গল্পসল্প/ম্যানেজারবাবু
আজ তােমাকে যে গল্পটা বলব মনে করেছি সেটা তােমার ভালাে লাগবে না।
তুমি বললেও ভালো লাগবে না কেন।
যে-লােকটার কথা বলব সে চিতাের থেকে আসে নি··· কোনাে রানা-মহারানার দল ছেড়ে—
চিতাের থেকে না এলে বুঝি গল্প হয় না?
হয় বৈকি সেইটাই তাে প্রমাণ করা চাই। এই মানুষটা ছিল সামান্য একজন জমিদারের সামান্য পাইক। এমন-কি, তার নামটাই ভুলে গেছি। ধরে নেওয়া যাক সুজনলাল মিশির। একটু নামের গােলমাল হলে ইতিহাসের কোনাে পণ্ডিত তা নিয়ে কোনাে তর্ক করবে না।
সেদিন ছিল যাকে বলে জমিদারী সেরেস্তার ‘পুণ্যাহ’, খাজনা-আদায়ের প্রথম দিন। কাজটা নিতান্তই বিষয়-কাজ। কিন্তু, জমিদারী মহলে সেটা হয়ে উঠেছে একটা পার্বণ। সবাই খুশি— যে খাজনা দেয় সেও, আর যে খাজনা বাক্সতে ভরতি করে সেও। এর মধ্যে হিসেব মিলিয়ে দেখবার গন্ধ ছিল না। যে যা দিতে পারে তাই দেয়, প্রাপ্য নিয়ে কোনাে তাকরার করা হয় না। খুব ধূমধাম, পাড়াগেঁয়ে সানাই অত্যন্ত বেসুরে আকাশ মাতিয়ে তােলে। নতুন কাপড় প’রে প্রজারা কাছারিতে সেলাম দিতে আসে। সেই পুণ্যাহের দিনে ঢাক ঢােল সানাইয়ের শব্দে জেগে উঠে ম্যানেজারবাবু ঠিক করলেন, তিনি স্নান করবেন দুধে। চারি দিকে সমারােহ দেখে হঠাৎ তাঁর মনে হল তিনি তাে সামান্য লােক নন। সামান্য জলে তাঁর অভিষেক কী করে হবে। ঘড় ঘড়া দুধ এল গােয়ালা প্রজাদের কাছ থেকে। হল তাঁর স্নান। নাম বেরিয়ে গেল চারি দিকে; সেদিন তিনি সন্ধ্যাবেলায় খুশি মনে বাসার রোয়াকে ব’সে গুড়গুড়ি টানছেন, এমন সময় মিশির সর্দার— ব্রাহ্মণের ছেলে, লাঠিখেলা নিয়ে খুব নাম করেছে— বললে, হুজুর, আপনার নিমক তো খেয়েছি অনেককাল, কিন্তু অনেকদিন বসে আছি, আমাকে তো কাজে লাগালেন না। যদি কিছু করবার থাকে তো হুকুম করুন।
ম্যানেজার গুড়গুড়ি টানতে লাগলেন। মনে পড়ে গেল একটা কাজের কথা। জসিম মণ্ডল চর–মহলের প্রজা, তার খেত ছিল পাশের জমিদারের সীমানা-ঘেঁষা। ফসল জন্মালেই প্রতিবেশী জমিদার লোকজন নিয়ে প্রজাকে আটকাত। দায়ে পড়ে জসিমের দুই জমিদারেরই খাতায় আর দু জায়গাতেই খাজনা দিয়ে ফসল সামলাতে হত। যে ম্যানেজার দুধে স্নান করেন এটা তাঁর ভালো লাগে নি। এ বছরের জলিধানের ফসল কাটবার সময় আসছে— এটা চরের বিশেষ ফসল। চরের জমির জল নেমে গেলেই কৃষাণ পলিমাটিতে বীজ ছিটিয়ে দেয়, শ্রাবণ-ভাদ্র মাসে ফসল গোলায় তোলে। এ বছরটা ছিল ভালো, ধানের শিষে সমস্ত মাঠ হি হি করছে। এবারকার ফসল বেদখল হলে ভারি লোকসান।
ম্যানেজার বললেন, সর্দার, একটা কাজ আছে। জসিমের জমিতে তোমাকে ধান আগলাতে হবে। একা তোমারই উপরে ভার। দেখব কেমন মরদ তুমি।
ম্যানেজার তখনো দুধের স্বানের গুমর হজম করে উঠতে পারেন নি। মিশিরকে হুকুম দিয়ে গুড়গুড়ি টানতে লাগলেন।
ধান কাটার সময় এল। দিন নেই, রাত নেই, মিশির জাসমের খেতে পাহারা দেয়।
একদিন ভরা খেতে অন্য পক্ষের লোক হল্লা ক’রে এল, মিশির বুক ফুলিয়ে বললে, বাবা-সকল, আমি থাকতে এ ধান তোমাদের ঘরে উঠবে না। সেলাম ঠুকে চলে যাও।
মিশির যত বড়ো সর্দার হোক, সেদিন সে একলা। যখন তাকে ঘেরাও করলে সে গুটিমুটি মেরে ব’সে সবাইকে আটকাতে লাগল।
অপর পক্ষের লোক বললে, দাদা, পারবে না। কেন প্রাণ দেবে।
মিশির বললে, নিমক খেয়েছি, প্রাণ যায় যাক; নিমকের মান রাখতেই হবে।
চলল দাঙ্গা— শুধু লাঠির মার হলে হয়তো মিশির ঠেকাতেও পারত। অপর পক্ষ সড়কি চালালো। একটা এসে বিঁধল মিশিরের পায়ে।
অপর পক্ষ আবার তাকে সতর্ক করে বললে, আর কেন। এবার ক্ষান্ত দে ভাই।
মিশির বললে, মিশির সর্দার প্রাণের ভয় করে না, ভয় করে বেইমানির।
শেষকালে একটা সড়কি এসে বিঁধল তার পেটে। এটা হল মরণের মার। পুলিসের হাতে পড়বার ভয়ে অপর পক্ষ পালাবার পথ দেখলে। মিশির সড়কি টেনে উপড়ে, পেটে চাদর জড়িয়ে, ছুটল তাদের পিছন-পিছন। বেশি দূরে যেতে পারলে না। পড়ে গেল মাটিতে।
পুলিস এল। মিশির জমিদারকে বাঁচাবার জন্য তাঁর নামও করলে না। বললে, আমি জসিমের চাকরি নিয়ে তার ধান আগলাচ্ছিলুম।
ম্যানেজার সব খবর পেলেন। গুড়গুড়ি লাগলেন টানতে।
তাঁর দুধের স্নানের খ্যাতি— এ তো যে-সে লোকের কর্ম নয়। কিন্তু, নিমক খেয়েছে যখন, তখন প্রাণ দেওয়া— এটা এতই কী আশ্চর্য। এমন তো ঘটেই থাকে। কিন্তু, দুধে স্নান!