গীতবিতান/গীতিনাট্য ও নৃত্যনাট্য/বাল্মীকিপ্রতিভা



বাল্মীকিপ্রতিভা


প্রথম দৃশ্য


অরণ্য


বনদেবীগণ


সহে না, সহে না, কাঁদে পরান।
সাধের অরণ্য হল শ্মশান।
দস্যুদলে আসি শান্তি করে নাশ,
ত্রাসে সকল দিশ কম্পমান।
আকুল কানন, কাঁদে সমীরণ,
চকিত মৃগ, পাখি গাহে না গান।
শ্যামল তৃণদল শোণিতে ভাসিল,
কাতর রোদনরবে ফাটে পাষাণ।
দেবী দুর্গে, চাহো, ত্রাহি এ বনে—
রাখো অধীনী জনে, করো শান্তিদান।

প্রস্থান


প্রথম দস্যুর প্রবেশ


আঃ  বেঁচেছি এখন।  শর্মা  ও দিকে আর নন।
গোলেমালে ফাঁকতালে পালিয়েছি কেমন।
লাঠালাঠি কাটাকাটি  ভাবতে লাগে দাঁতকপাটি,
তাই, মানটা রেখে প্রাণটা নিয়ে সটকেছি কেমন—
আহা  সটকেছি কেমন।
আসুক তারা আসুক আগে,  দুনোদুনি নেব ভাগে,
স্যান্তামিতে আমার কাছে দেখব কে কেমন।
শুধু  মুখের জোরে, গলার চোটে  লুট-করা ধন নেব লুটে,
শুধু  দুলিয়ে ভুঁড়ি বাজিয়ে তুড়ি করব সরগরম—
আহা  করব সরগরম।

লুঠের দ্রব্য লইয়া দস্যুগণের প্রবেশ


এনেছি মোরা এনেছি মোরা রাশি রাশি লুটের ভার।
করেছি ছারখার— সব করেছি ছারখার—
কত  গ্রাম পল্লী লুটে-পুটে করেছি একাকার।
প্রথম দস্যু।  আজকে তবে মিলে সবে করব লুটের ভাগ— 
এ-সব  আনতে কত লণ্ডভণ্ড করনু যজ্ঞ-যাগ।
দ্বিতীয় দস্যু।  কাজের বেলায় উনি কোথা যে ভাগেন, 
ভাগের বেলায় আসেন আগে আরে দাদা!
প্রথম দস্যু।  এত বড়ো আস্পর্ধা তোদের, 
মোরে নিয়ে এ কি হাসি-তামাশা!
এখনি মুণ্ড করিব খণ্ড, খবর্দার রে খবদার!
দ্বিতীয় দস্যু।  হাঃ হাঃ, ভায়া খাপ্পা বড়, এ কী ব্যাপার! 
আজি  বুঝি বা বিশ্ব করবে নস্য, এমনি যে আকার।
তৃতীয় দস্যু।  এম্‌নি যোদ্ধা উনি, পিঠেতেই দাগ— 
তলোয়ারে মরিচা, মুখেতেই রাগ।
প্রথম দস্যু।  আর যে এ-সব সহে না প্রাণে— 
নাহি কি তোদের প্রাণের মায়া!
দারুণ রাগে কাঁপিছে অঙ্গ—
কোথা রে লাঠি, কোথা রে ঢাল!
সকলে।  হাঃ হাঃ, ভায়া খাপ্পা বড়, এ কী ব্যাপার! 
আজি  বুঝি বা বিশ্ব করবে নস্য, এম্‌নি যে আকার।


বাল্মীকির প্রবেশ


সকলে। এক ডোরে বাঁধা আছি মোরা সকলে। 
না মানি বারণ, না মানি শাসন, না মানি কাহারে।
কে বা রাজা, কার রাজ্য; মোরা কী জানি!
প্রতি জনেই রাজা মোরা, বনই রাজধানী!
রাজা-প্রজা উঁচু-নিচু কিছু না গণি!

