নামঞ্জুর গল্প

আমাদের আসর জমেছিল পোলিটিক্যাল লঙ্কাকাণ্ডের পালায়। হাল আমলের উত্তরকাণ্ডে আমরা সম্পূর্ণ ছুটি পাই নি বটে, কিন্তু গলা ভেঙেছে, তা ছাড়া সেই অগ্নিদাহের খেলা বন্ধ।

 বঙ্গভঙ্গের রঙ্গভূমিতে বিদ্রোহীর অভিনয় শুরু হল। সবাই জানেন, এই নাট্যের পঞ্চম অঙ্কের দৃশ্য আলিপুর পেরিয়ে পৌঁছল আণ্ডামানের সমদ্রকূলে। পারানির পাথেয় আমার যথেষ্ট ছিল, তবু গ্রহের গুণে এ পারের হাজতেই আমার ভোগসমাপ্তি। সহযোগীদের মধ্যে ফাঁসিকাঠ পর্যন্ত যাদের সর্বোচ্চ প্রোমোশন হয়েছিল, তাদের প্রণাম ক’রে আমি পশ্চিমের এক শহরের কোণে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসায় পসার জমিয়ে তুললেম।

 তখনো আমার বাবা বেঁচে। তিনি ছিলেন বাংলাদেশের এক বড়ো মহকুমার সরকারি উকিল। উপাধি ছিল রায়বাহাদুর। তিনি বিশেষ-একটু ঘটা করেই আমার বাড়ি আসা বন্ধ করে দিলেন। তাঁর হৃদয়ের সঙ্গে আমার যোগ বিচ্ছিন্ন হয়েছিল কি না অন্তর্যামী জানেন, কিন্তু হয়েছিল পকেটের সঙ্গে। মনি-অর্ডারের সম্পর্ক পর্যন্ত ছিল না। যখন আমি হাজতে তখনই মায়ের মৃত্যু হয়েছিল। আমার পাওনা শাস্তিটা গেল তাঁর উপর দিয়েই।

 আমার পিসি ব’লে যিনি পরিচিত তিনি আমার স্বোপার্জিত কিম্বা আমার পৈতৃক, তা নিয়ে কারও কারও মনে সংশয় আছে। তার কারণ, আমি পশ্চিমে যাবার পূর্বে তাঁর সঙ্গে আমার সম্বন্ধ সম্পূর্ণই অব্যক্ত ছিল। তিনি আমার কে তা নিয়ে সন্দেহ থাকে তো থাক, কিন্তু তাঁর স্নেহ না পেলে সেই আত্মীয়তার অরাজকতা-কালে আমাকে বিষম দুঃখ পেতে হত। তিনি আজন্ম পশ্চিমেই কাটিয়েছেন; সেইখানেই বিবাহ, সেইখানেই বৈধব্য। সেইখানেই স্বামীর বিষয়সম্পত্তি। বিধবা তাই নিয়েই বদ্ধ ছিলেন।

 তাঁর আরও একটি বন্ধন ছিল। বালিকা অমিয়া। কন্যাটি স্বামীর বটে, স্ত্রীর নয়। তার মা ছিল পিসিমার এক যুবতী দাসী, জাতিতে কাহার। স্বামীর মৃত্যুর পর মেয়েটিকে তিনি ঘরে এনে পালন করছেন— সে জানেও না যে, তিনি তার মা নন।

 এমন অবস্থায় তাঁর আর-একটি বন্ধন বাড়ল, সে হচ্ছে আমি স্বয়ং। যখন জেলখানার বাইরে আমার স্থান অত্যন্ত সংকীর্ণ তখন এই বিধবাই আমাকে তাঁর ঘরে এবং হৃদয়ে আশ্রয় দিলেন। তার পরে বাবার দেহান্তে যখন জানা গেল, উইলে তিনি আমাকে বিষয় থেকে বঞ্চিত করেন নি, তখন সুখে দুঃখে আমার পিসির চোখে জল পড়ল। বুঝলেন, আমার পক্ষে তাঁর প্রয়োজন ঘুচল। তাই বলে স্নেহ তো ঘুচল না।

 তিনি বললেন, “বাবা, যেখানেই থাক আমার আশীর্বাদ রইল।”

 আমি বললেম, “সে তো থাকবেই, সেই সঙ্গে তোমাকেও থাকতে হবে, নইলে আমার চলবে না। হাজত থেকে বেরিয়ে যে মাকে আর দেখতে পাই নি তিনিই আমাকে পথ দেখিয়ে তোমার কাছে নিয়ে এসেছেন।”

 পিসিমা তাঁর এতকালের পশ্চিমের ঘর-সংসার তুলে দিয়ে আমার সঙ্গে কলকাতায় চলে এলেন। আমি হেসে বললেম, “তোমার স্নেহগঙ্গার ধারাকে পশ্চিম থেকে পূর্বে বহন করে এনেছি, আমি কলির ভগীরথ।”

 পিসিমা হাসলেন, আর চোখের জল মুছলেন। তাঁর মনের মধ্যে কিছু দ্বিধাও হল, বললেন, “অনেক দিন থেকে ইচ্ছে ছিল, মেয়েটার কোনো-একটা গতি ক’রে শেষ বয়সে তীর্থ করে বেড়াব—কিন্তু, বাবা, আজ যে তার উল্টো পথে টেনে নিয়ে চললি।”

 আমি বললাম, “পিসিমা, আমিই তোমার সচল তীর্থ। যে-কোনো ত্যাগের ক্ষেত্রেই তুমি আত্মদান কর’-না কেন, সেইখানেই তোমার দেবতা আপনি এসে তা গ্রহণ করবেন। তোমার যে পুণ্য আত্মা।”

