বাচস্পতি

 দাদামশায়, তুমি তোমার চার দিকে যে-সব পাগলের দল জমিয়েছিলে, গুণ হিসেব ক’রে তাদের বুঝি সব নম্বর দিয়ে রেখেছিলে?

 হ্যাঁ, তা করতে হয়েছে বৈকি। কম তো জমে নি।

 তোমার পয়লা নম্বর ছিলেন বাচস্পতি মশায়, তাঁকে আমার ভারি মজা লাগে।

 আমার শুধু মজা লাগে না, আশ্চর্য লাগে। কারণ বলি– কবিতা লিখে থাকি। কথা বাঁকানো-চোরানো আমাদের ব্যাবসা। যে শব্দের কোনো সাদা মানে আছে তাকে আমরা ধ্বনি লাগিয়ে তার চেহারা বদল করি। সে একরকমের জাদুবিদ্যা বললেই হয়। কাজটা সহজ নয়। আমাদের বাচস্পতি আমাকে আশ্চর্য করে দিয়েছিলেন যখন দেখলুম তিনি একেবারে গোড়াগুড়ি ভাষা বানিয়েছেন। কান দিয়ে ধ্বনির রাস্তায় তার মানের রাস্তা খুঁজতে হয়। আমাদের কাজটাও অনেকটা তাই, কিন্তু এতদূর পর্যন্ত নয়। আমরা তবু ব্যাকরণ অভিধান মেনে চলি। বাচস্পতির ভাষা চলত সে-সমস্তই ডিঙিয়ে। শুনলে মনে হত যেন কী একটি মানে আছে।— মানে ছিল বৈকি। কিন্তু, সেটা কানের সঙ্গে ধ্বনি মিলিয়ে আন্দাজ করতে হত। আমার ‘অদ্ভুত-রত্নাকর’ সভার প্রধান পণ্ডিত ছিলেন বাচস্পতি মশায়। প্রথম বয়সে পড়াশুনা করেছিলেন বিস্তর, তাতে মনের তল পর্যন্ত গিয়েছিল ঘুলিয়ে। হঠাৎ এক সময়ে তাঁর মনে হল, ভাষার শব্দগুলো চলে অভিধানের আঁচল ধ’রে। এই গোলামি ঘটেছে ভাষার কলিযুগে। সত্যযুগে শব্দগুলো আপনি উঠে পড়ত মুখে। সঙ্গে সঙ্গেই মানে আনত টেনে। তিনি বলতেন, শব্দের আপন কাজই হচ্ছে বোঝানো, তাকে আবার বোঝাবে কে। একদিন একটা নমুনা শুনিয়ে তাক্ লাগিয়ে দিলেন। বললেন, আমার নায়িক যখন নায়ককে বলেছিল হাত নেড়ে ‘দিন রাত তোমার ঐ হিদ্হিদ্-হিদিক্কারে আমার পাঁজঞ্জুরিতে তিড়িতঙ্ক লাগে’, তখন তার মানে বোঝাতে পণ্ডিতকে ডাকতে হয় নি। যেমন পিঠে কিল মেরে সেটাকে কিল প্রমাণ করতে মহামহোপাধ্যায়ের দরকার হয় না।

 সভাপতি একদিন বিষয়টা ধরিয়ে দিয়ে বললেন, ওহে বাচস্পতি, সেই ছেলেটার কী দশা হল।

 বাচস্পতি বললেন, সে ছেলেটার বুঝকিন্ গোড়া থেকেই ছিল বুঝভূম্বুল গোছের। তার নাম দিয়েছিলাম বিচ্কুমকুর।

 মথুরবাবু জিজ্ঞেস করলেন, ও নামটা কেন।

 বাচস্পতি বললেন, সে যে একেবারেই বিচ্কুমকুর। পাঠশালার পেডেণ্ডোকে দেখলেই তার আনতারা যেত ফুস্কলিয়ে। বুকের ভিতরে করতে থাকত কুড়ুক্কুর কুড়ুক্কুর। এমন ছেলেকে বেশি পড়ালে সে একেবারেই ফুসকে যাবে, এ কথাটা বলেছিল পাড়ার সব-চেয়ে যে ছিল পেড়াম্বর হুড়ুমকি। একটু রসুন— বুঝিয়ে বলি। পেডেণ্ডা কথাটা বালি দ্বীপের কাছে পেয়েছি। তাদের মুখের পণ্ডিত শব্দটা আপনিই হয়ে উঠেছে পেডেণ্ডো। ভেবে দেখুন, কত বড়ে ওজন, ওর বিদ্যের বোঝা ঠেলে নিয়ে যেতে দশ-বিশ জন ডিগ্রিধারী জোয়ানের দরকার হয়। আর পণ্ডিত— ছোঃ, তুড়ি দিয়ে তুড়তুড়ুং ক’রে উড়িয়ে দেওয়া যায়।

