গল্পগুচ্ছ (তৃতীয় খণ্ড)/শেষের রাত্রি

শেষের রাত্রি

 “মাসি!”

 “ঘুমােও যতীন, রাত হল যে।”

 “হােক-না রাত, আমার দিন তাে বেশি নেই। আমি বলছিলাম, মণিকে তার বাপের বাড়ি—ভুলে যাচ্ছি, ওর বাপ এখন কোথায়—”

 “সীতারামপুরে।”

 “হাঁ, সীতারামপুরে। সেইখানে মণিকে পাঠিয়ে দাও, আরও কতদিন ও রােগীর সেবা করবে! ওর শরীর তাে তেমন শক্ত নয়।”

 “শােনো একবার! এই অবস্থায় তােমাকে ফেলে বউ বাপের বাড়ি যেতে চাইবেই বা কেন।”

 “ডাক্তারেরা কী বলেছে সে কথা কি সে—

 “তা সে নাই জানল—চোখে তাে দেখতে পাচ্ছে। সেদিন বাপের বাড়ি যাবার কথা যেমন একটু ইশারায় বলা অমনি বউ কেঁদে অস্থির।”


মাসির এই কথাটার মধ্যে সত্যের কিছু অপলাপ ছিল সে কথা বলা আবশ্যক। মণির সঙ্গে সেদিন তাঁর এই প্রসঙ্গে যে আলাপ হইয়াছিল সেটা নিম্নলিখিত-মতাে।

 “বউ, তােমার বাপের বাড়ি থেকে কিছু খবর এসেছে বুঝি? তােমার জাঠততাে ভাই অনাথকে দেখলাম যেন।”

 “হাঁ, মা বলে পাঠিয়েছেন, আসছে শুক্রবারে আমার ছােটো বােনের অন্নপ্রাশন। তাই ভাবছি—”

 “বেশ তাে বাছা, একগাছি সােনার হার পাঠিয়ে দাও, তােমার মা খুশি হবেন।”

 “ভাবছি আমি যাব। আমার ছােটো বােনকে তাে দেখি নি, দেখতে ইচ্ছে করে।”

 “সে কী কথা। যতীনকে একলা ফেলে যাবে! ডাক্তার কী বলেছে শুনেছ তাে?”

 “ডাক্তার তাে বলছিল, এখনাে তেমন বিশেষ—”

 “তা যাই বলুক, ওর এই দশা দেখে যাবে কী ক’রে।”

 “আমার তিন ভাইয়ের পরে এই একটি বােন, বড়ো আদরের মেয়ে—শুনেছি ধুম ক’রে অন্নপ্রাশন হবে—আমি না গেলে মা ভারি—”

 “তােমার মায়ের ভাব বাছা, আমি বুঝতে পারি নে। কিন্তু, যতীনের এই সময়ে তুমি যদি যাও তােমার বাবা রাগ করবেন, সে আমি ব’লে রাখছি।”

 “তা জানি। তােমাকে এক লাইন লিখে দিতে হবে মাসি, যে, কোনাে ভাবনার কথা নেই—আমি গেলে বিশেষ কোনাে—”

 “তুমি গেলে কোনাে ক্ষতিই নেই সে কি জানি নে। কিন্তু, তােমার বাপকে যদি লিখতেই হয়, আমার মনে যা আছে সব খুলেই লিখব।”

 “আচ্ছা বেশ—তুমি লিখাে না। আমি ওঁকে গিয়ে বললেই উনি—”

 “দেখাে বউ, অনেক সয়েছি—কিন্তু, এই নিয়ে যদি তুমি যতীনের কাছে যাও কিছুতেই সইব না। তােমার বাবা তােমাকে ভালােরকমই চেনেন, তাঁকে ভােলাতে পারবে না।”


এই বলিয়া মাসি চলিয়া আসিলেন। মণি খানিক ক্ষণের জন্য রাগ করিয়া বিছানার উপর পড়িয়া রহিল।

 পাশের বাড়ি হইতে সই আসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “এ কী সই, গােঁসা কেন।”

 “দেখাে দেখি ভাই, আমার একমাত্র বােনের অন্নপ্রাশন—এরা আমাকে যেতে দিতে চায় না।”

 “ওমা, সে কী কথা। যাবে কোথায়। স্বামী যে রােগে শুষছে!”

 “আমি তাে কিছুই করি নে, করতে পারিও নে। বাড়িতে সবাই চুপচাপ, আমার প্রাণ হাঁপিয়ে ওঠে। এমন করে আমি থাকতে পারি নে, তা বলছি।”

 “তুমি ধন্যি মেয়েমানুষ যাহােক!”

 “তা, আমি ভাই, তােমাদের মতাে লােক-দেখানে ভান করতে পারি নে। পাছে কেউ কিছু মনে করে বলে মুখ গুঁজড়ে ঘরের কোণে পড়ে থাকা আমার কর্ম নয়।”

 “তা, কী করবে শুনি।”

 “আমি যাবই, আমাকে কেউ ধরে রাখতে পারবে না।”

 “ইস, তেজ দেখে আর বাঁচি নে!—চললুম, আমার কাজ আছে।”

বাপের বাড়ি যাইবার প্রসঙ্গে মণি কাঁদিয়াছে—এই খবরে যতীন বিচলিত হইয়া বালিশটাকে পিঠের কাছে টানিয়া তুলিল এবং একটু উঠিয়া হেলান দিয়া বসিল। বলিল, “মাসি, এই জানলাটা আর একটু খুলে দাও, আর এই আলােটা এ ঘরে দরকার নেই।”

 জানলা খুলিতেই স্তব্ধ রাত্রি অনন্ত তীর্থপথের পথিকের মতাে রােগীর দরজার কাছে চুপ করিয়া দাঁড়াইল। কত যুগের কত মত্যুকালের সাক্ষী ঐ তারাগুলি যতীনের মুখের দিকে তাকাইয়া রহিল।

