গল্পের বই/কাঁপুনি শিখ্তে হবে
“কাঁপুনি শিখ্তে হবে।”
একজন লোকের দুই ছেলে। বড় ছেলে হারু, সে খুব চালাক। আর ছোট ছেলে কানু, সে বড় বোকা। কাজেই বাড়ীর যত কাজকর্ম্ম বড় ছেলেকেই সব করতে হয়, কিন্তু রাত্রির বেলায় কোথাও যেতে হলে তার ভারি ভয় করে। আর ভূতের গল্প শুনলেই সে বলে “বাবারে! ভয়েতে আমার কাঁপুনি আস্ছে।” তার কথা শুনে ছোট ছেলে কামু মনে মনে ভাবে,“তাইত! কাঁপুনি কাকে বলে তা ত জানিনা! না জানি সেটা কি রকম জিনিষ!”
একদিন কানুর বাবা তাকে ডেকে বল্ল, “দেখ, তুই এত বড় হ’লি এখনও কিছু করতে শিখ্লি না। এরপর খাবি কি করে? তোর দাদা দেখ্ত কত কাজ করে।” কানু বল্ল, “বাবা আমি একটা জিনিষ শিখ্ব ঠিক করেছি। কাঁপুনি কাকে বলে বাবা? সেইটে শিখ্তে আমার বড় ইচ্ছা করে।” তার বাবা বল্ল, “সে জন্য ভাবনা নেই তুমি আপনিই শিখ্বে। কিন্তু তাতে কি আর পেট ভর্বে?”
পরদিন তাদের গুরুঠাকুর এসেছেন, আর তাদের বাবা তাঁর কাছে দুঃখ কর্ছে যে কানুটা কোন কাজ শিখ্ল না, কেবল বলে কিনা, “কাঁপুনি কি? কাঁপুনি শিখ্ব।” একথা শুনে গুরুঠাকুর বল্লেন “আমার বাড়ী পাঠিয়ে দিও, আমি খুব করে তাকে কাঁপুনি শিখিয়ে দেব।”
কানুও গুরুঠাকুরের সঙ্গে তাঁদের বাড়ী গেল। সেখানে তার কাজ হ’লো রােজ মন্দিরের সিঁড়ী ঝাঁট দেওয়া।
একদিন দুপুর রাত্রে উঠে গুরুঠাকুর বলেন, “কানু, কাল খুব সকাল সকাল পূজো কর্তে হবে; তুমি এখনি গিয়ে মন্দিরের সিঁড়ী ঝাঁট দিয়ে এসাে।” কানু সিঁড়ী ঝাঁট দিচ্ছে, ঝাঁট প্রায় শেষও হয়ে এসেছে। এমন সময় সে চেয়ে দেখে সকলের উপরের সিঁড়ীতে একটা শাদা মতন কি দাঁড়িয়ে আছে। সে ভাব্লে, “বুঝেছি চোর! নইলে এত রাত্তিরে এ এখানে কি কর্তে এসেছে?” তারপর সে চীৎকার করে বল্ল, “কে এখানে? শীগ্গীর পালাও, না হলে এক ঠেলা মেরে ফেলে দেব।” সে শাদা জিনিষটা কিন্তু কিছু বল্ল না, চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।
তখন কানু ছুটে গিয়ে তাকে এমনি এক ধাক্কা দিল, যে সেটা সিঁড়ী দিয়ে গড়াতে গড়াতে নীচে পড়ে গেল। তাতে কানু খুব খুশী হয়ে, ঝাঁট পাট শেষ করে বাড়ী এসে নাক ডেকে ঘুমুতে লাগ্ল। পরদিন সকাল বেলা সকলে এসে দেখে যে মন্দিরের সিঁড়ীর তলায় গুরুঠাকুর শাদা কাপড় মুড়ি দিয়ে পড়ে আছেন। তা দেখে তারা ভারি আশ্চর্য্য আর ব্যস্ত হয়ে, ধরাধরি করে তাঁকে বাড়ী নিয়ে গেল। তারপর তাঁর গায়ের বেদনা সার্তে অনেকদিন লেগেছিল। এ সব কথা শুনে কানুর বাবা তাকে বল্ল, “তুই দূর হয়ে যা। আমি আর তাের মুখ দেখ্ব না।”
কাজেই কানু আর কি করে, সে আস্তে আস্তে বাড়ী থেকে বেরিয়ে গেল। সে পথ দিয়ে যায় আর বলে, ‘কাঁপুনি শিখ্তে হবে, কাঁপুনি শিখ্তে হবে’। এমনি করে যেতে যেতে সে আর এক রাজার দেশে চলে গেল। সেখানে একদিন একজন তাকে ব্ল্ল, “কাঁপুনি শিখ্তে চাও? কি করে কাঁপুনি শেখা যায় আমি ব’লে দিতে পারি। ওই যে পাহাড়ের উপর দেখ্ছ ওটা ভূতের বাড়ী। ওখানে অনেক টাকাকড়ি আছে ভূতেরা সে সব পাহারা দেয়। আমাদের রাজা বলেছেন, যে লােক ওখানে এক রাত্রি থাক্তে পার্বে, তার সঙ্গে তাঁর মেয়ের বিয়ে দেবেন। তুমি ওই ভূতের বাড়ীতে এক রাত থাকলে কাঁপুনিও শিখ্তে পারবে, রাজার মেয়েও বিয়ে কর্তে পারবে।”
কানু তখনই গিয়ে রাজামশাইকে বল্ল, “রাজামশাই! আমি তিন রাত ঐ ভূতের বাড়ীতে থাক্ব।” রাজা বল্লেন, বেশ কথা! তিনটি জিনিষ তুমি সঙ্গে নিতে পার। তা তুমি কি কি চাও?”
