গীতবিতান/গীতিনাট্য ও নৃত্যনাট্য/চিত্রাঙ্গদা



চিত্রাঙ্গদা


ভূমিকা


প্রভাতের আদিম আভাস অরুণবর্ণ আভার আবরণে।
অর্ধসুপ্ত চক্ষুর ’পরে লাগে তারই প্রথম প্রেরণা।
অবশেষে রক্তিম আবরণ ভেদ ক’রে সে আপন নিরঞ্জন শুভ্রতায়
সমুজ্জ্বল হয় জাগ্রত জগতে।

তেমনি সত্যের প্রথম উপক্রম সাজসজ্জার বহিরঙ্গে,
বর্ণ বৈচিত্রে—
তারই আকর্ষণ অসংস্কৃত চিত্তকে করে অভিভূত।
একদা উন্মুক্ত হয় সেই বহিরাচ্ছাদন,
তখনই প্রবুদ্ধ মনের কাছে তার পূর্ণ বিকাশ।

এই তত্ত্বটি চিত্রাঙ্গদা নাট্যের মর্মকথা।
এই নাট্যকাহিনীতে আছে—
প্রথমে প্রেমের বান মোহাবেশে,
পরে তার মুক্তি সেই কুহক হতে
সহজ সত্যের নিরলংকৃত মহিমায়।

মণিপুররাজের ভক্তিতে তুষ্ট হয়ে শিব বর দিয়েছিলেন যে তার বংশে কেবল পুত্রই জন্মাবে। তৎসত্ত্বেও যখন রাজকুলে চিত্রাঙ্গদার জন্ম হল তখন রাজা তাঁকে পুত্ররূপেই পালন করলেন। রাজকন্যা অভ্যাস করলেন ধনুর্বিদ্যা শিক্ষা করলেন যুদ্ধবিদ্যা, রাজদণ্ডনীতি।

 অর্জুন দ্বাদশবর্ষব্যাপী ব্রহ্মচর্যব্রত গ্রহণ করে ভ্রমণ করতে করতে এসেছেন মণিপুরে। তখন এই নাটকের আখ্যান আরম্ভ।

মোহিনী মায়া এল,
এল  যৌবনকুঞ্জবনে।
এল  হৃদয়শিকারে,
এল গোপন পদসঞ্চারে,
এল  বর্ণকিরণবিজড়িত অন্ধকারে।

পাতিল ইন্দ্রজালের ফাঁসি,
হাওয়ায় হাওয়ায় ছায়ায় ছায়ায়
বাজায় বাঁশি।
করে  বীরের বীর্যপরীক্ষা,
হানে  সাধুর সাধনদীক্ষা,
সর্বনাশের বেড়াজাল
বেষ্টিল চারি ধারে।

এসো সুন্দর নিরলঙ্কার,
এসো  সত্য নিরহঙ্কার-
স্বপ্নের দুর্গ হানো,
আনো, আনো মুক্তি আনো—
ছলনার বন্ধন ছেদি
এসো পৌরুষ-উদ্ধারে।


প্রথম দৃশ্যে চিত্রাঙ্গদার শিকার-আয়োজন


গুরু গুরু গুরু গুরু ঘন মেঘ গরজে পর্বতশিখরে,
অরণ্যে তমশ্ছায়া।
মুখর নির্ঝরকলকল্লোলে
ব্যাধের চরণধ্বনি শুনিতে না পায় ভীরু
হরিণদম্পতি।
চিত্রব্যাঘ্র পদনখচিহ্নরেখাশ্রেণী
রেখে গেছে ওই পথপঙ্ক’পরে,
দিয়ে গেছে পদে পদে গুহার সন্ধান।

বনপথে অর্জুন নিদ্রিত


শিকারের বাধা মনে করে চিত্রাঙ্গদার সখী তাঁকে তাড়না করলে


অর্জুন।  অহো, কী দুঃসহ স্পর্ধা! 
অর্জুনে যে করে অশ্রদ্ধা
সে কোনখানে পাবে তার আশ্রয়!
চিত্রাঙ্গদা। অর্জুন! তুমি অর্জুন! 

বালকবেশীদের দেখে সকৌতুক অবজ্ঞায়


অর্জুন।  হাহাহাহা হাহাহাহা, বালকের দল, 
মা’র কোলে যাও চলে— নাই ভয়।
অহো, কী অদ্ভুত কৌতুক।

প্রস্থান


চিত্রাঙ্গদা। অর্জুন!  তুমি অর্জুন! 
ফিরে এসো, ফিরে এসো—
ক্ষমা দিয়ে কোরো না অসম্মান,
যুদ্ধে করো আহ্বান!

