গল্পগুচ্ছ (চতুর্থ খণ্ড)/ছোটো গল্প

প রি শি ষ্ট ১

‘শেষ কথা’ গল্পের পাঠান্তর

ছোটো গল্প

শেষ কথা

সাহিত্যে বড়ো গল্প ব’লে যে-সব প্রগল্‌ভ বাণীবাহন দেখা যায় তারা প্রাক্‌ভূতাত্ত্বিক যুগের প্রাণীদের মতো— তাদের প্রাণের পরিমাণ যত দেহের পরিমাণ তার চার গুণ, তাদের লেজটা কলেবরের অত্যুক্তি।

 অতিপরিমাণ ঘাস পাতা খেয়ে যাদের পেট মোটা তারা ভারবাহী জীব, স্তূপাকার মালের বস্তা টানা তাদের অদৃষ্টে। বড়ো গল্প সেই জাতের মাল-বোঝাই-ওয়ালা। যে-সব প্রাণীর খোরাক স্বল্প এবং সারালো, জাওর কেটে কেটে তারা প্রলম্বিত করে না ভোজন-ব্যাপার অধ্যায়ের পর অধ্যায়ে। ছোটো গল্প সেই জাতের; বোঝা বইবার জন্যে সে নয়, একেবারে সে মার লাগায় মর্মে লঘু লম্ফে।

 কিন্তু গল্পের ফরমাশ আসছে বড়ো বহরের। অনেকখানি মালকে মানুষ অনেকখানি দাম দিয়ে ঠকতেও রাজি হয়। ওটা তার আদিম দুর্নিবার প্রবৃত্তির দুর্বলতা। এটাই দেখতে পাওয়া যায় আমাদের দেশের বিয়ের ব্যাপারে। ইতরের-মন-ভোলানো অতিপ্রাচুর্য এমনতরো রসাত্মক ক্রিয়াকর্মেও ভদ্রসমাজের বিনা প্রতিবাদে আজও চলে আসছে। আতিশয্যের-ঢাক-বাজানো পৌত্তলিকতা মানষের প্রপৈত্রিক সংস্কার।

 মানুষের জীবনটা বিপুল একটা বনস্পতির মতো। তার আয়তন তার আকৃতি সুঠাম নয়। দিনে দিনে চলছে তার মধ্যে এলোমেলো ডালপালার পুনরাবৃত্তি। এই স্তূপাকার একঘেয়েমির মধ্যে হঠাৎ একটি ফল ফলে ওঠে— সে নিটোল, সে সুডোল, বাইরে তার রঙ রাঙা কিংবা কালো, ভিতরে তার রস তীব্র কিংবা মধুর। সে সংক্ষিপ্ত, সে অনিবার্য, সে দৈবলব্ধ, সে ছোটো গল্প।

 একটা দৃষ্টান্ত দেখানো যাক। রাজা এড্‌ওআর্ড্ ভ্রমণে বেরলেন দেশ-দেশান্তরে। মুগ্ধ স্তাবকদের ভিড় চলল সঙ্গে সঙ্গে, খবরের কাগজের প্যারাগ্রাফের ঠোঙাগুলো ঠেসে ভরে ভরে উঠল। এমন সময় যত-সব রাজদূত, রাষ্ট্রনায়ক, বণিক্‌সম্রাট, লেখনীবজ্রপাণি সংবাদপাত্রিকের ঘেঁষাঘেষি ভিড়ের মধ্যে একটা কোন্ ছোটো রন্ধ্র দিয়ে রাজার চোখে পড়ল এক অকুলীন আমেরিকানী। শব্দভেদী সমারোহের স্বরবর্ষণ মুহূর্তে হয়ে গেল অবাস্তব, কালো পর্দা পড়ে গেল ইতিহাসের অসংখ্য-দীপদীপ্ত রঙ্গমঞ্চের উপর। সমস্ত কিছু বাদ দিয়ে জ্বল্ জ্বল্ করে উঠল ছোটো গল্পটি—দুর্লভ, দুর্‌মূল্য। গোলমালের ভিতরে অদৃশ্য আর্টিস্ট্ ছিলেন আড়ালে, তাকিয়ে ছিলেন ব্যক্তিগত জীবনসরোবরের গভীর অগোচরে। দেখছিলেন অতল-সঞ্চারী অজানা মাছ কখন পড়ে তাঁর বড়শিতে গাঁথা, কখন চমক দিয়ে ওঠে তাঁর ছোটো গল্পটি নানা-বর্ণচ্ছটা-খচিত লেজ আছড়িয়ে।

 পৌরাণিক যুগের একটি ছোটো গল্প মনে পড়ছে—ঋষ্যশৃঙ্গমুনির আখ্যান। দুঃসাধ্য তাঁর তপস্যা। নিষ্কলঙ্ক ব্রহ্মচর্যের দুরূহ সাধনায়। অধিরোহণ করছিলেন বশিষ্ঠ-বিশ্বামিত্র-যাজ্ঞবল্ক্যের দুর্গম উচ্চতায়। হঠাৎ দেখা দিল সামান্য রমণী, যে শুচি নয়, সাধ্বী নয়, সে বহন করে নি তত্ত্ব বা মন্ত্র বা মুক্তি; এমনকি ইন্দ্রলোক থেকে পাঠানো অপ্সরীও সে নয়। সমস্ত যাগযজ্ঞ ধ্যানধারণা সমস্ত অতীত ভবিষ্যৎ আঁট বেঁধে গেল একটি ছোটো গল্পে।

 এই হল ভূমিকা। আমি হচ্ছি সেই মানুষ যার অদৃষ্ট ভীল-রমণীর মতো ঝুড়িতে প্রতিদিন সংগ্রহ করত কাঁচা পাকা বদরী ফল, একদিন হঠাৎ কুড়িয়ে পেয়েছিল গজমুক্তা, একটি ছোটো গল্প।

 সাহস করে লিখে ফেলব। কাজটা কঠিন। এতে হয়তো স্বাদ কিছু বা পাওয়া যাবে, কিন্তু পেট-ভরা ওজনের বস্তু মিলবে না।

প্রথম পর্ব

জীবনের প্রবহমান ঘোলা রঙের হ-য-ব-র-ল’র মধ্যে হঠাৎ যেখানে গল্পটা আপন রূপ ধ’রে সদ্য দেখা দেয়, তার অনেক পূর্ব থেকেই নায়ক-নায়িকারা আপন পরিচয়ের সূত্র গেঁথে আসে। গল্পের গোড়ায় প্রাক্‌গাল্পিক ইতিহাসের ধারা অনুসরণ করতেই হয়। তাতে কিছু সময় নেবে। আমি যে কে, সে কথাটা পরিষ্কার করে নিই।

 কিন্তু নামধাম ভাঁড়াতে হবে। নইলে চেনাশোনার মহলে গল্পের যাথাযথ্যের জবাবদিহি সামলাতে পারব না। এ কথা সবাই বোঝে না যে, ঠিকঠাক সত্য বলবার এক কায়দা আর তার চেয়েও বেশি সত্য বলবার ভঙ্গী আলাদা।

 কী নাম নেব তাই ভাবছি। রোম্যাণ্টিক নামকরণের দ্বারা গোড়া থেকে গল্পটাকে বসন্তরাগে পঞ্চমসুরে বাঁধতে চাই নে। নবীনমাধব নামটা বোধ হয় চলনসই। ওর শাম্‌লা রঙটা মেজে ফেলে গিল্‌টি লাগালে ওটা হতে পারত নবারুণ সেনগুপ্ত, কিন্তু খাঁটি শোনাত না।

 আমি ছিলুম বাংলাদেশের বিপ্লবীদলের একজন। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের মহাকর্ষ শক্তি আমাকে প্রায় টেনে নিয়ে গিয়েছিল আণ্ডামানের তীর বরাবর। নানা বাঁকা পথে সি. আই. ডি.’র ফাঁস এড়িয়ে প্রথমে আফগানিস্থান, তার পরে জাপান, তার পরে আমেরিকায় গিয়ে পৌঁচেছিলুম জাহাজি গোরার নানা কাজ নিয়ে।

 পূর্ববঙ্গীয় দুর্জয় জেদ ছিল মজ্জায়। একদিনও ভুলি নি যে ভারতবর্ষের হাতকড়ায় উখো ঘষতে হবে দিনরাত, যতদিন বেঁচে থাকি। কিন্তু এই সমুদ্রপারের কর্মপেশল হাড়-মোটা প্রাণঘন দেশে থাকতে থাকতে একটা কথা নিশ্চিত বুঝেছিলাম যে, আমরা যে প্রণালীতে বিপ্লবের পালা শুরু করেছিলুম সে যেন আতশবাজিতে পটকা ছোঁড়ার মতো। তাতে নিজেদের পোড়াকপাল আরও পুড়িয়েছে অনেকবার, কিন্তু ফুটো করতে পারে নি ব্রিটিশ রাজপতাকা। আগুনের উপর পতঙ্গের অন্ধ আসক্তি। যখন সদর্পে ঝাঁপ দিয়ে পড়ছিলুম, তখন বুঝতে পারি নি সেটাতে ইতিহাসের যজ্ঞানল জ্বালানো হচ্ছে না, জ্বালাচ্ছি নিজেদের খুব ছোটো ছোটো চিতানল।

 তার পরে স্বচক্ষে দেখলুম য়ুরোপীয় মহাসমর। কী রকম টাকা ওড়াতে হয় ধুলোর মতো আর প্রাণ উড়িয়ে দেয় ধোঁয়ার মতো দাবানলের। মরবার জন্যে তৈরি হতে হয় সমস্ত দেশ একজোট হয়ে, মারবার জন্যে তৈরি হতে হয় দীর্ঘকাল বিজ্ঞানের দূরূহ দীক্ষা নিয়ে। এই যুগান্তরসাধিনী সর্বনাশাকে আমাদের খোড়ো ঘরের চণ্ডীমণ্ডপে প্রতিষ্ঠিত করব কোন্ দুরাশায়! যথোচিত সমারোহে বড়ো রকমের আত্মহত্যা করবার আয়োজনও যে ঘরে নেই; ঠিক করলুম ন্যাশনাল দুর্গের গোড়া পাকা করতে হবে, যত সময়ই লাগুক। বাঁচতে যদি চাই, আদিম সৃষ্টির হাত দুখানায় গোটাদশেক নখ নিয়ে আঁচড় মেরে লড়াই করা চলবে না। এ যুগে যন্ত্রের সঙ্গে দিতে হবে পাল্লা। হাতাহাতি করার তাল-ঠোকা পালোয়ানি সহজ, বিশ্বকর্মার চেলাগিরি সহজ নয়। পথ দীর্ঘ, সাধনা দুরূহ।

 দীক্ষা নিলুম যন্ত্রবিদ্যায়। আমেরিকায় ডেট্রয়েটে ফোর্ডের মোটর-কারখানায় কোনোমতে ভর্তি হলুম। হাত পাকাচ্ছিলুম কিন্তু শিক্ষা এগচ্ছিল বলে মনে হয় নি। একদিন কী দুর্‌বুদ্ধি ঘটল, মনে হল ফোর্ড্‌কে যদি একটুখানি আভাস দিতে যাই যে নিজের স্বার্থসিদ্ধি আমার উদ্দেশ্য নয়, আমি চাই দেশকে বাঁচাতে, তা হলে ধনকুবের বুঝি বা খুশি হবে, এমন-কি দেবে আমার রাস্তা প্রশস্ত করে। অতি গম্ভীরমুখে ফোর্ড্ বললে, ‘আমার নাম হেন্‌রি ফোর্ড্, পুরোনো পাকা ইংরেজি নাম। কিন্তু আমি জানি আমাদের ইংলন্‌ডের মামাতো ভাইরা অকেজো, ইন্‌এফীসিয়েণ্ট্। তাদের আমি কেজো করে তুলব এই আমার সংকল্প।’ অর্থাৎ অকেজো টাকাওয়ালাকে কেজো করবে কেজো টাকাওয়ালা স্বগোত্রের লাইন বাঁচিয়ে, আমরা থাকব চিরকাল কেজোদের হাতে কাদার পিণ্ড। তারা পুতুল বানাবে। এই দুঃখেই গিয়েছিলুম একদিন সোভিয়েটের দলে ভিড়তে। তারা আর যাই করুক কোনো নিরুপায় মানব-জাতকে নিয়ে পতুলনাচের অর্থকরী ব্যাবসা করে না।

