পান্নালাল

 দাদামশায়, তোমার পাগলের দলের মধ্যে পান্নালাল ছিল খুব নতুন রকমের।

 জান দিদি, পাগলরা প্রত্যেকেই নতুন, কারে সঙ্গে কারো মিল হয় না। যেমন তোমার দাদামশায়। বিধাতার নতুন পরীক্ষা। ছাঁচ তিনি ভেঙে ফেলেন। সাধারণ লোকের বুদ্ধিতে মিল হয়, অসাধারণ পাগলের মিল হয় না। তোমাকে একটা উদাহরণ দেখাই।

 আমার দলে একজন পাগল ছিল, তার নাম ত্রিলোচন দাস। সে তিন ক্রোশ পথ না ঘুরে কখনো বাড়ি যেত না।

 জিজ্ঞাসা করলে বলত, বাবা, যমের চর চার দিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তাদের ফাঁকি দিতে না পারলে রক্ষে নাই। জান তো, আমার বাবা ছিলেন কিরকম একগুঁয়ে মানুষ? পাগল বললেই হয়। কোনোমতেই আমার পরামর্শ মানতেন না। বরাবর তিনি সিধে রাস্তায় বাড়ি গিয়েছেন— তার পরে জান তো? আজ তিনি কোথায়। আর, আমি আজ সাত বছর ধরে পশ্চিমমুখে রাস্ত ধরে আমার পুবের দিকের বাড়িতে যাই। কেউ জিজ্ঞাসা করলে বলি, ভোজুমণ্ডলের বাড়িতে আমার পুজোর নেমন্তন্ন।

 জগতে যত বুদ্ধিমান আছে সকলেই সিধে রাস্তায় বাড়ি যায়। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে কেবল একজন আছে যে বাড়ি যেতে তিন ক্রোশ পথ বেঁকে যায়।

 আমার দুই-নম্বরের কথা শোনো; সে বাচস্পতির কথা শুনে বলত, আহ, লোকটা একেবারে বেহেড হয়ে গেছে। আর, বাচস্পতি তার কথা শুনে মুখ টিপে হাসতেন; বলতেন, এই লোকটার মগজে আছে বুজগুম্বুলের বাসা।

 প্রেসিডেণ্ট বললেন, কী হে হাজরা, তোমার বাড়ির হয়েছিল কী।

 এতকালের পৈতৃক ঘরট পথের সঙ্গে ঝগড়া বাধিয়ে দিলে। এমন দৌড় মারলে, কোনো চিহ্ন রাখলে না কোথাও।

 বলো কী।

আজ্ঞে হ্যাঁ মহারাজ, কলকাতায় হয়েছি মানুষ। বাবার মৃত্যুর পর কিছু টাকা এল হাতে। ঠিক করলেম, পৈতৃক ভিটেটা একবার দেখে আসা দরকার। সেই ভিটের কথা এইটুকু মাত্র জানতুম— পাঁচকুণ্ডু গ্রামে ছিল তার ভিত, ভোজুঘাটার সাড়ে সাত ক্রোশ তফাতে। শুভদিন দেখে নৌকো করে পৌঁছলাম ভোজুঘাটায়। কেউ ঠিকানা বলতে পারলে না। চললেম খুঁজে বের করতে, মুদির দোকান থেকে চিঁড়ে মুড়কি নিলুম বেঁধে। সাত ক্রোশ পার হতে বাজল রাত্তির ন'টা। চার দিকে পোড়ো জমি, আগাছায় জঙ্গল, ভিটের কোনো চিহ্ন নাই। বারবার যাওয়া-আসা করেছি, ভিটে খুঁজে পাই নে। রাস্তার দোকানি আমাকে দেখে কী ভাবলে কে জানে, দুর্দশার কথা শুনল আমার কাছে। বললে, এক কাজ করো বাপু, বোড়োগ্রামে বিখ্যাত গণৎকার মধুসূদন জ্যোতিষী কুষ্ঠি দেখে তোমার ভিটের খবর দিতে পারবেন।

 কোথা থেকে তিনি খবর পেয়েছেন আমার হাতে কিছু মাল আছে। খুব স্ফূর্তি করে গণনায় বসে গেলেন। অনেক আঁকজোঁক কেটে শেষকালে বললেন, আপনার ঘরের সঙ্গে রাস্তার ঘোরতরে মন-কষাকষি হয়ে গেছে; একেবারে মুখ-দেখাদেখি বন্ধ; ভিটে রেগে দৌড় মেরেছে মাসির বাড়িতে।

 ব্যস্ত হয়ে বললেম, মাসির বাড়িটা কোথায়।

 শুনে বিশ্বাস করবেন না, একেবারে সাত হাত মাটির নীচে। ঐখানে মানুষ হয়েছিল, ঐখানেই মুখ লুকিয়েছে।

 তা হলে এখন উপায়?

 আছে উপায়। আপনি যান কলকাতায় ফিরে, উপযুক্ত-মতো কিছু টাকা রেখে যান। ঠিক সাড়ে সাত মাস পরে ফিরে আসবেন। মাসিকে খুশি ক’রে আপনার পৈতৃক বাড়ি ফিরিয়ে আনব। কিন্তু, কিছু দক্ষিণা লাগবে।

 আমি বললেম, তা যত লাগে লাগুক, আপনি ভাববেন না। পৈতৃক ভিটে আমার চাই।

 আশ্চর্য জ্যোতিষীর বাহাতুরি। সাড়ে সাত মাস পরে ফিরে এসে ভোজুঘাটার থেকে মেপে ঠিক সাড়ে সাত ক্রোশ পেরুলুম। যেখানে কিছু ছিল না সেখানে বাসাটা উঠেছে মাথা তুলে। আমি বললুম, কিন্তু, গণকঠাকুর, বাসাটা যে ঠেকছে একেবারে চাঁছাপোছা নতুন?

 গণকঠাকুর বললেন, হবে না? মাসির বাড়িতে খেয়েদেয়ে একেবারে চিক্‌চিকিয়ে উঠেছে।

 আপনার হাসাহাসি করছেন, কিন্তু এ একেবারে আমার স্বচক্ষে দেখা। আমকাঠের দরজা জানালা আর তালকাঠের কড়ি বরগা। আমার কলেজী বন্ধুরা কথাটাকে উড়িয়ে দিতে চেয়েছিল। আমার বালুকডাঙার বিখ্যাত পণ্ডিত হাজারীপ্রসাদ দ্বিবেদীকে ডাকিয়ে আনলুম বিধান দিতে। তিনি বললেন, সংসারে সকলের চেয়ে বড়ো বিপদ হচ্ছে পথের সঙ্গে ঘরের আড়াআড়ি নিয়ে।

 এর বেশি আর একটিও কথা বলতে চাইলেন না। আমি কলকাতার বন্ধুদের ঠেলা দিয়ে বললুম, কেমন!

 পান্নালালের গল্পটা শুনে বাচস্পতি মুচকে হেসে বললেন, ভোরম্ভোল।