পথ-হারা।



 নদীর জল কমিয়া আসিয়াছে, জল সরিয়া গিয়া কাদা বাহির হইয়াছে, এই সময়ে পল্লীগ্রামে নদীতে স্নান করিবার বড়ই অসুবিধা। শুধু স্নান করিবার কেন, সকল বিষয়েরই অসুবিধা। হেমন্তের শেষে শীতের প্রারম্ভে বর্ষার জল বন্ধ হইয়া নানাবিধ সংক্রামক ব্যাধির সৃষ্টি করিতে থাকে। রোগক্লিষ্ট কৃষক শুামল শস্য ক্ষেত্রে পক্ক ধান্তের দিকে চাহিয়া আশায় বুক বাঁধিয়া, আশায় দিনযাপন করে। যাহারা নদীতীরে বাস করে, তাহাদিগের এ সময়ে জলের বড়ই কষ্ট। নদীতে জল থাকিলে তাহা আনা কষ্টসাধ্য। নদীতীর তরল কর্দ্দমে পরিণত হয়, সেইজন্য গ্রামের লোকে বাঁধা ঘাট না থাকিলে কাদার উপরে কাঠ ফেলিয়া বা ইট ফেলিয়া পথ করিয়া দেয়।

 সন্ধ্যার প্রাক্কালে একটি কিশোরী অতি সন্তর্পণে জলে নামিতেছিল। ভাগীরথীর তীরে একটি পুরাতন বাঁধা ঘাট, যে কালে ভাগীরথীর রূপ যৌবনগর্ব্ব ছিল ঘাটটিও সেই কালের। কালের প্রভাবে জীর্ণ শীর্ণ নদী ঘাট হইতে সরিয়া গিয়াছে, ঘাটের নিম্নের সোপানগুলি মৃত্তিকায় আচ্ছন্ন হইয়া গিয়াছে, কেবল বর্ষার সময়ে ঘাটে জল আসিয়া থাকে। কিশোরী সোপান কয়টি অতিক্রম করিয়া কর্দ্দমের উপর দিয়া চলিয়াছে। চারি পাঁচখানি গ্রামের লোক একত্র হইয়া পথ বাঁধিয়া দিয়াছে, বড় বড় তাল গাছের উপরে কাঠ বাঁধিয়া পথ প্রস্তুত হইয়াছে, কিন্তু লোকের পায়ে পায়ে কাদা উঠিয়া পথ এত পিচ্ছিল হইয়াছে, যে কিশোরী সে পথে চলিতে ভরসা করিতেছে না। সে অতি ধীরে ধীরে পা টিপিয়া টিপিয়া কাদার উপর দিয়া চলিতেছিল, তাহার হাতে একখানি পিতলের রেকাবি, তাহাতে কাঁচা মাটীর কয়েকটা প্রদীপ, ভুলার সলিত ও ঘৃত দিয়া সাজান। সেইগুলি পড়িয়া যাইবার ভয়ে কিশোরী অতি ধীরে ধীরে চলিতেছিল, পা পিছলাইয়া যাইবার ভয়ে সে একবার পথের কাঠগুলি চাপিয়া ধরিতেছিল।

 ঘাটের রাণার উপরে বসিয়া একটি কর্দ্দমলিপ্ত বালক আমসত্ব ভক্ষণ করিতে করিতে বালিকার প্রতি লক্ষ্য করিতেছিল, বালিকা একবার পড়িতে পড়িতে রহিয়া গেল, বালক তাহা দেখিয়া হাসিয়া উঠিল। বালিকা ফিরিয়া চাহিয়া দেখিল; তখন বালকটি বলিয়া উঠিল “সুরি, থালাখানা আমাকে দে, আমি পৌঁছে দিই?” বালিকা উত্তর করিল “তোর যে এঁটো হাত!”

