চণ্ডী

 দিদি, তুমি বোধ হয় ও-পাড়ার চণ্ডীবাবুকে জান?

 জানি নে! তিনি যে ডাকসাইটে নিন্দুক।

 বিধাতার কারখানায় খাঁটি জিনিস তৈরি হয় না, মিশল থাকেই। দৈবাৎ এক-একজন উৎরে যায়। চণ্ডী তারই সেরা নমুনা। ওর নিন্দুকতায় ভেজাল নেই। জান তো আমি আর্টিস্ট মানুষ? সেইজন্যে এরকম খাঁটি জিনিস আমার দরবারে জুটিয়ে আনি। একেবারে লোকটা জীনিয়স বললেই হয়। একটা এড়িয়ে গেলে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। একদিন দেখি, অধ্যাপক অনিলের দরজায় কান দিয়ে কী শুনছে। আমি তাকে বললুম, অমন করে খুঁজে খুঁজে বেড়াচ্ছ কাকে হে।

 সেটাই যদি জানতুম তা হলে তো কথাই ছিল না। চার দিকে চোখ কান খুলে রাখতে হয়, কাউকে বিশ্বাস করবার জো নেই— চোর-ছ্যাঁচড়ে দেশ ভরে গেল।

 বলে কী হে।

 শুনে অবাক হবেন, এই সেইদিন অমন আমার চাঁপার রঙের গামছাখানা আলনার উপর থেকে বেমালুম গায়েব হয়ে গেল।

 বলে কী হে, গামছা!

 আজ্ঞে হ্যা, গামছা বৈকি। কোণটাতে একটুখানি ছেঁড়া ছিল, তা সেলাই করিয়ে নিয়েছিলুম।

 তুমি অনিলবাবুর দরজার কাছে অমন ঘুর-যুর করছিলে কেন। পরের ছেঁড়া গামছা জোগাড় করবার রোগে তাঁকে ধরেছে নাকি।

 আরে ছি ছি, ওঁরা হলেন বড়োলোক, গামছা কখনো চক্ষেও দেখেন নি। টার্কিস তোয়ালে না হলে ওঁর এক পা চলে না।

 তা হলে?

 আমি ভাবছিলুম, ওঁর পাওনা তো বেশি নয়। অথচ, এত বাবুআনা চলে কী ক’রে।

 বোধ হয় ধার ক’রে!

 আজকালকার বাজারে ধার তো সহজ নয়, তার চেয়ে সহজ ফাঁকি।

 আচ্ছা, তুমি পুলিসে খবর দিয়েছিলে নাকি।

 না, তার দরকার হয় নি। সেটা বেরোল আমার স্ত্রীর ময়লা কাপড়ের ঝুড়ির ভিতর থেকে। কাউকেই বিশ্বাস করবার জো নেই।

 কী বল তুমি, ওটা ঠিক জায়গাতেই তো ছিল।

 আপনি সাদা লোক, আসল কথাটাই বুঝতে পারছেন না। আপনি জানেন তো আমার শালা কোচলুকে। কী রকম সে গায়ে ফুঁ দিয়ে বেড়ায়। পয়সা জোটে কোথা থেকে। কাজটি করছেন তিনি, আর গিন্নি সেটাকে বেমালুম চাপ দিয়েছেন।

 তুমি জানলে কী ক’রে।

 হ্যাঁ হ্যাঁ, এ কি জানতে বাকি থাকে।

 কখনো তাকে নিতে দেখেছ?

 যে এমন কাজ করে সে কি দেখিয়ে দেখিয়ে করে। এ দিকে দেখুন-না, পুলিস আছে চোখ বুজে, তারা যে বখরা নিয়ে থাকে। এইসব উৎপাত আরম্ভ হয়েছে যখন থেকে দেখা দিয়েছেন ঐ আপনাদের গান্ধি মহারাজ।