 কিছুদিন চাকা চালিয়ে শেষকালে বুঝলুম যদুবিদ্যাশিক্ষার আরও গোড়ায় যেতে হবে। শুরুতে দরকার যন্ত্রনির্মাণের মালমসলা জোগাড় করার বিদ্যে। কৃতকর্মাদের জন্যেই ধরণী দুর্গম পাতালপরীতে জমা করে রেখেছেন কঠিন খনিজ পিণ্ড। সেইগুলো হস্তগত করে তারাই দিগ্বিজয় করেছে যারা বাহাদুর জাত। আর যাদের চিরকালই অদ্যভক্ষ্য ধনুর্‌গুণ তাদের জন্যেই বাঁধা বরাদ্দ উপরিস্তরের ফল-ফসল শাকসব্‌জি— হাড় বেরিয়ে গেল পাঁজরের, পেটে পিঠে গেল এক হয়ে।

 লেগে গেলাম খনিজবিদ্যায়। এ কথা ভুলি নি যে ফোর্ড্ বলেছেন ইংরেজ জাত অকেজো। তার প্রমাণ আছে ভারতবর্ষে। একদিন ওরা হাত লাগিয়েছিল নীলের চাষে, চায়ের চাষে আর-একদিন। সিভিলিয়ান-দল দফতরখানায় ‘ল অ্যাণ্ড্ অর্ডর’এর জাঁতা চালিয়ে দেশের অস্থিমজ্জা ছাতু করে বানিয়ে তুলেছে বস্তাবন্দী ভালোমানুষি, অতি মোলায়েম। সামান্য কিছু কয়লার আকর ছাড়া ভারতের অন্তর্ভাণ্ডারের সম্পদ উদ্ঘাটিত করতে উপেক্ষা করেছে কিংবা অক্ষমতা দেখিয়েছে। নিংড়েছে বসে বসে পাটের চাষীর রক্ত। জামশেদজি টাটাকে সেলাম করেছি সমুদ্রের ওপার থেকে। ঠিক করেছি আমার কাজ পটকা ছোঁড়া নয়। সিঁধ কাটতে যাব পাতালপুরীর পাষাণপ্রাচীরে। মায়ের আঁচল-ধরা খোকাদের দলে মিশে ‘মা মা’ ধ্বনিতে মন্তর আওড়াব না; আর দেশের যত অভুক্ত অক্ষম রূগ্‌ণ অশিক্ষিত কাল্পনিক-ভয়ে-দিনরাত-কম্পমান দরিদ্রকে সহজ ভাষায় দরিদ্র বলেই জানব — ‘দরিদ্রনারায়ণ’ ব’লে একটা বুলি বানিয়ে তাদের বিদ্রূপ করব না। প্রথম বয়সে একবার বচনের পুতুলগড়া খেলা অনেক খেলেছি। কবি-কারিগরদের কুমোরটলিতে স্বদেশের যে সস্তা রাঙতা-লাগানো প্রতিমা গড়া হয় তার সামনে গদ্গদ ভাষায় অনেক অশ্রুজল ফেলেছি। লোকে তার খুব একটা চওড়া নাম দিয়েছিল—‘দেশাত্মবোধ’। কিন্তু আর নয়। আক্কেলদাঁত উঠেছে। এই জাগ্রত বুদ্ধির দেশে এসে বাস্তবকে বাস্তব বলে জেনেই শুকনো চোখে কোমর বেঁধে কাজ করতে শিখেছি। এবার দেশে ফিরে গিয়ে বেরিয়ে পড়বে এই বিজ্ঞানী বাঙাল কোদাল নিয়ে কুড়ুল নিয়ে, হাতুড়ি নিয়ে, দেশের গুপ্তধনের তল্লাসে। মেয়েলি গলার মিহিসুরের মহাকবি-বিশ্বকবিদের অশ্রুরুদ্ধকণ্ঠ চেলারা এই অনুষ্ঠানকে তাদের দেশমাতৃকার পূজা বলে চিনতেই পারবে না।

 ফোর্ডের কারখানা ছেড়ে তার পর ন’ বছর কাটিয়েছি খনিবিদ্যা খনিজবিদ্যা শিখতে। য়ুরোপের নানা কর্মশালায় ফিরেছি, হাতে-কলমে কাজ করেছি, দুই-একটা যন্ত্রকৌশল নিজেও বানিয়েছি, উৎসাহ পেয়েছি অধ্যাপকের কাছ থেকে, নিজের উপরে বিশ্বাস হয়েছে, ধিক্কার দিয়েছি ভূতপূর্ব মন্ত্রমুগ্ধ অকৃতার্থ নিজেকে।

 আমার ছোটোগল্পের সঙ্গে এই-সব মোটা মোটা কথার বিশেষ যোগ নেই। বাদ দিলে চলত, হয়তো বা ভালোই হত। কেবল এই প্রসঙ্গে একটা কথা বলার দরকার ছিল, সেইটে বলি। যৌবনের গোড়ায় যখন নারীপ্রভাবের ম্যাগনেটিজ্‌ম্ রঙিন রশ্মির আন্দোলন তোলে জীবনের আকাশে আকাশে, তখন আমি ছিলুম কোমর বেঁধে অন্যমনস্ক। আমি সন্ন্যাসী, আমি কর্মযোগী, এই-সমস্ত বাণীর কুলপ আমার মনে কষে তালা এঁটে রেখেছিল। কন্যাদায়িকেরা যখন আশেপাশে ঘোরাঘুরি করেছে তখন আমি স্পষ্ট করেই বলেছি, কন্যার কুষ্টিতে যদি অকালবৈধব্যযোগ থাকে তবেই যেন তাঁরা আমার কথা চিন্তা করেন।

 পাশ্চাত্য মহাদেশে নারীসঙ্গলাভে বাধা দেবার কাঁটার বেড়া নেই। সেখানে দুর্যোগের আশঙ্কা ছিল। আমি যে সুপুরুষ, বঙ্গনারীর মুখের ভাষায় তার কোনো ভাষ্য পাই নি। তাই এ সংবাদটা আমার চেতনার বাইরেই ছিল। বিলেতে গিয়ে প্রথম আবিষ্কার করেছি যে সাধারণের চেয়ে আমার বদ্ধি বেশি, তেমনি ধরা পড়েছে আমার চেহারা ভালো। আমার দেশের অর্ধাশনশীর্ণ পাঠকের মুখে জল আসবার মতো রসগর্ভ কাহিনীর সূচনা সেখানে মাঝে মাঝে হয়েছিল। সেয়ানারা অবিশ্বাসে চোখ টেপাটেপি করতে পারেন, তবু জোর করেই বলব সে কাহিনী মিলনান্ত বা বিয়োগান্তের যবনিকাপতনে পৌঁছয় নি কেবল আমার জেদ-বশত। আমার স্বভাবটা কড়া, পাথুরে জমিতে জীবনের সংকল্প ছিল যক্ষের ধনের মতো পোঁতা, সেখানে চোরের সাবল ঠিকরে পড়ে ঠন্‌ করে ওঠে। তা ছাড়া আমি জাতপাড়াগেঁয়ে, সাবেককেলে ভদ্রঘরে আমার জন্ম, মেয়েদের সম্বন্ধে আমার সংকোচ ঘুচতে চায় না।

 আমার জর্মন ডিগ্রি উঁচুদরের ছিল। সেটা এখানে সরকারী কাজে বাতিল। তাই সুযোগ করে ছোটোনাগপরে চন্দ্রবংশীয় এক রাজার দরবারে কাজ নিয়েছি। সৌভাগ্যক্রমে তাঁর ছেলে দেবিকাপ্রসাদ কিছুদিন কেম্‌ব্রিজে পড়াশুনো করেছিলেন। দৈবাৎ জুরিকে তাঁর সঙ্গে আমার দেখা। তাঁকে বুঝিয়েছিলুম আমার প্ল্যান। শুনে উৎসাহিত হয়ে তাঁদের স্টেটে আমাকে লাগিয়ে দিলেন জিয়লজিকাল সর্ভের কাজে, খনি আবিষ্কারের প্রত্যাশায়। এত বড়ো কাজের ভার আনাড়ি সিভিলিয়নকে না দেওয়াতে সেক্রেটেরিয়টের উপরিস্তরে বায়ুমণ্ডল বিক্ষুব্ধ হয়েছিল। দেবিকাপ্রসাদ শক্ত ধাতের লোক, বড়ো রাজার মন টল্‌মল্ করা সত্ত্বেও টিঁকে গেলুম।

 এখানে আসবার আগে মা বললেন, “ভালো কাজ পেয়েছ, এবার বাবা বিয়ে করো।”

 আমি বললুম, “অর্থাৎ, ভালো কাজ মাটি করো।”

 তার পরে বোবা পাথরকে প্রশ্ন করে করে বেড়াচ্ছিলুম পাহাড়ে জঙ্গলে। সে সময়টাতে পলাশফলের রাঙা রঙে বনে বনে নেশা লেগে গিয়েছে। শালগাছে অজস্র মঞ্জরী, মৌমাছিদের অনবরত গুঞ্জন। ব্যাবসাদারেরা মৌ সংগ্রহে লেগেছে, কুলের পাতা থেকে জমা করছে তসর-রেশমের গুটি, সাঁওতালরা কুড়চ্ছে পাকা মহয়া ফল। ঝির্‌ঝির্ শব্দে হালকা নাচের ওড়না ঘুরিয়ে চলেছিল একটি ছিপ্‌ছিপে নদী। শুনেছি এখানকার কোনো অধিবাসিনী তার নাম দিয়েছেন তনিকা। তাঁর কথা পরে হবে।

 দিনে দিনে বুঝতে পারছি এ জায়গাটা ঝিমিয়ে পড়া ঝাপসা চেতনার দেশ, এখানে একলা মনের সন্ধান পেলে প্রকৃতি মায়াবিনী তাকে নিয়ে রঙরেজিনীর কাজ করে, যেমন করে সে অস্তসূর্যের উত্তরীয়ে।

 মনটাতে একটু আবেশের ঘোর লাগছিল। ক্ষণে ক্ষণে ঢিলে হয়ে আসছিল কাজের চাল। নিজের উপর বিরক্ত হচ্ছিলুম, ভিতর থেকে কষে জোর লাগাচ্ছিলুম দাঁড়ে। ভয় হচ্ছিল ট্রপিকাল মাকড়সার জালে জড়িয়ে পড়ছি বুঝি। শয়তান ট্রপিক্‌স্ জন্মকাল থেকে এ দেশে হাতপাখার হাওয়ায় ডাইনে বাঁয়ে হারের মন্ত্র চালাচ্ছে আমাদের ললাটে, মনে-মনে পণ করছি এর স্বেদসিক্ত জাআদু এড়াতেই হবে।


বেলা পড়ে এল। এক জায়গায় মাঝখানে চর ফেলে নুড়ি পাথর ঠেলে ঠেলে দুই শাখায় ভাগ হয়ে চলে গিয়েছে নদী। সেই বালুর দ্বীপে স্তব্ধ হয়ে বসে আছে সারি সারি বকের দল। দিনাবসানে তাদের এই ছুটির ছবি দেখে রোজ় আমি চলে যাই আমার কাজের বাঁক ফেরাতে। ঝুলিতে মাটি পাথর অভ্রের টুকরো নিয়ে সেদিন ফিরছিলুম আমার বাংলাঘরে, ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষার কাজে। অপরাহ্ণ আর সন্ধ্যার মাঝখানে দিনের যে একটা ফালতো পোড়ো সময় থাকে সেইখানটাতে একলা মানুষের মন এলিয়ে পড়ে। তাই আমি নিজেকে চেতিয়ে রাখবার জন্যে এই সময়টা লাগিয়েছি পরখ করার কাজে। ডাইনামো দিয়ে বিজলি বাতি জ্বালাই—কেমিক্যাল নিয়ে, মাইক্রস্‌কোপ নিয়ে, নিক্তি নিয়ে বসি। এক-একদিন রাত দুপুর পেরিয়ে যায়।

 আজ একটা পুরোনো পরিত্যক্ত তামার খনির খবর পেয়ে দ্রুত উৎসাহে তারই সন্ধানে চলেছিলুম। কাকগুলো মাথার উপর দিয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে চলেছে ফিকে আলোর আকাশে কা কা শব্দে। অদূরে একটা ঢিবির উপরে তাদের পঞ্চায়েত বসবার পড়েছে হাঁকডাক।

