মুনশী

 আচ্ছা দাদামশায়, তোমাদের সেই মুনশীজি এখন কোথায় আছেন।

 এই প্রশ্নের জবাব দিতে পারব তার সময়টা বুঝি কাছে এসেছে, তবু হয়তো কিছুদিন সবুর করতে হবে।

 ফের অমন কথা যদি তুমি বল, তা হলে তোমার সঙ্গে কথা বন্ধ করব।

 সর্বনাশ, তার চেয়ে যে মিথ্যে কথা বলাও ভালো। তোমার দাদামশায় যখন স্কুল-পালানে ছেলে ছিল তখন মুনশীজি ছিলেন, ঠিক কত বয়েস, তা বলা শক্ত।

 তিনি বুঝি পাগল ছিলেন?

 হাঁ, যেমন পাগল আমি।

 তুমি আবার পাগল? কী যে বল তার ঠিক নেই।

 তাঁর পাগলামির লক্ষণ শুনলে বুঝতে পারবে, আমার সঙ্গে তাঁর আশ্চর্য মিল।

 কী রকম শুনি।

 যেমন তিনি বলতেন, জগতে তিনি অদ্বিতীয়। আমিও তাই বলি।

 তুমি যা বল সে তো সত্যি কথা। কিন্তু, তিনি যা বলতেন তা যে মিথ্যে।

 দেখো দিদি, সত্য কখনো সত্যই হয় না যদি সকলের সম্বন্ধেই সে না খাটে। বিধাতা লক্ষকোটি মানুষ বানিয়েছেন, তাঁরা প্রত্যেকেই অদ্বিতীয়। তাঁদের ছাচ ভেঙে ফেলেছেন। অধিকাংশ লোকে নিজেকে পাঁচজনের সমান মনে ক’রে আরাম বোধ করে। দৈবাৎ এক-একজন লোককে পাওয়া যায় যারা জানে, তাদের জুড়ি নেই। মুনশী ছিলেন সেই জাতের মানুষ।

 দাদামশায়, তুমি একটু স্পষ্ট ক’রে তাঁর কথা বলো-না, তোমার অর্ধেক কথা আমি বুঝতে পারি নে।

 ক্রমে ক্রমে বলছি, একটু ধৈর্য ধরে।—

 আমাদের বাড়িতে ছিলেন মুনশী, দাদাকে ফারসি পড়াতেন। কাঠামোট তাঁর বানিয়ে তুলতে মাংসের পড়েছিল টানাটানি। হাড় ক’খানার উপরে একটা চামড় ছিল লেগে, যেন মোমজামার মতো। দেখে কেউ আন্দাজ করতে পারত না তাঁর ক্ষমতা কত। না পারবার হেতু এই যে, ক্ষমতার কথাটা জানতেন কেবল তিনি নিজে। পৃথিবীতে বড়ো বড়ো সব পালোয়ান কখনো জেতে কখনো হারে। কিন্তু, যে তালিম নিয়ে মুনশীর ছিল গুমর তাতে তিনি কখনো কারো কাছে হটেন নি। তাঁর বিদ্যেতে কারো কাছে তিনি যে ছিলেন কমতি সেটার নজির বাইরে থাকতে পারে, ছিল না তাঁর মনে। যদি হত ফারসি-পড়া বিদ্যে তা হলে কথাটা সহজে মেনে নিতে রাজী ছিল লোকে। কিন্তু, ফারসির কথা পাড়লেই বলতেন, আরে ও কি একটা বিদ্যে। কিন্তু, তাঁর বিশ্বাস ছিল আপনার গানে। অথচ তাঁর গলায় যে আওয়াজ বেরোত সেটা চেঁচানি কিংবা কাঁদুনির জাতের, পাড়ার লোকে ছুটে আসত বাড়িতে কিছু বিপদ ঘটেছে মনে ক’রে। আমাদের বাড়িতে নামজাদ গাইয়ে ছিলেন বিষ্ণু, তিনি কপাল চাপ্ড়িয়ে বলতেন, মুনশীজি আমার রুটি মারলেন দেখছি। বিষ্ণুর এই হতাশ ভাবখানা দেখে মুনশী বিশেষ দুঃখিত হতেন না— একটু মুচকে হাসতেন মাত্র। সবাই বলত, মুনশীজি, কী গলা-ই ভগবান আপনাকে দিয়েছেন। খোশনামটা মুনশী নিজের পাওনা বলেই টেঁকে গুঁজতেন। এই তো গেল গান।