বীর-হাতে মৃত্যুর গৌরব
করি যেন অনুভব—
অর্জুন!  তুমি অর্জুন।



হা হতভাগিনী, একি অভ্যর্থনা মহতের,
এল দেবতা তোর জগতের,
গেল চলি,
গেল তোরে গেল ছলি—
অর্জুন!  তুমি অর্জুন।
সখীগণ।  বেলা  যায় বহিয়া,  দাও কহিয়া 
কোন্ বনে যাব শিকারে।
কাজল মেঘে  সজল বায়ে
হরিণ ছুটে বেণুবনচ্ছায়ে।
চিত্রাঙ্গদা।  থাক্ থাক্, মিছে কেন এই খেলা আর। 
জীবনে হল বিতৃষ্ণা, আপনার ’পরে ধিক্কার।

আত্ম-উদ্দীপনার গান


ওরে  ঝড় নেমে আয়,  আয়,  আয় রে আমার
শুকনো পাতার ডালে
এই বরষায় নবশ্যামের আগমনের কালে।
যা উদাসীন, যা প্রাণহীন, যা আনন্দহারা,
চরম রাতের অশ্রুধারায় আজ হয়ে যাক সারা—
যাবার যাহা যাক সে চলে রুদ্র নাচের তালে।
আসন আমার পাততে হবে রিক্ত প্রাণের ঘরে,
নবীন বসন পরতে হবে সিক্ত বুকের ’পরে।
নদীর জলে বান ডেকেছে, কূল গেল তার ভেসে—
যূথীবনের গন্ধবাণী ছুটল নিরুদ্দেশে—
পরান আমার জাগল বুঝি মরণ-অন্তরালে।

সখী।  সখী, কী দেখা দেখিলে তুমি! 
এক পলকের আঘাতেই
খসিল কি আপন পুরানো পরিচয়।
রবিকরপাতে কোরকের আবরণ টুটি
মাধবী কি প্রথম চিনিল আপনারে।
চিত্রাঙ্গদা।  বঁধু,  কোন আলো লাগল চোখে! 
বুঝি  দীপ্তিরূপে ছিলে সূর্যলোকে!
ছিল মন তোমারি প্রতীক্ষা করি
যুগে যুগে দিন রাত্রি ধরি,
ছিল মর্মবেদনাঘন অন্ধকারে—
জন্ম-জনম গেল বিরহশোকে।
অস্ফুটমঞ্জরী কুঞ্জবনে,
সঙ্গীতশূন্য বিষন্ন মনে
সঙ্গীরিক্ত চিরদুঃখরাতি
পোহাব কি নির্জনে শয়ন পাতি!
সুন্দর হে, সুন্দর হে,
বরমাল্যখানি তব আনো বহে, তুমি  আনো বহে।
অবগুণ্ঠনছায়া ঘুচায়ে দিয়ে
হেরো  লজ্জিত স্মিতমুখ শুভ আলোকে।

প্রস্থান


বন্য অনুচরদের সঙ্গে অর্জুনের প্রবেশ ও নৃত্য



সখীদের গান


যাও, যাও যদি যাও তবে—
তোমায় ফিরিতে হবে—
হবে হবে।

ব্যর্থ চোখের জলে
আমি লুটাব না ধূলিতলে, লুটাব না।
বাতি নিবায়ে যাব না, যাব না, যাব না
জীবনের উৎসবে।
মোর  সাধনা ভীরু নহে,
শক্তি আমার হবে মুক্ত  দ্বার যদি রুদ্ধ রহে
বিমুখ মুহূর্তেরে করি না ভয়—
হবে জয়, হবে জয়, হবে জয়,
দিনে দিনে হৃদয়ের গ্রন্থি তব
খুলিব প্রেমের গৌরবে।

সখিসহ স্নানে আগমন


চিত্রাঙ্গদা। ক্ষণে ক্ষণে মনে মনে  শুনি 
অতল জলের আহ্বান।
মন রয় না, রয় না, রয় না ঘরে,
মন রয় না—
চঞ্চল প্রাণ।
ভাসায়ে দিব আপনারে  ভরা জোয়ারে,
সকল-ভাবনা-ডুবানো ধারায়  করিব স্নান।
ব্যর্থ বাসনার দাহ  হবে নির্বাণ।
ঢেউ দিয়েছে জলে—
ঢেউ দিল, ঢেউ দিল, ঢেউ দিল আমার মর্মতলে।
একি ব্যাকুলতা আজি আকাশে,  এই বাতাসে
যেন উতলা অপ্সরীর উত্তরীয়  করে রোমাঞ্চ দান।
দূর সিন্ধুতীরে কার মঞ্জীরে  গুঞ্জরতান

সখীদের প্রতি


দে তোরা আমায় নূতন ক’রে দে  নূতন আভরণে।

হেমন্তের অভিসম্পাতে রিক্ত অকিঞ্চন কাননভূমি—
বসন্তে হোক দৈন্যবিমোচন  নবলাবণ্যধনে।
শূন্য শাখা লজ্জা ভুলে যাক  পল্লব-আবরণে।
সখীগণ।  বাজুক প্রেমের মায়ামন্ত্রে 
পুলকিত প্রাণের বীণাযন্ত্রে
চিরসুন্দরের অভিবন্দনা।
আনন্দচঞ্চল নৃত্য অঙ্গে অঙ্গে বহে যাক
হিল্লোলে হিল্লোলে,
যৌবন পাক্ সম্মান  বাঞ্ছিতসম্মিলনে।

