ধর্মপুত্র যধিষ্ঠির নই, ভদ্রলোকের যতটুকু দুষ্কর্ম না করলে চলে না ততটুকু করেছি। তার জন্য আমার কিছুমাত্র খেদ নেই, নরকের ভয়ও নেই। তবে প্রায়শ্চিত্ত করলে তোমরা যদি মনে শান্তি পাও তো করতে পার। কিন্তু এখানে নয়, নীচে পূজোর দালানে কর গিয়ে। ঘণ্টার আওয়াজ যেন না আসে।
হরিপদ ‘যে আজ্ঞে’ ব’লে চলে গেলেন। মনে মনে ভাবলেন, ওঃ কি পাষণ্ড! মরতে বসেছে তবু ধর্মে মতি হ’ল না।
অটলবাবুর পৌত্রী রাধারানী এসে বললে, দাদাবাবু, বৃন্দাবন বাবাজী তাঁর কীর্তনের দল নিয়ে এসেছেন। মা জিজ্ঞাসা করলে, তুমি একটা নাম শুনবে কি?
—খবরদার। আমি এখন নিরিবিলিতে থাকতে চাই, চেঁচামেচি ভাল লাগে না। শ্রাদ্ধের দিন যত খুশি কীর্তন শুনিস— শীতল বাতাস ভাল লাগে না সখী, আমার বুকের পাঁজর ঝাঁজর হ’ল— যত সব ন্যাকামি।
রাধারানী ঠোঁট বেকিয়ে চলে গেল। ডাক্তার বললেন, সার, আপনি বড় বেশী কথা বলছেন। রাত হয়েছে, এখন চুপ ক’রে একটু ঘুমোবার চেষ্টা করুন।
—বেশী কথা তোমরাই বলছ। আর দেরি ক’রো, না, যা জিজ্ঞাসা করেছি তার স্পষ্ট উত্তর দাও।
ডাক্তার তাঁর স্টেথোস্কোপের নল চটকাতে চটকাতে বললেন, দু-চার ঘণ্টা হ’তে পারে, দু-চার দিনও হ’তে পারে, ঠিক বলা অসম্ভব। ইনজেকশনটা দিয়ে দি, আপনি অক্সিজেন শুঁকতে থাকুন, কষ্ট কমবে।
যথাকর্তব্য ক’রে ডাক্তার অটলবাবুর বিধবা পত্রবধূকে বললেন, হুঁশিয়ার হয়ে থাকতে হবে, আজ রাত বোধ হয় কাটবে না। নার্স ওঁর ঘরে থাকুক, আমি এই পাশের ঘরে রইলুম।
অটলবাবু অত্যন্ত হিসাবী লোক, আজীবন নানারকম কারবার করেছেন। তাঁর বয়স আশি পেরিয়েছে, শরীর রোগে অবসন্ন, কিন্তু বৃদ্ধি ঠিক আছে। মরণ আসন্ন জেনে তিনি মনে মনে ইহলোকের ব্যালান্স-শীট এবং পরলোকের একটা আন্দাজী প্রসপেকটস খাড়া করবার চেষ্টা করতে লাগলেন।
অটলবাবুর মনে পড়ল, বহুকাল পূর্বে কলেজে পড়বার সময় মৃচ্ছকটিকের একটি শ্লোক তাঁর ভাল লেগেছিল
সুখং হি দুঃখান্যনুভুয় শোভতে
ঘনান্ধকারেঙ্বিব দীপদর্শনম্।
সুখাত্তু ষো যাতি নরো দরিদ্রতাং
ধৃতঃ শরীরেণ মৃতঃ স জীবতি॥
—দুঃখ অনুভবের পরই সংখ শোভা পায়, যেমন ঘোর অন্ধকারে দীপদর্শন। কিন্তু যে লোক সুখভোগের পর দরিদ্রতা পায় সে শরীর ধারণ ক’রে মৃতের ন্যায় জীবিত থাকে।