ত্রিভুবনমাঝে আমরা সকলে কাহারে না করি ভয়—
মাথার উপরে রয়েছেন কালী, সমুখে রয়েছে জয়।

বাল্মীকির প্রতি


প্রথম দস্যু।  এখন করব কী বল্। 
সকলে।  এখন করব কী বল্। 
প্রথম দস্যু।  হো রাজা, হাজির রয়েছে দল! 
সকলে।  বল্ রাজা, করব কী বল্ এখন করব কী বল্। 
প্রথম দস্যু।  পেলে  মুখেরই কথা, 
আনি  যমেরই মাথা।  করে দিই রসাতল!
সকলে।  করে দিই রসাতল! 
সকলে।  হো রাজা, হাজির রয়েছে দল। 
বল্ রাজা, করব কী বল্ এখন করব কী বল্।
বাল্মীকি।  শোন্ তোরা তবে শোন। 
অমানিশা আজিকে,  পূজা দেব কালীকে।
ত্বরা করি যা তবে,  সবে মিলি যা তোরা—
বলি নিয়ে আয়।

বাল্মীকির প্রস্থান


সকলে।  ত্রিভুবনমাঝে আমরা সকলে কাহারে না করি ভয়, 
মাথার উপরে রয়েছেন কালী, সমুখে রয়েছে জয়।



তবে আয় সবে আয়, তবে আয় সবে আয়—
তবে ঢাল্ সুরা, ঢাল্ সুরা, ঢাল্ ঢাল্ ঢাল্!
দয়া মায়া কোন্ ছার, ছারখার হোক।
কে বা কাঁদে কার তরে, হাঃ হাঃ হাঃ!
তবে আন্ তলোয়ার, আন্ আন্ তলোয়ার,
তবে আন্ বরশা, আন্ আন্ দেখি ঢাল।
প্রথম দস্যু।  আগে পেটে কিছু ঢাল্, পরে পিঠে নিবি ঢাল। 

হাঃ হাঃ, হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ!
হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ, হাঃ হাঃ।

উঠিয়া


সকলে।  কালী কালী বলো রে আজ— 
বলো হো, হো হো, বলো হো, হো হো, বলো হো!
নামের জোরে সাধিব কাজ—
বলো হো হো হো, বলো হো, বলো হো!
ওই  ঘোর মত্ত করে নৃত্য রঙ্গমাঝারে,
ওই  লক্ষ লক্ষ যক্ষ রক্ষ ঘেরি শ্যামারে,
ওই  লট্টপট্টকেশ অট্ট অট্ট হাসে রে—
হাহাহা হাহাহা হাহাহা!
আরে  বল্ রে শ্যামা মায়ের জয়, জয় জয়!
জয় জয়, জয় জয়, জয় জয়, জয় জয়!
আরে  বল্‌ রে শ্যামা মায়ের জয়, জয় জয়!
আরে বল্ রে শ্যামা মায়ের জয়।

গমনোদ্যম


একটি বালিকার প্রবেশ


বালিকা।  ওই  মেঘ করে বুঝি গগনে। 
আঁধার ছাইল, রজনী আইল,
ঘরে ফিরে যাব কেমনে।
চরণ অবশ হায়, শ্রান্ত ক্লান্ত কায়
সারা দিবস বনভ্রমণে
ঘরে ফিরে যাব কেমনে।



এ কী এ ঘোর বন!  এনু কোথায়!
পথ যে জানি না, মোরে দেখায়ে দে না।
কী করি এ আঁধার রাতে।

কী হবে মোর হায়।
ঘন ঘোর মেঘ ছেয়েছে গগনে,
চকিত চপলা চমকে সঘনে,
একেলা বালিকা—
তরাসে কাঁপে কায়।

বালিকার প্রতি


প্রথম দস্যু।  পথ ভুলেছিস সত্যি বটে?  সিধে রাস্তা দেখতে চাস? 
এমন জায়গায় পাঠিয়ে দেব  সুখে থাকবি বারো মাস।
সকলে।  হাঃ হাঃ হাঃ, হাঃ হাঃ হাঃ। 

প্রথমের প্রতি


দ্বিতীয় দস্যু। কেমন হে ভাই!  কেমনে সে ঠাঁই? 
প্রথম দস্যু।  মন্দ নহে বড়ো— 
এক দিন না এক দিন সবাই সেথায় হব জড়ো।
সকলে।  হাঃ হাঃ হাঃ, হাঃ হাঃ হাঃ! 
তৃতীয় দস্যু।  আয় সাথে আয়, রাস্তা তোরে দেখিয়ে দিই গে তবে— 
আর তা হলে রাস্তা ভুলে ঘুরতে নাহি হবে।
সকলে।  হাঃ হাঃ হাঃ, হাঃ হাঃ হাঃ। 

সকলের প্রস্থান


বনদেবীগণের প্রবেশ


মরি ও কাহার বাছা, ওকে কোথায় নিয়ে যায়।
আহা, ঐ করুণ চোখে ও কার পানে চায়।
বাঁধা কঠিন পাশে,  অঙ্গ কাঁপে ত্রাসে,
আঁখি জলে ভাসে—এ কী দশা হায়।
এ বনে কে আছে, যাব কার কাছে—
কে ওরে বাঁচায়।

