গল্পসল্প/রাজার বাড়ি
কুসমি জিগেস করলে, দাদামশায়, ইরুমাসির বোধ হয় খুব বুদ্ধি ছিল।
ছিল বৈকি, তোর চেয়ে বেশি ছিল।
থমকে গেল কুসমি। অল্প একটু দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললে, ওঃ, তাই বুঝি তোমাকে এত ক’রে বশ করেছিলেন?
তুই যে উলটাে কথা বললি, বুদ্ধি দিয়ে কেউ কাউকে বশ করে?
তবে?
করে অবুদ্ধি দিয়ে। সকলেরই মধ্যে এক জায়গায় বাসা ক’রে থাকে একটা বোকা, সেইখানে ভালো ক’রে বোকামি চালাতে পারলে মানুষকে বশ করা সহজ হয়। তাই তো ভালোবাসাকে বলে মন-ভোলানো।
কেমন ক’রে করতে হয় বলো-না।
কিচ্ছু জানি নে, কী যে হয় সেই কথাই জানি, তাই তো বলতে যাচ্ছিলুম।
আচ্ছা, বলো।
আমার একটা কাঁচামি আছে, আমি সব-তাতেই অবাক হয়ে যাই; ইরু ঐখানেই পেয়ে বসেছিল। সে আমাকে কথায় কথায় কেবল তাক লাগিয়ে দিত।
কিন্তু, ইরুমাসি তো তোমার চেয়ে ছোটো ছিলেন।
অন্তত বছর-খানেক ছোটো। কিন্তু আমি তার বয়সের নাগাল পেতুম না; এমন করে আমাকে চালাত যেন আমার দুধে-দাঁত ওঠে নি। তার কাছে আমি হাঁ করেই থাকতুম|
ভারি মজা।
মজ বৈকি। তার কোনো-এক সাতমহল রাজবাড়ি নিয়ে সে আমাকে ছট্ফটিয়ে তুলেছিল। কোনো ঠিকানা পাই নি। একমাত্র সেই জানত রাজার বাড়ির সন্ধান। আমি পড়তুম থার্ড নম্বর রীডার; মাস্টার মশায়কে জিগ্গেস করেছি, মাস্টার মশায় হেসে আমার কান ধ’রে টেনে দিয়েছেন।
জিগগেস করেছি ইরুকে, রাজবাড়িটা কোথায় বলো-না।
সে চোখ দুটো এতখানি ক’রে বলত, এই বাড়িতেই।
আমি তার মুখের দিকে চেয়ে থাকতুম হাঁ করে। বলতুম, এই বাড়িতেই!— কোনখানে আমাকে দেখিয়ে দাও-না।
সে বলত, মন্তর না জানলে দেখবে কী করে।
আমি বলতুম, মন্তর আমাকে ব’লে দাও-না। আমি তোমাকে আমার কঁচা-আম-কাটা ঝিনুকটা দেব।
সে বলত, মন্তর বলে দিতে মানা আছে।
আমি জিগ্গেস করতুম, ব’লে দিলে কী হয়।
সে কেবল বলত, ও বাবা!
কী যে হয় জানাই হল না।— তার ভঙ্গী দেখে গা শিউরে উঠত। ঠিক করেছিলুম, একদিন যখন ইরু রাজবাড়িতে যাবে আমি যাব লুকিয়ে লুকিয়ে তার পিছনে পিছনে। কিন্তু, সে যেত রাজবাড়িতে আমি যখন যেতুম ইস্কুলে। একদিন জিগ্গেস করেছিলুম, অন্য সময়ে গেলে কী হয়। আবার সেই ‘ও বাবা’। পীড়াপীড়ি করতে সাহসে কুলোত না।
আমাকে তাক লাগিয়ে দিয়ে নিজেকে ইরু খুব-একটা-কিছু মনে করত। হয়তো একদিন ইস্কুল থেকে আসতেই সে ব’লে উঠেছে, উঃ, সে কী পেল্লায় কাণ্ড!
ব্যস্ত হয়ে জিগ্গেস করেছি, কী কাণ্ড।
সে বলেছে, বলব না।
ভালোই করত— কানে শুনতুম কী একটা কাণ্ড, মনে বরাবর রয়ে যেত পেল্লায় কাণ্ড।
ইরু গিয়েছে হস্ত-দন্তর মাঠে যখন আমি ঘুমোতুম। সেখানে পক্ষীরাজ ঘোড়া চ’রে বেড়ায়, মানুষকে কাছে পেলেই সে একেবারে উড়িয়ে নিয়ে যায় মেঘের মধ্যে।
আমি হাততালি দিয়ে ব’লে উঠতুম, সে তো বেশ মজা!
সে বলত, মজা বৈকি! ও বাবা!
কী বিপদ ঘটতে পারত শোনা হয় নি, চুপ করে গেছি মুখের ভঙ্গী দেখে। ইরু দেখেছে পরীদের ঘরকন্না— সে বেশি দূরে নয়। আমাদের পুকুরের পূব পাড়িতে যে চিনে বট আছে তারই মোটা মোটা শিকড়গুলোর অন্ধকার ফাঁকে ফাঁকে। তাদের ফুল তুলে দিয়ে সে বশ করেছিল। তারা ফুলের মধু ছাড়া আর কিছু খায় না। ইরুর পরী-বাড়ি যাবার একমাত্র সময় ছিল দক্ষিণের বারান্দায় যখন নীলকমল মাস্টারের কাছে আমাদের পড়া করতে বসতে হত।
ইরুকে জিগ্গেস করতুম, অন্য সময়ে গেলে কী হয়।
ইরু বলত, পরীরা প্রজাপতি হয়ে উড়ে যায়।
আরো অনেক-কিছু ছিল তার অবাক্-করা ঝুলিতে। কিন্তু, সবচেয়ে চমক লাগাত সেই না-দেখা রাজবাড়িটা। সে যে একেবারে আমাদের বাড়িতেই, হয়তো আমার শোবার ঘরের পাশেই। কিন্তু, মন্তর জানি নে যে। ছুটির দিনে দুপুর বেলায় ইরুর সঙ্গে গেছি আমতলায়, কাঁচা আম পেড়ে দিয়েছি, দিয়েছি তাকে আমার বহুমূল্য ঘষা ঝিনুক। সে খোসা ছাড়িয়ে শুলপো শাক দিয়ে বসে বসে খেয়েছে কাঁচা আম, কিন্তু মন্তরের কথা পাড়লেই বলে উঠেছে, ও বাবা!
তার পরে মন্তর গেল কোথায়, ইরু গেল শ্বশুরবাড়িতে, আমারও রাজবাড়ি খোঁজ করবার বয়স গেল পেরিয়ে— ঐ বাড়িটা রয়ে গেল গর-ঠিকানা। দূরের রাজবাড়ি অনেক দেখেছি, কিন্তু ঘরের কাছের রাজবাড়ি— ও বাবা!