সকলের প্রস্থান



অর্জুনের প্রবেশ ও ধ্যানে উপবেশন


তাঁকে প্রদক্ষিণ ক’রে চিত্রাঙ্গদার নৃত্য


চিত্রাঙ্গদা।  আমি  তোমারে করিব নিবেদন 
আমার হৃদয় প্রাণ মন।
অর্জুন।  ক্ষমা করো আমায়— আমায়— 
বরণযোগ্য নহি বরাঙ্গনে— ব্রহ্মচারী ব্রতধারী।

প্রস্থান


চিত্রাঙ্গদা।  হায় হায়, নারীরে করেছি ব্যর্থ 
দীর্ঘকাল জীবনে আমার।
ধিক্ ধনুঃশর!
ধিক্ বাহবল!
মুহূর্তের অশ্রুবন্যাবেগে
ভাসায়ে দিল যে মোর পৌরুষসাধনা।
অকৃতার্থ যৌবনের দীর্ঘশ্বাসে
বসন্তেরে করিল ব্যাকুল।

রোদন-ভরা এ বসন্ত,  সখী,
কখনো আসে নি বুঝি আগে।
মোর  বিরহবেদনা রাঙালো  কিংশুকরক্তিমিরাগে
সখীগণ। তোমার  বৈশাখে ছিল প্রখর রৌদ্রের জ্বালা, 
কখন বাদল আনে আষাঢ়ের পালা।
হায় হায় হায়!
চিত্রাঙ্গদা। কুঞ্জদ্বারে বনমল্লিকা 
সেজেছে পরিয়া নব পত্রালিকা,
সারা দিন-রজনী অনিমিখা
কার পথ চেয়ে জাগে।
সখীগণ। কঠিন পাষাণে কেমনে গোপনে ছিল, 
সহসা ঝরনা নামিল অশ্রুঢালা।
হায় হায় হায়!
চিত্রাঙ্গদা। দক্ষিণসমীরে দূর গগনে 
একেলা বিরহী গাহে বুঝি গো।
কুঞ্জবনে মোর মুকুল যত
আবরণবন্ধন ছিঁড়িতে চাহে।
সখীগণ। মৃগয়া করিতে বাহির হল যে বনে 
মৃগী হয়ে শেষে এল কি অবলা বালা।
হায় হায় হায়!
চিত্রাঙ্গদা। আমি এ প্রাণের রুদ্ধ দ্বারে 
ব্যাকুল কর হানি বারে বারে,
দেওয়া হল না যে আপনারে
এই ব্যথা মনে লাগে।
সখীগণ। যে ছিল আপন শক্তির অভিমানে 
কার পায়ে আনে হার মানিবার ডালা।
হায় হায় হায়।
একজন সখী। ব্রহ্মচর্য!— পুরুষের স্পর্ধা এ যে! 

নারীর এ পরাভবে
লজ্জা পাবে বিশ্বের রমণী।
পঞ্চশর, তোমারি এ পরাজয়।
জাগো হে অতনু,
সখীরে বিজয়দূতী করো তব,
নিরস্ত্র নারীর অস্ত্র দাও তারে—
দাও তারে অবলার বল।

মদনকে চিত্রাঙ্গদার পূজানিবেদন


চিত্রাঙ্গদা। আমার এই রিক্ত ডালি 
দিব তোমারি পায়ে।
দিব কাঙালিনীর আঁচল
তোমার পথে পথে, পথে বিছায়ে।
যে পুষ্পে গাঁথ পুষ্পধনু
তারি ফুলে ফুলে, হে অতনু, তারি ফুলে
আমার পূজা-নিবেদনের দৈন্য
দিয়ো দিয়ো দিয়ো ঘুচায়ে।
তোমার রণজয়ের অভিযানে
তুমি আমায় নিয়ো,
ফুলবাণের টিকা আমার ভালে
এঁকে দিয়ো দিয়ো—
রণজয়ের অভিযানে।
আমার শূন্যতা দাও যদি
সুধায় ভরি।
দিব তোমার জয়ধ্বনি
ঘোষণ করি— জয়ধ্বনি—
ফাল্গুনের আহ্বান জাগাও
আমার কায়ে দক্ষিণবায়ে।

মদনের প্রবেশ


মদন। মণিপুরনৃপদুহিতা 
তোমারে চিনি  তাপসিনী!
মোর পূজায় তব ছিল না মন,
তবে কেন অকারণ
তুমি মোর দ্বারে এলে তরুণী,
কহো কহো শুনি  তাপসিনী!
চিত্রাঙ্গদা। পুরুষের বিদ্যা করেছি শিক্ষা, 
লভি নাই মনোহরণের দীক্ষা—
কুসুমধনু,
অপমানে লাঞ্ছিত তরুণ তনু।
অর্জুন ব্রহ্মচারী
মোর মুখে হেরিল না নারী,
ফিরাইল, গেল ফিরে।
দয়া করো অভাগীরে—
শুধু এক বরষের জন্যে
পুষ্পপলাবণ্যে
মোর দেহ পাক্ তব স্বর্গের মূল্য
মর্তে অতুল্য।
মদন। তাই আমি দিনু বর, 
কটাক্ষে রবে তব পঞ্চম শর,
মম পঞ্চম শর—
দিবে মন মোহি,
নারীবিদ্রোহী সন্ন্যাসীরে
পাবে অচিরে—
বন্দী করিবে ভুজপাশে
বিদ্রূপহাসে।