 সব চেয়ে একটা যুক্তি তাঁর মনে প্রবল হল। তাঁর আশঙ্কা ছিল, স্বভাবতই আমার প্রবৃত্তির ঝোঁকটা আণ্ডামান-মুখো, অতএব কেউ আমাকে সামলাবার না থাকলে অবশেষে একদিন পুলিসের বাহবন্ধনে বদ্ধ হবই। তাঁর মতলব ছিল, যে কোমল বাহুবন্ধন তার চেয়ে অনেক বেশি কঠিন ও স্থায়ী আমার জন্য তারই ব্যবস্থা করে দিয়ে তবে তিনি তীর্থভ্রমণে বার হবেন। আমার বন্ধন নইলে তাঁর মুক্তি নেই।

 আমার চরিত্র সম্বন্ধে এইখানে ভুল হিসেবে করেছিলেন। কুষ্টিতে আমার বধ-বন্ধনের গ্রহটি অন্তিমে আমাকে শকুনি-গৃধিনীর হাতে সঁপে দিতে নারাজ ছিলেন না, কিন্তু প্রজাপতির হাতে নৈব নৈব চ। কন্যাকর্তারা ত্রুটি করেন নি, তাঁদের সংখ্যাও অজস্র। আমার পৈতৃক সম্পত্তির বিপুল সচ্ছলতার কথা সকলেই জানত; অতএব, ইচ্ছা করলে সম্ভবপর শ্বশুরকে দেউলে করে দিয়ে কন্যার সঙ্গে সঙ্গে বিশ-পঁচিশ হাজার টাকা নহবতে সাহানা বাজিয়ে হাসতে হাসতে আদায় করতে পারতেম। করি নি। আমার ভাবী চরিত-লেখক এ কথা যেন স্মরণ রাখেন যে, স্বদেশসেবার সংকল্পের কাছে এককালীন আমার এই বিশ-পঁচিশ হাজার টাকার ত্যাগ। জমা খরচের অঙ্কটা অদৃশ্য কালীতে লেখা আছে ব’লে যেন আমার প্রশংসার হিসাব থেকে বাদ না পড়ে। পিতামহ ভীষ্মের সঙ্গে আমার মহৎ চরিত্রের এইখানে মিল আছে।

 পিসিমা শেষ পর্যন্ত আশা ছাড়েন নি। এমন সময়ে ভারতের পোলিটিক্যাল আকাশে আমাদের সেই ক্ষাত্রযুগের পরবর্তী যুগের হাওয়া বইল। পূর্বেই বলেছি, এখনকার পালায় আমরা প্রধান নায়ক নই, তবু ফুট-লাইটের অনেক পিছনে মাঝে মাঝে নিস্তেজভাবে আমাদের আসা-যাওয়া চলছে। এত নিস্তেজ যে, পিসিমা আমার সম্বন্ধে নিশ্চিতই ছিলেন। আমার জন্যে কালীঘাটে স্বস্ত্যয়ন করবার ইচ্ছে এক কালে তাঁর ছিল, কিন্তু ইদানিং আমার ভাগ্য-আকাশে লাল-পাগড়ির রক্তমেঘ একেবারে অদৃশ্য থাকাতে তাঁর আর খেয়াল রইল না। এইটেই ভুল করলেন।

 সেদিন পুজোর বাজারে ছিল খদ্দরের পিকেটিং। নিতান্ত কেবল দর্শকের মতন গিয়েছিলেম— আমার উৎসাহের তাপমাত্রা ৯৮ অঙ্কেরও নীচে ছিল, নাড়ীতে বেশি বেগ ছিল না। সেদিন যে আমার কোনো আশঙ্কার কারণ থাকতে পারে সে খবর আমার কুষ্ঠির নক্ষত্র ছাড়া আর সবার কাছে ছিল অগোচর। এমন সময় খদ্দরপ্রচারকারিণী কোনো বাঙালি মহিলাকে পুলিস সার্জন দিলে ধাক্কা। মূহূর্তের মধ্যেই আমার অহিংস অসহযোগের ভাবখানা প্রবল দুঃসহযোগে পরিণত হল। সুতরাং অনতিবিলম্বে থানায় হল আমার গতি। তার পরে যথানিয়মে হাজতের লালায়িত কবলের থেকে জেলখানার অন্ধকার জঠরদেশে অবতরণ করা গেল। পিসিমাকে ব’লে গেলেম, “এইবার, কিছুকালের জন্যে তোমার মুক্তি। আপাতত আমার উপযুক্ত অভিভাবকের অভাব রইল না, অতএব এই সুযোগে তুমি তীর্থভ্রমণ করে নাও গে। অমিয়া থাকে কলেজের হস্টেলে; বাড়িতেও দেখবার-শোনবার লোক আছে; অতএব, এখন তুমি দেবসেবায় ষোলো-আনা মন দিলে দেব মানব কারও কোনো আপত্তির কথা থাকবে না।”

 জেলখানাকে জেলখানা বলেই গণ্য করে নিয়েছিলেম। সেখানে কোনোরকম দাবিদাওয়া আবদার উৎপাত করি নি। সেখানে সুখ সম্মান সৌজন্য বৃহৎ ও সুখাদ্যের অভাবে অত্যন্ত বেশি বিস্মিত হই নি। কঠোর নিয়মগুলোকে কঠোরভাবেই মেনে নিয়েছিলেম। কোনোরকম আপত্তি করাটাই লজ্জার বিষয় ব’লে মনে করতেন।

 মেয়াদ পুরো হবার কিছু পূর্বেই ছুটি পাওয়া গেল। চারি দিকে খুব হাততালি। মনে হল যেন বাংলাদেশের হাওয়ায় বাজতে লাগল, ‘এন্‌কোর! এক্‌সেলেণ্ট!’ মনটা খারাপ হল। ভাবলেম, যে ভুগল সেই কেবল ভুগল— আর, মিষ্টান্নমিতরে জনাঃ, রস পেলে দশে মিলে। সেও বেশিক্ষণ নয়; নাট্যমঞ্চের পর্দা পড়ে যায়, আলো নেভে, তার পরে ভোলবার পালা। কেবল বেড়ি-হাতকড়ার দাগ যার হাড়ে গিয়ে লেগেছে তারই চিরদিন মনে থাকে।

 পিসিমা এখনো তীর্থে। কোথায়, তার ঠিকানাও জানি নে। ইতিমধ্যে পূজোর সময় কাছে এল। একদিন সকালবেলায় আমার সম্পাদক-বন্ধু এসে উপস্থিত। বললেন, “ওহে, পূজোর সংখ্যার জন্যে একটা লেখা চাই।”

 জিজ্ঞাসা করলেম, “কবিতা?”