দ্বিতীয় দৃশ্য


অরণ্যে কালীপ্রতিমা


বাল্মীকি স্তবে আসীন


বাল্মীকি।  রাঙাপদপদ্মযুগে প্রণমি গো ভবদারা! 
আজি এ ঘোর নিশীথে পূজিব তোমারে তারা।
সুরনর থরহর— ব্রহ্মাণ্ডবিপ্লব করো,
রণরঙ্গে মাতো, মা গো, ঘোরা উন্মাদিনী-পারা।
ঝলসিয়ে দিশি দিশি ঘুরাও তড়িত-অসি,
ছুটাও শোণিতস্রোত, ভাসাও বিপুল ধরা।
উরো কালী কপালিনী, মহাকালসীমন্তিনী,
লহো জবাপুস্পাঞ্জলি মহাদেবী পরাৎপর।

বালিকাকে লইয়া দস্যুগণের প্রবেশ


দস্যুগণ।  দেখো হো ঠাকুর, বলি এনেছি মোরা। 
বড়ো সরেস পেয়েছি বলি সরেস—
এমন সরেস মছলি, রাজা, জালে না পড়ে ধরা।
দেরি কেন ঠাকুর, সেরে ফেলো ত্বরা।
বাল্মীকি।  নিয়ে আয় কৃপাণ।  রয়েছে তৃষিতা শ্যামা মা, 
শোণিত পিয়াও— যা ত্বরায়।
লোল জিহ্বা লকলকে, তড়িত খেলে চোখে,
করিয়ে খণ্ড দিক দিগন্ত ঘোর দন্ত ভায়।
বালিকা।  কী দোষে বাঁধিলে আমায়, আনিলে কোথায়। 
পথহারা একাকিনী বনে অসহায়—
রাখো রাখো রাখো, বাঁচাও আমায়।
দয়া করে অনাথারে— কে আমার আছে—
বন্ধনে কাতরতনু মরি যে ব্যথায়।
নেপথ্যে বনদেবী।  দয়া করো অনাথারে দয়া করো গো— 
বন্ধনে কাতর তনু জর্জর ব্যথায়।

বাল্মীকি।  এ কেমন হল মন আমার! 
কী ভাব এ যে কিছুই বুঝিতে যে পারি নে
পাষাণহৃদয় গলিল কেন রে!
কেন আজি আঁখিজল দেখা দিল নয়নে!
কী মায়া এ জানে গো,
পাষাণের বাঁধ এ যে টুটিল,
সব ভেসে গেল গো, সব ভেসে গেল গো—
মরুভূমি ডুবে গেল করুণার প্লাবনে।
প্রথম দস্যু।  আরে, কী এত ভাবনা কিছু তো বুঝি না। 
দ্বিতীয় দস্যু। সময় বহে যায় যে। 
তৃতীয় দস্যু।  কখন্ এনেছি মোরা, এখনো তো হল না। 
চতুর্থ দস্যু।  এ কেমন রীতি তব, বাহ্ রে। 
বাল্মীকি।  না না হবে না, এ বলি হবে না— 
অন্য বলির তরে যা রে যা।
প্রথম দস্যু। অন্য বলি এ রাতে কোথা মোরা পাব! 
দ্বিতীয় দস্যু। এ কেমন কথা কও, বাহ্ রে। 
বাল্মীকি।  শোন্ তোরা শোন্ এ আদেশ, 
কৃপাণ খৰ্পর ফেলে দে দে।
বাঁধন কর ছিন্ন,
মুক্ত কর এখনি রে।