 যতীন এই বৃহৎ অন্ধকারের পটের উপর তাহার মণির মুখখানি দেখিতে পাইল। সেই মুখের ডাগর দুটি চক্ষু মােটা মােটা জলের ফোঁটায় ভরা—সে জল আর শেষ হইল না, চিরকালের জন্য ভরিয়া রহিল।

 অনেক ক্ষণ সে চুপ করিয়া আছে দেখিয়া মাসি নিশ্চিন্ত হইলেন। ভাবিলেন, যতীনের ঘুম আসিয়াছে।

 এমন সময় হঠাৎ সে বলিয়া উঠিল, “মাসি, তােমরা কিন্তু বরাবর মনে করে এসেছ মণির মন চঞ্চল, আমাদের ঘরে ওর মন বসে নি। কিন্তু, দেখাে—”

 “না বাবা, ভুল বুঝেছিলুম—সময় হলেই মানুষকে চেনা যায়।”

 “মাসি!”

 “যতীন, ঘুমােও বাবা।”

 “আমাকে একটু ভাবতে দাও, একটু কথা কইতে দাও। বিরক্ত হােয়াে না, মাসি।”

 “আচ্ছা, বলো বাবা।”

 “আমি বলছিলুম, মানুষের নিজের মন নিজে বুঝতেই কত সময় লাগে। একদিন যখন মনে করতুম আমরা কেউ মণির মন পেলুম না, তখন চুপ করে সহ্য করেছি। তােমরা তখন—”

 “না বাবা, অমন কথা বােলাে না—আমিও সহ্য করেছি।”

 “মন তাে মাটির ঢেলা নয়, কুড়িয়ে নিলেই তাে নেওয়া যায় না। আমি জানতুম, মণি নিজের মন এখনাে বােঝে নি; কোনাে-একটা আঘাতে যেদিন বুঝবে সেদিন আর—”

 “ঠিক কথা, যতীন।”

 “সেইজন্যেই ওর ছেলেমানুষিতে কোনােদিন কিছু মনে করি নি।”

 মাসি এ কথার কোনাে উত্তর করিলেন না; কেবল মনে মনে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিলেন। কতদিন তিনি লক্ষ্য করিয়াছেন, যতীন বারান্দায় আসিয়া রাত কাটাইয়াছে, বৃষ্টির ছাঁট আসিয়াছে তবু ঘরে যায় নাই। কতদিন সে মাথা ধরিয়া বিছানায় পড়িয়া; একান্ত ইচ্ছা, মণি আসিয়া মাথায় একটু হাত বুলাইয়া দেয়। মণি তখন সখীদের সঙ্গে দল বাঁধিয়া থিয়েটার দেখিতে যাইবার আয়ােজন করিতেছে। তিনি যতীনকে পাখা করিতে আসিয়াছেন, সে বিরক্ত হইয়া তাঁহাকে ফিরাইয়া দিয়াছে। সেই বিরক্তির মধ্যে কত বেদনা তাহা তিনি জানিতেন। কতবার তিনি যতীনকে বলিতে চাহিয়াছেন, ‘বাবা, তুমি ঐ মেয়েটার দিকে অত বেশি মন দিয়াে না—ও একট, চাহিতে শিখুক—মানুষকে একটু কাঁদানাে চাই।’ কিন্তু এসব কথা বলিবার নহে, বলিলেও কেহ বােঝে না। যতীনের মনে নারীদেবতার একটি পীঠস্থান ছিল, সেইখানে সে মণিকে বসাইয়াছে। সেই তীর্থক্ষেত্রে নারীর অমৃতপাত্র চিরদিন তাহার ভাগ্যে শূন্য থাকিতে পারে, এ কথা মনে করা তাহার পক্ষে সহজ ছিল না। তাই পূজা চলিতেছিল, অর্ঘ্য ভরিয়া উঠিতেছিল, বরলাভের আশা পরাভব মানিতেছিল না।

 মাসি যখন আবার ভাবিতেছিলেন যতীন ঘুমাইয়াছে এমন সময় হঠাৎ সে বলিয়া উঠিল, “আমি জানি, তুমি মনে করেছিলে, মণিকে নিয়ে আমি সুখী হতে পারি নি। তাই তার উপর রাগ করতে। কিন্তু, মাসি, সুখ জিনিসটা ঐ তারাগুলির মতাে— সমস্ত অন্ধকার লেপে রাখে না, মাঝে মাঝে ফাঁক থেকে যায়। জীবনে কত ভুল করি, কত ভুল বুঝি, তবু তার ফাঁকে ফাঁকে কি স্বর্গের আলাে জ্বলে নি। কোথা থেকে আমার মনের ভিতরটি আজ এমন আনন্দে ভরে উঠেছে!”

 মাসি আস্তে আস্তে যতীনের কপালে হাত বুলাইয়া দিতে লাগিলেন। অন্ধকারে তাঁহার দুই চক্ষু ঝাহিয়া যে জল পড়িতেছিল তাহা কেহ দেখিতে পাইল না।

 “আমি ভাবছি মাসি, ওর অল্প বয়স, ও কী নিয়ে থাকবে।”

 “অল্প বয়স কিসের যতীন? এ তো ওর ঠিক বয়স। আমরাও তো বাছা, অল্প বয়সেই দেবতাকে সংসারের দিকে ভাসিয়ে অন্তরের মধ্যে বসিয়েছি—তাতে ক্ষতি হয়েছে কী। তাও বলি, সুখেরই বা এত বেশি দরকার কিসের।”

 “মাসি, মণির মনটি যেই জাগবার সময় হল অমনি আমি—”

 “ভাব’ কেন, যতীন। মন যদি জাগে তবে সেই কি কম ভাগ্য।”

