গল্পগুচ্ছ (দ্বিতীয় খণ্ড)/উলুখড়ের বিপদ
উলুখড়ের বিপদ
বাবুদের নায়েব গিরিশ বসুর অন্তঃপুরে প্যারী বলিয়া একটি নতন দাসী নিহত হইয়াছিল। তাহার বয়স অপ; চরিত্র ভালো। দর বিদেশ হইতে আসিয়া কিছুদিন কাজ করার পরেই একদিন সে বধ নায়েবের অনুরাগটি হইতে আত্মরক্ষার জন্য গহিণীর নিকট কাঁদিয়া গিয়া পড়িল। গৃহিণী কহিলেন, “বাছা, তুমি অন্য কোথাও যাও; তুমি ভালোমানুষের মেয়ে, এখানে থাকিলে তোমার সুবিধা হইবে না।” বলিয়া গোপনে কিছু অর্থ দিয়া বিদায় করিয়া দিলেন।
কিন্তু পালানো সহজ ব্যাপার নহে, হাতে পথখরচও সামান্য, সেইজন্য প্যারী গ্রামে হরিহর ভট্টাচার্য মহাশয়ের নিকট গিয়া আশ্রয় লইল। বিবেচক ছেলেরা কহিল, “বাবা, কেন বিপদ ঘরে আনিতেছেন।” হরিহর কহিলেন, “বিপদ স্বয়ং আসিয়া আশ্রয় প্রার্থনা করিলে তাহাকে ফিরাইতে পারি না।”
গিরিশ বসু, সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করিয়া কহিল, “ভট্টাচার্য মহাশয়, আপনি আমার ঝি ভাঙাইয়া আনিলেন কেন। ঘরে কাজের ভারি অসুবিধা হইতেছে।” ইহার উত্তরে হরিহর দু-চারটে সত্য কথা খুব শক্ত করিয়াই বলিলেন। তিনি মানী লোক ছিলেন, কাহারও খাতিরে কোনো কথা ঘুরাইয়া বলিতে জানিতেন না। নায়েব মনে মনে উতপক্ষ পিপীলিকার সহিত তাঁহার তুলনা করিয়া চলিয়া গেল। যাইবার সময় খুব ঘটা করিয়া পায়ের ধলা লইল। দুই-চারিদিনের মধ্যেই ভট্টাচার্যের বাড়িতে পুলিসের সমাগম হইল। গৃহিণীঠাকুরানীর বালিশের নীচে হইতে নায়েবের স্ত্রীর একজোড়া ইয়ারিং বাহির হইল। ঝি প্যারী চোর সাব্যস্ত হইয়া জেলে গেল। ভট্টাচার্য মহাশয় দেশবিখ্যাত প্রতিপত্তির জোরে চোরাই-মাল-রক্ষার অভিযোগ হইতে নিষ্কৃতি পাইলেন। নায়েব পুনশ্চ ব্রাহণের পদধুলি লইয়া গেল। ব্রাহমণ বুঝিলেন, হতভাগিনীকে তিনি আশ্রয় দেওয়াতেই প্যারীর সর্বনাশ ঘটিল। তাঁহার মনে শেল বিধিয়া রহিল। ছেলেরা কহিল, “জমিজমা বেচিয়া কলিকাতায় যাওয়া যাক, এখানে বড়ো মশকিল দেখিতেছি।” হরিহর কহিলেন, “পৈতৃক ভিটা ছাড়িতে পারিব না; অদৃষ্টে থাকিলে বিপদ কোথায় ঘটে।”
ইতিমধ্যে নায়েব গ্রামে অতিমাত্রায় খাজনা বৃদ্ধির চেষ্টা করায় প্রজারা বিদ্রোহী হইল। হরিহরের সমস্ত ব্রহোত্তর জমা, জমিদারের সঙ্গে কোনো সম্বন্ধ নাই। নায়েব তাহার প্রভুকে জানাইল, হরিহরই প্রজাদিগকে প্রশ্রয় দিয়া বিদ্রোহী করিয়া তুলিয়াছে। জমিদার কহিলেন, “যেমন করিয়া পার ভট্টাচার্যকে শাসন করো।” নায়েব ভট্টাচার্যের পদধুলি লইয়া