অটলবাবু ভাবলেন, ভুল, মস্ত ভুল। তিনি প্রথম ও মধ্য জীবনে বিস্তর সুখভোগ করেছেন, কিন্তু শেষ বয়সে অনেক দুঃখ পেয়েছেন। তাঁকে স্ত্রীপুত্রাদি আত্মীয়বিয়োগের শোক এবং ব্যবসায়ে বড় রকম লোকসান সইতে হয়েছে, সর্বস্বান্ত না হ’লেও তিনি আগের তুলনায় দরিদ্র হয়েছেন। বয়স যত বাড়ে সময় ততই ছোট হয়ে যায়; অন্তিম কালে অটলবাবুর মনে হচ্ছে তাঁর সমস্ত জীবন মুহূর্তমাত্র, সমস্ত সুখ দুঃখ তিনি এক সঙ্গেই ভোগ করেছেন এবং সবই এখন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। সুখভোগের পর দুঃখ পেয়েছেন—শুধু এই কারণেই সুখের চেয়ে দুঃখকে বড় মনে করবেন কেন? জীবনের খাতায় লাভ-লোকসান দুইই পাকা কালিতে লেখা রয়েছে, তাতে দেখা যায় তাঁর খরচের তুলনায় জমাই বেশী, মোটের উপর তিনি বঞ্চিত হন নি। অন্য লোকে যাই বলুক, তিনি নিজেকে ভাগ্যবান মনে করতে পারেন।
কিন্তু একটা খটকা দেখা যাচ্ছে। তিনি নিজে ভাগ্যবান হ’লেও যারা তাঁর অত্যন্ত প্রিয়জন ছিল তারা হতভাগ্য, অনেকে বহু দুঃখ পেয়ে অকালে মরেছে। তাদের দুঃখ অটলবাবু নিজের ব’লেই মনে করেন এবং তা লোকসানের দিকে ফেললে লাভের অঙ্ক খূব ক’মে যায়। শুধু তাই নয়, অন্যান্য যে সব লোককে তিনি আজীবন আশেপাশে দেখছেন তাদেরও অনেকে কষ্ট ভোগ করেছে। পূর্বে তাদের কথা তিনি ভাবেন নি, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে তারাও নিতান্ত আপন জন। তাদের দুঃখও যদি নিজের বলে ধরেন তবে জমাখরচ কষলে লোকসানই দেখা যায়।
অটলবাবু স্থির করতে পারলেন না তিনি জীবনে মোটের ঊপর সুখ বেশী পেয়েছেন কি দুঃখ বেশী পেয়েছেন। তিনি যদি ভক্ত হতেন তবে বলতে পারতেন—‘ধন্য হরি রাজ্যপাটে, ধন্য হরি শ্মশানঘাটে’। ভগবান যা করেন তা মঙ্গলের জন্যই করেন—এই খৃীষ্টানী প্রবোধবাক্যে তিনি বিশ্বাস করতে পারেন নি। অটলবাবু শুনেছেন, যিনি পরমহংস তিনি সমস্ত জীবের সুখদদুঃখ নিজের ব’লেই মনে করেন; সুখ আর দুঃখে কাটাকাটি হয়ে যায়, তার ফলে তিনি সুখীও হন না। দঃখীও হন না। কিন্তু অটলবাবু পরমহংস নন, তা ছাড়া তিনি জগতে সুখের চেয়ে দুখই বেশী দেখতে পান। তিনি যদি দুঃখের দিকে পিছন ফিরে জীবন উপভোগ করতে পারতেন তবে রবীন্দ্রনাথের মতন বলতে পারতেন—
এ দ্যুলোক মধুময়, মধুময় পৃথিবীর ধূলি—
অন্তরে নিয়েছি আমি তুলি
এই মহামন্ত্রখানি
চরিতার্থ জীবনের বাণী।
দিনে দিনে পেয়েছিনু সত্যের যা-কিছু উপহার
মধরসে ক্ষয় নাই তার।
তাই এই মন্ত্রবাণী মৃত্যুর শেষের প্রান্তে বাজে —
সব ক্ষতি মিথ্যা করি অনন্তের আনন্দে বিরাজে।
আরও বলতে পারতেন—
আমি কবি তর্ক নাহি জানি,
এ বিশ্বের দেখি তার সমগ্র স্বরূপে—
লক্ষ কোটি গ্রহ তারা আকাশে আকাশে
বহন করিয়া চলে প্রকাণ্ড সুষমা,
ছন্দ নাহি ভাঙে তার সুরে নাহি বাধে,
বিকৃতি না ঘটায় স্খলন...