মণিপুররাজকন্যা
কান্তহৃদয়বিজয়ে হবে ধন্যা।


নূতনরূপপ্রাপ্ত চিত্রাঙ্গদা


চিত্রাঙ্গদা। এ কী দেখি! 
এ কে এল মোর দেহে
পূর্ব-ইতিহাস-হারা!
আমি কোন্ গত জনমের স্বপ্ন!
বিশ্বের অপরিচিত আমি!
আমি নহি রাজকন্যা চিত্রাঙ্গদা—
আমি শুধু এক রাত্রে ফোটা
অরণ্যের পিতৃমাতৃহীন ফুল—
এক প্রভাতের শুধু পরমায়ু,
তার পরে ধূলিশয্যা,
তার পরে ধরণীর চির-অবহেলা।

সরোবর তীরে


আমার অঙ্গে অঙ্গে কে বাজায়, বাজায় বাঁশি।
আনন্দে বিষাদে মন উদাসী
পুষ্পবিকাশের সুরে  দেহ মন উঠে পূরে,
কী মাধুরীসুগন্ধ  বাতাসে যায় ভাসি।
সহসা মনে জাগে আশা,
মোর  আহুতি পেয়েছে অগ্নির ভাষা।
আজ মম রূপে বেশে  লিপি লিখি কার উদ্দেশে,
এল  মর্মের বন্দিনী বাণী বন্ধন নাশি।


মীনকেতু,
কোন্ মহারাক্ষসীরে দিয়েছ বাঁধিয়া অঙ্গসহচরী করি।
এ মায়ালাবণ্য মোর কী অভিসম্পাত! ক্ষণিক যৌবনবন্যা
রক্তস্রোতে তরঙ্গিয়া উন্মাদ করেছে মোরে।

নূতন কান্তির উত্তেজনায় নৃত্য


স্বপ্নমদির নেশায় মেশা এ উন্মত্ততা,
জাগায় দেহে মনে এ কী বিপুল ব্যথা।
বহে মম শিরে শিরে  এ কী দাহ, কী প্রবাহ—
চকিতে সর্বদেহে ছুটে তড়িৎলতা।
ঝড়ের পবনগর্জে হারাই আপনায়,
দুরন্ত যৌবনক্ষুব্ধ অশান্ত বন্যায়।
তরঙ্গ উঠে প্রাণে  দিগন্তে কাহার পানে,
ইঙ্গিতের ভাষায় কাঁদে—  নাহি নাহি কথা।


এরে ক্ষমা কোরো সখা—
এ যে এল তব আঁখি ভুলাতে,
শুধু ক্ষণকালতরে মোহ-দোলায় দুলাতে
আঁখি ভুলাতে।
মায়াপুরী হতে এল নাবি—
নিয়ে এল স্বপ্নের চাবি,
তব কঠিন হৃদয়দুয়ার খুলাতে,
আঁখি ভুলাতে।

প্রস্থান


অর্জুনের প্রবেশ


অর্জুন।  কাহারে হেরিলাম!  আহা! 
সে কি সত্য, সে কি মায়া!

সে কি কায়া,
সে কি সুবর্ণকিরণে-রঞ্জিত ছায়া!

চিত্রাঙ্গদার প্রবেশ


এসো এসো যে হও সে হও,
বলো বলো তুমি স্বপন নও, নও স্বপন নও।
অনিন্দ্যসুন্দর দেহলতা
বহে  সকল আকাঙ্ক্ষার পূর্ণতা।
চিত্রাঙ্গদা।  তুমি অতিথি, অতিথি আমার। 
বলো কোন্ নামে করি সৎকার।
অর্জুন।  পাণ্ডব আমি অর্জুন গাণ্ডীবধন্বা  নৃপতিকন্যা! 
লহো মোর খ্যাতি,
লহো মোর কীর্তি,
লহো পৌরুষগর্ব।
লহো আমার সর্ব।
চিত্রাঙ্গদা।  কোন্ ছলনা এ যে নিয়েছে আকার, 
এর কাছে মানিবে কি হার।
ধিক্ ধিক্ ধিক্‌।
বীর তুমি বিশ্বজয়ী,
নারী এ যে মায়াময়ী—
পিঞ্জর রচিবে কি এ মরীচিকার।
ধিক্ ধিক্ ধিক্।
লজ্জা, লজ্জা, হায় একি লজ্জা,
মিথ্যা রূপ মোর, মিথ্যা সজ্জা।
এ যে মিছে স্বপ্নের স্বর্গ,
এ যে শুধু ক্ষণিকের অর্ঘ্য,
এই কি তোমার উপহার
ধিক্ ধিক্ ধিক্,।