কানু বল্ল “আগুন জ্বালাবার জন্য কিছু কাঠ, একটা বস্বার চৌকি, আর একটা বড় ছুরি।”
রাজামশাই তখনি অনেক কাঠ, একটা চৌকি, আর একটা মস্ত বড় ছুরি ভূতের বাড়ীতে পাঠিয়ে দেওয়ালেন।
তারপর সন্ধ্যা হতেই কানু একলা একলা সেখানে গেল। তখন শীতকাল ছিল, তাই সে কাঠ দিয়ে আগুন জ্বেলে, ছুরি হাতে ক’রে আগুনের ধারে চৌকি পেতে চুপ করে বসে রইল।
ভূতের বাড়িতে কানু। অনেকক্ষণ ব’সে থাকবার পর তার মনে হল যেন চারদিকে কিসের একটা গােলমাল চল্ছে। নাকি সুরে, কারা যেন বল্ছে, “উঁ-হুঁ হুঁ —ভাঁরী শীঁতঁ। ভাঁরী শীঁতঁ!” কানু তখন চেঁচিয়ে তাদের বল্ল “তােরা ত ভারি বােকা রে! দূরে থেকে খালি ভাঁরী শীঁতঁ—ভাঁরী শীঁতঁ করছিস! শীত করে তাে আগুনের ধারে এসে বস্না!” অমনি চারদিক থেকে ধুপ্ ধাপ্ করে এই বড় বড় কালাে কালো কুকুর বেড়াল লাফিয়ে পড়তে লাগল। তারা সব ভূত। তাদের চোখগুলাে আগুনের মত জ্বলছে, লাল লাল জীভ্ সব লক্লক্ করছে। তারা এসে কানুকে ঘিরে আগুনের চারধরে বস্ল, আর তার দিকে চেয়ে চেয়ে ফোঁস ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলতে লাগল। কানু কিন্তু তাতে একটুও ভয় পেল না। খানিক পরে ভূতগুলাে তাকে বল্ল, “আয় না, খেলা করি।” কানু বল্ল, “আগে তােদের নখ দেখিত।” তারা তাদের কালাে কালো থাবা বার করে দেখাল, তাতে এই বড় বড় বাঘের নখের মত নখ। তাই দেখে কানু বল্ল, “তােদের যে নখ, খেল্তে গিয়ে যদি আঁচড়ে দিস্? আয়, আগে তােদের নখ কেটেদি।” এই বলে সে ছুরি বার করে তাদের নখ কাট্তে গিয়েছে, অমনি সব কুকুর বেড়াল কোথায় মিলিয়ে গেল। তারা কিনা ভূত! যে ভয় পায় তাকে তারা মেরে ফেলে, আর যে ভয় পায় না তার কিচ্ছু কর্তে পারে না।
এতক্ষণে কানুর ভারি ঘুম পেয়েছে। সেই ঘরের এক কোণে একটা মস্ত বড় খাটে সুন্দর বিছানা করা ছিল। কানু সেটা দেখ্তে পেয়েই ভারী খুসি হয়ে তাতে গিয়ে শুয়ে রইল। তার পর সবে তার চোখ বুজে এসেছে, এমন সময় তার মনে হল যেন খাটখানা একটু একটু নড়্ছে। দেখ্তে দেখ্তে খাটখানা ঠক ঠক করে নড়ে উঠল, তারপর দোলনার মতন দোল খেয়ে খেয়ে শেষে একেবারে লাফাতেই লাগল। কানু কিন্তু তবু ওঠেনা; সে বিছানা বালিস শক্ত করে ধরে শুয়ে আছে। লাফাতে লাফাতে শেষটায় খাট তাকে নিয়ে ছুট দিল। সিঁড়ী দিয়ে, উঠানের উপর দিয়ে, ঘরের ভিতর দিয়ে, সমস্ত বাড়ীময় খাটটা বেড়াতে লাগ্ল। খট্খট্ ঘট্ঘট্ হড়হড় ঘড়ঘড় শব্দে কানে তালা লেগে গেল! তখনও কিন্তু কানু বিছানায় শুয়ে আছে। তারপর হঠাৎ খাটটা উল্টে গিয়ে, তােষক বিছানা বালিস সবশুদ্ধ কানুকে হুড়মুড় ক’রে মাটিতে ফেলে দিয়ে, চুপ করে দাঁড়াল। তখন কানু আস্তে আস্তে উঠে ভাবল যে, “আর ঘুম ত হবে না; যাই আগুনের কাছে গিয়েই বসি।” কিন্তু সেখানে গিয়ে সে দেখল যে তার চৌকির উপরে একটা মস্ত দাড়িওয়ালা লােক বসে আছে। কানু তাকে বলল, “ওটা আমার চৌকি। তুই ওখান থেকে ওঠ্; ওখান, আমি বস্ব।” দাড়িওয়ালা লােকটা বল্ল, “বটে, তাের চৌকি! দেখি তাের গায়ে কত জোর, আমাকে চৌকি থেকে ওঠা দেখি।” যেই এই কথা বলা, অমনি এক ঠেলা দিয়ে কানু তাকে চৌকি থেকে ফেলে দিল। তখন দুজনে এমনি কুস্তি লেগে গেল যে কি বলব! অনেকক্ষণ কুস্তির পর সেই দাড়িওয়ালী লােকটা বল্ল, “আর না ভাই, ঢের হয়েছে। তাের গায়ে ত খুব জোর আর তাের খুব সাহসও আছে দেখছি। আমি এই বাড়ীর ভূতদের সর্দ্দার। এখানে যে সব টাকাকড়ি আছে সে সব এতদিন আমরা পাহারা দিতাম। এখন সে টাকাকড়ি তাের। এই বলে সে কানুকে একটা ঘরে নিয়ে গিয়ে দেখাল, সে ঘর ভরা কত সােনা রূপো, মণি, মুক্ত ঝক্ ঝক্ কর্ছে।
পরদিন সকাল হতেই রাজামশাই অনেক লােকজন নিয়ে ভূতের বাড়ীতে গেলেন। তাঁরা ত মনে করেছেন ভূতেরা নিশ্চয়ই কানুকে মেরে ফেলেছে। কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখেন যে সে নাক ডাকিয়ে ঘুমুচ্ছে। তা দেখে রাজামশাই যেমন আশ্চর্য্য হলেন, কানুর কাছে সব কথা শুনে তেমনি খুসীও হলেন। তার পর তাকে আদর করে গায়ে হাত বুলিয়ে, নিজের বাড়ীতে এনে খুব ধূমধাম করে তার সঙ্গে মেয়ের বিয়ে দিলেন।
রাজার বাড়ীতে কানু খুব সুখেই আছে, কিন্তু তার এখনও এই ভারি দুঃখ যে সে কাপুনি শিখ্তে পারল না। সে রাত্রে ঘুমের মধ্যেও বলে “তাইত, কাঁপুনি শিখ্তে পারলাম না। কাঁপুনি শিখ্তে হবে।”
তা শুনে একদিন রাজার মেয়ে করলেন কি, তাঁর ঝিকে বললেন, “ঝি, নদী থেকে কতগুলাে ছােট ছোট মাছ ধরে নিয়ে আয় তো। এনে, মাছগুলাে এক কলসী ঠাণ্ডা জলে রেখে দে।”
তখন শীতকাল। রাত্রে যখন কানু ঘুমিয়েছে, এমন সময় সেই মাছভরা ঠাণ্ডা জলের কলসী নিয়ে রাজার মেয়ে তার গায়ে ঢেলে দিলেন। ঠাণ্ডা জলের সঙ্গে সেই ছােট ছােট মাছগুলাে কিল বিল করে তার গায়ে পড়তেই এমনি শীত আর কাঁপুনি তাকে ধর্ল যে কাঁপুনি যাকে বলে। সে ধড়ফড়িয়ে লাফিয়ে উঠে খালি “হু-হু-হু-হু! হী-হী-হী-হী” করে কাঁপছে আর বল্ছে “আরে, আরে একি? এই বুঝি তবে কাঁপুনি?” তারপর সে খুব হাততালি দিয়ে নাচ্তে নাচ্তে বল্তে লাগ্ল “কাঁপুনি শিখেছি, কাঁপুনি শিখেছি।”