 বালক। তা হোক্‌গে—কেউ তো আর দেখতে আসছে না।

 বালিকা। দূর পাগল, তাই কি হয়, এ যে ঠাকুরদের জিনিষ।

 বালক। ঠাকুররা তো আর দেখতে আস্‌ছে না।

 বালিকা। মা বলেন, ঠাকুররা সব দিকে সব সময় দেখতে পান।

 বালক। বাবা, তুই যেন ভাই পুরুত মশাই! তোর সঙ্গে কথা কইবার যো নাই।

 বালিকা কথা কহিবার জন্য দাঁড়াইয়াছিল আবার চলিতে আরম্ভ করিল। দেখিতে দেখিতে তাহার পা পিছলাইয়া গেল, সে পথের কাঠ ধরিয়া সামলাইল বটে, কিন্তু রেকারী হইতে দুইটী প্রদীপ পড়িয়া গেল। বালক হাসিতে হাসিতে কাঠের উপর দিয়া ছুটিয়া আসিল, বলিল “দেখলি সুরি, আমি তখনই তোকে বলেছিলুম, থালাখানা আমায় দে, আমি পৌঁছে দিই, তা আমার কথা শুনলি নি, এখন কি করবি কর”। বালিকা হাসিয়া বলিল “কি আর করব বাড়ী ফিরে যাই, আবার গিয়ে নিয়ে আসি, মা অনেক প্রদীপ গড়িয়ে রেখেছেন”। বালিকা ধীরে ধীরে ধীরে ঘাটের উপর উঠিল, বালকও ফিরিল। বালিকা গৃহে ফিরিবার উদ্যোগ করিতেছে দেখিয়া বালক বলিল “সুরি, তুই তবে বাড়ী চল্লি? আমি এই খানে বসে থাকি। তোর সঙ্গে এক সঙ্গে বাড়ী যাব।”

 বালিকা ঘাটের উপরে উঠিয়া চমকিয়া উঠিল, তাহার সম্মুখ দিয়া একটি শৃগাল দৌড়িয়া চলিয়া গেল, বালিকা সভয়ে চীৎকার করিয়া ডাকিল “মণি, ও মণি, শিগ্‌গির আয়না ভাই!” বালক তখন ঘাটের রাণার উপর বসিয়া এক মনে আমসত্ব ভক্ষণ করিতেছিল, সে অন্যমনস্ক হইয়া উত্তর দিল “কেন”? বালিকা তাহাকে বসিয়া থাকিতে দেখিয়া আরও চীৎকার করিয়া ডাকিল, “মণি, শিগ্‌গির আয়।” বালক আমসত্ব ফেলিয়া এক লম্ফে বালিকার নিকট উপস্থিত হইল এবং ব্যস্ত হইয়া জিজ্ঞাসা করিল “কি? কি হয়েছে?” বালিকা তখনও ভয়ে কাঁপিতেছিল, সে ধীরে ধীরে বলিল “ভাই, একটা শিয়াল, তুই আমাকে বাড়ী পৌঁছে দিয়ে আয়”। বালক খুব একচোট হাসিয়া লইল, তাহার পর বলিল “চল্‌ যাচ্ছি।”

 দেখিতে দেখিতে পূর্ব্বদিক তমসাচ্ছন্ন হইয়া আসিল, গঙ্গাবক্ষ হইতে বাস্পপুঞ্জ উখিত হইয়া তীরে কুয়াসার সহিত মিশিতে লাগিল, অস্তাচলগামী মরীচিমালীর রশ্মিতে পশ্চিম গগন সিন্দূররঞ্জিত হইয়া গেল, দেখিতে দেখিতে সোনার খালাখানি অদৃশ্য হইল। গঙ্গাতীরের অদূরে বৃক্ষরাজীর মধ্যে গ্রামখানি অবস্থিত, ধান্য ক্ষেত্রের মধ্য দিয়া উভয়ে সেই দিকে চলিতেছিল। পবন হিল্লোলে সুপক্ক ধান্যশীর্ষগুলি আন্দোলিত হইতেছিল, মনে হইতেছিল গঙ্গাতীরে হরিদ্বর্ণ সরোবরের বিশাল বক্ষে তরঙ্গরাশি নৃত্য করিতেছে। ধান্তক্ষেত্র পরিত্যাগ করিয়া উভয়ে অন্ধকারে মিশাইয় গেল।