অর্জুন।  হে সুন্দরী, উন্মথিত যৌবন আমার 
সন্ন্যাসীর ব্রতবন্ধ দিল ছিন্ন করি।
পৌরুষের সে অধৈর্য
তাহারে গৌরব মানি আমি—
আমি তো আচারভীরু নারী নহি
শাস্ত্রবাক্যে-বাঁধা।
এসো সখী, দুঃসাহসী প্রেম
বহন করুক আমাদের
অজানার পথে।
চিত্রাঙ্গদা। তবে তাই হোক 
কিন্তু মনে রেখো,
কিংশুকদলের প্রান্তে এই-যে দুলিছে
একটু শিশির— তুমি যারে করিছ কামনা
সে এমনি শিশিরের কণা
নিমিষের সোহাগিনী।



কোন্ দেবতা সে কী পরিহাসে  ভাসালো মায়ার ভেলায়
স্বপ্নের সাথি, এসো মোরা মাতি  স্বর্গের কৌতুকখেলায়।
সুরের প্রবাহে হাসির তরঙ্গে
বাতাসে বাতাসে ভেসে যাব রঙ্গে  নৃত্যবিভঙ্গে,
মাধবীবনের মধুগন্ধে  মোদিত মোহিত মন্থর বেলায়।


যে ফুলমালা দুলায়েছ আজি  রোমাঞ্চিত বক্ষতলে,
মধুরজনীতে রেখো সরসিয়া  মোহের মদির জলে।
নবোদিত সূর্যের করসম্পাতে
বিকল হবে হায় লজ্জা-আঘাতে,
দিন গত হলে নূতন প্রভাতে
মিলাবে ধুলার তলে কার অবহেলায়।

অর্জুন। আজ মোরে 
সপ্তলোক স্বপ্ন মনে হয়।
শুধু একা পূর্ণ তুমি,
সর্ব তুমি,
বিশ্ববিধাতার গর্ব তুমি,
অক্ষয় ঐশ্বর্য তুমি,
এক নারী— সকল দৈন্যের তুমি মহা অবসান—
সব সাধনার তুমি শেষ পরিণাম।
চিত্রাঙ্গদা।  সে আমি যে আমি নই, আমি নই— 
হায় পার্থ, হায়,
সে যে কোন্ দেবের ছলনা।
যাও যাও ফিরে যাও, ফিরে যাও বীর।
শৌর্য বীর্য মহত্ত্ব তোমার
দিয়ো না মিথ্যার পায়ে—
যাও যাও ফিরে যাও।

প্রস্থান


অর্জুন। এ কী তৃষ্ণা, এ কী দাহ! 
এ যে অগ্নিলতা পাকে পাকে
ঘেরিয়াছে তৃষ্ণার্ত কম্পিত প্রাণ।
উত্তপ্ত হৃদয়
ছুটিয়া আসিতে চাহে সর্বাঙ্গ টুটিয়া।



অশান্তি আজ হানল একি দহনজ্বালা!
বিঁধল হৃদয় নিদয় বাণে বেদন-ঢালা।
বক্ষে জ্বালায় অগ্নিশিখা,
চক্ষে কাঁপায় মরীচিকা,
মরণ-সুতোয় গাঁথল কে মোর বরণমালা।

চেনা ভুবন হারিয়ে গেল স্বপন-ছায়াতে,
ফাগুন-দিনের পলাশ-রঙের রঙিন মায়াতে।
যাত্রা আমার নিরুদ্দেশা—
পথ-হারানোর লাগল নেশা,
অচিন দেশে এবার আমার যাবার পালা।

8


মদন ও চিত্রাঙ্গদা


চিত্রাঙ্গদা। ভম্মে ঢাকে ক্লান্ত হতাশন— 
এ খেলা খেলাবে, হে ভগবন্, আর কতখন।
এ খেলা খেলাবে আর কতখন।
শেষ যাহা হবেই হবে, তারে
সহজে হতে দাও শেষ।
সুন্দর যাক রেখে স্বপ্নের রেশ।
জীর্ণ কোরো না, কোরো না, যা ছিল নূতন
মদন।  না না না সখী,  ভয় নেই সখী, ভয় নেই— 
ফুল যবে সাঙ্গ করে খেলা
ফল ধরে সেই।
হর্ষ-অচেতন বর্ষ
রেখে যাক মন্ত্রস্পর্শ
নবতর ছন্দস্পন্দন।

প্রস্থান


অজুন ও চিত্রাঙ্গদা


কেটেছে একেলা বিরহের বেলা আকাশকুসুমচয়নে।
সব পথ এসে মিলে গেল শেষে তোমার দুখানি নয়নে—
নয়নে, নয়নে।