 “আরে, না। তোমার জীবনবৃত্তান্ত।”

 “সে তো তোমার এক সংখ্যায় ধরবে না।”

 “এক সংখ্যায় কেন। ক্রমে ক্রমে বেরোবে।”

 “সতীর মৃতদেহ সুদর্শনচক্রে টুক্‌রো টুক্‌রো ক’রে ছড়ানো হয়েছিল। আমার জীবনচরিত সম্পাদকি চক্রে তেমনি টুকরো টুকরো ক’রে সংখ্যায় সংখ্যায় ছড়িয়ে দেবে, এটা আমার পছন্দসই নয়। জীবনী যদি লিখি গোটা আকারে বের করে দেব।”

 “নাহয় তোমার জীবনের কোনো একটা বিশেষ ঘটনা লিখে দাও-না।”

 “কিরকম ঘটনা।”

 “তোমার সব চেয়ে কঠোর অভিজ্ঞতা, খুব যাতে ঝাঁজ।”

 “কী হবে লিখে।”

 “লোকে জানতে চায় হে।”

 “এত কৌতূহল? আচ্ছা, বেশ, লিখব।”

 “মনে থাকে যেন, সব চেয়ে যেটাতে তোমার কঠোর অভিজ্ঞতা।”

 “অর্থাৎ, সব চেয়ে যেটাতে দঃখ পেয়েছি লোকের তাতেই সব চেয়ে মজা। আচ্ছা, বেশ। কিন্তু, নামটামগুলো অনেকখানি বানাতে হবে।”

 “তা তো হবেই। যেগুলো একেবারে মারাত্মক কথা তার ইতিহাসের চিহ্ন বদল না করলে বিপদ আছে। আমি সেইরকম মরিয়া-গোছের জিনিসই চাই। পেজ প্রতি তোমাকে—”

 “আগে লেখাটা দেখো, তার পরে দরদস্তুর হবে।”

 “কিন্তু, আর-কাউকে দিতে পারবে না বলে রাখছি।” যিনি যত দর হাঁকুন, আমি তার উপরে—”

 “আচ্ছা আচ্ছা, সে হবে।”

 শেষকালটা উঠে যাবার সময় বলে গেলেন, “তোমাদের ইনি— বুঝতে পারছ? নাম করব না—ঐ-যে তোমাদের সাহিত্যধুরন্ধর—মস্ত লেখক ব’লে বড়াই— কিন্তু, যা বলো তোমার স্টাইলের কাছে তার স্টাইল যেন ডসনের বুট আর তালতলার চটি।”

 বুঝলেম আমাকে উপরে চড়িয়ে দেওয়াটা উপলক্ষমাত্র, তুলনায় ধুরন্ধরকে নাবিয়ে দেওয়াটাই লক্ষ্য।

 এই গেল আমার ভূমিকা। এইবার আমার কঠোর অভিজ্ঞতার কাহিনী।—


‘সন্ধ্যা’ কাগজ যেদিন থেকে পড়তে শুরু সেইদিন থেকেই আহারবিহার সম্বন্ধে আমার কড়া ভোগ। সেটাকে জেলযাত্রার রিহার্সাল বলা হত। দেহের প্রতি অনাদরের অভ্যাস পাকা হয়ে উঠল। তাই প্রথমবার যখন ঠেললে হাজতে, প্রাণপুরুষ বিচলিত হয় নি। তার পর বেরিয়ে এসে নিজের ’পরে কারও সেবাশুশ্রূষার হস্তক্ষেপমাত্র বর্দাস্ত করি নি। পিসিমা দুঃখবোধ করতেন। তাঁকে বলতেম, “পিসিমা, স্নেহের মধ্যে মুক্তি, সেবার মধ্যে বন্ধন। তা ছাড়া, একের শরীরে অন্য শরীরধারীর আইন খাটানোকে বলে ডাইয়ার্কি, স্বৈরাজ্য— সেইটের বিরুদ্ধে আমাদের অসহযোগ।”

 তিনি নিশ্বাস ছেড়ে বলতেন, “আচ্ছা বাবা, তোমাকে বিরক্ত করব না।”

 নির্বোধ, মনে মনে ভাবতেম বিপদ কাটল।

 ভুলেছিলেম, স্নেহসেবার একটা প্রচ্ছন্ন রূপ আছে। তার মায়া এড়ানো শক্ত। অকিঞ্চন শিব যখন তাঁর ভিক্ষের ঝুলি নিয়ে দারিদ্র্যাগৌরবে মগ্ন তখন খবর পান না যে, লক্ষ্মী কোন্-এক সময়ে সেটা নরম রেশম দিয়ে বুনে রেখেছেন, তার সোনার সুতোর দামে সূর্যনক্ষত্র বিকিয়ে যায়। যখন ‘ভিক্ষের অন্ন খাচ্ছি’ বলে সন্ন্যাসী নিশ্চিন্ত তখন জানেন না যে, অন্নপূর্ণা এমন মসলায় বানিয়েছেন যে, দেবরাজ প্রসাদ পাবার জন্যে নন্দীর কানে কানে ফিস্‌ফিস্ করতে থাকেন। আমার হল সেই দশা। শয়নে বসনে অশনে পিসিমার সেবার হস্ত গোপনে ইন্দ্রজাল বিস্তার করতে লাগল, সেটা দেশাত্মবোধীর অন্যমনস্ক চোখে পড়ল না। মনে মনে ঠিক দিয়ে বসে আছি, তপস্যা আছে অক্ষুণ্ণ। চমক ভাঙল জেলখানায় গিয়ে। পিসিমা ও পুলিসের ব্যবস্থার মধ্যে যে-একটা ভেদ আছে, কোনো রকম অদ্বৈতবুদ্ধি দ্বারা তার সমন্বয় করতে পারা গেল না। মনে মনে কেবলই গীতা আওড়াতে লাগলেম; নিস্ত্রৈগুণ্যো ভব্যর্জুন। হায় রে তপস্বী, কখন যে পিসিমার নানা গুণ নানা উপকরণ-সংযোগে হৃদয়দেশ পেরিয়ে একেবারে পাকযন্ত্রে প্রবেশ করেছে, তা জানতেও পারি নি। জেলখানায় এসে সেই জায়গাটাতে বিপাক ঘটতে লাগল।