  গ্রামখানির নাম দৌলতপুর, ইহার অধিকাংশ অধিবাসীই ভদ্রলোক। গ্রামের জমিদার গ্রামেই বাস করেন। পূর্ব্বে তাঁহার অবস্থা ভাল ছিল না, বহু কষ্টে লেখা-পড়া শিখিয়া উকিল হইয়াছিলেন, তাহার পর তাঁর ভাগ্য ফিরিল, চঞ্চলা লক্ষ্মী ঠাকুরাণী গ্রামের বুনিয়াদী জমিদার গৃহ পরিত্যাগ করিয়া সদাশিব মিত্রের গৃহে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। দেনার দায়ে যখন জমিদার প্রবোধচন্দ্র ঘোষের যথা-সর্ব্বস্ব বিক্রয় হইয়া গেল, তখন সদাশিব মিত্র বাস-গ্রামখানি কিনিয়া লইলেন; এখন তিনিই গ্রামের জমিদার। সদাশিব পূর্ব্বে বড় গ্রামে আসিতেন না; কিন্তু জমিদার খরিদ করিবার পর হইতে ছুটির সময় গ্রামে আসিয়া থাকেন, দুই একটি করিয়া পূজা-পার্ব্বণও আরম্ভ করিয়াছেন। গ্রামের কেহ কেহ পূর্ব্ব-অভ্যাস মত প্রবোধ বাবুকে জমিদার বলিয়া ফেলিলে, মিত্র মহাশয় বড়ই অসন্তুষ্ট হন।

  পুরাতন জমিদার-বংশ লোপ হইতে চলিয়াছে। প্রবোধ বাবুর বয়স প্রায় পঞ্চাশ বৎসরের কাছাকাছি, সুরমা তাহার এক মাত্র কন্যা, আর সন্তান হইবার কোন আশাও নাই। প্রবোধ বাবু সময় সময় দুঃখ করিয়া বলিতেন ঠিক সময়ে মালক্ষ্মী ঘোষবংশের বাস্তুভিটা ছাড়িয়াছেন। মেয়েটার বিবাহ দিয়া স্ত্রী-পুরুষে কাশী চলিয়া যাইব, বাড়ীঘর পড়িয়া যাইবে, তাহা আর আমাকে চোখে দেখিতে হইবে না। মিত্র গোষ্ঠীর সহিত ঘোষ বংশের প্রকাশ্য বিবাদ না থাকিলেও পরস্পরের মধ্যে সম্ভার ছিল না। এক-পুরুষের জমিদার বলিয়া অনেকেই সদাশিব মিত্রকে উপহাস করিতেন, মিত্র মহাশয়ও অন্নহীনের বুনিয়াদী চাল সম্বন্ধে নানান কথা বলিতেন।

 মণিলাল, সদাশিব মিত্রের একমাত্র পুত্র, মিত্র মহাশয়ের আরও অনেক গুলি সন্তান হইয়াছিল, কিন্তু তাহার কেহই বাঁচিয়া নাই। হারা-মরা বলিয়া মণিলাল বড়ই আদরের। মণিলাল বড়ই দুষ্ট, গ্রামের কোন “ছেলের সহিত তাহার বনে না। তাহার গুণের মধ্যে একটি, সে পড়াশুনায় বড়ই মনোযোগী। এই জন্যই তাহার পিতা দুষ্টামির জন্য তাহাকে কিছু বলেন না। মণিলাল যতদিন সহরে ছিল, ততদিন কাহারও সহিত মিশিত না, কিন্তু দৌলতপুরে আসিয়া তাহার এক আশ্চর্য্য পরিবর্ত্তন দেখা গিয়াছিল। সুরমার সহিত কোথায় তাহার পরিচয় হইয়াছিল তাহা কেহই বলিতে পারে না। সে ক্রমশঃ সুরমার বশীভূত হইয়া পড়িয়াছিল। তাহার কথার বাধ্য হইয়া সুরমাকে সময়ে সময়ে মিত্র বাড়ী যাইতে হইত, আর সেতো সমস্ত দিনই মুরমাদের বাড়ী কাটাইয়া দিত। সদাশিব মিত্র নিষেধ করিয়াও মণিলালের সুরমাদের বাড়ী যাওয়া বন্ধ করিতে পারেন নাই। প্রবোধ বাবুও প্রকাশ্যে কিছু না বলিলেও মনে মনে চটিতেন। কিন্তু উভয় গোষ্ঠিতেই ইহাদের যাতায়াত সহিয়া গিয়াছিল।  সুরমার মাতা তুলসীতলায় সন্ধা দিতেছিলেন, দূর হইতে সুরমাকে দেখিয়া তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন “সুরি, তুই যে বড় ফিরে এলি?”