দেখিতে দেখিতে নূতন আলোকে
কে দিল রচিয়া ধ্যানের পুলকে
নূতন ভুবন নূতন দ্যুলোকে  মোদের মিলিত নয়নে—
নয়নে, নয়নে।
বহির-আকাশে মেঘ ঘিরে আসে,  এল সব তারা ঢাকিতে।
হারানো সে আলো আসন বিছালো  শুধু দুজনের আঁখিতে—
আঁখিতে, আঁখিতে।
ভাষাহারা মম বিজন রোদনা
প্রকাশের লাগি করেছে সাধনা,
চিরজীবনেরি বাণীর বেদনা  মিটিল দোঁহার নয়নে—
নয়নে, নয়নে।

প্রস্থান


অর্জুনের প্রবেশ


অর্জুন। কেন রে ক্লান্তি আসে আবেশভার বহিয়া, 
দেহ মন প্রাণ দিবানিশি জীর্ণ অবসাদে কেন রে।
ছিন্ন করো এখনি বীর্যবিলোপী এ কুহেলিকা।
এই কর্মহারা কারাগারে রয়েছ কোন্ পরমাদে।
কেন রে।

গ্রামবাসীগণের প্রবেশ


গ্রামবাসীগণ।  হো, এল এল এল রে দস্যুর দল, 
গর্জিয়া নামে যেন বন্যার জল— এল এল।
চল্ তোরা পঞ্চগ্রামী,
চল্ তোরা কলিঙ্গধামী,
মল্লপল্লী হতে চল্  চল্।
‘জয় চিত্রাঙ্গদা’ বল, বল বল ভাই রে—
ভয় নাই, ভয় নাই, ভয় নাই, নাই রে।
অর্জুন।  জনপদবাসী, শোনো শোনো, 
রক্ষক তোমাদের নাই কোনো?

গ্রামবাসীগণ।  তীর্থে গেছেন কোথা তিনি 
গোপনব্রতধারিণী,
চিত্রাঙ্গদা তিনি রাজকুমারী।
অর্জুন।  নারী!  তিনি নারী! 
গ্রামবাসীগণ। স্নেহহবলে তিনি মাতা,  বাহুবলে তিনি রাজা। 
তাঁর নামে ভেরী বাজা,
‘জয় জয় জয়’ বলো ভাই রে—
ভয় নাই, ভয় নাই, ভয় নাই, নাই রে।



সন্ত্রাসের বিহ্বলতা নিজেরে অপমান।
সঙ্কটের কল্পনাতে হোয়ো না ম্রিয়মাণ— আ! আহা!
মুক্ত করো ভয়,
আপনা-মাঝে শক্তি ধরো, নিজেরে করো জয়— আ! আহা!
দুর্বলেরে রক্ষা করো, দুর্জনেরে হানো,
নিজেরে দীন নিঃসহায় যেন কভু না জানো।
মুক্ত করো ভয়,
নিজের ’পরে করিতে ভর না রেখো সংশয় আ! আহা!
ধর্ম যবে শঙ্খরবে করিবে আহ্বান
নীরব হয়ে নম্র হয়ে পণ করিয়ো প্রাণ।
মুক্ত করো ভয়,
দুরূহ কাজে নিজেরই দিয়ো কঠিন পরিচয়— আ! আহা।

প্রস্থান


চিত্রাঙ্গদার প্রবেশ


চিত্রাঙ্গদা।  কী ভাবিছ নাথ, কী ভাবিছ। 
অর্জুন।  চিত্রাঙ্গদা রাজকুমারী 
কেমন না জানি
আমি তাই ভাবি মনে মনে।

শুনি  স্নেহে সে নারী,
শুনি  বীর্যে সে পুরুষ,
শুনি  সিংহাসনা যেন সে সিংহবাহিনী।
জান যদি বলো প্রিয়ে, বলো তার কথা।
চিত্রাঙ্গদা।  ছি ছি, কুৎসিত কুরূপ সে। 
হেন বঙ্কিম ভুরুযুগ নাহি তার,
হেন উজ্জ্বলকজ্জল আঁখিতারা।
সন্ধিতে পারে লক্ষ্য  কিণাঙ্কিত তার বাহু,
বিঁধিতে পারে না বীরবক্ষ  কুটিল কটাক্ষশরে।
নাহি লজ্জা, নাহি শঙ্কা,  নাহি নিরসুন্দর রঙ্গ,
নাহি নীরব ভঙ্গীর সঙ্গীতলীলা  ইঙ্গিতছন্দোমধুর।
অর্জুন। আগ্রহ মোর অধীর অতি— 
কোথা সে রমণী বীর্যবতী।
কোষবিমুক্ত কৃপাণলতা—
দারুণ সে, সুন্দর সে
উদ্যত বজ্রের রুদ্ররসে—
নহে সে ভোগীর লোচনলোভা,
ক্ষত্রিয়বাহুর ভীষণ শোভা।
সখীগণ।  নারীর ললিত লোভন লীলায় এখনি কেন এ ক্লান্তি। 
এখনি কি, সখা, খেলা হল অবসান।
যে মধুর রসে ছিলে বিহ্বল
সে কি মধুমাখা ভ্রান্তি—
সে কি স্বপ্নের দান,
সে কি সত্যের অপমান।
দূর দুরাশায় হৃদয় ভরিছ,
কঠিন প্রেমের প্রতিমা গড়িছ,
কী মনে ভাবিয়া নারীতে করিছ পৌরুষসন্ধান।
এও কি মায়ার দান।