 হঠাৎ বাধা পড়ল আমার কাজের রাস্তায়। পাঁচটা গাছের চক্রমণ্ডলী ছিল বনের পথের ধারে একটা উঁচু ডাঙার ’পরে। সেই বেষ্টনীর মধ্যে কেউ বসে থাকলে কেবল একটিমাত্র অবকাশে তাকে দেখা যায়, হঠাৎ চোখ এড়িয়ে যাবারই কথা। সেদিন মেঘের মধ্যে দিয়ে একটি আশ্চর্য দীপ্তি বিচ্ছুরিত হয়েছিল। সেই গাছগুলোর ফাঁকটার ভিতর দিয়ে রাঙা আলোর ছোরা চিরে ফেলেছিল ভিতরকার ছায়াটাকে।

 ঠিক সেই আলোর পথে বসে আছে মেয়েটি গাছের গুঁড়িতে হেলান দিয়ে, পা দুটি বুকের কাছে গুটিয়ে নিয়ে। পাশে ঘাসের উপর পড়ে আছে একখানা খাতা, বোধ হয় ডায়ারি।

 বুকের মধ্যে ধক্ করে উঠল, থমকিয়ে গেলুম। দেখলুম যেন বিকেলের ম্লান রৌদ্রে গড়া একটি সোনার প্রতিমা। চেয়ে রইলুম গাছের গাড়ির আড়ালে দাঁড়িয়ে। অপূর্ব ছবি এক মুহূর্তে চিহ্নিত হয়ে গেল মনের চিরস্মরণীয়াগারে।

 আমার বিস্তৃত অভিজ্ঞতার পথে অনেক অপ্রত্যাশিত মনোহরের দরজায় ঠেকেছে মন, পাশ কাটিয়ে চলে গেছি, আজ মনে হল জীবনের একটা কোন্ চরমের সংস্পর্শে এসে পৌঁছলুম। এমন করে ভাবা, এমন করে বলা আমার একেবারে অভ্যস্ত নয়। যে আঘাতে মানুষের নিজের অজানা একটা অপূর্ব স্বরূপ ছিটকিনি খুলে অবারিত হয়, সেই আঘাত আমাকে লাগল কী করে!

 অত্যন্ত ইচ্ছা করছিল ওর কাছে গিয়ে কথার মতো কথা একটা কিছু বলি। কিন্তু জানি নে কী কথা যে পরিচয়ের সব-প্রথম কথা, যে কথায় জানিয়ে দেবে খৃস্টীয় পুরাণের প্রথম সৃষ্টির বাণী— আলো হোক, ব্যক্ত হোক যা অব্যক্ত।

 আমি মনে মনে ওর নাম দিলুম—অচিরা। তার মানে কী? তার মানে এক মুহূর্তেই যার প্রকাশ, বিদ্যুতের মতো।

 এক সময়ে মনে হল অচিরা যেন জানতে পেরেছে কে একজন দাঁড়িয়ে আছে আড়ালে। স্তব্ধ উপস্থিতির একটা নিঃশব্দ শব্দ আছে বুঝি।

 একটু তফাতে গিয়ে কোমরবন্ধ থেকে ভুজালি নিয়ে একান্ত মনোযোগের ভান করে মাটি খোঁচাতে লাগলুম। ঝুলিতে যা-হয় কিছু দিলুম পুরে, গোটাকয়েক কাঁকরের ঢেলা। চলে গেলুম মাটির দিকে ঝুঁকে পড়ে কী যেন সন্ধান করতে করতে।

 কিন্তু নিশ্চয় মনে জানি যাঁকে ভোলাতে চেয়েছিলুম তিনি ভোলেন নি। মুগ্ধ পুরষচিত্তের বিহ্বলতার আরও অনেক দৃষ্টান্ত আরও অনেকবার তাঁর গোচর হয়েছে সন্দেহ নেই। আশা করলুম আমার বেলায় এটা তিনি উপভোগ করলেন, সকৌতুকে কিংবা সগর্বে, কিংবা হয়তো বা একটু মগ্ধ মনে। কাছে যাবার বেড়া যদি আর-একটু ফাঁক করতুম তা হলে কী জানি কী হত। রাগ করতেন, না রাগের ভান করতেন?

 অত্যন্ত চঞ্চল মনে চলেছি আমার বাংলাঘরের দিকে, এমন সময় চোখে পড়ল দুই টুকরোয় ছিন্ন করা একখানা চিঠির খাম। তাতে নাম লেখা ভবতোষ মজুমদার, আই. সি. এস., ছাপরা। তার বিশেষত্ব এই যে, এতে টিকিট আছে, কিন্তু সে টিকিটে ডাকঘরের ছাপ নেই। বুঝতে পারলুম ছোঁড়া চিঠির খামের মধ্যে একটা ট্র্যাজেডির ক্ষতচিহ্ন আছে। পৃথিবীর ছেঁড়া স্তর থেকে তার বিপ্লবের ইতিহাস বের করা আমার কাজ। সেই রকম কাজে লাগলুম ছেঁড়া খামটা নিয়ে।

 ইতিমধ্যে ভাবনা ধরিয়ে দিয়েছে আমার নিজের অন্তঃকরণটা। নিজের অপ্রমত্ত কঠিন মনটাকে চিনে নিয়েছি বলে স্পষ্ট ধারণা ছিল। আজ এই প্রথম দেখলুম তার পাশের পাড়াতেই লুকিয়ে বসে আছে বুদ্ধিশাসনের বহির্ভূত একটা অবোধ।

 নির্জন অরণ্যের সুগভীর কেন্দ্রস্থলে একটা নিবিড় সম্মোহন আছে যেখানে চলছে তার বুড়ো বুড়ো গাছপালার কানে কানে চক্রান্ত, যেখানে ভিতরে ভিতরে উচ্ছ্বসিত হচ্ছে সৃষ্টির আদিম প্রাণের মন্ত্রগুঞ্জরণ। দিনে দুপুরে ঝাঁ ঝাঁ করে ওঠে তার সুর উদাত্ত পর্দায়, রাতে দুপুরে তার মন্ত্রগম্ভীর ধ্বনি স্পন্দিত হতে থাকে জীবচেতনায়, বুদ্ধিকে দেয় আবিষ্ট করে। জিয়লজি-চর্চার ভিতরে ভিতরেই মনের আন্তর্ভৌম প্রদেশে ব্যাপ্ত হচ্ছিল এই আরণ্যক মায়ার কাজ। হঠাৎ স্পষ্ট হয়ে উঠে সে এক মুহূর্তে আমার দেহমনকে আবিষ্ট করে দিল, যখনই দেখলুম অচিরাকে কুসুমিত ছায়ালোকের পরিবেষ্টনে।

 বাঙালি মেয়েকে ইতিপূর্বে দেখেছি সন্দেহ নেই। কিন্তু তাকে এমন বিশুদ্ধ স্বপ্রকাশ স্বাতন্ত্র্যে দেখি নি। লোকালয়ে যদি এই মেয়েটিকে দেখতুম তা হলে যাকে দেখা যেত নানা লোকের সঙ্গে নানা সম্বন্ধে জড়িত বিমিশ্রিত, এ মেয়ে সে নয়; এ দেখা দিল পরিবিস্তৃত নির্জন সবুজ নিবিড়তার পরিপ্রেক্ষিতে একান্ত স্বকীয়তায়। মনে হল না বেণী দুলিয়ে এ কোনো কালে ডায়োসিশনে পর্সেণ্টেজ রাখতে গেছে, শাড়ির উপরে গাউন ঝুলিয়ে ডিগ্রি নিতে গেছে কন্‌ভোকেশনে, বালিগঞ্জে টেনিসপার্টিতে চা ঢালছে উচ্চ কলহাস্যে। অল্প বয়সে শুনেছি পুরোনো বাংলা গান ‘মনে রইল সই মনের বেদনা’— তারই সরল সুরের সঙ্গে মিশিয়ে চিরকালের বাঙালি মেয়ের একটা করুণ চেহারা আমি দেখতে পেতুম। অচিরাকে দেখে মনে হল সেইরকম বারোয়াঁ গানে তৈরি বাণীমূর্তি, যে গান রেডিয়োতে বাজে না, গ্রামোফোনে পাড়া মুখর করে না। এ দিকে আমার আপনার মধ্যে দেখলুম মনের নীচের তলাকার তপ্তবিগলিত একটা প্রদীপ্ত রহস্য হঠাৎ উপরের আলোতে উদ্‌গীর্ণ হয়ে উঠেছে।

 বুঝতে পারছি আমি যখন রোজ বিকেলে এই পথ দিয়ে কাজে ফিরেছি অচিরা আমাকে দেখেছে, অন্যমনস্ক আমি ওকে দেখি নি। নিজের চেহারা সম্বন্ধে যে বিশ্বাস এনেছি বিলেত থেকে, এই ঘটনা সম্পর্কে মনের মধ্যে তার প্রতিক্রিয়া যে হয় নি তা বলতে পারি নে। কিন্তু সন্দেহও ছিল। বিলেত-ফেরত কোনো কোনো বন্ধুর কাছে শুনেছি, বিলিতি মেয়ের রুচির সঙ্গে বাঙালি মেয়ের রুচি মেলে না। এরা পুরুষের রূপে খোঁজে মেয়েলি মোলায়েম ছাঁদ। বাঙালি কার্তিক আর যাই হোক কোনো কালে দেবসেনাপতি ছিল না। এটা বলতে হবে আমাকেও ময়ূরে চড়ালে মানাবে না। এতদিন এ-সব আলোচনা আমার মনের ধার দিয়েও যায় নি। কিন্তু কয়েক দিন ধরে আমাকে ভাবিয়েছে। রোদে পোড়া আমার রঙ, লম্বা আমার দেহ, শক্ত আমার বাহন, দ্রুত আমার চলন, নাক চিবুক কপাল নিয়ে খুব স্পষ্ট রেখায় আঁকা আমার চেহারা—আমি নবনীনিন্দিত কষিতকাঞ্চনকান্তি বাঙালি মায়ের আদরের ধন নই।

 আমার নিকটবর্তিনী বঙ্গনারীর সঙ্গে আমি মনে মনে ঝগড়া করেছি—একলা ঘরের কোণে বুক ফলিরে বলেছি, ‘তোমার পছন্দ পাই আর নাই পাই এ কথা নিশ্চয় জেনো তোমার দেশের চেয়ে বড়ো বড়ো দেশের স্বয়ম্বরসভার বরমাল্য উপেক্ষা করে এসেছি।’ এই বানানো ঝগড়ার উষ্মায় একদিন হেসে উঠেছি আপন ছেলেমানুষিতে। আবার এ দিকে বিজ্ঞানীর যুক্তিও কাজ করেছে ভিতরে ভিতরে। আপন মনে তর্ক করেছি, একান্ত নিভৃতে থাকাই যদি ওর প্রার্থনীয় তা হলে বারবার আমার সুস্পষ্ট দৃষ্টিপাত এড়িরে এতদিনে ও তো ঠাঁই বদল করত। কাজ সেরে এ পথ দিয়ে আগে যেতুম একবার মাত্র, আজকাল যখন-তখন যাতায়াত করি, যেন এই জায়গাটাতেই সোনার খনির খবর পেয়েছি। কখনও স্পষ্ট যখন চোখোচোখি হয়েছে আমার বিশ্বাস সেটাকে চার চোখের অপঘাত বলে ওর ধারণা হয় নি। এক-একদিন হঠাৎ পিছন ফিরে দেখেছি আমার তিরোগমনের দিকে অচিরা তাকিয়ে আছে, ধরা পড়তেই দ্রুত চোখ ফিরিয়ে নিয়েছে।

 তথ্যসংগ্রহের কাজে লাগলাম। পাটনা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার কেম্‌ব্রিজের সতীর্থ প্রোফেসর আছেন বঙ্কিম। তাঁকে চিঠি লিখলুম, ‘তোমাদের বেহার সিভিল সার্ভিসে আছেন এক ভদ্রলোক, নাম ভবতোষ। আমার কোনো বন্ধু তাঁর মেয়ের জন্যে লোকটিকে উদ্‌বাহবন্ধনে জড়াবার দুষ্কর্মে সাহায্য করতে আমাকে অনুরোধ করেছেন। জানতে চাই রাস্তা খোলসা কি না, আর লোকটার মতিগতি কী রকম।’