 ফল হল এই যে, বজ্রাঘাত ছাড়া আর কিছুতে যে শরীর কাবু হত না সে পড়ল অসুস্থ হয়ে। জেলের পেয়াদা যদি-বা ছাড়লে জেলের রোগগুলোর মেয়াদ আর ফুরোতে চায় না। কখনো মাথা ধরে, হজম প্রায় হয় না, বিকেলবেলা জ্বর হতে থাকে। ক্রমে যখন মালাচন্দন হাততালি ফিকে হয়ে এসেছে তখনো এ আপদগুলো টন্‌টনে হয়ে রইল।

 মনে মনে ভাবি, পিসিমা তো তীর্থ করতে গেছেন, তাই ব’লে অমিয়াটার কি ধর্মজ্ঞান নেই। কিন্তু, দোষ দেব কাকে। ইতিপূর্বে অসুখে-বিসুখে আমার সেবা করবার জন্যে পিসিমা তাকে অনেকবার উৎসাহিত করেছেন— আমিই বাধা দিয়ে বলেছি, ভালো লাগে না।

 পিসিমা বলেছেন, “অমিয়ার শিক্ষার জন্যেই বলছি, তোর আরামের জন্যে নয়।”

 আমি বলেছি, “হাসপাতালে নার্সিং করতে পাঠাও-না।”

 পিসিমা রাগ করে আর জবাব করেন নি।

 আজ শুয়ে শুয়ে মনে মনে ভাবছি, ‘নাহয় এক সময়ে বাধাই দিয়েছি, তাই বলে কি সেই বাধাই মানতে হবে। গুরুজনের আদেশের ’পরে এত নিষ্ঠা এই কলিযুগে!’

 সাধারণত নিকট সংসারের ছোটোবড়ো অনেক ব্যাপারই দেশাত্মবোধীর চোখ এড়িয়ে যায়। কিন্তু, অসুখ ক’রে পড়ে আছি বলে আজকাল দৃষ্টি হয়েছে প্রখর। লক্ষ্য করলেম, আমার অবর্তমানে অমিয়ারও দেশাত্মবোধ পূর্বের চেয়ে অনেক বেশি প্রবল হয়ে উঠেছে। ইতিপূর্বে আমার দৃষ্টান্ত ও শিক্ষায় তার এত অভাবনীয় উন্নতি হয় নি। আজ অসহযোগের অসহ্য আবেগে সে কলেজ-ত্যাগিনী; ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা করতেও তার হৃৎকম্প হয় না; অনাথাসদনের চাঁদার জন্যে অপরিচিত লোকের বাড়িতে গিয়েও সে ঝুলি ফিরিয়ে বেড়ায়। এও লক্ষ্য করে দেখলেম, অনিল তার এই কঠিন অধ্যবসায় দেখে তাকে দেবী ব’লে ভক্তি করে— ওর জন্মদিনে সেই ভাবেরই একটা ভাঙা ছন্দের স্তোত্র সে সোনার কালীতে ছাপিয়ে ওকে উপহার দিয়েছিল।

 আমাকেও ঐ ধরনের একটা কিছু বানাতে হবে, নইলে অসুবিধা হচ্ছে। পিসিমার আমলে চাকরবাকরগুলো যথানিয়মে কাজ করত; হাতের কাছে কাউকে না কাউকে পাওয়া যেত। এখন এক গ্লাস জলের দরকার হলে আমার মেদিনীপুরবাসী শ্রীমান জলধরের অকস্মাৎ অভ্যাগমের প্রত্যাশায় চাতকের মতো তাকিয়ে থাকি; সময় মলিয়ে ওষুধ খাওয়া সম্বন্ধে নিজের ভোলা মনের ’পরেই একমাত্র ভরসা। আমার চিরদিনের নিয়মবিরুদ্ধ হলেও রোগশয্যায় হাজিরে দেবার জন্যে অমিয়াকে দুই-একবার ডাকিয়ে এনেছি; কিন্তু দেখতে পাই, পায়ের শব্দ শুনলেই সে দরজার দিকে চমকে তাকায়, কেবলই উস্‌খুস্ করতে থাকে। মনে দয়া হয়; বলি, “অমিয়া, আজ নিশ্চয় তোদের মিটিং আছে।”

 অমিয়া বলে, “তা হোক-না দাদা, এখনো আর-কিছুক্ষণ—”

 আমি বলি, “না না, সে কি হয়। কর্তব্য সব আগে।”

 কিন্তু, প্রায়ই দেখতে পাই, কর্তব্যের অনেক আগেই অনিল এসে উপস্থিত হয়। তাতে অমিয়ার কর্তব্য-উৎসাহের পালে যেন দম্‌কা হাওয়া লাগে, আমাকে বড়ো বেশি-কিছু বলতে হয় না।