যথাদিষ্ট কৃত


তৃতীয় দৃশ্য


অরণ্য


বাল্মীকি। ব্যাকুল হয়ে বনে বনে 
ভ্রমি একেলা শূন্যমনে।

কে পুরাবে মোর কাতর প্রাণ
জুড়াবে হিয়া সুধাবরিষণে।

প্রস্থান


দস্যুগণ বালিকাকে পুনর্বার ধরিয়া আনিয়া


ছাড়ব না ভাই, ছাড়ব না ভাই,
এমন শিকার ছাড়ব না।
হাতের কাছে অম্‌নি এল, অম্‌নি যাবে!
অম্‌নি যেতে দেবে কে রে!
রাজাটা খেপেছে রে, তার কথা আর মানব না।
আজ রাতে ধুম হবে ভারী— নিয়ে আয় কারণবারি,
জ্বেলে দে মশালগুলো,  মনের মতন পুজো দেব
নেচে নেচে ঘুরে ঘুরে— রাজাটা খেপেছে রে,
তার কথা আর মানব না।
প্রথম দস্যু।  রাজা মহারাজা কে জানে, আমিই রাজাধিরাজ। 
তুমি উজির, কোতোয়াল তুমি,
ওই ছোঁড়াগুলো বৰ্কন্দাজ।
যত সব কুঁড়ে আছে ঠাঁই জুড়ে,
কাজের বেলায় বুদ্ধি যায় উড়ে।
পা ধোবার জল নিয়ে আয় ঝট্,
কর্ তোরা সব যে যার কাজ।
দ্বিতীয় দস্যু।  আছে তোমার বিদ্যে-সাধ্যি জানা। 
রাজত্ব করা, এ কি তামাশা পেয়েছ।
প্রথম দস্যু।  জানিস নে কেটা আমি। 
দ্বিতীয় দস্যু। ঢের ঢের জানি— ঢের ঢের জানি— 
প্রথম দস্যু।  হাসিস নে হাসিস নে মিছে, যা যা— 
সব আপন কাজে যা যা,
যা আপন কাজে।

দ্বিতীয় দস্যু।  খুব তোমার লম্বাচওড়া কথা। 
নিতান্ত দেখি তোমায় কৃতান্ত ডেকেছে।
তৃতীয় দস্যু।  আঃ  কাজ কী গোলমালে,  নাহয় রাজাই সাজালে। 
মরবার বেলায় মরবে ওটাই, আমরা সব থাকব ফাঁকতালে।
প্রথম দস্যু।  রাম রাম! হরি হরি!  ওরা থাকতে আমি মরি! 
তেমন তেমন দেখলে, বাবা, ঢুকব আড়ালে।
সকলে।  ওরে  চল্ তবে শিগ্‌গিরি, 
আনি  পূজার সামিগ্‌গিরি।
কথায় কথায় রাত পোহালো, এমনি কাজের ছিরি।

প্রস্থান


বালিকা।  হায়, কী দশা হল আমার! 
কোথা গো মা করুণাময়ী, অরণ্যে প্রাণ যায় গো।
মুহূর্তের তরে মা গো, দেখা দাও আমারে—
জনমের মতো বিদায়।

পূজার উপকরণ লইয়া দস্যুগণের প্রবেশ


ও কালীপ্রতিমা ঘিরিয়া নৃত্য


এত রঙ্গ শিখেছ কোথা মুণ্ডমালিনী!
তোমার  নৃত্য দেখে চিত্ত কাঁপে, চমকে ধরণী।
ক্ষান্ত দে মা, শান্ত হ মা, সন্তানের মিনতি।
রাঙা নয়ন দেখে নয়ন মুদি ও মা ত্রিনয়নী।

বাল্মীকির প্রবেশ


বাল্মীকি।  অহো! আম্পর্ধা একি তোদের নরাধম! 
তোদের কারেও চাহি নে আর, আর, আর না রে—
দূর দূর দূর, আমারে আর ছুঁস নে।
এ-সব কাজ আর না, এ পাপ আর না,
আর না, আর না, ত্রাহি— সব ছাড়িনু।

প্রথম দস্যু।  দীন হীন এ অধম আমি, কিছুই জানি নে রাজা। 
এরাই তো যত বাধালে জঞ্জাল,
এত করে বোঝাই বোঝে না।
কী করি, দেখো বিচারি।
দ্বিতীয় দস্যু।  বাঃ— এও তো বড় মজা, বাহবা! 
যত কুয়ের গোড়া ওই তো, আরে বল্-না রে।
প্রথম দস্যু।  দুর দূর দূর, নির্লজ্জ, আর বকিস নে। 
বাল্মীকি।  তফাতে সব সরে যা।  এ পাপ আর না, 
আর না, আর না, ত্রাহি— সব ছাড়িনু।

দস্যুগণের প্রস্থান


বাল্মীকি।  আয়, মা, আমার সাথে, কোনো ভয় নাহি আর। 
কত দুঃখ পেলি বনে, আহা, মা আমার!
নয়নে ঝরিছে বারি, এ কি, মা, সহিতে পারি—
কোমল কাতর তনু কাঁপিতেছে বার বার।