 উত্তর এল, ‘পাকা দেয়াল তোলা হয়ে গেছে, রাস্তা বন্ধ। তার পরেও লোকটার মতিগতি সম্বন্ধে যদি কৌতূহল থাকে তবে শোনো।— এ দেশে থাকতে আমি যাঁর ছাত্র ছিলুম তাঁর নাম নাই জানলে। তিনি পরম পণ্ডিত আর ঋষিতুল্য লোক। তাঁর নাতনিটিকে যদি দেখ তা হলে জানবে সরস্বতী কেবল যে আবির্ভূত হয়েছেন অধ্যাপকের বিদ্যামন্দিরে তা নয়, তিনি দেহ নিয়ে এসেছেন তাঁর কোলে। এমন বুদ্ধিতে উজ্জ্বল অপরূপ সুন্দর চেহারা কখনও দেখি নি।

 ‘ভবতোষ ঢুকল শয়তান তাঁর স্বর্গলোকে। স্বল্পজল নদীর মতো বুদ্ধি তার অগভীর ব’লেই জ্বল্ জ্বল্ করে আর সেই জন্যেই তার বচনের ধারা অনর্গল। ভুললেন অধ্যাপক, ভুললেন নাতনি। রকসকম দেখে আমাদের তো হাত নিস্‌পিস্ করতে থাকত। কিছু বলবার পথ ছিল না—বিবাহের সম্বন্ধ পাকাপাকি, বিলেত গিয়ে সিভিলিয়ান হয়ে আসবে তারই ছিল অপেক্ষা। তারও পাথেয় এবং খরচ জুগিয়েছেন কন্যার পিতা। লোকটার সর্দির ধাত, একান্ত মনে কামনা করেছিলাম ন্যুমোনিয়া হবে। হয় নি। পাস করলে পরীক্ষায়; দেশে ফেরবামাত্রই বিয়ে করলে ইন্‌ডিয়া গবর্মে‌ণ্টের উচ্চপদস্থ মুরুব্বির মেয়েকে। লোকসমাজে নাতনির লজ্জা বাঁচাবার জন্যে মর্মাহত অধ্যাপক কোথায় অন্তর্ধান করেছেন জানি নে। অনতিকালের মধ্যে ভবতোষের অপ্রত্যাশিত পদোন্নতির সংবাদ এল। মস্ত একটা বিদায়ভোজের আয়োজন হল। শুনেছি খরচটা দিয়েছে ভবতোষ গোপনে নিজের পকেট থেকে। আমরাও নিজের পকেট থেকেই খরচ দিয়ে গুণ্ডা লাগিয়ে ভোজটা দিলুম লণ্ডভণ্ড করে। কাগজে কংগ্রেসওয়ালাদের প্রতিই সন্দেহ প্রকাশ করেছিল ভবতোষেরই ইশারায়। আমি জানি এই সৎকার্যে তারা লিপ্ত ছিল না। যে নাগরা জুতো লেগেছিল পলায়মানের পিঠে, সেটা অধ্যাপকেরই এক প্রাক্তন ছাত্রের প্রশস্ত পায়ের মাপে। পুলিস এল গোলমালের অনেক পরে—ইনস্পেক্টর আমার বন্ধু, লোকটা সহৃদয়।’

 চিঠিখানা পড়লুম, প্রাক্তন ছাত্রটির প্রতি ঈর্ষা হল।


অচিরার সঙ্গে প্রথম কথাটি শুরু করাই সব চেয়ে কঠিন কাজ। আমি বাঙালি মেয়েকে ভয় করি। বোধ করি চেনা নেই বলেই। অথচ কাজে যোগ দেব কিছু আগেই কলকাতায় কাটিয়ে এসেছি। সিনেমামঞ্চপথবর্তিনী বাঙালি মেয়ের নতুন-চাষ-করা ভ্রূবিলাস দেখে তো স্তম্ভিত হয়েছি— তারা সব জাতবান্ধবী—থাক্ তাদের কথা। কিন্তু অচিরাকে দেখলুম এ কালের ঠেলাঠেলি ভিড়ের বাইরে—নির্মল আত্মমর্যাদায়, স্পর্শভীরু মেয়ে।

 আমি তাই ভাবছি প্রথম কথাটি শুরু করব কী করে।

 জনরব এই-যে কাছাকাছি ডাকাতি হয়ে গেছে। ভাবলুম, হিতৈষী হয়ে বলি ‘রাজা-বাহাদুরকে বলে আপনার জন্যে পাহারার বন্দোবস্ত করে দিই।’ ইংরেজ মেয়ে হলে হয়তো গায়ে-পড়া আনুকূল্য সইতে পারত না, মাথা বাঁকিয়ে বলত ‘সে ভাবনা আমার’। এই বাঙালি মেয়ে অচেনার কাছ থেকে কী ভাবে কথাটা নেবে আমার জানা নেই, হয়তো আমাকেই ডাকাত বলে সন্দেহ করবে।

 ইতিমধ্যে একটা ঘটনা ঘটল সেটা উল্লেখযোগ্য।

 দিনের আলো প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। অচিরার সময় হয়েছে ঘরে ফেরবার। এমন সময়ে একটা হিন্দুস্থানী গোঁয়ার এসে তার হাত থেকে তার খাতা আর থলিটা নিয়ে যখন ছুটেছে আমি তখনই বনের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে বললুম, “কোনো ভয় নেই আপনার।” এই ব’লে ছুটে সেই লোকটার ঘাড়ের উপর পড়তেই সে ব্যাগ খাতা ফেলে দৌড় মারলে। আমি লুঠের মাল নিয়ে এসে অচিরাকে দিলুম। অচিরা বললে, “ভাগ্যিস আপনি—”

 আমি বললেম, “আমার কথা বলবেন না, ভাগ্যিস ঐ লোকটা এসেছিল।”

 “তার মানে!”

 “তার মানে তারই কৃপায় আপনার সঙ্গে আমার প্রথম আলাপ হয়ে গেল।”

 অচিরা বিস্মিত হয়ে বললে, “কিন্তু ও যে ডাকাত!”

 “এমন অন্যায় অপবাদ দেবেন না। ও আমার বরকন্দাজ, রামশরণ।”

 অচিরা মুখের উপর খয়েরি রঙের আঁচল টেনে নিয়ে খিল্‌খিল্ করে হেসে উঠল। হাসি থামতে চায় না। কী মিষ্টি তার ধ্বনি। যেন ঝর্‌নার নীচে নুড়িগলো ঠন্‌ঠুন্ করে উঠল সুরে সুরে। হাসি-অবসানে সে বললে, “কিন্তু সত্যি হলে খুব মজা হত।”

 “মজা কার পক্ষে?”

 “যাকে নিয়ে ডাকাতি।”

 “আর উদ্ধারকর্তার?”

 “বাড়ি নিয়ে গিয়ে তাকে এক পেয়ালা চা খাইয়ে দিতুম আর গোটা দুয়েক স্বদেশী বিস্কুট।”

 “আর এই ফাঁকি উদ্ধারকর্তার কী হবে।”

 “যে রকম শোনা গেল তাঁর তো আর কিছুতে দরকার নেই, কেবল প্রথম কথাটা।”

 “ঐ প্রথম পদক্ষেপেই গণিতের অগ্রগতিটা কি বন্ধ হবে।”

 “কেন হবে। ওকে চালাবার জন্যে বরকন্দাজের সাহায্য দরকার হবে না।”

 বসলুম সেখানেই ঘাসের উপরে। একটা কাটা গাছের গুঁড়ির উপরে বসে ছিল অচিরা। আমি জিজ্ঞাসা করলুম, “আপনি হলে আমাকে প্রথম কথাটা কী বলতেন।”

 “বলতুম রাস্তায় ঘাটে ঢেলা কুড়িয়ে কুড়িয়ে করছেন কী। আপনার কি বয়স হয় নি।”

 “বলেন নি কেন।”

 “ভয় করেছিল।”

 আমাকে ভয় কিসের।”

 “আপনি যে মস্ত লোক, দাদুর কাছে শুনেছি। তিনি আপনার লেখা প্রবন্ধ বিলিতি কাগজে পড়েছেন। তিনি যা পড়েন আমাকে শোনাতে চেষ্টা করেন।”

 “এটাও কি করেছিলেন।”

 “নিষ্ঠুর তিনি করেছিলেন। লাটিন শব্দের ভিড় দেখে জোড়হাত করে তাঁকে বলেছিলাম, ‘দাদু, এটা থাক্। বরঞ্চ তোমার সেই কোয়াণ্টম থিয়োরির বইখানা খোলো।”

 “সে থিয়োরিটা বাঝি আপনার জানা আছে?”

 “কিছুমাত্র না। কিন্তু দাদুর দৃঢ় বিশ্বাস সবাই সব কিছু বুঝতে পারে। আর তাঁর অদ্ভুত এই একটা ধারণা যে, মেয়েদের বুদ্ধি পুরুষদের বুদ্ধির চেয়ে বেশি তীক্ষ্ণ। তাই ভয়ে ভয়ে আছি অবিলম্বে আমাকে ‘টাইম্‌স্পেস’এর জোড়মিলনের ব্যাখ্যা শুনতে হবে। দিদিমা যখন বেঁচে ছিলেন, দাদু বড়ো বড়ো কথা পাড়লেই তিনি মুখ বন্ধ করে দিতেন; এটাই যে মেয়েদের বুদ্ধির প্রমাণ, দাদু কিন্তু সেটা বোঝেন নি।”

 অচিরার দুই চোখ স্নেহে আর কৌতুকে ছল্‌ছল্, জ্বল্‌জ্বল্ করে উঠল।

 দিনের আলো নিঃশেষ হয়ে এল। সন্ধ্যায় প্রথম তারা জ্বলে উঠেছে একটা একলা, তালগাছের মাথার উপরে। সাঁওতাল মেয়েরা ঘরে চলেছে জ্বালানি কাঠ সংগ্রহ ক’রে, দূর থেকে শোনা যাচ্ছে তাদের গান।

 এমন সময় বাইরে থেকে ডাক এল, “কোথায় তুমি। অন্ধকার হয়ে এল যে! আজকাল সময় ভালো নয়।”

 অচিরা উত্তর দিল, “সে তো দেখতেই পাচ্ছি। তাই জন্যে একজন ভলণ্টিয়র নিযুক্ত করেছি।”

 আমি অধ্যাপকের পায়ের ধুলো নিয়ে প্রণাম করলুম। তিনি শশব্যস্ত হয়ে উঠলেন। আমি পরিচয় দিলুম, “আমার নাম শ্রীনবীনমাধব সেনগুপ্ত।”

 বৃদ্ধের মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বললেন, “বলেন কী। আপনিই ডাক্তার সেনগুপ্ত? কিন্তু আপনাকে যে বড়ো ছেলেমানুষ দেখাচ্ছে।”

 আমি বললুম, “ছেলেমানুষ না তো কী। আমার বয়স এই ছত্রিশের বেশি নয়— সাঁইত্রিশে পড়ব।”

 আবার অচিরার সেই কলমধুর কণ্ঠের হাসি। আমার মনে যেন দূন লয়ের ঝংকারে সেতার বাজিয়ে দিল। বললে, “দাদর কাছে সবাই ছেলেমানুষ। আর উনি নিজে সব ছেলেমানুষের আগরওয়াল।”

 অধ্যাপক হেসে বললেন, “আগরওয়াল, ভাষায় নতুন শব্দের আমদানি!”

