সংযোজন
ইঁদুরের ভোজ

 ছেলেরা বললে, ভারি অন্যায়, আমরা নতুন পণ্ডিতের কাছে কিছুতেই পড়ব না।

 নতুন পণ্ডিত-মশায় যিনি আসছেন তাঁর নাম কালীকুমার তর্কালঙ্কার।

 ছুটির পরে ছেলেরা রেলগাড়িতে যে যার বাড়ি থেকে ফিরে আসছে ইস্কুলে। ওদের মধ্যে একজন রসিক ছেলে কালো কুমড়োর বলিদান বলে একটা ছড়া বানিয়েছে, সেইটে সকলে মিলে চীৎকার শব্দে আওড়াচ্ছে। এমন সময় আড়খোলা ইস্টেশন থেকে গাড়িতে উঠলেন একজন বুড়ো ভদ্রলোক। সঙ্গে আছে তাঁর কাঁথায় মোড়া বিছানা। ন্যাকড়া দিয়ে মুখ বন্ধ করা দু-তিনটে হাঁড়ি, একটা টিনের ট্রাঙ্ক, আর কিছু পুঁটুলি। একটা ষণ্ডা-গোছের ছেলে, তাকে ডাকে সবাই বিচকুন ব’লে, সে চেঁচিয়ে উঠল— এখানে জায়গা হবে না বুড্ঢা, যাও দুসরা গাড়িতে।

 বুড়ো বললেন, বড়ো ভিড়, কোথাও জায়গা নেই, আমি এই কোণটুকুতে থাকব, তোমাদের কোনো অসুবিধা হবে না। ব’লে ওদের বেঞ্চি ছেড়ে দিয়ে নিজে এক কোণে মেঝের উপর বিছানা পেতে বসলেন।

 ছেলেদের জিজ্ঞাসা করলেন, বাবা তোমরা কোথা যাচ্ছ, কী করতে।

 বিচকুন বলে উঠল, শ্রাদ্ধ করতে।

 বুড়ো জিজ্ঞাসা করলেন, কার শ্রাদ্ধ?

 উত্তরে শুনলেন, কালো কুমড়ো টাটকা লঙ্কার।

 ছেলেগুলো সব সুর করে চেঁচিয়ে উঠল—

কালো কুমড়ে টাটকা লঙ্কা
দেখিয়ে দেব লবোডঙ্কা।

 আসানসোলে গাড়ি এসে থামল, বুড়ো মানুষটি নেবে গেলেন, সেখানে স্নান করে নেবেন। স্নান সেরে গাড়িতে ফিরতেই বিচকুন বললে, এ গাড়িতে থাকবেন না মশায়!

 কেন বলো তো।

 ভারি ইঁদুরের উৎপাত।

 ইদুরের? সে কী কথা!

 দেখুন-না আপনার ঐ হাঁড়ির মধ্যে ঢুকে কী কাণ্ড করেছিল।

 ভদ্রলোক দেখলেন তাঁর যে হাঁড়িতে কদম ছিল সে হাড়ি ফাঁকা, আর যেটাতে ছিল খইচুর তার একটা দানাও বাকি নেই।

 বিচকুন বললে, আর আপনার ন্যাকড়াতে কী একটা বাঁধা ছিল সেটা শুদ্ধ নিয়ে দৌড় দিয়েছে।

 সেটাতে ছিল ওঁর বাগানের গুটি-পাঁচেক পাকা আম।

 ভদ্রলোক একটু হেসে বললেন, আহা, ইঁদুরের অত্যন্ত ক্ষিদে পেয়েছে দেখছি।

 বিচকুন বললে, না না, ও জাতটাই ওরকম, ক্ষিদে না পেলেও খায়।

 ছেলেগুলো চীৎকার করে হেসে উঠল; বললে, হাঁ মশায়, আরো থাকলে আরো খেত।

 ভদ্রলোক বললেন, ভুল হয়েছে, গাড়িতে এত ইঁদুর একসঙ্গে যাবে জানলে আরো কিছু আনতুম।

 এত উৎপাতেও বুড়ে রাগ করলে না দেখে ছেলেরা দমে গেল— রাগলে মজা হত।

 বর্ধমানে এসে গাড়ি থামল। ঘণ্টাখানেক থামবে। অন্য লাইনে গাড়ি বদল করতে হবে। ভদ্রলোকটি বললেন, বাবা, এবারে তোমাদের কষ্ট দেব না, অন্ত কামরায় জায়গা হবে।

 না না, সে হবে না, আমাদের গাড়িতেই উঠতে হবে। আপনার পুঁটুলিতে যদি কিছু বাকি থাকে আমরা সবাই মিলে পাহারা দেব, কিছুই নষ্ট হবে না।

 ভদ্রলোক বললেন, আচ্ছা বাবা, তোমরা গাড়িতে ওঠে, আমি আসছি।

 ছেলেরা তো উঠল গাড়িতে। একটু বাদেই মিঠাইওয়ালার ঠেলাগাড়ি ওদের কামরার সামনে এসে দাঁড়ালো, সেইসঙ্গে ভদ্রলোক।

 এক-এক ঠোঙা এক-একজনের হাতে দিয়ে বললেন, এবারে ইদুঁরের ভোজে অনটন হবে না। ছেলেগুলো হুররে ব’লে লাফালাফি করতে লাগল। আমের ঝুড়ি নিয়ে আমওয়ালাও এল— ভোজে আমও বাদ গেল না।

 ছেলের তাঁকে বললে, আপনি কী করতে কোথায় যাচ্ছেন বলুন।

 তিনি বললেন, আমি কাজ খুঁজতে চলেছি, যেখানে কাজ পাব সেখানেই নেবে পড়ব

 ওরা জিজ্ঞাসা করলে, কী কাজ আপনি করেন?

 তিনি বললেন, আমি টুলো পণ্ডিত, সংস্কৃত পড়াই।

 ওরা সবাই হাততালি দিয়ে উঠল; বললে, তা হলে আমাদের ইস্কুলে আসুন।

 তোমাদের কর্তারা আমাকে রাখবেন কেন?

 রাখতেই হবে। কালে কুমড়ো টাটকা লঙ্কাকে আমরা পাড়ায় ঢুকতেই দেব না।

 মুশকিলে ফেললে দেখছি। যদি সেক্রেটারিবাবু আমাকে পছন্দ না করেন?

 পছন্দ করতেই হবে— না করলে আমরা সবাই ইস্কুল ছেড়ে চলে যাব।

 আচ্ছা বাবা, তোমরা আমাকে তবে নিয়ে চলো।

 গাড়ি এসে পৌঁছল স্টেশনে। সেখানে স্বয়ং সেক্রেটারিবাবু উপস্থিত। বৃদ্ধ লোকটিকে দেখে বললেন, আসুন, আসুন তর্কালঙ্কার মশায়! আপনার বাসা প্রস্তুত আছে।

 ’বলে পায়ের ধুলো নিয়ে প্রণাম করলেন।