 শুধু অনিল নয়, বিদ্যালয়-বর্জক আরও অনেক উৎসাহী যুবক আমার বাড়ির একতলায় বিকেলে চা এবং ইন্‌স্‌পিরেশন গ্রহণ করতে একত্র হয়। তারা সকলেই অমিয়াকে যুগলক্ষ্মী বলে সম্ভাষণ করে। একরকম পদবী আছে, যেমন রায়বাহাদুর, পাট-করা চাদরের মতো, যাকেই দেওয়া যায় নির্ভাবনায় কাঁধে ঝুলিয়ে বেড়াতে পারে। আর-একরকম পদবী আছে, যার ভাগ্যে জোটে সে বেচারা নিজেকে পদবীর সঙ্গে মাপসই করবার জন্যে অহরহ উৎকণ্ঠিত হয়ে থাকে। স্পষ্টই বুঝলেম, অমিয়ার সেই অবস্থা সর্বদাই অত্যন্ত বেশি উৎসাহপ্রদীপ্ত হয়ে না থাকলে তাকে মানায় না। খেতে শুতে তার সময় না-পাওয়াটা বিশেষ সমারোহ করেই ঘটে। এ পাড়ায় ও পাড়ায় খবর পৌঁছয়। কেউ যখন বলে এমন করলে শরীর টিঁকবে কী করে, সে একটুখানি হাসে— আশ্চর্য সেই হাসি। ভক্তরা বলে, “আপনি একটু বিশ্রাম করুন গে, একরকম করে কাজটা সেরে নেব”; সে তাতে ক্ষুণ্ণ হয়— ক্লান্তি থেকে বাঁচানোই কি বড়ো কথা। দুঃখগৌরব থেকে বঞ্চিত করা কি কম বিড়ম্বনা। তার ত্যাগস্বীকারের ফর্দের মধ্যে আমিও পড়ে গেছি। আমি যে তার এত বড়ো জেল-খাটা দাদা— উল্লাসকর-কানাই-বারীন-উপেন্দ্র প্রভৃতির সঙ্গে এক জ্যোতিষ্কমণ্ডলীতে যার স্থান, গীতার দ্বিতীয় অধ্যায় পার হয়ে তার যে দাদা গীতার শেষ দিকের অধ্যায়ের মুখে অগ্রসর হয়েছে, তাকেও যথোচিত পরিমাণে দেখবার সে সময় পায় না। এত বড়ো স্যাক্রিফাইস! যেদিন কোনো কারণে তার দলের লোকের অভাব হয়েছে সেদিন আমিও তার উৎসাহের মৌতাত জোগাবার জন্য বলেছি, “অমিয়া, ব্যক্তিগত মানুষের সঙ্গে সম্বন্ধ তোর জন্যে নয়, তোর জন্যে বর্তমান যুগ।” আমার কথাটা সে গম্ভীরমুখে নীরবে মেনে নিয়েছে। জেলে যাওয়ার পর থেকে আমার হাসি অন্তঃশীলা বইছে— যারা আমাকে চেনে না তারা বাইরে থেকে আমাকে খুব গম্ভীর বলেই মনে করে।

 বিছানায় একলা পড়ে পড়ে কড়িকাঠের দিকে চেয়ে চেয়ে ভাবছি: বিমুখা বান্ধবী যান্তি। হঠাৎ মনে পড়ে গেল, সেদিন কোথা থেকে একটা ন্যাঙলা কুকুর আমার বারান্দার কোণে আশ্রয় খুঁজছিল। গায়ের রোঁওয়া উঠে গেছে, জীর্ণ চামড়ার তলায় কঙ্কালের আব্রু নেই— আধমরা তার অবস্থা। অত্যন্ত ঘৃণার সঙ্গে তাকে দূর-দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছিলেম। আজ ভাবছিলেম, এতটা বেশি ঝাঁজের সঙ্গে তাকে তাড়ালেম কেন। বেগানা কুকুর ব’লে নয়, ওর সর্বাঙ্গে মরণদশা দেখা দিয়েছে ব’লে। প্রাণের সংগীতসভায় ওর অস্তিত্বটা বেসুরো, ওর রুগ্‌ণতা বেয়াদবি। ওর সঙ্গে নিজের তুলনা মনে এল। চারি দিকের চলমান প্রাণের ধারার মধ্যে আমার অস্বাস্থ্য একটা স্থাবর পদার্থ, স্রোতের বাধা। সে দাবি করে, ‘শিয়রের কাছে চুপ করে বসে থাকো।’ প্রাণের দাবি, ‘দিকে বিদিকে চ’লে বেড়াও।’ রোগের বাঁধনে যে নিজে বদ্ধ, অরোগীকে সে বন্দী করতে চায়— এটা একটা অপরাধ। অতএব, জীবলোকের উপর সব দাবি একেবারে পরিত্যাগ করব মনে ক’রে গীতা খুলে বসলেম। প্রায় যখন স্থিতধী অবস্থায় এসে পৌঁচেছি, মনটা রোগ-অরোগের দ্বন্দ্ব ছাড়িয়ে গেছে, এমন সময় অনুভব করলেম কে আমার পা ছুঁয়ে প্রণাম করলে। গীতা থেকে চোখ নামিয়ে দেখি, পিসিমার পোষ্যমণ্ডলীভুক্ত একটি মেয়ে। এ পর্যন্ত দূরের থেকেই সাধারণভাবেই তাকে জানি; বিশেষভাবে তার পরিচয় জানি নে— তার নাম পর্যন্ত আমার অবিদিত। মাথায় ঘোমটা টেনে ধীরে ধীরে সে আমার পায়ে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল।