 এর মধ্যে তিনি আবার এলেন কোত্থেকে।

 ঐ যে তাঁর অহিংস্র নীতি। ধড়াধড় না পিটোলে চোরের চুরি-রোগ কখনো সারে? তিনি নিজে থাকেন কপনি প’রে। এক পয়সা সম্বল নেই। এ-সব লম্বাচওড়া বুলি তাঁকেই সাজে। আমরা গেরস্থ মানুষ, শুনে চক্ষুস্থির হয়ে যায়। এ দিকে আর-এক নতুন ফন্দি বেরিয়েছে জানেন তো? ঐ-যে যাকে আপনার বলেন চাঁদা। তার মুনফা কম নয়। কিন্তু সেটা তলিয়ে যায় কোথায়, তার হিসাব রাখে কে। মশায়, সেদিন আমারই ঘরে এসে উপস্থিত অনাথ-হাসপাতালের চাঁদা চাইতে। লজ্জা হয়, কী আর বলব। খাত হাতে যিনি এসেছিলেন আপনার সবাই তাঁকে জানেন। ডাক্তার— আর নাম করে কাজ নেই, কে আবার তাঁর কানে ওঠাবে। তিনি যে মাঝে মাঝে আসেন আমাদের ঘরে নাড়ী টিপতে। সিকি পয়সা দিতে হয় না বটে, তেমনি সিকি পয়সার ফলও পাই নে। তবু হাজার হোক, এম. বি. তো বটে। এমনি হাল আমলের তাঁর চিকিৎসা যে রোগীরা তাঁর কাছে ঘেঁষে না। কাজেই টাকার টানাটানি হয় বৈকি।

 ছি ছি, কী বলছ তুমি।

 তা মশায়, আমি মুখফোড় মানুষ। সত্যি কথা আমার বাধে না। ওঁর মুখের সামনেই শুনিয়ে দিতে পারতুম। কিন্তু কী বলব, আমার ছেলেটাকে আদায়ের কাজে রেখে আমার মুখ বন্ধ করেছেন। তার কাছ থেকেও মাঝে মাঝে ইশারা পাই। দক্ষিণ হস্ত বেশ চলছে ভালো। বুঝছেন তো? আমাদের দেশে আজকালকার ইৎরমি যে কিরকম অসহ্য, তার আর-একটা নমুনা আপনাকে শোনাই।

 কিরকম।

 আমাদের পাড়ায় আছে একটা গোমুখ্যু যাকে ওরা নাম দিয়েছে কবিবর। তাকে দিয়ে দেখুন আমার নামে কী লিখিয়েছে। ঘোর লাইবেল। নিন্দুকেরা দল পাকিয়েছে। পাড়ায় কান পাতবার জো নেই। খ্যাঁক্শিয়ালি বলে চেঁচাচ্ছে আমার পিছনে পিছনে। এত সাহস হত না যদি-না এদের পিছনে থাকত নামজাদ মুরুব্বি সব গান্ধিজির চ্যালা।

 দেখি দেখি কী লিখেছে, মন্দ হয় নি তো। লোকটার হাত দোরস্ত আছে—

আলো যার মিট্‌মিটে,
স্বভাবটা খিটখিটে,
বড়োকে করিতে চায় ছোটো,
সব ছবি ভুষো মেজে
কালো ক’রে নিজেকে যে
মনে করে ওস্তাদ পোটো,
বিধাতার অভিশাপে
ঘুরে মরে ঝোপে ঝাপে,
স্বভাবটা যার বদখেয়ালি,
খ্যাঁক্ খ্যাঁক্ করে মিছে
সব তাতে দাঁত খিঁচে,
তারে নাম দিব খ্যাঁকশেয়ালি।

 ও কী ও, আপনার দরজায় পুলিস যে!

 ব্যাপারটা কী।

 চণ্ডীবাবুর ছেলের নামে কেস এসেছে।

 হ্যাঁ, কিসের কেস।

 অনাথ-হাসপাতালের চাঁদার টাকা তিনি ভেঙে বসেছেন।

 মিথ্যে কথা। আগাগোড়া পুলিসের সাজানো। আপনি তো জানেন, আমার ছেলে একসময় আহার-নিদ্রা ছেড়ে গান্ধির নামে দরজায় দরজায় চাঁদা ভিক্ষে করে বেড়িয়েছিল, সেই অবধি বরাবর তার উপর পুলিসের নজর লেগে আছে। কিছু না, এটা পলিটিক্যাল মামলা।

 দাদামশায়, তোমার এই গল্পটা আমার একটুও ভালো লাগল না।