কহিল, “সামনের ঐ জমিটা পরগনার ভিটার মধ্যে পড়িতেছে; ওটা তো ছাড়িয়া দিতে হয়।” হরিহর কহিলেন, “সে কী কথা। ও যে আমার বহুকালের ব্রহয়।” হরিহরের গহপ্রাঙ্গণের সংলগ্ন পৈতৃক জমি জমিদারের পরগনার অন্তর্গত বলিয়া নালিশ রজ হইল। হরিহর বলিলেন, “এ জমিটা তো তবে ঘড়িয়া দিতে হয়, আমি তো বদ্ধ বয়সে আদালতে সাকি দিতে পারিব না।” ছেলেরা বলিল, “বাড়ির সংলগ্ন জমিটাই যদি ছাড়িয়া দিতে হয় তবে ভিটায় টিকিব কী করিয়া।”
প্রাণাধিক পৈতৃক ভিটার মায়ায় বধ কম্পিতপদে আদালতের সাক্ষ্যমঞ্চে গিয়া দাঁড়াইলেন। মাসেফ নবগোপালবাব তাঁহার সাক্ষাই প্রামাণ্য করিয়া মকদ্দমা ডিসমিস করিয়া দিলেন। ভট্টাচাষের খাস প্রজারা ইহা লইয়া গ্রামে ভারি উৎসব সমারোহ আরম্ভ করিয়া দিল। হরিহর তাড়াতাড়ি তাহাদিগকে থামাইয়া দিলেন। নায়েব আসিয়া পরম আড়ম্বরে ভট্টাচায্যের পদধলি লইয়া গায়ে মাথায় মাখিল এবং আপিল রজন্ম করিল। উকিলরা হরিহরের নিকট হইতে টাকা লন না। তাঁহারা ব্রহমণকে বারবার আশবাস দিলেন, এ মকদ্দমায় হারিবার কোনো সম্ভাবনাই নাই। দিন কি কখনও রাত হইতে পারে। শনিয়া হরিহর নিশ্চিত হইয়া ঘরে বসিয়া রহিলেন।
একদিন জমিদারি কাছারিতে ঢাকঢোল বাজিয়া উঠিল, পঠিা কাটিয়া নায়েবের বাসায় কালীপজা হইবে। ব্যাপারখানা কী। ভট্টাচার্য খবর পাইলেন, আপিলে তাঁহার হার হইয়াছে।
ভট্টাচার্য মাথা চাপড়াইয়া উকিলকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “বসন্তবাব, করিলেন কী। আমার কী দশা হইবে।”
দিন যে কেমন করিয়া রাত হইল বসন্তবাব তাহার নিগুঢ় বক্তাত বলিলেন, “সম্প্রতি যিনি নতেন অ্যাডিশনাল জজ হইয়া আসিয়াছেন তিনি মন্সেফ থাকা কালে মাসেফ নবগোপালবাবরে সহিত তাঁহার ভারি খিটিমিটি বাধিয়াছিল। তখন কিছ করিয়া উঠিতে পারেন নাই; আজ জজের আসনে বসিয়া নবগোপালবাবরে রায় পাইবামাত্র উলটাইয়া দিতেছেন; আপনি হারিলেন সেইজন্য।” ব্যাকুল হরিহর কহিলেন, “হাইকোটে ইহার কোনো আপিল নাই?” বসন্ত কহিলেন, “জজবাব আপিলে ফল পাইবার সম্ভাবনামাত্র রাখেন নাই। তিনি আপনাদের সাক্ষীকে সন্দেহ করিয়া বিরদ্ধে পক্ষের সাক্ষীকেই বিশ্বাস করিয়া গিয়াছেন; হাইকোটে তো সাক্ষীর বিচার হইবে না।”
বন্ধ সাশ্রনেত্রে কহিলেন, “তবে আমার উপায়?”
উকিল কহিলেন, “উপায় কিছুই দেখি না।”
গিরিশ বসু পরদিন লোকজন সঙ্গে লইয়া ঘটা করিয়া ব্রাহরণের পদধলি লইয়া গেল এবং বিদায়কালে উচ্ছসিত দীর্ঘনিশবাসে কহিল, “প্রভু, তোমারই ইচ্ছা।”