প্রস্থান


চতুর্থ দৃশ্য


বনদেবীগণের প্রবেশ


রিম্ ঝিম্ ঘন ঘন রে বরষে।
গগনে ঘনঘটা, শিহরে তরুলতা,
ময়ুর ময়ুরী নাচিছে হরষে।
দিশি দিশি সচকিত, দামিনী চমকিত,
চমকি উঠিছে হরিণী তরাসে।

প্রস্থান


বাল্মীকির প্রবেশ


কোথায় জুড়াতে আছে ঠাঁই—
কেন প্রাণ কেন কাঁদে রে।

যাই দেখি শিকারেতে,  রহিব আমোদে মেতে,
ভুলি সব জ্বালা বনে বনে ছুটিয়ে—
কেন প্রাণ কেন কাঁদে রে।
আপনা ভুলিতে চাই, ভুলিব কেমনে—
কেমনে যাবে বেদনা।
ধরি ধনু আনি বাণ  গাহিব ব্যাধের গান,
দলবল লয়ে মাতিব—
কেন প্রাণ কেন কাঁদে রে।

শৃঙ্গধ্বনিপুর্বক দস্যুগণকে আহ্বান


দস্যুগণের প্রবেশ


দস্যু।  কেন রাজা, ডাকিস কেন, এসেছি সবে। 
বুঝি আবার শ্যামা মায়ের পুজো হবে?
বাল্মীকি।  শিকারে হবে যেতে, আয় রে সাথে। 
প্রথম দস্যু। ওরে, রাজা কী বলছে শোন্। 
সকলে।  শিকারে চল্ তবে। 
সবারে আন্ ডেকে যত দলবল সবে।

বাল্মীকির প্রস্থান


এই বেলা সবে মিলে চলো হো, চলো হো!
ছুটে আয়, শিকারে কে রে যাবি আয়,
এমন রজনী বহে যায় যে।
ধনুর্বাণ বল্লম লয়ে হাতে আয় আয় আয় আয় রে।
বাজা শিঙা ঘন ঘন,  শব্দে কঁপিবে বন,
আকাশ ফেটে যাবে, চমকিবে পশু পাখি সবে,
ছুটে যাবে কাননে কাননে—
চারি দিকে ঘিরে  যাব পিছে পিছে
হো হো হো হো।

বাল্মীকির প্রবেশ


বাল্মীকি।  গহনে গহনে যা রে তোরা, নিশি বহে যায় যে! 
তন্ন তন্ন করি অরণ্য, করী বরাহ খোঁজ্‌গে—
এই বেলা যা রে।
নিশাচর পশু সবে  এখনি বাহির হবে,
ধনুর্বাণ নে রে হাতে, চল্ ত্বরা চল্।
জ্বালায়ে মশাল-আলো এই বেলা আয় রে।

প্রস্থান


প্রথম দস্যু।  চল্ চল্ ভাই, ত্বরা করে মোরা আগে যাই। 
দ্বিতীয় দস্যু। প্রাণপণ খোঁজ্, এ বন, সে বন— 
চল্ মোরা ক’জন ও দিকে যাই।
প্রথম দস্যু।  না না ভাই, কাজ নাই। 
হোথা কিছু নাই, কিছু নাই—
ওই ঝোপে যদি কিছু পাই।
দ্বিতীয় দস্যু।  বরা বরা! 
প্রথম দম্য।  আরে দাঁড়া দাঁড়া, অত ব্যস্ত হলে ফস্কাবে শিকার। 
চুপি চুপি আয়, চুপি চুপি আয় ওই অশথতলায়।
এবার ঠিকঠাক হয়ে সবে থাক্—
সাবধান ধরো বাণ, সাবধান ছাড়ো বাণ,
গেল গেল ঐ, পালায় পালায়, চল্ চল্।
ছোট্ রে পিছে; আয় রে ত্বরা যাই।

বনদেবীগণের প্রবেশ


কে এল আজি এ ঘোর নিশীথে
সাধের কাননে শান্তি নাশিতে।
মত্ত করী যত পদ্মবন দলে
বিমল সবোবর মন্থিয়া,

ঘুমন্ত বিহগে কেন বধে রে
সঘনে খর শর সন্ধিয়া
তরাসে চমকিয়ে হরিণহরিণী
স্খলিত চরণে ছুটিছে—
স্খলিত চরণে ছুটিছে কাননে,
করুণ নয়নে চাহিছে।
আকুল সরসী, সারসসারসী
শরবনে পশি কাঁদিছে।
তিমির দিগ ভরি ঘোর যামিনী
বিপদ ঘন ছায়া ছাইয়া—
কী জানি কী হবে আজি এ নিশীথে,
রাসে প্রাণ ওঠে কাঁপিয়া।