 অচিরা বললে, “মনে নেই? সেই যে তোমার মাড়োয়াড়ি ছাত্র কুন্দনলাল আগরওয়ালা, আমাকে এনে দিত বোতলে করে কাঁচা আমের চাট্‌নি— তাকে জিগ্‌গেসা করেছিলুম আগরওয়াল শব্দের অর্থ কী, সে ফস্ করে বলে দিল পায়োনিয়র।”

 অধ্যাপক বললেন, “ডাক্তার সেনগুপ্ত, আপনার সঙ্গে আলাপ হল যদি, আমাদের ওখানে খেতে যেতে হবে তো।”

 “কিছু বলতে হবে না দাদু, যাবার জন্যে ওঁর মন লাফালাফি করছে। আমি যে এইমাত্র ওঁকে বলে দিয়েছি দেশকালের মিলনতত্ত্ব তুমি ব্যাখ্যা করবে।”

 মনে মনে বললুম, ‘বাস্ রে, কী দুষ্টমি।’

 অধ্যাপক উৎসাহিত হয়ে বলে উঠলেন, “আপনার বুঝি টাইম-ম্পেস’এর—”

 আমি ব্যস্ত হয়ে বলে উঠলুম, “কিছু, জানা নেই— বোঝাতে গেলে আপনার বৃথা সময় নষ্ট হবে।”

 বৃদ্ধ ব্যগ্র হয়ে বলে উঠলেন, “এখানে সময়ের অভাব কোথায়। আচ্ছা, এক কাজ করন-না, আজই চলুন আমার ওখানে আহার করবেন।”

 আমি লাফ দিয়ে বলতে যাচ্ছিলুম, ‘এখ্‌খনি।’ অচিরা বলে উঠল, “দাদু, সাথে তোমাকে বলি ছেলেমানুষ? যখন খুশি নেমন্তন্ন করে ফেল, আমি পড়ি মুশকিলে। ওঁরা বিলেতের ডিনার-খাইরে সর্বগ্রাসী মানুষ, কেন তোমার নাতনির বদনাম করবে!”

 অধ্যাপক ধমক-খাওয়া বালকের মতো বললেন, “আচ্ছা, তবে আর কোন্ দিন আপনার সুবিধে হবে বলুন।”

 “সুবিধে আমার কালই হতে পারবে কিন্তু অচিরাদেবীকে রসদ নিয়ে বিপন্ন করতে চাই নে। পাহাড়ে পর্বতে ঘুরি, সঙ্গে রাখি থলি ভরে চিঁড়ে, ছড়া কয়েক কলা, বিলিতি-বেগুন, কাঁচা ছোলার শাক, চিনেবাদাম। আমিই বরঞ্চ সঙ্গে নিয়ে আসব ফলারের আয়োজন। অচিরাদেবী যদি স্বহস্তে দই দিয়ে মেখে দেন লজ্জা পাবে ফিরপোর দোকান।”

 “দাদু, বিশ্বাস কোরো না এই-সব মুখমিষ্টি লোককে। উনি নিশ্চয় পড়েছেন তোমার সেই লেখাটা বাংলা কাগজে, সেই ভিটামিনের গুণপ্রচার। তাই তোমাকে খুশি করবার জন্যে শোনালেন চিঁড়েকলার ফর্দ।”

 মুশকিলে ফেললে। বাংলা কাগজ পড়া তো আমার ঘ’টেই ওঠে না।

 অধ্যাপক উৎফুল্ল হয়ে জিগ্‌গেসা করলেন, “সেটা পড়েছেন বুঝি?”

 অচিরার চোখের কোণে দেখতে পেলাম একটা হাসি। তাড়াতাড়ি শব্দ করে দিলাম, “পড়ি আর নাই পড়ি তাতে কিছু আসে যায় না, কিন্তু আসল কথাটা হচ্ছে—”

 আসল কথাটা আর হাতড়ে পাই নে।

 অচিরা দয়া করে ধরিয়ে দিলে, “আসল কথা উনি নিশ্চিত জানেন, কাল যদি তোমার ওখানে নেমন্তন্ন জোটে তা হলে ওঁর পাতে পশুপক্ষী স্থাবরজঙ্গম কিছুই বাদ যাবে না। তাই অত নিশ্চিন্ত মনে বিলিতি-বেগুনের নামকীর্তন করলেন। দাদু, তুমি সবাইকে অত্যন্ত বেশি বিশ্বাস কর, এমন-কি, আমাকেও। সেইজন্যেই ঠাট্টা করে তোমাকে কিছু বলতে সাহস হয় না।”

 কথা বলতে বলতে ধীরে ধীরে ওঁদের বাড়ির দিকে এগিয়ে চলেছি এমন সময় অচিরা হঠাৎ আমাকে বলে উঠল, “বাস্, আর নয়— এইবার যান বাসার ফিরে।”

 আমি বললুম, “দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দেব।”

 অচিরা বললে, “সর্বনাশ! দরজা পেরলেই আলুথালু, উচ্ছৃঙ্খলতা, আমাদের দুজনের সম্মিলিত রচনা। আপনি অবজ্ঞা করে বলবেন বাঙালি মেয়েরা অগোছালো। একটু সময় দিন, কাল দেখলে মনে হবে শ্বেতদ্বীপের শ্বেতভূজার অপূর্ব কীর্তি, মেমসাহেবী সৃষ্টি।”

 অধ্যাপক কিছু কুণ্ঠিত হয়ে আমাকে বললেন, “আপনি কিছু মনে করবেন না— দিদি বড়ো বেশি কথা কচ্ছে। কিন্তু ওটা ওর স্বভাব নয় মোটে। এখানে অত্যন্ত নির্জন, তাই ও আমার মনের ফাঁক ভরে রেখে দেয় কথা কয়ে। সেটা ওর অভ্যেস হয়ে যাচ্ছে। ও যখন চুপ করে থাকে ঘরটা ছম্‌ছম্ করতে থাকে, আমার মনটাও। ও নিজে জানে না সে কথা। আমার ভয় হয় পাছে বাইরের লোকে ওকে ভুল বোঝে।”

 বুড়োর গলা জড়িয়ে ধরে অচিরা বললে, “বুঝুক-না দাদু! অত্যন্ত অনিন্দনীয়া হতে চাই নে, সেটা অত্যন্ত আন্‌ইণ্টারেস্টিঙ্‌।”

 অধ্যাপক সগর্বে বলে উঠলেন, “আমার দিদি কিন্তু কথা বলতে জানে, অমন আর কাউকে দেখি নি।”

 “তুমিও আমার মতো কাউকে দেখ নি, আমিও কাউকে দেখি নি তোমার মতো।”

 আমি বললাম, “আচার্যদেব, আজ বিদায় নেবার পূর্বে আমাকে একটা কথা দিতে হবে।”

 “আচ্ছা বেশ।”

 “আপনি যতবার আমাকে আপনি বলেন, আমি মনে-মনে ততবার জিভ কাটি। আমাকে দয়া করে তুমি বলে যদি ডাকেন তা হলে মন সহজে সাড়া দেবে। আপনার নাতনিও সহকারিতা করবেন।”

 অচিরা দুই হাত নেড়ে বললে, “অসম্ভব, আরও কিছুদিন যাক। সর্বদা দেখাশানো হতে হতে বড়োলোকের তিলকলাঞ্ছন যখন ঘষা পয়সার মতো পালিশ করা হয়ে যাবে তখন সবই সম্ভব হবে। দাদুর কথা স্বতন্ত্র। আমি বরঞ্চ ওঁকে পড়িয়ে নিই। বলো তো দাদু, ‘তুমি কাল খেতে এসো। দিদি যদি মাছের ঝোলে নুন দিতে ভোলে, মুখ না বেঁকিয়ে বোলো, কী চমৎকার। বোলো, সবটা আমারই পাতে দেওয়া ভালো, অন্যরা এরকম রান্না তো প্রায়ই ভোগ করে থাকেন।’”

 অধ্যাপক সস্নেহে আমার কাঁধে হাত দিয়ে বললেন, “ভাই, তুমি বুঝতে পারবে না আসলে এই মেয়েটি লাজুক, তাই যখন আলাপ করা কর্তব্য মনে করে তখন সংকোচ ঠেলে উঠতে গিয়ে কথা বেশি হয়ে পড়ে।”

 “দেখেছেন ডক্টর সেনগুপ্ত? দাদু আমাকে কী রকম মধুর করে শাসন করেন। অনায়াসে বলতে পারতেন, তুমি বড়ো মুখরা, তোমার বকুনি অসহ্য। আপনি কিন্তু আমাকে ডিফেন্‌ড্ করবেন। কী বলবেন বলুন তো।”

 “আপনার মুখের সামনে বলব না।”

 “বেশি কঠোর হবে?”

 “আপনি মনে-মনেই জানেন।”

 “থাক্ থাক্‌, তা হলে বলে কাজ নেই। বাড়ি যান।”

 আমি বললুম, “তার আগে সব কথাটা শেষ করে নিই। কাল আপনাদের ওখানে আমার নেমতন্নটা নামকর্তন অনুষ্ঠানের। কাল থেকে নবীনমাধব নামটা থেকে কাটা পড়বে ডাক্তার সেনগুপ্ত। সূর্যের কাছাকাছি এলে ধূমকেতুর কেতুটা পায় লোপ, মুণ্ডুটা থাকে বাকি।”


এইখানে শেষ হল আমার বড়োদিন। দেখলাম বার্ধক্যের কী সৌম্যসুন্দর মূর্তি। পালিশ-করা লাঠি হাতে, গলায় শুভ্র পাট-করা চাদর, ধুতি যত্নে কোঁচানো, গারে তসরের জামা, মাথায় শুভ্র চুল বিরল হয়ে এসেছে কিন্তু পরিপাটি করে আঁচড়ানো। স্পষ্ট বোঝা যায় নাতনির হাতের শিল্পকার্য এঁর বেশভূষণে, এঁর দিনযাত্রায়। অতিলালনের অত্যাচার ইনি সস্নেহে সহ্য করেন, খুশি রাখবার জন্যে নাতনিটিকে।

 এই গল্পের পক্ষে অধ্যাপকের ব্যবহারিক নাম অনিলকুমার সরকার। তিনি গত জেনেরেশনের কেম্‌ব্রিজের-বড়োপদবী-ধারী। মাস আষ্টেক আগে কোনো কলেজের অধ্যক্ষপদ ত্যাগ করে এখানকার এস্টেটের একটা পোড়ো বাড়ি ভাড়া নিয়ে নিজের খরচে সেটা বাসযোগ্য করেছেন।

অন্তপর্ব

আমার গল্পের আদিপর্ব হল শেষ। ছোটো গল্পের আদি ও অন্তের মাঝখানে বিশেষ একটা ছেদ থাকে না— ওর আকৃতিটা গোল।

 অচিরার সঙ্গে আমার অপরিচয়ের ব্যবধান ক্ষয় হয়ে আসছে। কিন্তু মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে যেন পরিচয়টাই ব্যবধান। কাছাকাছি আসছি বটে কিন্তু তাতে একটা প্রতিঘাত জাগছে। কেন। অচিরার প্রতি আমার ভালোবাসা ওর কাছে স্পষ্ট হয়ে আসছে, অপরাধ কি তারই মধ্যে। কিংবা আমার দিকে ওর সৌহৃদ্য স্ফুটতর হয়ে উঠছে, সেইটেতেই ওর গ্লানি? কে জানে।

 সেদিন চড়িভাতি তনিকা নদীর তীরে।

 অচিরা ডাক দিলে, “ডাক্তার সেনগুপ্ত!”

 আমি বললুম, “সেই প্রাণীটার কোনো ঠিকানা নেই, সুতরাং কোনো জবাব মিলবে না।”

 “আচ্ছা, তা হলে নবীনবাবু।”

 “সেও ভালো, যাকে বলে মন্দর ভালো।”

 “কাণ্ডটা কী দেখলেন তো?”