হঠাৎ অনেক দিনের শােনা একটা বাউলের গান যতীনের মনে পড়িয়া গেল—

ওরে মন, যখন জাগলি না রে
তখন মনের মানুষ এল দ্বারে।
তার চলে যাবার শব্দ শুনে
ভাঙল রে ঘুম,
ও তাের  ভাঙল রে ঘুম অন্ধকারে।

 “মাসি, ঘড়িতে ক’টা বেজেছে।”

 “ন’টা বাজবে।”

 “সবে ন’টা? আমি ভাবছিলুম বুঝি দুটো তিনটে কি ক’টা হবে। সন্ধ্যার পর থেকেই আমার দুপর রাত আরম্ভ হয়। তবে তুমি আমার ঘুমের জন্য অত ব্যস্ত হয়েছিলে কেন।”

 “কালও সন্ধ্যার পর এইরকম কথা কইতে কইতে কত রাত পর্যন্ত তােমার আর ঘুম এল না, তাই আজ তােমাকে সকাল-সকাল ঘুমােতে বলছি।”

 “মণি কি ঘুমিয়েছে।”

 “না, সে তােমার জন্যে মসুরির ডালের সুপ তৈরি ক’রে তবে ঘুমােতে যায়।”

 “বলাে কী মাসি, মণি কি তবে—”

 “সেই তাে তােমার জন্যে সব পথ্যি তৈরি করে দেয়। তার কি বিশ্রাম আছে।”

 “আমি ভাবতুম, মণি বুঝি—”

 “মেয়েমানুষের কি আর এ-সব শিখতে হয়। দায়ে পড়লেই আপনি করে নেয়।”

 “আজ দুপুরবেলা মৌরলা মাছের যে ঝােল হয়েছিল তাতে বড় সুন্দর একটি তার ছিল। আমি ভাবছিলাম তােমারই হাতের তৈরি।”

 কপাল আমার! মণি কি আমাকে কিছু করতে দেয়। তােমার গামছা তােয়ালে নিজের হাতে কেচে শুকিয়ে রাখে। জানে যে, কোথাও কিছু নােংরা তুমি দেখতে পার না। তােমার বাইরের বৈঠকখানা যদি একবার দেখ তবে দেখতে পাবে, মণি দুবেলা সমস্ত ঝেড়ে মুছে কেমন তক্‌তকে ক’রে রেখে দিয়েছে; আমি যদি তােমার এ ঘরে ওকে সর্বদা আসতে দিতুম তা হলে কি আর রক্ষা থাকত। ও তাে তাই চায়।”

 “মণির শরীর বুঝি—”

 “ডাক্তাররা বলে, রােগীর ঘরে ওকে সর্বদা আনাগােনা করতে দেওয়া কিছু নয়। ওর মন বড়াে নরম কি না, তােমার কষ্ট দেখলে দুদিনে যে শরীর ভেঙে পড়বে।”

 “মাসি, ওকে তুমি ঠেকিয়ে রাখ কী ক’রে।”

 “আমাকে ও বড় মানে বলেই পারি। তব, বারবার গিয়ে খবর দিয়ে আসতে হয়—ঐ আমার আর-এক কাজ হয়েছে।”


আকাশের তারাগুলি যেন করুণাবিগলিত চোখের জলের মতাে জ্বল্‌জ্বল করিতে লাগিল। যে জীবন আজ বিদায় লইবার পথে আসিয়া দাঁড়াইয়াছে যতীন তাহাকে মনে মনে কৃতজ্ঞতার প্রণাম করিল—এবং সম্মুখে মৃত্যু আসিয়া অন্ধকারের ভিতর হইতে যে দক্ষিণ হাত বাড়াইয়া দিয়াছে যতীন স্নিগ্ধ বিশ্বাসের সহিত তাহার উপরে আপনার রােগক্লান্ত হাতটি রাখিল।

 একবার নিশ্বাস ফেলিয়া, একটুখানি উসখুস করিয়া যতীন বলিল, “মাসি, মণি যদি জেগেই থাকে তা হলে একবার যদি তাকে—”

 “এখনি ডেকে দিচ্ছি, বাবা।”

 “আমি বেশি ক্ষণ তাকে এ ঘরে রাখতে চাই নে—কেবল পাঁচ মিনিট—দুটো-একটা কথা যা বলবার আছে—”


মাসি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া মণিকে ডাকিতে আসিলেন। এ দিকে যতীনের নাড়ী দ্রুত চলিতে লাগিল। যতীন জানে, আজ পর্যন্ত সে মণির সঙ্গে ভালাে করিয়া কথা জমাইতে পারে নাই। দুই যন্ত্র দুই সুরে বাঁধা, এক সঙ্গে আলাপ চলা বড়াে কঠিন। মণি তাহার সঙ্গিনীদের সঙ্গে অনর্গল বকিতেছে হাসিতেছে, দুর হইতে তাহাই শুনিয়া যতীনের মন কতবার ঈর্ষায় পীড়িত হইয়াছে। যতীন নিজেকেই দোষ দিয়াছে—সে কেন অমন সামান্য যাহা-তাহা লইয়া কথা কহিতে পারে না। পারে না যে তাহাও তাে নহে, নিজের বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে যতীন সামান্য বিষয় লইয়াই কি আলাপ করে না। কিন্তু, পুরুষের যাহা-তাহা তাে মেয়েদের যাহা-তাহার সঙ্গে ঠিক মেলে না। বড়াে কথা একলাই একটানা বলিয়া যাওয়া চলে, অন্য পক্ষ মন দিল কি না খেয়াল না করিলেই হয়; কিন্তু তুচ্ছ কথায় নিয়ত দুই পক্ষের যােগ থাকা চাই। বাঁশি একাই বাজিতে পারে, কিন্তু দুইয়ের মিল না থাকিলে করতালের খচমচ জমে না। এইজন্য কত সন্ধ্যাবেলায় যতীন মণির সঙ্গে যখন খোলা বারান্দায় মাদুর পাতিয়া বসিয়াছে, দুটো-চারটে টানাবােনা কথার পরেই কথার সূত্র একেবারে ছিঁড়িয়া ফাঁক হইয়া গেছে; তাহার পরে সন্ধ্যার নীরবতা যেন লজ্জায় মরিতে চাহিয়াছে। যতীন বুঝিতে পারিয়াছে, মণি পালাইতে পারিলে বাঁচে; মনে মনে কামনা করিয়াছে, এখনই কোনাে-একজন তৃতীয় ব্যক্তি যেন আসিয়া পড়ে। কেননা, দুই জনে কথা কহা কঠিন, তিন জনে সহজ।