প্রথম দস্যুর প্রবেশ


প্রথম দস্যু। প্রাণ নিয়ে তো সট্‌কেছি রে, করবি এখন কী। 
ওরে বরা,  করবি এখন কী।
বাবা রে,  আমি চুপ করে এই  কচুবনে লুকিয়ে থাকি।
এই মরদের মুরদখানা  দেখেও কি রে ভড়কালি না।
বাহবা!  শাবাশ তোরে, শাবাশ রে তোর ভরসা দেখি।

খোঁড়াইতে খোঁড়াইতে আর-একজন


দস্যুর প্রবেশ


অন্য দস্যু।  বলব কী আর বলব খুড়ো— উঁ উঁ— 
আমার যা হয়েছে  বলি কার কাছে—
একটা  বুনো ছাগল তেড়ে এসে মেরেছে ঢুঁ।
প্রথম দস্যু।  তখন যে ভারী ছিল জারিজুরি, 
এখন কেন করছ, বাপু, উঁ উঁ উঁ—
কোন্‌খানে লেগেছে বাবা, দিই একটু ফুঁ।

দস্যুগণের প্রবেশ


দস্যুগণ।  সর্দারমশায় দেরি না সয়, 
তোমার আশায় সবাই বসে।
শিকারেতে হবে যেতে,
মিহি কোমর বাঁধো কষে।
বনবাদাড় সব ঘেঁটেঘুটে
আমরা মরি খেটেখুটে,
তুমি কেবল লুটেপুটে
পেট পোরাবে ঠেসেঠুসে!
প্রথম দস্যু।  কাজ কি খেয়ে, তোফা আছি— 
আমায় কেউ না খেলেই বাঁচি।
শিকার করতে যায় কে মরতে—
ঢুঁসিয়ে দেবে বরা-মোষে।
ঢু খেয়ে তো পেট ভরে না—
সাধের পেটটি যাবে ফেঁসে।

হাসিতে হাসিতে প্রস্থান ও শিকারের


পশ্চাৎ পশ্চাৎ পুনঃপ্রবেশ



বাল্মীকির দ্রুত প্রবেশ


বাল্মীকি।  রাখ্ রাখ্, ফেল ধনু, ছাড়িস নে বাণ। 
হরিণশাবক দুটি  প্রাণভয়ে ধায় ছুটি,
চাহিতেছে ফিরে ফিরে করুণনয়ান।
কোনো দোষ করে নি তো, সুকুমার কলেবর—
কেমনে কোমল দেহে বিঁধিবি কঠিন শর!
থাক্ থাক্ ওরে থাক্,  এ দারুণ খেলা রাখ্,
আজ হতে বিসর্জিনু এ ছার ধনুক বাণ।

প্রস্থান

দস্যুগণের প্রবেশ


দস্যুগণ।  আর না, আর না, এখানে আর না— 
আয় রে সকলে চলিয়া যাই।
ধনুক বাণ ফেলেছে রাজা,
এখানে কেমনে থাকিব ভাই!
চল্ চল্ চল্  এখনি যাই।

বাল্মীকির প্রবেশ


দস্যুগণ।  তোর দশা, রাজা, ভালো তো নয়— 
রক্তপাতে পাস রে ভয়—
লাজে মোরা মরে যাই।
পাখিটি মারিলে কাঁদিয়া খুন,
না জানি কে তোরে করিল গুণ—
হেন কভু দেখি নাই।

দস্যুগণের প্রস্থান


পঞ্চম দৃশ্য


বাল্মীকি।  জীবনের কিছু হল না হায়— 
হল না গো হল না, হায় হায়।
গহনে গহনে কত আর ভ্রমিব নিরাশার এ আঁধারে।
শূন্য হৃদয় আর বহিতে যে পারি না,
পারি না গো, পারি না আর।
কী লয়ে এখন ধরিব জীবন, দিবসরজনী চলিয়া যায়—
দিবসরজনী চলিয়া যায়—
কত কী করিব বলি কত উঠে বাসনা,
কী করিব জানি না গো।
সহচর ছিল যারা ত্যেজিয়া গেল তারা। ধনুর্বাণ ত্যেজেছি,
কোনো আর নাহি কাজ—