 তখন মনে পড়ল, মাঝে মাঝে সে আমার দরজার বাইরের কোণে ছায়ার মতো এসে বারবার ফিরে ফিরে গেছে। বোধ করি সাহস করে ঘরে ঢুকতে পারে নি। আমার অজ্ঞাতসারে আমার মাথা ধরার, গায়ে ব্যথার, ইতিবৃত্তান্ত সে আড়াল থেকে অনেকটা জেনে গিয়েছে। আজ সে লজ্জাভয় দূর ক’রে ঘরের মধ্যে এসে প্রণাম করে বসল। আমি যে একদিন একজন মেয়েকে অপমান থেকে বাঁচাবার জন্যে দুঃখস্বীকারের অর্থ নারীকে দিয়েছি, সে হয়তো বা দেশের সমস্ত মেয়ের হয়ে আমার পায়ের কাছে তারই প্রাপ্তিস্বীকার করতে এসেছে। জেল থেকে বেরিয়ে অনেক সভায় অনেক মালা পেয়েছি, কিন্তু আজ ঘরের কোণে এই-যে অখ্যাত হাতের মানটুকু পেলেম এ আমার হৃদয়ে এসে বাজল। নিস্ত্রৈগুণ্য হবার উমেদার, এই জেল-খাটা পুরুষের বহু কালের শুকনো চোখ ভিজে ওঠবার উপক্রম করলে। পূর্বেই বলেছি, সেবায় আমার অভ্যেস নাই। কেউ পা টিপে দিতে এলে ভালোই লাগত না, ধমকে তাড়িয়ে দিতেম। আজ এই সেবা প্রত্যাখ্যান করার স্পর্ধা মনেও উদয় হল না।

 খুলনা জেলায় পিসিমার আদি শ্বশুরবাড়ি। সেখানকার গ্রামসম্পর্কের দুটিচারটি মেয়েকে পিসিমা আনিয়ে রেখেছেন। পিসিমার কাজকর্মে— পূজা-অর্চনায় তারা ছিল তাঁর সহকারিণী। তাঁর নানারকম ক্রিয়াকর্মে তাদের না হলে তাঁর চলত না। এ বাড়িতে আর সর্বত্রই অমিয়ার অধিকার ছিল, কেবল পুজোর ঘরে না। অমিয়া তার কারণ জানত না, জানবার চেষ্টাও করত না। পিসিমার মনে ছিল, অমিয়া ভালোরকম লেখাপড়া শিখে এমন ঘরে বিয়ে করবে যেখানে আচার-বিচারের বাঁধাবাঁধি নেই, আর দেবদ্বিজ যেখান থেকে খাতির না পেয়ে শূন্য হাতে ফিরে আসেন। এটা আক্ষেপের কথা। কিন্তু, এ ছাড়া ওর আর কোনো গতি হতেই পারে না— বাপের পাতক থেকে মেয়েকে সম্পূর্ণ বাঁচাবে কে। সেই কারণে অমিয়াকে তিনি ঢিলেমির ঢালু তট বেয়ে আধুনিক আচারহীনতার মধ্যে উত্তীর্ণ হতে বাধা দেন নি। ছেলেবেলা থেকে অঙ্কে আর ইংরেজিতে ক্লাসে সে হয়েছে ফার্স্ট। বছরে বছরে মিশনারি ইস্কুল থেকে ফ্রক্ প’রে বেণী দুলিয়ে চারটে-পাঁচটা ক’রে প্রাইজ নিয়ে এসেছে। যেবারে দৈবাৎ পরীক্ষায় দ্বিতীয় হয়েছে সেবারে শোবার ঘরে দরজা বন্ধ ক’রে কেঁ’দে চোখ ফুলিয়েছে; প্রায়োপবেশন করতে যায় আর-কি। এমনি ক’রে পরীক্ষাদেবতার কাছে সিদ্ধির মানত ক’রে সে তারই সাধনায় দীর্ঘকাল তন্ময় ছিল। অবশেষে অসহযোগের যোগিনীমন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে পরীক্ষাদেবীর বর্জন-সাধনাতেও সে প্রথম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হল। পাস্-গ্রহণেও যেমন পাস্-ছেদনেও তেমনি, কিছুতেই সে কারও চেয়ে পিছিয়ে থাকবার মেয়ে নয়। পড়াশুনো করে তার যে খ্যাতি—পড়াশানো ছেড়ে তার চেয়ে খ্যাতি অনেক বেশি বেড়ে গেল। আজ যে-সব প্রাইজ তার হাতের কাছে ফিরছে তারা চলে, তারা বলে, তারা অশ্রুসলিলে গলে, তারা কবিতাও লেখে।

 বলা বাহুল্য, পিসিমার পাড়াগেঁয়ে পোষ্য মেয়েগুলির ’পরে অমিয়ার একটুও শ্রদ্ধা ছিল না। অনাথাসদনে যে সময়ে চাঁদার টাকার চেয়ে অনাথারই অভাব বেশি সেই সময়ে এই মেয়েদের সেখানে পাঠাবার জন্যে পিসিমার কাছে অমিয়া অনেক আবেদন করেছে। পিসিমা বলেছেন, “সে কী কথা— এরা তো অনাথা নয়, আমি বেঁচে আছি কী করতে। অনাথ হোক সনাথ হোক, মেয়েরা চায় ঘর; সদনের মধ্যে তাদের ছাপ মেরে বস্তাবন্দী করে রাখা কেন। তোমার যদি এতই দয়া থাকে তোমার ঘর নেই নাকি।”

 যা হোক, মেয়েটি যখন মাথা হেঁট ক’রে পায়ে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে, আমি সংকুচিত অথচ বিগলিতচিত্তে একখানা খবরের কাগজ মুখের সামনে ধ’রে বিজ্ঞাপনের উপর চোখ বুলিয়ে যেতে লাগলেম। এমন সময় হঠাৎ অকালে অমিয়া ঘরের মধ্যে এসে উপস্থিত; নবযুগের উপযোগী ভাইফোঁটার একটা নূতন ব্যাখ্যা সে লিখেছে। সেইটে ইংরেজিতেও সে প্রচার করতে চায়; আমার কাছে তারই সাহায্য আবশ্যক। এই লেখাটির ওরিজিন্যাল আইডিয়াতে ভক্তদল খুব বিচলিত—এই নিয়ে তারা একটা ধূমধাম করবে ব’লে কোমর বেঁধেছে।