ভাগ্যদোষে অটলবাবু ভক্ত নন, কবি নন, ভাবুক নন, দার্শনিক নন, সরল বিশ্বাসীও নন। তিনি নানা বিষয়ে ঠোকর মেরেছেন কিন্তু কিছুই আয়ত্ত করতে পারেন নি, আজীবন সংশয়ে কাটিয়েছেন কিন্তু কোনও বিষয়েই নিষ্ঠা রাখতে পারেন নি। তাঁর মূলধন কি তাই তিনি জানেন না, লাভ-লোকসান খতাবেন কি করে? শুধু এইটুকুই বলতে পারেন — অনেকের তুলনায় তিনি ভাগ্যবান, অনেকের তুলনায় তিনি হতভাগ্য। এ সম্বন্ধে আর তিনি বৃথা মাথা ঘামাবেন না, জ্ঞান থাকতে থাকতে তাঁর ভবিষ্যৎটা একটু আন্দাজ করার চেষ্টা করবেন। তাঁর আর বাঁচবার ইচ্ছা নেই। তিনি মরলে কারও আর্থিক ক্ষতি বা মানসিক দুঃখ হবে না, যে অল্প আয় আছে তা বন্ধ হবে না, বরং ইনশিওরান্সের একটা মোটা টাকা ঘরে আসবে। তিনি এখন আত্মীয়দের গলগ্রহ মাত্র, তারা বোধ হয় মনে মনে তাঁর মরণ কামনা করে।
অটলবাবু কি আবার জন্মাবেন? তাঁর গতজন্মের কথা কিছুই মনে নেই। জাতিস্মর লোকের বিবরণ মাঝে মাঝে খবরের কাগজ পাওয়া যায়, কিন্তু তা মোটেই বিশ্বাস্য নয়। মালবীয়জীর যখন কায়কল্প চিকিৎসা চলছিল তখন এক বিখ্যাত সংবাদপত্রের নিজস্ব সংবাদদাতা খবর পাঠাচ্ছিলেন—পণ্ডিতজীর পাকা চুল সমস্ত কাল হয়ে গেছে, নূতন দাঁতও উঠছে। নির্জলা মিথ্যা কথা লিখতে এঁদের বাধে না। যদি পুনর্জন্মের কথা মনে না থাকে তবে এক জন্মের রামবাবুই যে অন্য জন্মে শ্যামবাবু হয়েছেন তার প্রমাণ কি? তার পর স্বর্গ মর্ত্য। তিনি এক পাদ্রির কাছে শুনেছিলেন, যিশু খ্রীষ্টের শরণ নিলে অনন্ত স্বর্গ, না নিলে অনন্ত নরক। এরকম ছেলেমানষী কথায় ভুলবেন অটলবাবু এমন বোকা নন। আমাদের পুরাণে আছে, যার পাপ অল্প সে আগে অল্প কাল নরকভোগ করে, তার পর দীর্ঘ কাল স্বর্গভোগ করে, পুণ্যক্ষয় হলে আবার জন্মায়। যার পুণ্য অল্প সে অল্প কাল স্বর্গবাসের পর দীর্ঘ কাল নরকবাস করে, তার পর আবার জন্মায়। এই মত খীষ্টানী মতের চেয়ে ভাল, কিন্তু মানুষের পাপ-পুণ্য মাপা হবে কি ক’রে? পাপ-পুণ্য তো যুগে যুগে বদলাচ্ছে। পঞ্চাশ-ষাট বৎসর আগে মুরগি খেলে পাপ হ’ত, এখন আর হয় না। পুরাকালের হিন্দুরা অন্যান্য নিষিদ্ধ মাংসও খেত, ভবিষ্যতে আবার খাবে তার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। সবাই বলে নরহত্যা মহাপাপ, কিন্তু এই সেদিন শান্ত শিষ্ট ভদ্রলোকের ছেলেরাও বেপরোয়া খুন করেছে, বড়োরা উৎসাহ দিয়ে বলেছে—এ হ’ল আপদ্ধর্ম, সাপ মারলে পাপ হয় না, কে ঢোঁড়া কে কেউটে তা চেনবার দরকার নেই। পাপ-পুণ্যের যখন স্থিরতা নেই তখন স্বর্গনরক অবিশ্বাস্য।