 আরো একটা বিদ্যে মুনশীর দখলে ছিল। তারও সমজদার পাওয়া যেত না। ইংরেজি ভাষায় কোনো হাড়পাকা ইংরেজও তাঁর সামনে দাঁড়াতে পারে না, এই ছিল তাঁর বিশ্বাস। একবার বক্তৃতার আসরে নাবলে সুরেন্দ্র বাঁড়ুজ্জেকে দেশছাড়া করতে পারতেন কেবল যদি ইচ্ছে করতেন। কোনোদিন তিনি ইচ্ছে করেন নি। বিষ্ণুর রুটি বেঁচে গেল, সুরেন্দ্রনাথের নামও। কেবল কথাটা উঠলে মুনশী একটু মুচকে হাসতেন।

 কিন্তু, মুনশীর ইংরেজি ভাষায় দখল নিয়ে আমাদের একটা পাপকর্মের বিশেষ সুবিধা হয়েছিল। কথাটা খুলে বলি। তখন আমরা পড়তুম বেঙ্গল অ্যাকাডেমিতে, ডিক্রূজ সাহেব ছিলেন ইস্কুলের মালিক। তিনি ঠিক করে রেখেছিলেন, আমাদের পড়াশুনো কোনোকালেই হবে না। কিন্তু, ভাবন কী। আমাদের বিদ্যেও চাই নে, বুদ্ধিও চাই নে, আমাদের আছে পৈতৃক সম্পত্তি। তবুও তাঁর ইস্কুল থেকে ছুটি চুরি করে নিতে হলে তার চলতি নিয়মটা মানতে হত। কর্তাদের চিঠিতে ছুটির দাবির কারণ দেখাতে হত। সে চিঠি যত বড়ো জালই হোক, ডিক্রূজ সাহেব চোখ বুজে দিতেন ছুটি। মাইনের পাওনাতে লোকসান না ঘটলে তাঁর ভাবনা ছিল না। মুনশীকে জানাতুম ছুটি মঞ্জুর হয়েছে। মুনশী মুখ টিপে হাসতেন। হবে না? বাস্ রে, তাঁর ইংরেজি ভাষার কী জোর। সে ইংরেজি কেবল ব্যাকরণের ঠেলায় হাইকোর্টের জজের রায় ঘুরিয়ে দিতে পারত। আমরা বলতুম ‘নিশ্চয়’। হাইকোর্টের জজের কাছে কোনোদিন তাঁকে কলম পেশ করতে হয় নি।

 কিন্তু, সব চেয়ে তাঁর জাঁক ছিল লাঠি-খেলার কারদানি নিয়ে। আমাদের বাড়ির উঠোনে রোদ্দুর পড়লেই তাঁর খেলা শুরু হত। সে খেলা ছিল নিজের ছায়াটার সঙ্গে। হুংকার দিয়ে ঘা লাগাতেন কখনো ছায়াটার পায়ে, কখনো তার ঘাড়ে, কখনো তার মাথায়। আর, মুখ তুলে চেয়ে চেয়ে দেখতেন চারি দিকে যারা জড়ো হত তাদের দিকে। সবাই বলত, সাবাস্! বলত, ছায়াটা যে বর্তিয়ে আছে সে ছায়ার বাপের ভাগ্যি। এই থেকে একটা কথা শেখা যায় যে, ছায়ার সঙ্গে লড়াই করে কখনো হার হয় না। আর-একটা কথা এই যে, নিজের মনে যদি জানি ‘জিতেছি’ তা হলে সে জিত কেউ কেড়ে নিতে পারে না। শেষ দিন পর্যন্ত মুনশীজির জিত রইল। সবাই বলত ‘সাবাস’, আর মুনশী মুখ টিপে হাসতেন।

 দিদি, এখন বুঝতে পারছ, ওর পাগলামির সঙ্গে আমার মিল কোথায়। আমিও ছায়ার সঙ্গে লড়াই করি। সে লড়াইয়ে আমি যে জিতি তার কোনো সন্দেহ থাকে না। ইতিহাসে ছায়ার লড়াইকে সত্যি লড়াই ব’লে বর্ণনা করে।