 মণি আসিলে আজ কেমন করিয়া কথা আরম্ভ করিবে যতীন তাহাই ভাবিতে লাগিল। ভাবিতে গেলে কথাগুলাে কেমন অস্বাভাবিক-রকম বড়াে হইয়া পড়ে— সে-সব কথা চলিবে না। যতীনের আশঙ্কা হইতে লাগিল আজকের রাত্রের পাঁচ মিনিটও ব্যর্থ হইবে। অথচ, তাহার জীবনের এমনতরাে নিরালা পাঁচ মিনিট আর কটাই বা বাকি আছে।

 “একি বউ, কোথাও যাচ্ছ নাকি।”

 “সীতারামপুরে যাব।”

 “সে কী কথা। কার সঙ্গে যাবে।”

 “অনাথ নিয়ে যাচ্ছে।”

 “লক্ষ্মী মা আমার, তুমি যেয়াে, আমি তােমাকে বারণ করব না—কিন্তু আজ নয়।”

 “টিকিট কিনে গাড়ি রিজার্ভ্ করা হয়ে গেছে।”

 “তা হোক, ও লোকসান গায়ে সইবে—তুমি কাল সক্কালেই চলে যেয়ো—আজ যেয়ো না।”

 “মাসি, আমি তোমাদের তিথি বার মানি নে, আজ গেলে দোষ কী।”

 “যতীন তোমাকে ডেকেছে, তোমার সঙ্গে তার একটু কথা আছে।”

 “বেশ তো, এখনো সময় আছে—আমি তাঁকে বলে আসছি।”

 “না, তুমি বলতে পারবে না যে যাচ্ছ।”

 “তা বেশ, কিছু বলব না, কিন্তু আমি দেরি করতে পারব না। কালই অন্নপ্রাশন—আজ যদি না যাই তো চলবে না।”

 “আমি জোড়হাত করছি বউ, আমার কথা আজ এক দিনের মতো রাখো। আজ মন একটু শান্ত করে যতীনের কাছে এসে বোসো—তাড়াতাড়ি কোরো না।”

 “তা, কী করব বলো, গাড়ি তো আমার জন্য বসে থাকবে না। অনাথ চলে গেছে—দশ মিনিট পরে সে এসে আমাকে নিয়ে যাবে। এই বেলা তাঁর সঙ্গে দেখা সেরে আসি গে।”

 “না, তবে থাক্—তুমি যাও। এমন করে তার কাছে যেতে দেব না। ওরে অভাগিনী, তুই যাকে এত দুঃখ দিলি সে তো সব বিসর্জন দিয়ে আজ বাদে কাল চলে যাবে—কিন্তু, যত দিন বেঁচে থাকবি এ দিনের কথা তোকে চিরদিন মনে রাখতে হবে—ভগবান আছেন, ভগবান আছেন, সে কথা একদিন বুঝবি।”

 “মাসি, তুমি অমন ক’রে শাপ দিয়ো না বলছি।”

 “ওরে বাপ রে, আর কেন বেঁচে আছিস রে বাপ! পাপের যে শেষ নেই—আমি আর ঠেকিয়ে রাখতে পারলাম না।”


মাসি একটু দেরি করিয়া রোগীর ঘরে গেলেন। আশা করিলেন যতীন ঘুমাইয়া পড়িবে। কিন্তু, ঘরে ঢুকিতেই দেখিলেন, বিছানার উপর যতীন নড়িয়া-চড়িয়া উঠিল। মাসি বললেন, “এই এক কাণ্ড ক’রে বসেছে।”

 “কী হয়েছে। মণি এল না? এত দেরি করলে কেন, মাসি।”

 “গিয়ে দেখি, সে তোমার দুধ জ্বাল দিতে গিয়ে পুড়িয়ে ফেলেছে ব’লে কান্না। আমি বলি, হয়েছে কি, আরও তো দুধ আছে। কিন্তু, অসাবধান হয়ে তোমার খাবার দুধে পুড়িয়ে ফেলেছে, বউয়ের এ লজ্জা আর কিছুতেই যায় না। আমি তাকে অনেক ঠাণ্ডা করে বিছানায় শুইয়ে রেখে এসেছি। আজ আর তাকে আনলুম না। সে একটু ঘুমোক।”

 মণি আসিল না বলিয়া যতীনের বুকের মধ্যে যেমন বাজিল তেমনি সে আরামও পাইল। তাহার মনে আশঙ্কা ছিল যে, পাছে মণি সশরীরে আসিয়া মণির ধ্যানমাধুরীটুকুর প্রতি জুলম করিয়া যায়। কেননা, তাহার জীবনে এমন অনেকবার ঘটিয়াছে। দুধ পুড়াইয়া ফেলিয়া মণির কোমল হৃদয় অনুতাপে ব্যথিত হইয়া উঠিয়াছে, ইহারই রসটুকুতে তাহার হৃদয় ভরিয়া ভরিয়া উঠিতে লাগিল।

 “মাসি!”