সহসা মন্ত্রবলে
নমনীয় এই কমনীয়তারে
যদি আমাদের সখী একেবারে
পরের বসন-সমান ছিন্ন করি ফেলে ধূলিতলে,
সবে না সবে না সে নৈরাশ্য—
ভাগ্যের সেই অট্টহাস্য
জানি জানি, সখা, ক্ষুব্ধ করিবে লুব্ধ পুরুষপ্রাণ—
হানিবে নিঠুর বাণ।
অর্জুন।  যদি মিলে দেখা তবে তারি সাথে 
ছুটে যাব আমি আর্তত্রাণে।
ভোগের আবেশ হতে
ঝাঁপ দিব যুদ্ধস্রোতে।
আজি মোর চঞ্চল রক্তের মাঝে
ঝন নন ঝন নন ঝঞ্ঝনা বাজে— বাজে— বাজে।
চিত্রাঙ্গদা রাজকুমারী
একাধারে মিলিত পুরুষ নারী।
চিত্রাঙ্গদা।  ভাগ্যবতী সে যে, 
এত দিনে তার আহ্বান  এল তব বীরের প্রাণে।
আজ অমাবস্যার রাতি  হোক অবসান।
কাল শুভ শুভ্র প্রাতে  দর্শন মিলিবে তার,
মিথ্যায় আবৃত নারী  ঘুচাবে মায়া-অবগুণ্ঠন।

অর্জুনের প্রতি


সখী।  রমণীর মন-ভোলাবার ছলাকলা 
দূর ক’রে দিয়ে উঠিয়া দাঁড়াক নারী
সরল উন্নত বীর্যবন্ত অন্তরের বলে
পর্বতের তেজস্বী তরুণ তরু সম—
যেন সে সম্মান পায় পুরুষের।

রজনীর নর্মসহচরী
যেন হয় পুরুষের কর্মসহচরী,
যেন বামহস্তসম দক্ষিণহস্তের থাকে সহকারী।
তাহে যেন পুরুষের তৃপ্তি হয় বীরোত্তম।


চিত্রাঙ্গদা ও মদন


চিত্রাঙ্গদা। লহো লহো ফিরে লহো 
তোমার এই বর
হে অনঙ্গদেব!
মুক্তি দেহো মোরে, ঘুচায়ে দাও
এই মিথ্যার জাল
হে অনঙ্গদেব!
চুরির ধন আমার দিব ফিরায়ে
তোমার পায়ে
আমার অঙ্গশোভা—
অধররক্ত-রাঙিমা যাক মিলায়ে
অশোকবনে হে অনঙ্গদেব!
যাক যাক যাক এ ছলনা,
যাক এ স্বপন হে অনঙ্গদেব।
মদন। তাই হোক তবে তাই হোক, 
কেটে যাক রঙিন কুয়াশা—
দেখা দিক শুভ্র আলোক।
মায়া ছেড়ে দিক পথ,
প্রেমের আসুক জয়রথ,
রূপের অতীত রূপ
দেখে যেন প্রেমিকের চোখ-

দৃষ্টি হতে খসে যাক, খসে যাক মোহনির্মোক—
যাক খসে যাক, খসে যাক মোহনির্মোক।

প্রস্থান


বিন সাজে সাজি দেখা দিবে তুমি কবে—
আভরণে আজি আবরণ কেন রবে।
ভালোবাসা যদি মেশে মায়াময় মোহে,
আলোতে আঁধারে দোঁহারে হারাব দোঁহে।
ধেয়ে আসে হিয়া তোমার সহজ রবে—
আভরণ দিয়া আবরণ কেন তবে।
ভাবের রসেতে যাহার নয়ন ডোবা
ভূষণে তাহারে দেখাও কিসের শোভা।
কাছে এসে তবু কেন রয়ে গেলে দূরে—
বাহির-বাঁধনে বাঁধিবে কি বন্ধুরে।
নিজের ধনে কি নিজে চুরি করে লবে—
আভরণে, আজি আবরণ কেন তবে।


চিত্রাঙ্গদার সহচর-সহচরীগণ


অর্জুনের প্রতি


এসো এসো পুরুষোত্তম, এসো এসো বীর মম!
তোমার পথ চেয়ে আছে প্রদীপ জ্বালা।
আজি  পরিবে বীরাঙ্গনার হাতে দৃপ্ত ললাটে, সখা,
বীরের বরণমালা।
ছিন্ন ক’রে দিবে সে তার শক্তির অভিমান,
তোমার  চরণে করিবে দান  আত্মনিবেদনের ডালা—
চরণে করিবে দান।