 সুরমা! কাদায় পড়ে গিয়েছিলুম মা, তাই আবার প্রদীপ নিতে এসেছি।

 মাতা ঠাকুর ঘর হইতে প্রদীপ বাহির করিয়া দিলেন, কন্যা তাহা রেকবীতে তুলিয়া লইল, মাতা তখন আবার বলিলেন “তুই অন্ধকারে এক যেতে পারবি ত?”

 সুরমা। এক কেন, আমার সঙ্গে যে মণিলাল এসেছে?

 মাতা। কই?

 সুরমা। ওই যে কাঁঠালতলায় দাঁড়িয়ে আছে।

 মাতা। আমিত তাকে দেখতে পাইনি।

 বাস্তবিক মণিলাল নিতান্ত অপরাধীর ন্যায় দূরে অন্ধকারে দাঁড়াইয়া ছিল। সুরমা আঙ্গিনা ছাড়াইয়া বাহির হইল, মণিলাল কিছু না বলিয়া পিছু পিছু চলিল।

 সুরমার মাতা তুলসীতলায় প্রণাম করিতে করিতে বলিতে লাগিলেন, হে ঠাকুর। আমার সুরির যেন মণিলালের সঙ্গে বিবাহ হয়।

 দীর্ঘ বৎসর গুলা যেন দেখিতে দেখিতে কাটিয়া যায়, কালের গীতি অবিরাম, কিন্তু নীরব। দেখতে দেখতে পাঁচ বৎসর অতীত হইয়া গিয়াছে। দৌলতপুর গ্রামে অনেক পরিবর্ত্তন হইয়াছে; সুরমা আর কিশোরী নাই, মণিলালও কাদা মাখিয়া গঙ্গার ঘাটে বসিয়া আমসত্ব খায় না। সুরমা এখন পূর্ণ যুবতী, কিন্তু এখনও তাহার বিবাহ হয় নাই। মণিলাল বড় হইয়া উঠিয়াছে, সে এখন কলিকাতার কলেজে পড়ে। আধুনিক যুবা-জনোচিত সভ্যতার আদব কায়াগুলি মণিলালের বেশ অভ্যস্ত হইয়াছে, তাহার পাড়াগেঁয়ে ভাবটি কাটিয়া গিয়াছে। পুত্র সৌখীন হইয়াছে দেখিয়া মণিলালের মাতা বিবাহ দিবার জন্য ব্যস্ত হইয়াছেন, কিন্তু মণিলাল বিবাহ করিতে চায় না। সে কলিকাতা হইতে দৌলতপুরে বড় একটা আদিতে চায় না, কলেজে ছুটী হইলে হয় অন্য স্থানে বেড়াইতে যায়, না হয় কলিকাতাতেই থাকে। বৎসরের মধ্যে দুই একবার যখন বাড়ী আসে, তখন মণিলাল সর্ব্বাগ্রে সুরমাদের বাড়ী ছুটিয়া যায়।

 মণিলাল বিবাহ করিতে চায় না, কথাটা গ্রামে রাষ্ট্র হইতে বাকি রহিল না। কুৎসা যাঁহাদিগের উপজীবিকা তাঁহাদিগের একটা নুতন খোরাক জুটিল, কেহ বলিলেন সুরমা স্বয়ম্বর হইয়াছে, কেহ বলিল মণিলাল গান্ধর্ব্ব বিবাহ করিয়াছে, কোন কোন দূরদর্শী রাজনৈতিক ইহাতে রোমিও-জুলিয়েটের কাহিনীর পূর্ব্বাভাষ দেখিতে পাইলেন। যাহাদিগকে লইয়া এত কথা চলিতেছে ক্রমশ: একথা তাহাদিগের কর্ণেও পৌঁছিল, সুরমা লজ্জায় মরিয়া গেল, মণিলাল দৌলতপুরে আসা পরিত্যাগ করিল।

