গীতাঞ্জলি/১০৭
১০৭
হে মাের চিত্ত, পুণ্য তীর্থে
জাগরে ধীরে-
এই ভারতের মহা-মানবের
সাগর-তীরে।
হেথায় দাঁড়ায়ে দু বাহু বাড়ায়ে
নমি নর-দেবতারে,
উদার ছন্দে পরমানন্দে
বন্দন করি তাঁরে।
ধ্যান-গম্ভীর এই যে ভূধর,
নদী-জপমালা-ধৃত প্রান্তর,
হেথায় নিত্য হের পবিত্র
ধরিত্রীরে,
এই ভারতের মহামানবের
সাগরতীরে।
কেহ নাহি জানে কার আহ্বানে
কত মানুষের ধারা
দুর্বার স্রোতে এল কোথা হতে
সমুদ্রে হল হারা।
হেথায় আর্য, হেথা অনার্য্য
হেথায় দ্রাবিড়, চীন,-
শক হুন-দল পাঠান মােগল
এক দেহে হল লীন।
পশ্চিম আজি খুলিয়াছে দ্বার
সেথা হতে সবে আনে উপহার,
দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে
যাবে না ফিরে,
এই ভারতের মহামানবের
সাগরতীরে।
রণধারা বাহি, জয়গান গাহি
উন্মাদ কলরবে
ভেদি মরুপথ গিরি-পৰ্বত
যারা এসেছিল সবে,
তারা মাের মাঝে সবাই বিরাজ
কেহ নহে নহে দূর,
আমার শােণিতে রয়েছে ধ্বনিতে
তার বিচিত্র সুর।
হে রুদ্রবীণা, বাজো, বাজো, বাজো,
ঘৃণা করি দূরে আছে যারা আজো,
বন্ধ নাশিবে তারাও আসিবে
দাড়াবে ঘিরে,-
এই ভারতের মহামানবের
সাগরতীরে।
হেথা একদিন বিরামবিহীন
মহা ওঙ্কারধ্বনি
হৃদয়তন্ত্রে একের মন্ত্রে
উঠেছিল রণরণি।
তপস্যা-বলে একের অনলে
বহুরে আহুতি দিয়া
বিভেদ ভুলিল, জাগায়ে ভুলিল
একটি বিরাট হিয়া।
সেই সাধনার সে আরাধনার
যজ্ঞশালায় খােল আজি দ্বার,
হেথায় সবারে হবে মিলিবারে
আনত শিরে,-
এই ভারতের মহামানবের
সাগরতীরে।
সেই হােমানলে হের আজি জ্বলে
দুখের রক্ত শিখা,
হবে তা সহিতে মর্ম্মে দহিতে
আছে সে ভাগ্যে লিখা।
এ দুখ বহন কর মাের মন,
শােনরে একের ডাক।
যত লাজ ভয় কর কর জয়
অপমান দূরে যাক্।
দুঃসহ ব্যথা হয়ে অবসান
জন্ম লভিবে কি বিশাল প্রাণ!
পােহায় রজনী, জাগিছে জননী
বিপুল নীড়ে,
এই ভারতের মহামানবের
সাগরতীরে।
এস হে আর্য্য, এস অনার্য্য,
হিন্দু মুসলমান।
এস এস আজ তুমি ইংরাজ,
এস এস খৃষ্টান।
এস ব্রাহ্মণ, শুচি করি মন
ধর হাত সবাকার,
এস হে পতিত, কর অপনীত
সব অপমানভার।
মার অভিষেকে এস এস ত্বরা,
মঙ্গলঘট হয়নি যে ভরা
সবার পরশে পবিত্র-করা
তীর্থনীরে
আজি ভারতের মহামানবের
সাগরতীরে।
১৮ আষাঢ় ১৩১৭