 ঘরে ঢুকেই সেবানিযুক্ত মেয়েটিকে দেখেই অমিয়ার মুখের ভাব অত্যন্ত শক্ত হয়ে উঠল। তার দেশবিশ্রুত দাদা যদি একটু ইশারামাত্র করত তা হলে তার সেবা করবার লোকের কি অভাব ছিল। এত মানুষ থাকতে শেষকালে কি এই—

 থাকতে পারলে না। বললে, “দাদা, হরিমতিকে কি তুমি—”

 প্রশ্নটা শেষ করতে না দিয়ে ফস্ ক’রে বলে ফেললেম, “পায়ে বড়ো ব্যথা করছিল।”

 পলিস-সার্জনের হাতে একটি মেয়ের অপমান বাঁচাতে গিয়ে জেলখানায় গিয়েছিলেম। আজ এক মেয়ের আক্রোশ থেকে আর-এক মেয়েকে আচ্ছাদন করবার জন্যে মিথ্যে কথা বলে ফেললুম। এবারেও শাস্তি শুরু হল। অমিয়া আমার পায়ের কাছে বসল। হরিমতি তাকে কুণ্ঠিত মৃদুকণ্ঠে কী-একটা বললে, সে ঈষৎ মখ বাঁকিয়ে জবাবই করলে না। হরিমতি আস্তে আস্তে উঠে চলে গেল। তখন অমিয়া পড়ল আমার পা নিয়ে। বিপদ ঘটল আমার। কেমন করে বলি ‘দরকার নেই, আমার ভালোই লাগে না।’ এতদিন পর্যন্ত নিজের পায়ের সম্বন্ধে যে স্বায়ত্তশাসন সম্পূর্ণ বজায় রেখেছিলেম, সে আর টেঁকে না বুঝি!

 ধড়্‌ফড়্ করে উঠে বসে বললেম, “অমিয়া, দে তোর লেখাটা, ওটা তর্জমা করে ফেলি।”

 “এখন থাক্‌-না দাদা। তোমার পা কামড়াচ্ছে, একটু, টিপে দিই-না?”

 “না, পা কেন কামড়াবে। হাঁ হাঁ, একটু কামড়াচ্ছে বটে। তা, দেখ্ অমি, তোর এই ভাইফোঁটার আইডিয়াটা ভারি চমৎকার। কী ক’রে তোর মাথায় এল তাই ভাবি। ঐ যে লিখেছিস বর্তমান যুগে ভাইয়ের ললাট অতি বিরাট, সমস্ত বাংলাদেশে বিস্তৃত, কোনো একটিমাত্র ঘরে তার স্থান হয় না— এটা খুব একটা বড়ো কথা। দে, আমি লিখে ফেলি: With the advent of the present age, Brother's brow, waiting for its auspicious anointment from the sisters of Bengal, has grown immensely beyond the narrowness of domestic privacy, beyond the boundaries of the individual home। একটা আইডিয়ার মতো আইডিয়া পেলে কলম পাগল হয়ে ছোটে।”

 অমিয়ার পা টেপার ঝোঁক একেবারে থেমে গেল। মাথাটা ধরে ছিল, লিখতে একটুও গা লাগছিল না— তবু এস্পেরিনের বড়ি গিলে বসে গেলেম।

 পরদিন দুপুরবেলায় আমার জলধর যখন দিবানিদ্রায় রত, দেউড়িতে দরোয়ানজি তুলসীদাসের রামায়ণ পড়ছে, গলির মোড় থেকে ভালকে-নাচওয়ালার ডুগ্‌ডুগি শোনা যাচ্ছে, বিশ্রামহারা অমিয়া যখন যুগলক্ষ্মীর কর্তব্যপালনে বেরিয়েছে, এমন সময় দরজার বাইরে নির্জন বারান্দায় একটি ভীরু ছায়া দেখা দিলে। শেষকালে দ্বিধা করতে করতে কখন হঠাৎ এক সময়ে সেই মেয়েটি একটা হাতপাখা নিয়ে আমার মাথার কাছে বসে বাতাস করতে লাগল। বোঝা গেল, কাল অমিয়ার মুখের ভাবখানা দেখে পায়ে হাত দিতে আজ আর সাহস হল না। এতক্ষণে নববঙ্গের ভাইফোঁটাপ্রচারের মিটিং বসেছে। অমিয়া ব্যস্ত থাকবে। তাই ভাবছিলুম ভরসা করে ব’লে ফেলি, পায়ে বড়ো ব্যথা করছে। ভাগ্যে বলি নি।—মিথ্যে কথাটা মনের মধ্যে যখন ইতস্তত করছে ঠিক সেই সময়ে অনাথাসদনের ত্রৈমাসিক রিপোর্ট হাতে অমিয়ার প্রবেশ। হরিমতির পাখা-দোলনের মধ্যে হঠাৎ চমক লাগল; তার হৃৎপিণ্ডের চাঞ্চল্য ও মখেশ্রীর বিবর্ণতা আন্দাজ করা শক্ত হল না। অনাথাসদনের এই সেক্রেটারির ভয়ে তার পাখার গতি খুব মৃদু হয়ে এল।

 অমিয়া বিছানার এক ধারে ব’সে খুব শক্ত সুরে বললে, “দেখো দাদা, আমাদের দেশে ঘরে ঘরে কত আশ্রয়হারা মেয়ে বড়ো বড়ো পরিবারে প্রতিপালিত হয়ে দিন কাটাচ্ছে, অথচ সে-সব ধনীঘরে তাদের প্রয়োজন একটুও জরুরি নয়। গরিব মেয়ে, যারা খেটে খেতে বাধ্য, এরা তাদেরই অন্ন-অর্জনে বাধা দেয় মাত্র। এরা যদি সাধারণের কাজে লাগে, যেমন আমাদের অনাথাসদনের কাজ—তা হলে—”