 “কী বাবা।”

 “আমি বেশ জানছি, আমার দিন শেষ হয়ে এসেছে। কিন্তু, আমার মনে কোনাে খেদ নেই। তুমি আমার জন্য শােক কোরাে না।”

 “না বাবা, আমি শােক করব না। জীবনেই যে মঙ্গল আর মরণে যে নয় এ কথা আমি মনে করি নে।”

 “মাসি, তােমাকে সত্য বলছি, মত্যুকে আমার মধুর মনে হচ্ছে।”

 অন্ধকার আকাশের দিকে তাকাইয়া যতীন দেখিতেছিল, তাহার মণিই আজ মৃত্যুর বেশ ধরিয়া আসিয়া দাঁড়াইয়াছে। সে আজ অক্ষয় যৌবনে পূর্ণ—সে গৃহিণী, সে জননী; সে রূপসী, সে কল্যাণী। তাহারই এলােচুলের উপরে ঐ আকাশের তারাগুলি লক্ষ্মীর স্বহস্তের আশীর্বাদের মালা। তাহাদের দুজনের মাথার উপরে এই অন্ধকারের মঙ্গলবস্ত্রখানি মেলিয়া ধরিয়া আবার যেন নূতন করিয়া শুভদৃষ্টি হইল। রাত্রির এই বিপুল অন্ধকার ভরিয়া গেল মণির অনিমেষ প্রেমের দৃষ্টিপাতে। এই ঘরের বধূ মণি, এই একটুখানি মণি, আজ বিশ্বরূপ ধরিল; জীবনমরণের সংগমতীর্থে ঐ নক্ষত্রবেদীর উপরে সে বসিল; নিস্তব্দ রাত্রি মঙ্গলঘটের মতাে পুণ্যধারায় ভরিয়া উঠিল। যতীন জোড়হাত করিয়া মনে মনে কহিল, ‘এত দিনের পর ঘােমটা খুলিল, এই ঘাের অন্ধকারের মধ্যে আবরণ ঘুচিল। অনেক কাঁদাইয়াছ— সুন্দর, হে সুন্দর, তুমি আর ফাঁকি দিতে পারিবে না।

8

“কষ্ট হচ্ছে মাসি, কিন্তু যত কষ্ট মনে করছ তার কিছুই নয়। আমার সঙ্গে আমার কষ্টের ক্রমশই যেন বিচ্ছেদ হয়ে আসছে। বােঝাই নৌকার মতাে এতদিন সে আমার জীবন-জাহাজের সঙ্গে বাঁধা ছিল; আজ যেন বাঁধন কাটা পড়েছে, সে আমার সব বােঝা নিয়ে দূরে ভেসে চলল। এখনও তাকে দেখতে পাচ্ছি, কিন্তু তাকে যেন আর আমার ব’লে মনে হচ্ছে না—এ দুদিন মণিকে একবারও দেখি নি, মাসি।”

 “পিঠের কাছে আর-একটা বালিশ দেব কি যতীন।”

 “আমার মনে হচ্ছে মাসি, মণিও যেন চলে গেছে। আমার বাঁধন-ছেড়া দুঃখের নৌকাটির মতাে।”

 “বাবা, একটু বেদানার রস খাও, তােমার গলা শুকিয়ে আসছে।”

 “আমার উইলটা কাল লেখা হয়ে গেছে—সে কি আমি তােমাকে দেখিয়েছি—ঠিক মনে পড়ছে না।”

 “আমার দেখবার দরকার নেই, যতীন।”

 “মা যখন মারা যান আমার তাে কিছুই ছিল না। তােমার খেয়ে তােমার হাতে আমি মানুষ। তাই বলছিলুম—

 “সে আবার কী কথা। তােমার তাে কেবল এই একখানা বাড়ি আর সামান্য কিছু সম্পত্তি ছিল। বাকি সবই তাে তােমার নিজের রােজগার।”

 “কিন্তু, এই বাড়িটা—”

 “কিসের বাড়ি আমার! কত দালান তুমি বাড়িয়েছ, আমার সে কোথায় আছে খুঁজেই পাওয়া যায় না।”

 "মণি তােমাকে ভিতরে ভিতরে খুব—”

 “সে কি জানি নে যতীন। তুই এখন ঘুমাে।”

 “আমি মণিকে সব লিখে দিলুম বটে, কিন্তু তােমারই সব রইল মাসি। ও তাে তোমাকে কখনাে অমান্য করবে না।”

 “সেজন্য অত ভাবছ কেন, বাছা।”

 “তােমার আশীর্বাদেই আমার সব, তুমি আমার উইল দেখে এমন কথা কোনােদিন মনে কোরাে না—”

 “ও কী কথা যতীন। তােমার জিনিস তুমি মণিকে দিয়েছ বলে আমি মনে করব! আমার এমনি পােড়া মন! তােমার জিনিস ওর নামে লিখে দিয়ে যেতে পারছ বলে তােমার যে সুখ সেই তাে আমার সকল সুখের বেশি, বাপ।”

 “কিন্তু, তােমাকেও আমি—”

 “দেখ্ যতীন, এইবার আমি রাগ করব। তুই চলে যাবি, আর তুই আমাকে টাকা দিয়ে ভুলিয়ে রেখে যাবি?”