 আমি বললুম, “আমার সামনে লক্ষ্য করবার বিষয় কেবল একটিমাত্রই ছিল, আর কিছুই ছিল না।”

 এইটুকু ঠাট্টায় অচিরা সত্যই বিরক্ত হয়ে বললে, “আপনার আলাপ ক্রমেই যদি অমন ইশারাওয়ালা হয়ে উঠতে থাকে তা হলে ফিরিয়ে আনব ডাক্তার সেনগুপ্তকে, তাঁর স্বভাব ছিল গম্ভীর।”

 আমি বললাম, “আচ্ছা, তা হলে কাণ্ডটা কী হয়েছিল বলুন।”

 “ঠাকুর যে ভাত রেঁধেছিল সে কড়কড়ে, আদ্ধেক তার চাল। আমি বললুম, ‘দাদু, এ তো তোমার চলবে না।’ দাদু অমনি বলে বসলেন, ‘জান তো ভাই, খাবার জিনিস শক্ত হলে ভালো করে চিবোবার দরকার হয়, তাতেই হজমের সাহায্য করে।’ পাছে আমি দুঃখ করি দাদুর জেগে উঠল সায়েন্সের বিদ্যে। নিমকিতে নতুনের বদলে যদি চিনি দিত তা হলে নিশ্চয় দাদু বলত, চিনিতে শরীরের এনার্জি বাড়িয়ে দেয়।—

 “দাদু, ও দাদু, তুমি ওখানে বসে বসে কী পড়ছ। আমি যে এ দিকে তোমার চরিত্রে অতিশয়োক্তি-অলংকার আরোপ করছি, আর নবীনবাবু সমস্তই বেদবাক্য বলে বিশ্বাস করে নিচ্ছেন।”

 কিছু দূরে পোড়ো মন্দিরের সিঁড়ির উপরে বসে অধ্যাপক বিলিতি ত্রৈমাসিক পড়ছিলেন। অচিরার ডাক শুনে সেখান থেকে উঠে আমাদের কাছে বসলেন। ছেলেমানুষের মতো হঠাৎ আমাকে জিগ্‌গেসা করলেন, “আচ্ছা নবীন, তোমার কি বিবাহ হয়েছে।”

 কথাটা এতই সুস্পষ্টভাবব্যঞ্জক যে আর কেউ হলে বলত না, কিংবা ঘুরিয়ে বলত।

 আমি আশাপ্রদ ভাষায় উত্তর দিলাম, “না, এখনও হয় নি।”

 অচিরার কাছে কোনো কথা এড়ায় না। সে বললে, “ঐ এখনও শব্দটা সংশয়গ্রস্ত কন্যাকর্তাদের মনকে সান্ত্বনা দেবার জন্যে, ওর কোনো যথার্থ অর্থ নেই।”

 “একেবারেই নেই নিশ্চিত ঠাওরালেন কী করে।”

 “ওটা গণিতের প্রব্লেম, সেও হাইয়ার ম্যাথ্‌ম্যাটিক্‌স্ নয়। পূর্বেই শোনা গেছে আপনি ছত্রিশ বছরের ছেলেমানুষ। হিসেব করে দেখলাম এর মধ্যে আপনার মা অন্তত পাঁচ-সাত-বার বলেছেন, ‘বাবা, ঘরে বউ আনতে চাই।’ আপনি জবাব করেছেন, ‘তার পূর্বে ব্যাঙ্কে টাকা আনতে চাই।’ মা চোখের জল মুছে চুপ করে রইলেন, তার পরে মাঝখানে আপনার আর-সব ঘটেছিল— কেবল ফাঁসি ছিল বাকি। শেষকালে এখানকার রাজসরকারে মোটা মাইনের কাজ জুটল। মা বললেন, ‘এইবার বউ নিয়ে এসো ঘরে। বড়ো কাজ পেয়েছ।’ আপনি বললেন, ‘বিয়ে করে সে কাজ মাটি করতে পারব না।’ আপনার ছত্রিশ বছরের গণিতফল গণনা করতে ভুল হয়েছে কি না বলুন।”

 এ মেয়ের সঙ্গে অনবধানে কথা বলা নিরাপদ নয়। কিছুদিন আগেই আমার একটা পরীক্ষা হয়ে গেছে। কথায় কথায় অচিরা আমাকে বলেছিল, “আমাদের দেশের মেয়েরা আপনাদের সংসারের সঙ্গিনী হতে পারে কিন্তু বিলেতে যারা জ্ঞানের তাপস তাদের তপস্যার সঙ্গিনী তো জোটে যেমন ছিলেন অধ্যাপক কুরির সধর্মিণী মাদাম কুরি। আপনার কি তেমন কেউ জোটে নি।”

 মনে পড়ে গেল ক্যাথারিনকে। সে একই কালে আমার বিজ্ঞানের এবং জীবনযাত্রার সাহচর্য করতে চেয়েছিল।

 অচিরা জিগ্‌গেসা করলে, “আপনি কেন তাঁকে বিয়ে করতে চাইলেন না।”

 কী উত্তর দেব ভাবছিলাম—অচিরা বললে, “আমি জানি কেন। আপনার সত্যভঙ্গ হবে এই ভয় ছিল; নিজেকে আপনার মুক্ত রাখতেই হবে। আপনি যে সাধক। আপনি তাই নিষ্ঠুর, নিষ্ঠুর নিজের প্রতি, নিষ্ঠুর তার ’পরে যে আপনার পথের সামনে আসে। এই নিষ্ঠুরতায় আপনার বীরত্ব দৃঢ়প্রতিষ্ঠিত।”

 কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আবার সে বললে, “বাংলা সাহিত্য বোধ হয় আপনি পড়েন না। কচ ও দেবযানী বলে একটা কবিতা আছে। তার শেষ কথাটা এই, মেয়েদের ব্রত পুরুষকে বাঁধা আর পুরুষের ব্রত মেয়ের বাঁধন কাটিয়ে স্বর্গলোকের রাস্তা বানানো। কচ বেরিয়ে পড়েছিল দেবযানীর অনুরোধ এড়িয়ে, আর আপনি মায়ের অনুনয়— একই কথা।”

 আমি বললুম, “দেখন, আমি হয়তো ভুল করেছিলাম। মেয়েদের নিয়ে পুরুষের কাজ যদি না চলে, তা হলে মেয়েদের সৃষ্টি কেন।”

 অচিরা বললে, “বারো-আনার চলে মেয়েরা তাদের জন্যেই। কিন্তু বাকি মাইনরিটি, যারা সব-কিছু পেরিয়ে নতুন পথের সন্ধানে বেরিয়েছে, তাদের চলে না। সব-পেরোবার মানষকে মেয়েরা যেন চোখের জল ফেলে রাস্তা ছেড়ে দেয়। যে দুর্গম পথে মেয়ে-পুরুষের চিরকালের দ্বন্দ্ব সেখানে পুরুষেরা হোক জয়ী। যে মেয়েরা মেয়েলি, প্রকৃতির বিধানে তাদের সংখ্যা অনেক বেশি, তারা ছেলে মানুষ করে, সেবা করে ঘরের লোকের। যে পুরুষ যথার্থ পুরুষ, তাদের সংখ্যা খুব কম; তারা অভিব্যক্তির শেষ কোঠায়। মাথা তুলছে দুটি-একটি করে। মেয়েরা তাদের ভয় পায়, বুঝতে পারে না, টেনে আনতে চায় নিজের অধিকারের গণ্ডিতে। এই তত্ত্ব শুনেছি আমার দাদুর কাছে।—

 “দাদু, তোমার পড়া রেখে আমার কথা শোনো। মনে আছে?—তুমি একদিন বলেছিলে, পুরুষ যেখানে অসাধারণ সেখানে সে নিরতিশয় একলা, নিদারুণ তার নিঃসঙ্গতা, কেননা তাকে যেতে হয় যেখানে কেউ পৌঁছয় নি। আমার ডায়ারিতে লেখা আছে।”

 অধ্যাপক মনে করবার চেষ্টা করে বললেন, “বলেছিলুম নাকি। হয়তো বলেছিলুম।”

 অচিরা খুব বড়ো কথাও কয় হাসির ছলে, আজ সে অত্যন্ত গম্ভীর।

 খানিক বাদে আবার সে বললে, “দেবযানী কচকে কী অভিসম্পাত দিয়েছিল জানেন?”

 “না।”

 “বলেছিল, তোমার সাধনায় পাওয়া বিদ্যা তোমার নিজের ব্যবহারে লাগাতে পারবে না। যদি এই অভিসম্পাত আজ দিত দেবতা য়ুরোপকে, তা হলে য়ুরোপ বেঁচে যেত। বিশ্বের জিনিসকে নিজের মাপে ছোটো করেই ওখানকার মানুষ মরছে লোভের তাড়ায়।— সত্যি কি না বলো দাদু!”

 “খুব সত্যি, কিন্তু এত কথা কী করে ভাবলে।”

 “নিজের বুদ্ধিতে না। একটা তোমার মহদ্‌গুণ আছে, কখন কাকে কী যে বল, ভোলানাথ তুমি সব ভুলে যাও। তাই চোরাই মালের উপর নিজের ছাপ লাগিয়ে দিতে ভাবনা থাকে না।”

 আমি বললুম, “নিজের ছাপ যদি লাগে তা হলেই অপরাধ খণ্ডন হয়।”

 “জানেন, নবীনবাবু, ওঁর কত ছাত্র ওঁর কত মুখের কথা খাতায় টুকে নিয়ে বই লিখে নাম করেছে? উনি তাই পড়ে আশ্চর্য হয়ে প্রশংসা করেছেন, বুঝতেই পারেন নি নিজের প্রশংসা নিজেই করছেন। কোন কথা আমার কথা আর কোন কথা ওঁর নিজের, সে ওঁর মনে থাকে না— লোকের সামনে আমাকে বলে বসেন ওরিজিন্যাল, তখন সেটার প্রতিবাদ করার মতো মনের জোর পাওয়া যায় না। স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি নবীনবাবরও এ ভ্রম ঘটছে।—কী করব বলো, আমি তো কোটেশনমার্কা দিয়ে দিয়ে কথা বলতে পারি নে।”

 “নবীনবাবুর এ ভ্রম কোনোদিন ঘুচবে না।”

 অচিরা বললে, “দাদু একদিন আমাদের কলেজ-ক্লাসে কচ ও দেবযানীর ব্যাখ্যা করছিলেন। কচ হচ্ছে পুরুষের প্রতীক, আর দেবযানী মেয়ের। সেই দিন নির্মম পুরুষের মহৎ গৌরব মনে-মনে মেনেছি, মুখে কখ্‌খনো স্বীকার করি নে।”

 অধ্যাপক বললেন, “কিন্তু দিদি, আমার কোনো কথায় মেয়েদের গৌরবের আমি কোনোদিন লাঘব করি নি।”

 “তুমি আবার করবে! হায় রে! মেয়েদের তুমি যে অন্ধ ভক্ত। তোমার মুখের স্তবগান শুনে মনে-মনে হাসি। মেয়েরা নির্লজ্জ হয়ে সব মেনে নেয়। তার উপরেও বুক ফলিয়ে সতীসাধ্বীগিরির বড়াই করে নিজের মুখে। সস্তায় প্রশংসা আত্মসাৎ করা ওদের অভ্যেস হয়ে গেছে।”

 অধ্যাপক বললেন, “না দিদি, অবিচার কোরো না। অনেক কাল ওরা হীনতা সহ্য করেছে, হয়তো সেই জন্যেই নিজেদের শ্রেষ্ঠতা নিয়ে একটু বেশি জোর দিয়ে তর্ক করে।”

 “না দাদু, ও তোমার বাজে কথা। আসল হচ্ছে এটা স্ত্রীদেবতার দেশ—এখানে পুরুষেরা স্ত্রৈণ, মেয়েরাও স্ত্রৈণ। এখানে পুরুষেরা কেবলই ‘মা মা’ করছে, আর মেয়েরা চিরশিশুদের আশ্বাস দিচ্ছে যে তারা মায়ের জাত। আমার তো লজ্জা করে। পশুপক্ষীদের মধ্যেও মায়ের জাত নেই কোথায়।”


চিত্তচাঞ্চল্যে কাজের এত বাধা ঘটছে যে লজ্জা পাচ্ছি মনে-মনে। সদরে বাজেটের মিটিঙে রিসর্চ্‌বিভাগে আরও কিছু দান মঞ্জুর করিয়ে নেবার প্রস্তাব ছিল। তার সমর্থক রিপোর্ট্‌খানা অর্ধেকের বেশি লেখাই হয় নি। অথচ এ দিকে ক্রোচের এস্‌থেটিক্‌স্‌ নিয়ে ধারাবাহিক আলোচনা শুনে আসছি। অচিরা নিশ্চিত জানে বিষয়টা আমার উপলব্ধি ও উপভোগের সম্পূর্ণ বাইরে। তা হলেও চলত, কিন্তু আমার বিশ্বাস ব্যাপারটাকে সে ইচ্ছে করে শোচনীয় করে তুলেছে। ঠিক এই সময়টাতেই সাঁওতালদের পার্বণ। তারা পচাই মদ খাচ্ছে আর মাদল বাজিরে মেয়েপুরুষে নৃত্য করছে। অচিরা ওদের পরম বন্ধু। মদের পয়সা জোগায়, সালু কিনে দেয় সাঁওতাল ছেলেদের কোমর বাঁধবার জন্যে, বাগান থেকে জবাফুলের জোগান দেয় সাঁওতাল মেয়েদের চুলে পরবার। ওকে না হলে তাদের চলেই না। অচিরা অধ্যাপককে বলেছে, ও তো এ কদিন থাকতে পারবে না, অতএব এই সময়টাতে বিরলে আমাকে নিয়ে ক্রোচের রসতত্ত্ব যদি পড়ে শোনান তা হলে আমার সময় আনন্দে কাটবে। একবার সসংকোচে বলেছিলুম, ‘সাঁওতালদের উৎসব দেখতে আমার বিশেষ কৌতূহল আছে।’ স্বয়ং অধ্যাপক বললেন, ‘না, সে আপনার ভালো লাগবে না।’ আমার ইন্‌টেলেক্‌চুয়ল মনোবৃত্তির নির্জলা একান্ততার ’পরে তাঁর বিশ্বাস। মধ্যাহ্নভোজনের পরেই অধ্যাপক গুন্ গুন্ করে পড়ে চলেছেন। দূরে মাদলের আওয়াজ এক-একবার থামছে। পরক্ষণেই দ্বিগুণ জোরে বেজে উঠছে। কখনও বা পদশব্দ কল্পনা করছি, কখনও বা হতাশ হয়ে ভাবছি অসমাপ্ত রিপোর্টের কথা। সুবিধে এই অধ্যাপক জিগ্‌গেসাই করেন না কোথাও আমার ঠেকছে কি না। তিনি ভাবেন সমস্তই জলের মতো সোজা। মাঝে মাঝে প্রতিবাদ উপলক্ষে প্রশ্ন করেন, ‘আপনারও কি এই মনে হয় না।’ আমি খুব জোরের সঙ্গে বলি, ‘নিশ্চয়!’