‘কী করি কী করি’ বলি হাহা করি ভ্রমি গো—

কী করিব জানি না যে।

ব্যাধগণের প্রবেশ


প্রথম ব্যাধ।  দেখ্ দেখ্, দুটো পাখি বসেছে গাছে। 
দ্বিতীয় ব্যাধ।  আয় দেখি চুপিচুপি আয় রে কাছে। 
প্রথম ব্যাধ।  আরে,  ঝট্‌ করে এইবারে ছেড়ে দে রে বাণ। 
দ্বিতীয় ব্যাধ।  রোস্, রোস্, আগে আমি করি রে সন্ধান। 
বাল্মীকি।  থাম্ থাম, কী করিবি বধি পাখিটির প্রাণ। 
দুটিতে রয়েছে সুখে,  মনের উল্লাসে গাহিতেছে গান।
প্রথম ব্যাধ।  রাখো মিছে ও-সব কথা, 
কাছে মোদের এস নাকো হেথা,
চাই নে ও-সব-শাস্তর-কথা— সময় বহে যায় যে।
বাল্মীকি।  শোনো শোনো, মিছে রোষ কোরো না। 
ব্যাধ।  থামো থামো ঠাকুর— এই ছাড়ি বাণ। 

একটি ক্রৌঞ্চকে বধ


বাল্মীকি।  মা নিষাদ প্রতিষ্ঠাং ত্বমগমঃ শাশ্বতীঃ সমাঃ। 
যৎ ক্রৌঞ্চমিথুনাদেকমবধীঃ কামমোহিতম্।




কী বলিনু আমি! এ কী সুললিত বাণী রে!
কিছু না জানি কেমনে যে আমি প্রকাশিনু দেবভাষা,
এমন কথা কেমনে শিখিনু রে!
পুলকে পূরিল মনপ্রাণ, মধু বরষিল শ্রবণে,
এ কী! হৃদয়ে এ কী এ দেখি!
ঘোর অন্ধকারমাঝে, এ কী জ্যোতি ভায়—
অবাক্! করুণা এ কার।

সরস্বতীর আবির্ভাব


বাল্মীকি।  এ কী এ, এ কী এ, স্থির চপলা! 
কিরণে কিরণে হল সব দিক উজলা।

কী প্রতিমা দেখি এ—  জোছনা মাখিয়ে
কে রেখেছে আঁকিয়ে  আ মরি কমলপুতলা।

ব্যাধগণের প্রস্থান


বনদেবীগণের প্রবেশ


বনদেবী।  নমি নমি, ভারতী, তব কমলচরণে। 
পুণ্য হল বনভূমি, ধন্য হল প্রাণ।
বাল্মীকি।  পূর্ণ হল বাসনা, দেবী কমলাসনা— 
ধন্য হল দসুপতি, গলিল পাষাণ।
বনদেবী।  কঠিন ধরাভূমি এ, কমলালয়া তুমি যে— 
হৃদয়কমলে চরণকমল করো দান।
বাল্মীকি। তব কমলপরিমলে রাখো হৃদি ভরিয়ে— 
চিদিবস করিব তব চরণসুধাপান।

দেবীগণের অন্তর্ধান


কালী-প্রতিমার প্রতি


শ্যামা,  এবার ছেড়ে চলেছি মা!
পাষাণের মেয়ে পাষাণী তুই, না বুঝে মা বলেছি মা!
এত দিন কী ছল করে তুই পাষাণ করে রেখেছিলি—
আজ  আপন মায়ের দেখা পেয়ে নয়ন-জলে গলেছি মা!
কালো দেখে ভুলি নে আর, আলো দেখে ভুলেছে মন—
আমায় তুমি ছলেছিলে,  এবার  আমি তোমায় ছলেছি মা!
মায়ার মায়া কাটিয়ে এবার মায়ের কোলে চলেছি মা।

ষষ্ঠ দৃশ্য


বাল্মীকি।  কোথা লুকাইলে! 
সব আশা নিভিল, দশ দিশি অন্ধকার।
সবে গেছে চলে ত্যেজিয়ে আমারে,
তুমিও কি তেয়াগিলে।