 “মাসি, টাকার চেয়ে আরও বড়াে যদি কিছু, তােমাকে—”

 “দিয়েছিস যতীন, ঢের দিয়েছিস। আমার শূন্য ঘর ভরে ছিলি, এ আমার অনেক জন্মের ভাগ্য। এতদিন তাে বুক ভরে পেয়েছি, আজ আমার পাওনা যদি ফুরিয়ে গিয়ে থাকে তাে নালিশ করব না। দাও, সব লিখে দাও, লিখে দাও—বাড়িঘর, জিনিসপত্র, ঘােড়াগাড়ি, তালক-মুলক —যা আছে সব মণির নামে লিখে দাও—এ-সব বােঝা আমার সইবে না।”

 “তােমার ভােগে রুচি নেই—কিন্তু, মণির বয়স অল্প, তাই—”

 “ও কথা বলিস নে, ও কথা বলিস নে। ধনসম্পদ দিতে চাস দে, কিন্তু ভােগ করা—”

 “কেন ভােগ করবে না মাসি।”

 “না গাে না, পারবে না, পারবে না! আমি বলছি, ওর মুখে রুচবে না! গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাবে, কিছুতে কোনাে রস পাবে না।”

 যতীন চুপ করিয়া রহিল। তাহার অভাবে সংসারটা মণির কাছে একেবারে বিস্বাদ হইয়া যাইবে এ কথা সত্য কি মিথ্যা, সুখের কি দুঃখের, তাহা সে যেন ভাবিয়া ঠিক করিতে পারিল না। আকাশের তারা যেন তাহার হদয়ের মধ্যে আসিয়া কানে কানে বলিল, ‘এমনিই বটে—আমরা তাে হাজার হাজার বছর হইতে দেখিয়া আসিলাম, সংসার-জোড়া এই-সমস্ত আয়ােজন এত বড়ােই ফাঁকি।’

 যতীন গভীর একটা নিশ্বাস ফেলিয়া বলিল, “দেবার মতাে জিনিস তাে আমরা কিছুই দিয়ে যেতে পারি নে।”

 “কম কী দিয়ে যাচ্ছ বাছা। এই ঘরবাড়ি-টাকাকড়ির ছল করে তুমি ওকে যে কী দিয়ে গেলে তার মূল্য ও কি কোনােদিন বুঝবে না। যা তুমি দিয়েছ তাই মাথা পেতে নেবার শক্তি বিধাতা ওকে দিন, এই আশীর্বাদ ওকে করি।”

 “আর-একটু বেদানার রস দাও, আমার গলা শুকিয়ে এসেছে। মণি কি কাল এসেছিল—আমার ঠিক মনে পড়ছে না।”

 “এসেছিল। তখন তুমি ঘুমিয়ে পড়েছিলে। শিয়রের কাছে বসে বসে অনেক ক্ষণ বাতাস ক’রে তার পরে ধোবাকে তােমার কাপড় দিতে গেল।”

 “আশ্চর্য! বােধ হয় আমি ঠিক সেই সময়ে স্বপ্ন দেখছিলুম, যেন মণি আমার ঘরে আসতে চাচ্ছে—দরজা অল্প একটু ফাঁক হয়েছে—ঠেলাঠেলি করছে, কিন্তু কিছুতেই সেইটুকুর বেশি আর খুলছে না। কিন্তু, মাসি, তােমরা একটু বাড়াবাড়ি করছ—ওকে দেখতে দাও যে আমি মরছি—নইলে মত্যুকে হঠাৎ সইতে পারবে না।”

 “বাবা, তােমার পায়ের উপরে এই পশমের শালটা টেনে দিই—পায়ের তেলো ঠাণ্ডা হয়ে গেছে।”

 “না মাসি, গায়ের উপর কিছু দিতে ভালাে লাগছে না।”

 “জানিস যতীন? এই শালটা মণির তৈরি, এতদিন রাত জেগে জেগে সে তােমার জন্যে তৈরি করছিল। কাল শেষ করেছে।”

 যতীন শালটা লইয়া দুই হাত দিয়া একটু নাড়াচাড়া করিল। মনে হইল, পশমের কোমলতা যেন মণির মনের জিনিস; সে যে যতীনকে মনে করিয়া রাত জাগিয়া এইটি বুনিয়াছে, তার মনের সেই প্রেমের ভাবনাটি ইহার সঙ্গে গাঁথা পড়িয়াছে। কেবল পশম দিয়া নহে, মণির কোমল আঙুলের স্পর্শ দিয়া ইহা বােনা। তাই মাসি যখন শালটা তাহার পায়ের উপর টানিয়া দিলেন তখন তাহার মনে হইল, মণিই রাত্রির পর রাত্রি জাগিয়া তাহার পদসেবা করিতেছে।

 “কিন্তু মাসি, আমি তাে জানতুম মণি শেলাই করতে পারে না—সে শেলাই করতে ভালােই বাসে না।”

 “মন দিলে শিখতে কতক্ষণ লাগে। তাকে দেখিয়ে দিতে হয়েছে—ওর মধ্যে অনেক ভুল শেলাইও আছে।”

 “তা, ভুল থাকনা। ও তাে প্যারিস একজিবিশনে পাঠানাে হবে না—ভুল শেলাই দিয়ে আমার পা ঢাকা বেশ চলবে।”

 শেলাইয়ে যে অনেক ভুল-ত্রুটি আছে সেই কথা মনে করিয়াই যতীনের আরও বেশি আনন্দ হইল। বেচারা মণি পারে না, জানে না, বারবার ভুল করিতেছে, তবু ধৈর্য ধরিয়া রাত্রির পর রাত্রি শেলাই করিয়া চলিয়াছে—এই কল্পনাটি তাহার কাছে বড়াে করুণ, বড়াে মধুর লাগিল। এই ভুলে-ভরা শালটাকে আবার সে একটু নাড়িয়াচাড়িয়া লইল।


 “মাসি, ডাক্তার বুঝি নীচের ঘরে?”