তবে কি অটলবাবু স্পিরিচুয়ালিস্টদের পরলোকে যাবেন —ষা স্বর্গও নয় নরকও নয়? আজকাল ইওরোপ-আমেরিকার বৃত্তান্তের মতন পরলোকের বৃত্তান্তও অনেক ছাপা হচ্ছে। দূর্বলচিত্ত লোকে বিপদে পড়লে যেমন কবচ-মাদুলি ধারণ করে, জ্যোতিষী বা গুরুর শরণাপন্ন হয়, তেমনি শান্তির প্রত্যাশায় পরলোকের কথা পড়ে। অনেক বৎসর পূর্বে অটলবাবু একটি অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেছিলেন, এখন তা মনে পড়ে গেল।— তিনি বিদেশে এক বন্ধুর বাড়ি অতিথি হয়েছেন। রাত্রিতে আহারের পর তাঁর জন্য নির্দিষ্ট ঘরে শুতে যাবার সময় দেখলেন, পাশে একটি তালা-লাগানো ঘর আছে। শোবার কিছুক্ষণ পরে শুনতে পেলেন, পাশের ঘরের তালা খোলা হ’ল, আবার বন্ধ করা হ’ল। তার পর অটলবাবু ঘুমিয়ে পড়লেন। একটু পরেই গোলমালে ঘুম ভেঙে গেল, পাশের ঘরে যেন হাতাহাতি মারামারি চলছে। অনেক রাত পর্যন্ত এইরকম চলল, অটলবাবু ঘুমতে পারলেন না। পরদিন বাড়ির কর্তা তাঁকে বললেন, আপনার নিদ্রার ব্যাঘাত হয়েছে তার জন্য আমি বড় দুঃখিত। ব্যাপার কি জানেন—আমার একটি ছেলে অল্প বয়সে মারা যায়, তার গর্ভধারিণী রোজ রাত্রে থালায় ভরতি ক’রে তার জন্য ওই ঘরে খাবার রাখেন। কিন্তু ছেলে খেতে পায় না, তার পূর্বপুরুষরা দল বেধে এসে খাবার নিয়ে কাড়াকাড়ি করেন।
এই স্বপ্নের কথা মনে পড়ার পর অটলবাবু একটি বিভীষিকা দেখলেন। মনে হ’ল তাঁর বাবা বলছেন, অট্লা, প্রণাম কর্, এই ইনি তোর পিতামহ, ইনি প্রপিতামহ, ইনি বৃদ্ধপ্রপিতামহ, ইনি অতিবৃদ্ধ —ইত্যাদি ইত্যাদি। অটলবাবু দেখলেন, তাঁর বংশের অসংখ্য ঊর্ধ্বতন স্ত্রীপুরুষ প্রণাম নেবার জন্য সামনে কিউ ক’রে দাঁড়িয়ে আছেন। ওই তাঁর পাঁচ নম্বর পূর্বপুরুষ— প্রবলপ্রতাপ জমিদার, মাথায় টিকি, কপালে রক্তচন্দনের ফোঁটা, গলায় রুদ্রাক্ষ, কাঁধে পইতের গোছা, পায়ে খড়ম—দেখলেই বোধ হয় ব্যাটা ডাকাতের সর্দার, নরবলি দিত। ওই উনি, যাঁর দাঁতে মিসি, নাকে নথ, কানে মাকড়ির ঝালর, পায়ে বাঁকমল, কোমরে গোট, অটলবাবুর অতিবৃদ্ধপ্রমাতামহী—ও মাগী নিশ্চয় ডাইনী, সতিনপোকে বিষ খাইয়ে মেরেছিল। দলের মধ্যে সাধুপুরুষ আর সাধ্বী স্ত্রীও অনেক আছেন, কিন্তু অটলবাবু তো ভাল মন্দ বেছে প্রণাম করতে পারেন না। তা ছাড়া তাঁর বয়স এত হয়েছে যে কোনও গরুজন আর বেঁচে নেই, তিনি প্রণাম করাই ভুলে গেছেন। ছেলেবেলায় তিনি তাঁর বাবাকে দেখলে হুঁকো লুকোতেন, কিন্তু