 অটলদা বললেন, বাচস্পতি, তোমার আজকেকার বর্ণনাটা যে একেবারেই চলতি গ্রাম্য ভাষায়। এ তোমাকে মানায় না। সেই সেদিন যে সাধু ভাষা বেরিয়েছিল তোমার মুখ দিয়ে, যার সধ্বংসৃনিত হার্দিক্যে বুদবুধিদের মন তিংতিড়ি তিংতিড়ি করে ওঠে, সেই ভাষার একটু নমুনা আজ এদের শুনিয়ে দাও। যে-ভাষায় ভারতের ইতিহাসটি গেঁথেছ, যার গুরু ভার হিসেব করে বলেছিলে ডুণ্ডুস্মানিত ভাষা, তার পরিচয়টা চাই। শুনে এদের সকলের আনতার ফাঁচ্কলিয়ে যাক।

 বাচস্পতি মশায় শুরু করলেন, সম্মমমরাট সমুদ্রগুপ্তের ক্রেঙ্কটাকৃষ্ট ত্বরিত্রম্যন্ত পর্যূগাসন উত্থংসিত—

 একজন সভাসদ বললেন, বাচস্পতি মশায়, উত্থ্রংসিত কথাটা শোনাচ্ছে ভালো, ওর মানেটা বুঝিয়ে দিন।

 পণ্ডিতজি বললেন, ওর মানে উত্থ্রংসিত।

 তার মানে?

 তার মানে উত্থ্রংসিত।

 অর্থাৎ?

 অর্থাৎ, তার মানে হতেই পারে না। মেরে-কেটে একটা মানে দিতেও পারি।

 কী রকম।

 ভিরভ্রিংগট্ট।

 আর বলতে হবে না, স্পষ্ট বুঝেছি, বলে যান।

 বাচস্পতি আবার শুরু করে দিলেন, সম্মমরাট সমুদ্রগুপ্তের ক্রেঙ্কটাকৃষ্ট ত্বরিৎত্রম্যস্ত পর্যূগাসন উত্থ্রংসিত নিরংকরালের সহিত—

 মথুরবাবুর মুখের দিকে চেয়ে বললেন, কেমন মশায়, বুঝেছেন তো নিরংকরাল—

 একেবারে জলের মতো। ওর চেয়ে বেশি বুঝতে চাই নে— মুশকিল হবে।

 বাচস্পতি আবার ধরলেন, নিরংকরালের সহিত অজাতশত্রু অপরিপর্যম্মিত গৰ্গরায়ণকে পরমন্তি শয়নে সমুসদৃগারিত করিয়াছিল।

 এই পর্যন্ত বলে বাচস্পতি মশায় একবার সভাস্থ সকলের মুখের দিকে চোখ বুলিয়ে নিলেন। বললেন, দেখুন একবার, সহজ কাকে বলে! অভিধানের প্রয়োজনই হয় না।

 সভার লোকেরা বললে, প্রয়োজন হলেই বা পাব কোথায়।

 বাচস্পতি মশায় একটু চোখ টিপে বললেন, ভাবখানা বুঝেছেন তো?

 মথুরবাবু বললেন, বুঝেছি বৈকি। সমুদ্রগুপ্ত অজাতশত্রুকে আচ্ছা করে পিটিয়ে দিয়েছিলেন। আহা বাচস্পতি মশায়, লোকটাকে একেবারে সমুসদ্গারিত করে দিলে গো— একেবারে পরমন্তি শয়নে।

 বাচস্পতি বললেন, ছোটোলাট একবার এসেছিলেন আমাদের পাড়ার স্কুলে বুটের ধুলো দিয়ে যেতে। তখন আমি তাঁকে এই বুগবুলবুলি ভাষার একটা ইংরেজি তর্জমা শুনিয়েছিলুম।

 সভাস্থ সকলেই বললেন, ইংরেজিটা শোনা যাক।

 বাচস্পতি পড়ে গেলেন, দি হাব্বারফ্লুয়াস ইন্ফ্যাচুফুয়েশন অব আকবর ডৰ্বেণ্ডিক্যালি ল্যাসেরটাইজট্ দি গৰ্ব্যাণ্ডিজম অফ হুমায়ুন।– শুনে ছোটোলাট একেরারে টরেটম্ বনে গিয়েছিলেন; মুখ হয়েছিল চাপা হাসিতে ফুস্কায়িত। হেড পেডেণ্ডোর টিকির চার ধারে ভেরেণ্ডম্ লেগে গেল, সেক্রেটারি চৌকি থেকে তড়তং করে উৎখিয়ে উঠলেন। ছেলেগুলোর উজবুম্মুখো ফুড়ফুড়োমি দেখে মনে হল, তারা যেন সব ফিরিচুঞ্চুসের একেবারে চিক্‌চাকস্ আমদানি। গতিক দেখে আমি চংচটকা দিলুম।

 সভাপতি বললেন, বাচস্পতি, এইখানেই ক্ষান্ত দাও হে, আর বেশিক্ষণ চললে পরাগগলিত হয়ে যাব। এখনি মাথাটার মধ্যে তাজ্ঝিম মাজ্ঝিম করছে।

 বাচস্পতি আর কিছুদিন বেঁচে থাকলে সভাপতির ভাষা এতদিনে ওঁদের মুখবুদবুদী শব্দে রঝম্ গঝম্ করে উঠত।