 “হাঁ যতীন, আজ রাত্রে থাকবেন।”

 “কিন্তু, আমাকে যেন মিছামিছি ঘুমের ওষুধ দেওয়া না হয়। দেখেছ তাে ওতে আমার ঘুম হয় না, কেবল কষ্ট বাড়ে। আমাকে ভালাে ক’রে জেগে থাকতে দাও। জান মাসি? বৈশাখ-দ্বাদশীর রাত্রে আমাদের বিয়ে হয়েছিল—কাল সেই স্বাদশী আসছে—কাল সেইদিনকার রাত্রের সব তারা আকাশে জ্বালানাে হবে। মণির বােধ হয় মনে নেই—আমি তাকে সেই কথাটি আজ মনে করিয়ে দিতে চাই; কেবল তাকে তুমি দু মিনিটের জন্যে ডেকে দাও। চুপ করে রইলে কেন। বােধ হয় ডাক্তার তােমাদের বলেছে আমার শরীর দুর্বল, এখন যাতে আমার মনে কোনাে—কিন্তু, আমি তােমাকে নিশ্চয় বলছি মাসি, আজ রাত্রে তার সঙ্গে দুটি কথা কয়ে নিতে পারলে আমার মন খুব শান্ত হয়ে যাবে—তা হলে বােধ হয় আর ঘুমােবার ওষুধ দিতে হবে না। আমার মন তাকে কিছু বলতে চাচ্ছে ব’লেই এই দু রাত্রি আমার ঘুম হয় নি।— মাসি, তুমি অমন করে কেঁদো না। আমি বেশ আছি, আমার মন আজ যেমন ভরে উঠেছে আমার জীবনে এমন আর কখনােই হয় নি। সেইজন্যই আমি মণিকে ডাকছি। মনে হচ্ছে, আজ যেন আমার ভরা হৃদয়টি তার হাতে দিয়ে যেতে পারব। তাকে অনেক দিন অনেক কথা বলতে চেয়েছিলাম, বলতে পারি নি, কিন্তু আর এক মুহূর্ত দেরি করা নয়, তাকে এখনি ডেকে দাও—এর পরে আর সময় পাব না—না মাসি, তােমার ঐ কান্না আমি সইতে পারি নে। এতদিন তাে শান্ত ছিলে, আজ কেন তােমার এমন হল।”

 “ওরে যতীন, ভেবেছিলাম আমার সব কান্না ফুরিয়ে গেছে—কিন্তু দেখতে পাচ্ছি এখনাে বাকি আছে—আজ আর পারছি নে।”

 “মণিকে ডেকে দাও—তাকে বলে দেব, কালকের রাতের জন্যে যেন—„”

 “যাচ্ছি, বাবা। শম্ভু দরজার কাছে রইল, যদি কিছু দরকার হয় ওকে ডেকো।”


মাসি মণির শােবার ঘরে গিয়া মেজের উপর বসিয়া ডাকিতে লাগিলেন, “ওরে, আয়—একবার আয়—আয় রে রাক্ষসী, যে তােকে তার সব দিয়েছে তার শেষ কথাটি রাখ্—সে মরতে বসেছে, তাকে আর মারিস নে।”


যতীন পায়ের শব্দে চমকিয়া উঠিয়া কহিল, “মণি!”

 “না, আমি শম্ভু। আমাকে ডাকছিলেন?”

 “একবার তাের বউঠাকরুনকে ডেকে দে।”

 “কাকে?”

 “বউঠাকরুনকে।”

 “তিনি তাে এখনাে ফেরেন নি।”

 “কোথায় গেছেন?”

 “সীতারামপুরে।”

 “আজ গেছেন?”

 “না, আজ তিন দিন হল গেছেন।”

 ক্ষণকালের জন্য যতীনের সর্বাঙ্গ ঝিম্‌ঝিম্ করিয়া আসিল—সে চোখে অন্ধকার দেখিল। এতক্ষণ বালিশে ঠেসান দিয়া বসিয়াছিল, শুইয়া পড়িল। পায়ের উপর সেই পশমের শাল ঢাকা ছিল, সেটা পা দিয়া ঠেলিয়া ফেলিয়া দিল।

অনেক ক্ষণ পরে মাসি যখন আসিলেন যতীন মণির কথা কিছুই বলিল না। মাসি ভাবিলেন, সে কথা উহার মনে নাই।

 হঠাৎ যতীন এক সময়ে বলিয়া উঠিল, “মাসি, তােমাকে কি আমার সেদিনকার স্বপ্নের কথা বলেছি।”

 “কোন্ স্বপ্ন।”

 “মণি যেন আমার ঘরে আসবার জন্য দরজা ঠেলছিল—কোনােমতেই দরজা এতটুকুর বেশি ফাঁক হল না, সে বাইরে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগল, কিন্তু কিছুতেই ঢুকতে পারল না। মণি চিরকাল আমার ঘরের বাইরেই দাঁড়িয়ে রইল। তাকে অনেক করে ডাকলাম, কিন্তু এখানে তার জায়গা হল না।”

 মাসি কিছু না বলিয়া চুপ করিয়া রহিলেন। ভাবিলেন, ‘যতীনের জন্য মিথ্যা দিয়া যে একটুখানি স্বর্গ রচিতেছিলাম সে আর টিঁকিল না। দুঃখ যখন আসে তাহাকে স্বীকার করাই ভালাে—প্রবঞ্চনার দ্বারা বিধাতার মার ঠেকাইবার চেষ্টা করা কিছু নয়।’

 “মাসি, তােমার কাছে যে স্নেহ পেয়েছি সে আমার জন্মজন্মান্তরের পাথেয়, আমার সমস্ত জীবন ভরে নিয়ে চললুম। আর-জন্মে তুমি নিশ্চয় আমার মেয়ে হয়ে জন্মাবে, আমি তােমাকে বুকে করে মানুষ করব।”

 “বলিস কী যতীন, আবার মেয়ে হয়ে জন্মাব? নাহয়, তােরই কোলে ছেলে হয়েই জন্ম হবে—সেই কামনাই কর্-না।”

 “না, না, ছেলে না। ছেলেবেলায় তুমি যেমন সুন্দরী ছিলে তেমনি অপরূপ সুন্দরী হয়েই তুমি আমার ঘরে আসবে। আমার মনে আছে, আমি তােমাকে কেমন করে সাজাব।”

 “আর বকিস্ নে যতীন, বকিস্ নে— একটু ঘুমাে।”

 “তােমার নাম দেব লক্ষীরানী।”

 “ও তাে একেলে নাম হল না।”

 “না, একেলে নাম না। মাসি, তুমি আমার সাবেক-কেলে—সেই সাবেক কাল নিয়েই তুমি আমার ঘরে এসাে।”

 “তাের ঘরে আমি কন্যাদায়ের দুঃখ নিয়ে আসব, এ কামনা আমি তাে করতে পারি নে।”

 “মাসি, তুমি আমাকে দুর্বল মনে কর?— আমাকে দুঃখ থেকে বাঁচাতে চাও?”