লক্ষ্মীর আবির্ভাব


লক্ষ্মী।  কেন গো আপনমনে  ভ্রমিছ বনে বনে, 
সলিল দু নয়নে  কিসের দুখে!
কমলা দিতেছে আসি  রতন রাশি রাশি,
ফুটুক তবে হাসি  মলিন মুখে।
কমলা যারে চায়  বলো সে কী না পায়,
দুখের এ ধরায়  থাকে সে সুখে।
ত্যেজিয়া কমলাসনে  এসেছি এ ঘোর বনে,
আমারে শুভক্ষণে  হেরো গো চোখে।
বাল্মীকি।  কোথায় সে উষাময়ী প্রতিমা— 
তুমি তো নহ সে দেবী কমলাসনা।
কোরো না আমারে ছলনা।
কী এনেছ ধন মান!  তাহা যে চাহে না প্রাণ।
দেবী গো, চাহি না, চাহি না, মণিময় ধূলিরাশি চাহি না—
তাহা লয়ে সুখী যারা হয় হোক,  হয় হোক—
আমি, দেবী, সে সুখ চাহি না।
যাও লক্ষ্মী অলকায়,  যাও লক্ষ্মী অমরায়,
এ বনে এসো না,  এসো না—
এসো না এ দীনজনকুটিরে।
যে বীণা শুনেছি কানে  মন প্রাণ আছে ভোর—
আর কিছু চাহি না, চাহি না।

লক্ষ্মীর অন্তর্ধান


বাল্মীকির প্রস্থান



বনদেবীগণের প্রবেশ


বাণী বীণাপাণি, করুণাময়ী,
অন্ধজনে নয়ন দিয়ে অন্ধকারে ফেলিলে,
দরশ দিয়ে লুকালে কোথা দেবী অয়ি!

স্বপনসম মিলাবে যদি  কেন গো দিলে চেতনা—
চকিতে শুধু দেখা দিয়ে  চির মরমবেদনা!
তোমারে চাহি ফিরিছে হেরো  কাননে কাননে ওই।

বনদেবীগণের প্রস্থান


বাল্মীকির প্রবেশ


সরস্বতীর আবির্ভাব


বাল্মীকি।  এই-যে হেরি গো দেবী আমারি! 
সব কবিতাময় জগত-চরাচর, সব শোভাময় নেহারি।
ছন্দে উঠিছে চন্দ্রমা, ছন্দে কনকরবি উদিছে,
ছন্দে জগমণ্ডল চলিছে, জ্বলন্ত কবিতা তারকা সবে।
এ কবিতার মাঝারে তুমি কে গো দেবী,
আলোকে আলো আঁধারি।
আজি মলয় আকুল বনে বনে একি গীত গাহিছে;
ফুল কহিছে প্রাণের কাহিনী, নব রাগরাগিণী উছাসিছে—
এ আনন্দে আজ গীত গাহে মোর হৃদয় সব অবারি।
তুমিই কি দেবী ভারতী! কৃপাগুণে অন্ধ আঁখি ফুটালে—
উষা আনিলে প্রাণের আঁধারে,
প্রকৃতির রাগিণী শিখাইলে।
তুমি ধন্য গো! রব চিরকাল চরণ ধরি তোমারি।
সরস্বতী।  দীনহীন বালিকার সাজে এসেছিনু এ ঘোর বনমাঝে 
গলাতে পাষাণ তোর মন—
কেন, বৎস, শোন্ তাহা শোন্!
আমি বীণাপাণি তোরে এসেছি শিখাতে গান—
তোর গানে গলে যাবে সহস্র পাষাণপ্রাণ।
যে রাগিণী শুনে তোর গলেছে কঠোর মন
সে রাগিণী তোরি কণ্ঠে বাজিবে রে অনুক্ষণ।
অধীর হইয়া সিন্ধু কাঁদিবে চরণতলে,
চারি দিকে দিক্‌বধূ আকুল নয়নজলে।

মাথার উপরে তোর কাঁদিবে সহস্র তারা,
অশনি গলিয়া গিয়া হইবে অশ্রুর ধারা।
যে করুণ রসে আজি ডুবিল রে ও হৃদয়
শত স্রোতে তুই তাহা ঢালিবি জগৎময়।
যেথায় হিমাদ্রি আছে সেথা তোর নাম রবে,
যেথায় জাহ্নবী বহে তোর কাব্যস্রোত রবে।
সে জাহ্নবী বহিবেক অযুত হৃদয় দিয়া,
শ্মশান পবিত্র করি, মরুভূমি উর্বরিয়া।
মোর পদ্মাসনতলে রহিবে আসন তোর,
নিত্য নব নব গীতে সতত রহিবি ভোর।
বসি তোর পদতলে কবি-বালকেরা যত
শুনি তোর কণ্ঠস্বর শিখিবে সঙ্গীত কত।
এই নে আমার বীণা, দিনু তোরে উপহার—
যে গান গাহিতে সাধ ধ্বনিবে ইহার তার।