 ইতিমধ্যে কিছুদুরে আমাদের অর্ধসমাপ্ত কয়লার খনিতে মজুরদের হল স্ট্রাইক। ঘটালেন যিনি, এই তাঁর ব্যাবসা, স্বভাব এবং অভাব-বশত; সমস্ত কাজের মধ্যে এইটেই সব চেয়ে সহজ। কোনো কারণ ছিল না— কেননা আমি নিজে সোশালিস্ট্, সেখানকার বিধিবিধান আমার নিজের হাতে বাঁধা, কারও সেখানে না ছিল লোকসান, না ছিল অসম্মান।

 নূতন যন্ত্র এসেছে জর্মান থেকে, তারই খাটাবার চেষ্টায় ব্যস্ত আছি। এমন সময় উত্তেজিতভাবে এসে উপস্থিত অচিরা। বললে, “আপনি মোটা মাইনে নিয়ে ধনিকের নায়েবি করছেন, এ দিকে গরিবের দারিদ্র্যের সুযোগটাকে নিয়ে আপনি—”

 চন্ করে উঠল মাথা। বাধা দিয়ে বললুম, “কাজ চালাবার দায়িত্ব এবং ক্ষমতা যাদের তারাই অন্যায়কারী আর জগতে যারা কোনো কাজই করে না, করতে পারেও না, দয়ামায়া কেবল তাদেরই— এই সহজ অহংকারের মত্ততায় সত্য-মিথ্যার প্রমাণ নিতেও মন চায় না।”

 অচিরা বললে, “সত্য নয় বলতে চান?”

 আমি বললুম, “সত্য শব্দটা আপেক্ষিক। যা-কিছু যত ভালোই হোক, তার চেয়ে আরও ভালো হতেও পারে। এই দেখুন না আমার মোটা মাইনে বটে, তার থেকে মাকে পাঠাই পঞ্চাশ, নিজে রাখি ত্রিশ, আর বাকি—সে হিসেবটা থাক্। কিন্তু মার জন্যে পনেরো নিজের জন্যে পাঁচ রাখলে আইডিয়ালের আরও কাছ ঘেঁষে যেত, কিন্তু একটা সীমা আছে তো।”

 অচিরা বললে, “সীমাটা কি নিজের ইচ্ছের উপরেই নির্ভর করে।”

 আমি বললুম, “না, অবস্থার উপরে। যে কথাটা উঠল সেটা একটু বিচার করে দেখুন। য়ুরোপে ইণ্ডস্টিয়ালিজম্ গড়ে উঠেছে দীর্ঘকাল ধরে। যাদের হাতে টাকা ছিল এবং টাকা করবার প্রতিভা ছিল তারাই এটা গড়েছে। গড়েছে নিছক টাকার লোভে— সেটা ভালো নয় তা মানি। কিন্তু ঐ ঘুষটকু যদি না পেত তা হলে একেবারে গড়াই হত না। এতদিন পরে আজ ওখানে পড়েছে হিসেবনিকেশের তলব।”

 অচিরা বললে, “আপনি বলতে চান পায়ে তেল শুরুতে, কানমলা তার পরে?”

 “নিশ্চয়। আমাদের দেশে ভিত গাঁথা সবে আরম্ভ হয়েছে, এখনই যদি মার লাগাই তা হলে শুরুতেই হবে শেষ—সুবিধে হবে বিদেশী বণিকদের। মানছি আজ আমি লোভীদের ঘুষ দেওয়ার কাজ নিয়েছি, টাকাওয়ালার নায়েবি আমি করি। আজ সেলাম করছি বাদশার দরবারে এসে, কাল ওদের সিংহাসনের পায়ায় লাগাব কুড়ল। ইতিহাসে তো এই দেখা গেছে।”

 অচিরা বললে, সব বঝলুম। কিন্তু আমি দিনের পর দিন অপেক্ষা করে আছি দেখতে, এই স্ট্রাইক মেটাতে আপনি নিজে কবে যাবেন। নিশ্চয়ই আপনাকে ডাকও পড়েছিল। কিন্তু কেন যান নি।”

 চাপা গলায় বলতে চেষ্টা করলুম, “এখানে কাজ ছিল বিস্তর।”

 কিন্তু ফাঁকি দেব কী করে। আমার ব্যবহারে তো আমার কৈফিয়তের প্রমাণ হয় না।

 কঠিন হাসি হেসে দ্রুতপদে চলে গেল অচিরা।

 আর চলবে না। একটা শেষ নিষ্পত্তি করাই চাই। নইলে অপমানের অন্ত থাকবে না।


সাঁওতালী পার্বণ শেষ হয়েছে। সকালে বেড়াতে বেরিয়েছি। অচিরা সঙ্গে ছিল। উত্তরের দিকে একটা পাহাড় উঠেছে, আকাশের নীলের চেয়ে ঘন নীল। তার গায়ে গায়ে চারা শাল আর বৃদ্ধ শাল গাছে বন অন্ধকার। মাঝখান দিয়ে কাঠুরেদের পায়ে-চলার পথ। অধ্যাপক একটা অর্কিড ফুল বিশেষ করে পর্যবেক্ষণ করছেন, তাঁর পকেটে সর্বদা থাকে আতস কাচ।

 গাছগুলোর মধ্যে অন্ধকার যেখানে ভ্রূকুটিল হয়ে উঠেছে আর ঝিঁঝিঁপোকা ডাকছে তীব্র আওয়াজে, অচিরা বসল একটা শেওলাঢাকা পাথরের উপর। পাশে ছিল মোটা জাতের বাঁশগাছ, তারই ছাঁটা কঞ্চির উপর আমি বসলুম। আজ সকাল থেকে অচিরার মুখে বেশি কথা ছিল না। সেই জন্যেই তার সঙ্গে আমার কথা কওয়া বাধা পাচ্ছিল।

 সামনের দিকে তাকিয়ে এক সময় সে আস্তে আস্তে বলে উঠল, “সমস্ত বনটা মিলে প্রকাণ্ড একটা বহু-অঙ্গ-ওয়ালা প্রাণী। গুঁড়ি মেরে বসে আছে শিকারি জন্তুর মতো। যেন স্থলচর অক্টোপাশ, কালো চোখ দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। তার নিরন্তর হিপ্‌নটিজমে ক্রমে ক্রমে দিনে দিনে আমার মনের মধ্যে একটা ভয়ের বোঝা যেন নিরেট হয়ে উঠছে।”

 আমি বললুম, “কতকটা এই রকম কথাই এই সেদিন আমার ডায়ারিতে লিখেছি।”

 অচিরা বলে চলল, “মনটা যেন পুরোনো ইমারত, সকল কাজের বার। নিষ্ঠুর অরণ্য যেখানে পেয়েছে তার ফাটল, চালিয়ে দিয়েছে শিকড়, সমস্ত ভিতরটাকে টানছে ভাঙনের দিকে। এই বোবা কালা মহাকায় জন্তু মনের ফাটল আবিষ্কার করতে মজবুত— আমার ভয় বেড়ে চলেছে। দাদু বলেছিলেন, ‘লোকালয় থেকে একান্ত দূরে থাকলে মানুষের মনঃপ্রকৃতি আসে অবশ হয়ে, প্রবল হয়ে ওঠে তার প্রাণপ্রকৃতি।’ আমি জিগ্‌গেস করলুম, ‘এর প্রতিকার কী।’ তিনি বললেন, মানুষের মনের শক্তিকে আমরা সঙ্গে করে আনতে পারি, এই দেখো-না এনেছি তাকে আমার লাইব্রেরিতে।’ দাদুর উপযুক্ত এই উত্তর। কিন্তু আপনি কী বলেন।”

 আমি বললাম “আমাদের মন খোঁজে এমন একজন মানুষের সঙ্গ যে আমাদের সমস্ত অস্তিত্বকে সম্পূর্ণ জাগিয়ে রাখতে পারে, চেতনার বন্যা বইয়ে দেয় জনশূন্যতার মধ্যে। এ তো লাইব্রেরির সাধ্য নয়।”

 অচিরা একট, অবজ্ঞা করে বললে, “আপনি যার খোঁজ করছেন তেমন মানুষ পাওয়া যায় বই-কি, যদি বড্ড দরকার পড়ে। তারা চৈতন্যকে উসকিয়ে তোলে নিজের দিকেই, বন্যা বইয়ে দিয়ে সাধনার বাঁধ ভেঙে ফেলে। এ সমস্তই কবিদের বানানো কথা, মোহরস দিরে জারানো। আপনাদের মতো বুকের-পাটা-ওয়ালা লোকের মুখে মানায় না। প্রথম যখন আপনাকে দেখেছিলুম, তখন দেখেছি আপনি রস খুঁজে বেড়ান নি, পথ খুঁড়ে বেরিয়েছিলেন কড়া মাটি ভেঙে। দেখেছি আপনার নিরাসক্ত পৌরুষের মূর্তি— সমস্ত মনপ্রাণ দিয়ে আপনাকে প্রণাম করেছি। আজ আপনি কথার পুতুল দিয়ে নিজেকে ভোলাতে বসেছেন। এ দশা ঘটালে কে। স্পষ্ট করেই জিজ্ঞাসা করি, এর কারণ কি আমি।”

 আমি বললুম, “তা হতে পারে। কিন্তু আপনি তো সাধারণ মেয়ে নন। পুরুষকে আপনি শক্তি দেবেন।”

 “হাঁ, শক্তি দেব, যদি নিজেকেই মোহ জড়িয়ে না ধরে। আভাসে বুঝেছি আপনি আমার ইতিহাস কিছু কিছু সংগ্রহ করেছেন। আপনার কাছে কিছু ঢাকবার দরকার নেই। আপনি শুনেছেন আমি ভবতোষকে ভালোবেসেছিলুম।”

 “হাঁ, শুনেছি।”

 “এও জানেন আমার ভালোবাসার অপমান ঘটেছে।”

 “হাঁ, জানি।”

 “সেই অপমানিত ভালোবাসা অনেক দিন ধরে আমাকে আঁকড়ে ধরে দুর্বল করেছে। আমি জেদ করে বসেছিলুম তারই একনিষ্ঠ স্মৃতিকে জীবনের পূজামন্দিরে বসাব। চিরদিন একমনে সেই নিষ্ফল সাধনা করব মেয়েরা যাকে বলে সতীত্ব। নিজের ভালোবাসার অহংকারে সংসারকে ঠেলে ফেলে নির্জনে চলে এসেছি। কর্তব্যকে অবজ্ঞা করেছি, নিজের দুঃখকে সম্মান করব বলে। আমার দাদুকে অনায়াসে সরিয়ে এনেছি তাঁর কাজের ক্ষেত্র থেকে। যেন এই মেয়েটার হৃদয়ের অহমিকা পৃথিবীর সব কিছুর উপরে। মোহ, মোহ, অন্ধ মোহ!”