 বঝলেম, আমাকে উপলক্ষ করে হরিমতির উপরে বক্তৃতার এই শিলাবৃষ্টি। আমি বললেম, “অর্থাৎ, তুমি চলবে নিজের শখ-অনুসারে, আর আশ্রয়হীনারা চলবে তোমার হকুম-অনুসারে। তুমি হবে অনাথাসদনের সেক্রেটারি, আর ওরা হবে অনাথাসদনের সেবাকারিণী! তার চেয়ে নিজেই লাগো সেবার কাজে; বুঝতে পারবে, সে কাজ তোমার অসাধ্য। অনাথাদের অতিষ্ঠ করা সহজ, সেবা করা সহজ নয়। দাবি নিজের উপরে করো, অন্যের উপরে কোরো না।”

 আমার ক্ষাত্রস্বভাব, মাঝে মাঝে ভুলে যাই ‘অক্রোধেন জয়েৎ ক্রোধম্’। ফল হল এই যে, অমিয়া পিসিমারই সদস্যদের মধ্য থেকে আর একটি মেয়েকে এনে হাজির করলে— তার নাম প্রসন্ন। তাকে আমার পায়ের কাছে বসিয়ে দিয়ে বললে, “দাদার পায়ে ব্যথা করে, তুমি পা টিপে দাও।” সে যথোচিত অধ্যবসায়ের সঙ্গে আমার পা টিপতে লাগল। এই হতভাগ্য দাদা এখন কোন মুখে বলে যে তার পায়ে কোনোরকম বিকার হয় নি। কেমন করে জানায় যে এমনতরো টেপাটেপি ক’রে কেবলমাত্র তাকে অপদস্ত করা হচ্ছে। মনে মনে বুঝলেম, রোগশয্যায় রোগীর আর স্থান হবে না। এর চেয়ে ভালো, নববঙ্গের ভাইফোঁটা-সমিতির সভাপতি হওয়া। পাখার হাওয়া আস্তে আস্তে থেমে গেল। হরিমতি স্পষ্ট অনুভব করলে, অস্ত্রটা তারই উদ্দেশে। এ হচ্ছে প্রসন্নকে দিয়ে হরিমতিকে উৎখাত করা। কণ্টকেনৈব কণ্টকম্। একটু পরে পাখাটা মাটিতে রেখে সে উঠে দাঁড়ালো। আমার পায়ের কাছে মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম ক’রে আস্তে আস্তে দুই পায়ে হাত বুলিয়ে চলে গেল।

 আবার আমাকে গীতা খুলতে হল। তবুও শ্লোকের ফাঁকে ফাঁকে দরজার ফাঁকের দিকে চেয়ে দেখি— কিন্তু, সেই একটুখানি ছায়া আর কোথাও দেখা গেল না। তার বদলে প্রসন্ন প্রায়ই আসে, প্রসন্নের দৃষ্টান্তে আরও দুই-চারিটি মেয়ে অমিয়ার দেশবিশ্রুত দেশভক্ত দাদার সেবা করবার জন্যে জড়ো হল। অমিয়া এমন ব্যবস্থা করে দিলে, যাতে পালা করে আমার নিত্যসেবা চলে। এ দিকে শোনা গেল, হরিমতি একদিন কাউকে কিছু না ব’লে কলকাতা ছেড়ে তার পাড়াগাঁয়ের বাড়িতে চলে গেছে।


মাসের বারোই তারিখে সম্পাদক-বন্ধু এসে বললেন, “একি ব্যাপার। ঠাট্টা নাকি। এই কি তোমার কঠোর অভিজ্ঞতা।”

 আমি হেসে বললেম, “পুজোর বাজারে চলবে না কি।”

 “একেবারেই না। এটা তো অত্যন্তই হাল্কা-রকমের জিনিস।”

 সম্পাদকের দোষ নেই। জেলবাসের পর থেকে আমার অশ্রুজল অন্তঃশীলা বইছে। লোকে বাইরে থেকে আমাকে খুব হাল্কা প্রকৃতির লোক মনে করে।

 গল্পটা আমাকে ফেরত দিয়ে গেল।

 ঠিক সেই মুহূর্তে এল অনিল। বললে, “মুখে বলতে পারব না, এই চিঠিটা পড়ুন।”

 চিঠিতে অমিয়াকে, তার দেবীকে, যুগলক্ষ্মীকে বিবাহ করবার ইচ্ছে জানিয়েছে; এ কথাও বলেছে, অমিয়ার অসম্মতি নেই।

 তখন অমিয়ার জন্মবৃত্তান্ত তাকে বলতে হল। সহজে বলতেম না; কিন্তু জানতেম, হীনবর্ণের ’পরে অনিল শ্রদ্ধাপূর্ণ করুণা প্রকাশ করে থাকে। আমি তাকে বললেম, “পূর্বপুরুষের কলঙ্ক জন্মের দ্বারাই স্থলিত হয়ে যায়, এ তো তোমরা অমিয়ার জীবনেই স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছ। সে পদ্ম, তাতে পঙ্কের চিহ্ন নেই।”

 নববঙ্গের ভাইফোঁটার সভা তার পরে আর জমল না। ফোঁটা রয়েছে তৈরি, কপাল মেরেছে দৌড়। আর শুনেছি, অনিল কলকাতা ছেড়ে কুমিল্লায় স্বরাজ-প্রচারের কী-একটা কাজ নিয়েছে।

 অমিয়া কলেজে ভর্তি হবার উদ্যোগে আছে। ইতিমধ্যে পিসিমা তীর্থ থেকে ফিরে আসার পর শুশ্রূষার সাত-পাক বেড়ি থেকে আমার পা দুটো খালাস পেয়েছে।

 অগ্রহায়ণ ১৩৩২