আজ  পরাবে বীরাঙ্গনা তোমার
দৃপ্ত ললাটে, সখা,
বীরের বরণমালা।
সখী। হে কৌন্তেয়, 
ভালো লেগেছিল ব’লে
তব করযুগে সখী দিয়েছিল ভরি  সৌন্দর্যের ডালি
নন্দনকানন হতে পুষ্প তুলে এনে  বহু সাধনায়।
যদি সাঙ্গ হল পূজা
তবে আজ্ঞা করো, প্রভু,
নির্মাল্যের সাজি  থাক পড়ে মন্দিরবাহিরে।
এইবার প্রসন্ন নয়নে চাও  সেবিকার পানে।

চিত্রাঙ্গদার প্রবেশ


চিত্রাঙ্গদা।  আমি চিত্রাঙ্গদা, আমি রাজেন্দ্রনন্দিনী। 
নহি দেবী, নহি সামান্যা নারী।
পূজা করি মোরে রাখিবে উর্ধ্বে সে নহি নহি,
হেলা করি মোরে রাখিবে পিছে সে নহি নহি।
যদি পার্শ্বে রাখ মোরে সঙ্কটে সম্পদে,
সম্মতি দাও যদি কঠিন ব্রতে  সহায় হতে
পাবে তবে তুমি চিনিতে মোরে।
আজ শুধু করি নিবেদন—
আমি চিত্রাঙ্গদা রাজেন্দ্রনন্দিনী।
অর্জুন। ধন্য ধন্য ধন্য আমি। 

সমবেত নৃত্য


তৃষ্ণার শান্তি সুন্দরকান্তি
তুমি এসো বিরহের সন্তাপভঞ্জন।
দোলা দাও বক্ষে,  এঁকে দাও চক্ষে
স্বপনের তুলি দিয়ে মাধুরীর অঞ্জন।

এনে দাও চিত্তে রক্তের নৃত্যে
বকুলনিকুঞ্জের মধুকরগুঞ্জন—
উদ্‌বেল উতরোল
যমুনার কল্লোল,
কম্পিত বেণুবনে মলয়ের চুম্বন।
আনো নবপল্লবে নর্তন উল্লোল,
অশোকের শাখা ঘেরি বল্লরীবন্ধন।



এস’ এস’ বসন্ত ধরাতলে—
আন’ মুহু মুহু নব তান,
আন’ নব প্রাণ,
নব গান,
আন’ গন্ধমদভরে অলস সমীরণ,
আন’ বিশ্বের অন্তরে অন্তরে নিবিড় চেতনা।
আন’ নব উল্লাসহিল্লোল,
আন’ আন’ আনন্দছন্দের হিন্দোলা
ধরাতলে।
এস’ এস’।
ভাঙ’ ভাঙ’ বন্ধনশৃঙ্খল,
আন’ আন’ উদ্দীপ্ত প্রাণের বেদনা
ধরাতলে।
এস’ এস’।
এস’  থরথরকম্পিত
মর্মরমুখরিত
মধুসৌরভপুলকিত
ফুল-আকুল মালতিবল্লিবিতানে
সুখছায়ে মধুবায়ে।
এস’ এস’।

এস’  বিকশিত উন্মুখ,
এস’ চির-উৎসুক,
নন্দনপথচিরযাত্রী।
আন’  বাঁশরিমন্দ্রিত মিলনের রাত্রি,
পরিপূর্ণ সুধাপাত্র নিয়ে এস’।
এস’  অরুণচরণ কমলবরণ
তরুণ উষার কোলে।
এস’  জ্যোৎস্নাবিবশ নিশীথে,
এস’  নীরব কুঞ্জকুটিরে,
সুখসুপ্ত সরসীনীরে।
এস’ এস’।
এস’  তড়িৎশিখাসম ঝঞ্ঝাবিভঙ্গে,
সিন্ধুতরঙ্গদোলে।
এস’  জাগরমুখর প্রভাতে,
এস’  নগরে প্রান্তরে বনে,
এস’  কর্মে বচনে মনে।
এস’ এস’।
এস’  মঞ্জিরগুঞ্জর চরণে,
এস’  গীতমুখর কলকণ্ঠে।
এস’  মঞ্জুল মল্লিকামাল্যে,
এস’  কোমল কিশলয়বসনে।
এস’  সুন্দর, যৌবনবেগে
এস’  দৃপ্ত বীর, নব তেজে।
ওহে  দুর্মদ, কর’ জয়যাত্রা।
চল’  জরাপরাভব সমরে—
পবনে কেশররেণু ছড়ায়ে,
চঞ্চল কুন্তল উড়ায়ে।
এস’ এস’।

অর্জুন।  মা মিৎ কিল ত্বং বনাঃ শাখাং মধুমতীমিম্ 
যথা সুপর্ণঃ প্রপতন্ পক্ষৌ নিহন্তি ভূম্যাম্
এবা নিহন্মি তে মনঃ।
চিত্রাঙ্গদা।  যথেমে দ্যাবা পৃথিবী সদ্যঃ পর্যেতি সূর্যঃ 
এবা পর্যেমি তে মনঃ।
উভয়ে।  অক্ষৌ নৌ মধুসংকাশে অনীকং নৌ সমঞ্জনম্। 
অন্ত কৃণুস্ব মাং হৃদি মন ইম্নৌ সহাসতি।