 মণিলালের মাতা ভাবিলেন, যে ছেলে হয়ত সুরমার জন্যই বিবাহ করিতে চায় না, এবং স্থির করিলেন যে সুরমার সহিত সম্বন্ধ হইলেই মণিলালের বিবাহে আপত্তি থাকবে না। স্বামীকে রাজি করিতে তাঁহার বড় বিশেষ বেগ পাইতে হইল না, কারণ মণিলালের জন্য সদাশিবও চিন্তিত হইয়া পড়িয়াছিলেন। যথাসময়ে সদাশিব মিত্রের প্রস্তাব প্রবোধ বাবুর নিকট উপস্থিত করা হইল, মিত্র মহাশয় ভাবিয়াছিলেন যে তাঁহার প্রস্তাব সাগ্রহে গৃহীত হইবে, সেইজন্য তিনি বিবাহ সম্বন্ধে একপ্রকার নিশ্চিন্ত হইয়াছিলেন। ঘটক যখন ফিরিয়া আসিয়া বলিল যে, প্রবোধ ঘোষ মিত্র-বংশে কন্যাদান করিবে না, তখন বিস্ময়ে তাঁহার বাক্‌রোধ হইয়া গেল। সুরমার মাতা কিছুতেই স্বামীর মত করাইতে পারিলেন না, প্রবোধ ঘোষ অপমান ভুলিতে পারে নাই, প্রতিজ্ঞা করিয়া বসিয়াছিল যে সদাশিব মিত্রের পুত্রকে কন্যা-দান করিবে না। কলিকাতায় মণিলাল সব কথা শুনিয়াছিল। সে স্থির করিল যে দৌলতপুর গ্রামে আর যাইবে না।

 অনেক অনুসন্ধানের পরে সুরমার বিবাহের সম্বন্ধ স্থির হইল, দূর দেশের একজন ধনবান জমিদার যৌবনের শেষে পত্নীহারা হইয়া একটি বয়স্থা সুন্দরী পাত্রীর অনুসন্ধান করিতেছেন, সুরমাকে দেখিয়া তাহার পছন্দ হইল। শুভদিন দেখিয়া সুরমার বিবাহ হইয়া গেল, লজায়, ঘৃণায়, অভিমানে মিত্রজা মরমে মরিয়া গেলেন। যথাসময়ে মণিলাল সুরমার বিবাহের কথা শুনিল, শুনিয়া পাঠে দ্বিগুণ মনঃসংযোগ করিল, সদাশিব মিত্র ভাবিলেন পুত্রের জীবনের ছায়া কাটিয়া গেল।

 সুরমা এখন ধনীর গৃহিণী, পিত্রালয়ে আসিবার অবসর পায় না, আসিলেও দুএকদিন থাকিয়া চলিয়া যায়। প্রবোধ ঘোষ ভদ্রাসনখানি এক ব্রাহ্মণকে দান করিয়া কাশীবাসের চেষ্টায় আছেন। তিনি বলিয়া থাকেন যে সুরমাকে এমন ঘরে দিয়াছেন যে তাহার পক্ষে পিতৃগৃহে আসা অসম্ভব, সুতরাং তিনি কাশীবাস করিলেও সে কখনও তাঁহার অভাব অনুভব করিবে না।  বহুকালপরে সুরমা দৌলতপুরে আসিয়াছে, তাহার পিতা মাতা কাশীযাত্রা করিবেন, সেই জন্য একবার দেখা দিতে আসিয়াছে। সুরমা আসিয়া শুনিয়াছে যে সদাশিব মিত্র ও তাঁহার পত্নী গঙ্গালাভ করিয়াছে, মণিলালদের বাড়ীতে আর কেহই নাই, সে নিজে কলিকাতায় থাকে, ভুলিয়াও দেশে আসে না। একদিন সন্ধ্যার পূর্ব্বে পাড়ায় বেড়াইতে গিয়া সুরমা মণিলালদের বাড়ীখানি দেখিয়া আসিয়াছে, দেখিয়া নিজের অজ্ঞাতসারে একটি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া আসিয়াছে। এই সেদিন সে সদাশিব মিত্রের কোলাহলপূর্ণ অট্টালিকায় সুখের সংসার দেখিয়া গিয়াছে, আর আজি দুইদিন পরে সেখানে মহাশ্মশান।