এখন এই পঙ্গপালের মতন পূর্বপুরুষেদের খাতির করা তাঁর পক্ষে অসম্ভব। তাঁর প্রিয়জন এবং অপ্রিয়জনও পাশে এসে দাঁড়িয়েছে, কেউ হাসিমুখে কেউ ছলছল চোখে কেউ ভ্রুকুটি করে তাঁকে দেখছে। শুধু মানুষে নয়, মানুষের পিছনে অতি দূরে জন্তুর দলও রয়েছে, পশু সরীসপ মাছ কৃমি কীট কীটাণু পর্যন্ত। এরাও তাঁর পর্বপুরুষ, এরাও তাঁর জ্ঞাতি, সকলের সঙ্গেই তাঁর রক্তের যোগ আছে। কি ভয়ানক, ইহলোকের জনকয়েক আত্মীয়বন্ধুর সংশ্রব ত্যাগ করে তাঁকে কি পরলোকের প্রেতারণ্যে বাস করতে হবে? ওখানে সঙ্গী রূপে কাকে তিনি বরণ করবেন, কাকে বর্জন করবেন? অটলবাবু অস্পষ্টম্বরে বললেন, দূর হ, দূর হ।
নার্স কাছে এসে জিজ্ঞাসা করলে, আমাকে ডাকছেন? অটলবাবু আবার বললেন, দূর হ, দূরে হ। নার্স বিরক্ত হয়ে তার চেয়ারে গিয়ে বসল এবং আবার ঢুলতে লাগল।
বিকারের ঘোর কাটিয়ে উঠে অটলবাবু ভাবতে লাগলেন —পুনর্জন্ম নয়, স্বর্গ নয়, স্পিরিচুয়াল প্রেতলোকও নয়। কোথায় যাবেন? মমৃত্যুর পর দেহ পঞ্চভূতে মিলিয়ে যায়, দেহের উপাদান পৃথিবীর জড় বস্তুতে লয় পায়। মৃত ব্যক্তির চেতনাও কি বিরাট বিশ্বচেতনায় লীন হয়? আমিই অটল চৌধুরী —এই বোধ কি তখনও থাকবে? অটলবাবু আর ভাবতে পারেন না, মাথার মধ্যে সব গোলমাল হয়ে যাচ্ছে।
শেষ রাত্রে অটলবাবুর নাড়ী নিঃশ্বাস আর বুকে পরীক্ষা ক’রে ডাক্তার বললেন, ঘণ্টাখানেক হ’ল গেছেন। আশ্চর্য মাননুষ, হরিনাম নয়, রামধুন নয়, তারকব্রহ্মনাম নয়, কিছুই শুনলেন না, ভদ্রলোক লাভ-লোকসান কষতে কষতেই মরেছেন। বোধ হয় হিসেব মেলাতে পারেন নি, দেখুন না, ভ্রূ, একটু কুঁচকে রয়েছে।
পুত্রবধূ বললেন, তা বেশ গেছেন, নিজেও বেশী দিন ভোগেন নি, আমাদেরও ভোগান নি। চিকিৎসার খরচও তো কম নয়।
অটলবাবুর কাগজপত্র হাঁটকে দেখে তাঁর পৌত্র বললে, এঃ, বড়ো ঠকিয়েছে, যা রেখে গেছে তা কিছুই নয়।
অনুরক্ত বন্ধুরা বললেন, একটা ইন্দ্রপাত হ’ল। এমন খাঁটী মানষে দেখা যায় না। ইনি স্বর্গে যাবেন না তো যাবে কে? কি বলেন দত্ত মশাই?
হারাধন দত্ত মশাই পরলোকতত্ত্বজ্ঞ, যদিও পরলোক দেখবার সংযোগ এখনও পান নি। তিনি একটু চিন্তা ক’রে বললেন, উঁহু, স্বর্গে যাওয়া অত সহজ নয়, দরজা খোলা পাবেন না; উনি যে কিছুই মানতেন না। অ্যাস্ট্রাল প্লেনেই আটকে থাকবেন, ত্রিশঙ্কুর মতন।
হরিপদ ভটচাজ মনে মনে বললেন, তোমরা ছাই জান, পাষণ্ড এতক্ষণ নরকে পৌঁছে গেছে।
অটলবাবু কোথায় গেছেন তা তিনিই জানেন। অথবা তিনিও জানেন না।
১৩৫৫