 খানিক ক্ষণ চুপ করে থেকে হঠাৎ সে বলে উঠল, “জানেন? আপনিই সেই মোহ ভাঙিয়ে দিয়েছেন।”

 বিস্মিত হয়ে তার মুখের দিকে চেয়ে রইলুম।

 সে বললে, “আপনিই এই আত্মাবমাননা থেকে ছিনিয়ে এনে আমাকে বাঁচালেন।”

 স্তব্ধ রইলুম নিরুত্তর প্রশ্ন নিয়ে।

 “আপনি তখনও আমাকে দেখেন নি। আমি আশ্চর্য হয়ে দেখেছি আপনার সুসাধ্য প্রয়াসের দিনগুলি—সঙ্গ নেই, আরাম নেই, ক্লান্তি নেই, একটু কোথাও ছিদ্র নেই অধ্যবসায়ে। দেখেছি আপনার প্রশস্ত ললাট, আপনার চাপা ঠোঁটে অপরাজেয় ইচ্ছাশক্তির লক্ষণ, আর দেখেছি মানুষকে কী রকম অনায়াসে প্রভুত্বের জোরে চালনা করেন। দাদুর কাছে আমি মানুষ—আমি পুরুষের ভক্ত, যে পুরুষ সত্য, যে পুরুষ তপস্বী। সেই পুরুষকেই দেখবার জন্যে আমার ভক্তিপিপাসু নারী ভিতরে ভিতরে অপেক্ষা করে ছিল নিজের অগোচরে। মাঝখানে এসেছিল অপদেবতা প্রবৃত্তির টানে। অবশেষে নিষ্কাম পুরুষের সুদৃঢ় শক্তিরূপ আপনিই আনলেন আমার চোখের সামনে।”

 আমি জিগ্‌গেসা করলুম, “তার পর কি ভাবের পরিবর্তন হয়েছে।”

 “হাঁ, হয়েছে। আপনার বেদি থেকে নেমে এসেছেন প্রতিদিন। স্থানীয় কাগজে পড়লুম, দূরে অন্য এক জায়গায় সন্ধানের কাজে আপনার ডাক পড়েছে। আপনি নড়লেন না, ভিতরে ভিতরে আত্মগ্লানি ভোগ করলেন। আপনার পথের সামনেকার ঢেলাখানার মতো আমাকে লাথি মেরে ছুঁড়ে ফেলে দিলেন না কেন। কেন নিষ্ঠুর হতে পারলেন না। যদি পারতেন তবে আমি ধন্য হতুম। আমার ব্রতের পারণা হত আমার কান্না দিয়ে।”

 মৃদুস্বরে বললুম, “যাবার জন্যেই কাগজপত্তর গুছিয়ে নিচ্ছিলুম।”

 “না, না, কখনোই না। মিথ্যে ছুতো করে নিজেকে ভোলাচ্ছিলেন। যতই দেখলুম আপনার দূর্বলতা, ভয় হতে লাগল আমার নিজেকে নিয়ে। ছি ছি, কী পরাভবের বিষ এনেছি নারীর জীবনে, কেবল অন্যের জন্য নয়, নিজের জন্যেও। ক্রমশই একটা চাঞ্চল্য আমাকে পেয়ে বসল, সে যেন এই বনের বিষনিশ্বাস থেকে। একদিন এখানকার পিশাচী রাত্রি এমন আমাকে আবিষ্ট করে ধরেছিল যে মনে হল যে, এত বড়ো প্রবৃত্তিরাক্ষসীও আছে যে আমার দাদুর কাছ থেকেও আমাকে ছিনিয়ে নিতে পারে। তখনই সেই রাত্রেই ছুটে নদীর জলে ঝাঁপ দিয়ে পড়ে ডুব দিয়ে স্নান করে এসেছি।”

 এই কথা বলতে বলতে অচিরা ডাক দিল, “দাদু!”

 অধ্যাপক গাছতলায় বসে পড়ছিলেন। উঠে এসে স্নেহের স্বরে বললেন, “কী দিদি। দূর থেকে বসে বসে ভাবছিলুম, তোমার উপরে আজ বাণী ভর দিয়েছেন— জ্বল্ জ্বল্ করছে তোমার চোখ দুটি।”

 “আমার কথা থাক্, তুমি শোনো। তুমি সেদিন বলেছিলে মানুষের চরম অভিব্যক্তি তপস্যার মধ্যে দিয়ে।”

 “হাঁ, আমি তাই তো বলি। বর্বর মানুষ জন্তুর পর্যায়ে। কেবলমাত্র তপস্যার মধ্য দিয়ে সে হয়েছে জ্ঞানী মানুষ। আরও তপস্যা আছে সামনে, স্থূল আবরণ যুগে যুগে ত্যাগ করতে করতে সে হবে দেবতা। পুরাণে দেবতার কল্পনা আছে—কিন্তু দেবতা ছিলেন না অতীতে, দেবতা আছেন ভবিষ্যতে। মানুষের ইতিহাসের শেষ অধ্যায়ে।”

 অচিরা বললে, “দাদু, এইবার এসো, তোমার আমার কথাটা আপসে চুকিয়ে দিই, কদিন থেকে মনের মধ্যে তোলপাড় করছে।”

 আমি উঠে পড়লুম; বললুম, “তা হলে যাই।”

 “না, আপনি বসুন।— দাদু, সেই-যে কলেজের অধ্যক্ষপদটা তোমার ছিল, সেটা খালি হয়েছে। তোমাকে ডাক দিয়েছে ওরা।”

 অধ্যাপক আশ্চর্য হয়ে বললেন, “কী করে জানলে ভাই।”

 “তোমার কাছে চিঠি এসেছে, সে আমি চুরি করেছি।”

 “চুরি করেছ!”

 “করব না! আমাকে সব চিঠিই দেখাও, কেবল কলেজের ছাপ-মারা ঐ চিঠিটাই দেখালে না! তোমার দূরভিসন্ধি সন্দেহ করে চুরি করে দেখতে হল।”

 অধ্যাপক অপরাধীর মতো ব্যস্ত হয়ে বললেন, “আমারই অন্যায় হয়েছে।”

 “কিছু অন্যায় হয় নি। আমাকে লুকোতে চেয়েছিলে যে আমার জীবনের অভিসম্পাত এখনও তুমি নিজের উপর টেনে নিয়ে চলবে। তোমার আপন আসন থেকে আমি যে নামিয়ে এনেছি তোমাকে। আমাদের তো ঐ কাজ।”

 “কী বলছ দিদি।”

 “সত্যি কথাই বলছি। তুমি শিক্ষাদানযজ্ঞের হোতা, এখানে এনে আমি তোমাকে করেছি শুধু গ্রন্থকীট। বিশ্বসৃষ্টি বাদ দিলে কী দশা হয় বিশ্বকর্তার? ছাত্র না থাকলে তোমার হয় ঠিক তেমনি। সত্যি কথা বলো।”

 “বরাবর ইস্কুলমাস্টারি করে এসেছি কিনা।”

 “তুমি আবার ইস্কুলমাস্টার! কী যে বল তুমি! তুমি যে স্বভাবতই আচার্য। দেখেন নি নবীনবাবু?—ওঁর মাথায় একটা আইডিয়া এসেছে কি, আর দয়ামায়া থাকে না। অমনি আমাকে নিয়ে পড়েন— বারো-আনাই বুঝতেই পারি নে। নইলে হাতড়িয়ে বের করেন এই নবীনবাবুকে, সে হয় আরও শোচনীয়। দাদু, ছাত্র তোমার নিতান্তই চাই জানি, কিন্তু বাছাই করে নিয়ো, রূপকথার রাজা সকালে ঘুম থেকে উঠেই যার মুখ দেখত তাকেই কন্যা দান করত। তোমার বিদ্যাদান অনেকটা সেই রকম।”

 “না দিদি, আমাকে বাছাই করে নেয় যারা তারাই সাহায্য পায় আমার। এখনকার দিনে কর্তৃপক্ষ বিজ্ঞাপন দিয়ে ছাত্র সংগ্রহ করে, আগেকার দিনে সন্ধান করে শিক্ষক লাভ করত শিক্ষার্থী।”

 “আচ্ছা, সে কথা পরে হবে। এখনকার সিদ্ধান্ত এই যে, তোমাকে তোমার সেই কাজটা ফিরিয়ে নিতে হবে।”

 অধ্যাপক হতবুদ্ধির মতো নাতনির মুখের দিকে চেয়ে রইলেন।

 অচিরা বললে, “তুমি ভাবছ, আমার গতি কী হবে। আমার গতি তুমি। আর আমাকে ছাড়লে তোমার কী গতি জানই তো। এখন যে তোমার পনেরোই আশ্বিনে পনেরোই অক্টোবরে এক হয়ে যায়, নিজের নূতন ছাতার সঙ্গে পরের পুরোনো ছাতার স্বত্বাধিকারে ভেদজ্ঞান থাকে না, গাড়ি চ’ড়ে ড্রাইভারকে এমন ঠিকানা বাতলিয়ে দাও সেই ঠিকানায় আজ পর্যন্ত কোনো বাড়ি তৈরি হয় নি, আর চাকরের ঘুম ভাঙবার ভয়ে সাবধানে পা টিপে টিপে কলতলায় নিজে গিয়ে কুঁজোয় জল ভরে নিয়ে আস।”

 অধ্যাপক আমার দিকে চেয়ে বললেন, “তুমি কী বল নবীন?”

 কী জানি ওঁর হয়তো মনে হয়েছিল ওঁদের এই পারিবারিক প্রস্তাবে আমার ভোটেরও একটা মূল্য আছে।

 আমি খানিক ক্ষণ চুপ করে রইলুম, তার পরে বললুম, “অচিরাদেবীর চেয়ে সত্য পরামর্শ আপনাকে কেউ দিতে পারবে না।”

 অচিরা তখনই উঠে দাঁড়িয়ে পা ছুঁয়ে আমাকে প্রণাম করলে। বোধ হল যেন চোখ থেকে জল পড়ল আমার পায়ে। আমি সংকুচিত হয়ে পিছু হটে গেলুম।

 অচিরা বললে, “সংকোচ করবেন না। আপনার তুলনায় আমি কিছুই নই, সে কথা নিশ্চয় জানবেন। এই কিন্তু শেষ বিদায় যাবার আগে আর দেখা হবে না।”

 অধ্যাপক বিস্মিত হয়ে বললেন, “সে কী কথা দিদি।”

 অচিরা বাষ্পগদ্‌গদ কণ্ঠ সামলিয়ে হেসে বললে, “দাদু, তুমি অনেক কিছু জান, কিন্তু আরও-কিছু সম্বন্ধে আমার বুদ্ধি তোমার চেয়ে অনেক বেশি এ কথাটা মেনে নিয়ো।”

 এই বলে চলতে উদ্যত হল। আবার ফিরে এসে বললে, “আমাকে ভুল বুঝবেন না—আজ আমার তীব্র আনন্দ হচ্ছে যে আপনাকে মুক্তি দিলাম, তার থেকে আমারও মুক্তি। আমার চোখ দিয়ে জল পড়ছে— লুকোব না, জল আরও পড়বে। নারীর চোখের জল তাঁরই সম্মানে যিনি সব বন্ধন কাটিয়ে জয়যাত্রায় বেরিয়েছেন।”

 দ্রুতপদে অচিরা চলে গেল।

 আমি পদধূলি নিয়ে প্রণাম করলাম অধ্যাপককে। তিনি আমাকে বুকে চেপে ধরে বললেন, “আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি তোমার সামনে কীর্তির পথ প্রশস্ত।”


ছোটো গল্প ফুরল। পরেকার কথাটা খনি-খোঁড়ার ব্যাপার নিয়ে। তারও পরে আরও বাকি আছে— সে ইতিহাস নিরতিশয় একলার অভিযান, জনতার মাঝখান দিয়ে দুর্গম পথে রুদ্ধদুর্গের দ্বার-অভিমুখে।

 বাড়ি ফিরে গিয়ে যত আমার প্ল্যান আর নোট আর রেকর্ড্ উলটে-পালটে নাড়াচাড়া করলুম। দেখলুম, সামনে দিগন্তবিস্তৃত কাজের ক্ষেত্র, তাতেই আমার বৃহৎ ছুটি।

 সন্ধেবেলায় বারান্দায় এসে বসলুম। খাঁচা ভেঙে গেছে। পাখির পায়ে আটকে রইল ছিন্ন শিকল। সেটা নড়তে চড়তে পায়ে বাজবে।

৪. ১০. ৩৯
অগ্রহায়ণ ১৩৪৬