 “বাছা, আমার যে মেয়েমানুষের মন, আমিই দুর্বল—সেইজন্যেই আমি বড়ো ভয়ে ভয়ে তােকে সকল দুঃখ থেকে চিরদিন বাঁচাতে চেয়েছি। কিন্তু, আমার সাধ্য কী আছে। কিছুই করতে পারি নি।”

 “মাসি, এ জীবনের শিক্ষা আমি এ জীবনে খাটাবার সময় পেলুম না। কিন্তু, এ সমস্তই জমা রইল, আসছে বারে মানুষ যে কী পারে তা আমি দেখাব। চিরটা দিন নিজের দিকে তাকিয়ে থাকা যে কী ফাঁকি তা আমি বুঝেছি।”

 “যাই বল বাছা, তুমি নিজে কিছু নাও নি, পরকেই সব দিয়েছ।”

 “মাসি, একটা গর্ব আমি করব, আমি সখের উপরে জবর্দস্তি করি নি—কোনােদিন এ কথা বলি নি, যেখানে আমার দাবি আছে সেখানে আমি জোর খাটাব। যা পাই নি তা কাড়াকাড়ি করি নি। আমি সেই জিনিস চেয়েছিলুম যার উপরে কারও স্বত্ব নেই—সমস্ত জীবন হাতজোড় ক’রে অপেক্ষাই করলুম; মিথ্যাকে চাই নি ব’লেই এতদিন এমন করে বসে থাকতে হল—এইবার সত্য হয়তাে দয়া করবেন। ও কে ও—মাসি, ও কে।”

 “কই, কেউ তাে না যতীন।”

 “মাসি, তুমি একবার ও ঘরটা দেখে এসো গে, আমি যেন—”

“না বাছা, কাউকে তাে দেখলুম না।”

 “আমি কিন্তু স্পষ্ট যেন—”

 “কিচ্ছু না, যতীন—ঐ যে ডাক্তারবাবু, এসেছেন।”


 “দেখুন, আপনি ওঁর কাছে থাকলে উনি বড় বেশি কথা কন। কয়রাত্রি এমনি ক’রে তাে জেগেই কাটালেন। আপনি শুতে যান, আমার সেই লােকটি এখানে থাকবে।”

 “না মাসি, না, তুমি যেতে পাবে না।”

 “আচ্ছা বাছা, আমি নাহয় ঐ কোণটাতে গিয়ে বসছি।”

 “না, না, তুমি আমার পাশেই বসে থাকো—আমি তােমার এ হাত কিছুতেই ছাড়ছি নে—শেষ পর্যন্ত না। আমি যে তােমারই হাতের মানুষ, তােমারই হাত থেকে ভগবান আমাকে নেবেন।”

 “আচ্ছা বেশ, কিন্তু আপনি কথা কবেন না যতীনবাবু। সেই ওষুষটা খাওয়াবার সময় হল—”

 “সময় হল? মিথ্যা কথা। সময় পার হয়ে গেছে—এখন ওষুধ খাওয়ানো কেবল ফাঁকি দিয়ে সান্ত্বনা করা। আমার তার কোনাে দরকার নেই। আমি মরতে ভয় করি নে। মাসি, যমের চিকিৎসা চলছে, তার উপরে আবার সব ডাক্তার জড়াে করেছ কেন—বিদায় করে দাও, সব বিদায় করে দাও। এখন আমার একমাত্র তুমি—আর আমার কাউকে দরকার নেই—কাউকে না—কোনাে মিথ্যাকেই না।”

 “আপনার এই উত্তেজনা ভালাে হচ্ছে না।”

 “তা হলে তােমরা যাও, আমাকে উত্তেজিত কোরাে না।—মাসি, ডাক্তার গেছে? আচ্ছা, তা হলে তুমি এই বিছানায় উঠে বােসাে—আমি তােমার কোলে মাথা দিয়ে একটু শুই।”

 “আচ্ছা, শােও বাবা, লক্ষীটি, একটু ঘুমােও।”

 “না মাসি, ঘুমােতে বােলাে না—ঘুমােতে ঘুমােতে হয়তাে আর ঘুম ভাঙবে না। এখনাে আর-একটু আমার জেগে থাকবার দরকার আছে।— তুমি শব্দ শুনতে পাচ্ছ না? ঐ যে আসছে! এখনই আসবে।”

 “বাবা যতীন, একটু চেয়ে দেখাে—ঐ যে এসেছে। একবারটি চাও।”

 “কে এসেছে। স্বপ্ন?”

 “স্বপ্ন নয় বাবা, মণি এসেছে—তােমার শ্বশুর এসেছেন।”

 “তুমি কে।”

 “চিনতে পারছ না বাবা, ঐ তাে তােমার মনি।”

 “মণি, সেই দরজাটা কি সব খুলে গিয়েছে।”

 “সব খুলেছে, বাপ আমার, সব খুলেছে।

 “না মাসি, আমার পায়ের উপর ও শাল নয়, ও শাল নয়! ও শাল মিথ্যে, ও শাল ফাঁকি!”

 “শাল নয় যতীন। বউ তোর পায়ের উপর পড়েছে—ওর মাথায় হাত রেখে একটু আশীর্বাদ কর্।— অমন করে কাঁদিস নে বউ, কাঁদবার সময় আসছে—এখন একটুখানি চুপ কর্।”

 আশ্বিন ১৩২১