 প্রবোধ বাবু যেদিন কাশীযাত্রা করিবেন, সেই দিন প্রভাতে সুরমা একটি দাসী সঙ্গে লইয়া গঙ্গাস্নান করিতে চলিয়াছে। তাহার শ্বশুরালয় হইতে গঙ্গা বহুদূর, সেই জন্যও বটে, আর জন্মের মত শৈশবের লীলাক্ষেত্র, বাল্যের কৈশোরের সুমধুর স্মৃতি-বিজড়িত স্থানগুলি দেখিবার জন্যও বটে, সুরমা পুরাতন বাঁধা ঘাটে স্নান করিতে যাইতেছিল। ঘাটের অবস্থা ক্রমশঃ অতি শোচনীয় হইয়া উঠিয়াছে, চাতাল ও রাণাগুলি ভাঙ্গিয়া গিয়াছে, তাহা কেহই সংস্কার করিয়া দেয় না। ঘাটের ধাপগুলি কাদায় ভরিয়া গিয়াছে, গঙ্গার জলও অনেকদূর সরিয়া গিয়াছে, এখন বর্ষার সময়েও ঘাটে জল আসে না, ঘাটের অবস্থা দেখিয়া সুরমার চোখে জল আসিল। গ্রামের লোক এখন আর ঘাট ব্যবহার করে না; স্নান করিতে আসিয়া ঘাটের পাশ দিয়া চলিয়া যায়, সুরমা গ্রামের পথ ছাড়িয়া ভাল করিয়া দেখিবার জন্য ঘাটের উপর উঠিল। সে দেখিল যে সকলের নীচের ধাপে একজন সুসজ্জিত পুরুষ বসিয়া আছে।  সুরমা দাঁড়াইল, তাহার দাসী তখনও পশ্চাতে পড়িয়াছিল, তাহার জন্য অপেক্ষা করিতে লাগিল। সেই পুরুষটি তাহার দিকে চাহিয়া দেখিল, দেখিয়াই ব্যস্ত হইয়া উঠিয়া আসিল। তাহাকে দেখিয়া সুরমা ঘোমটা টানিয়া ভয়ে ও লজ্জায় জড়সড় হইয়া একপাশে দাঁড়াইল, যুবক তাহা দেখিয়া অগ্রস্তুত হইয়া ডাকিল “সুরমা!“সুরমা মুখ তুলিয়। চাহিয়া দেখিল, সে মণিলাল। মণিলাল তাহাকে নিরুত্তর দেখিয়া বলিল “সুরমা আমায় চিনিতে পারিলে না?” সুরমা তখন একটা প্রণাম করিয়া বলিল “হ্যাঁ পেরেছি, আপনি মণিদা!” উত্তর শুনিয়া যুবকের মুখ লাল হইয়া উঠিল। উভয়ে অরক্ষণ নীরবে দাঁড়াইয়া রহিল, তাহার পর মণিলাল কহিল “সুরমা, তুমি দৌলতপুর ছেড়ে যাবে শুনে একবার দেখিতে এলাম।” সুরমা কোন উত্তর দিল না, অধোমুখে দাঁড়াইয়া রহিল। মণিলাল আবার বলিল “সুরমা তবে এখন আসি।” সুরমা কি বলিতে বাইতেছিল, তাহা আর বলা হইল না, মণিলাল ঘাট ছাড়িয়া চলিয়া গেল।

 কলিকাতায় জগন্নাথ ঘাটে আজ লোকের বড় ভিড়, কারণ আজ বারুণী। পল্লীগ্রাম হইতে দলে দলে লোক গঙ্গাস্নান করিতে আসিয়াছে, গঙ্গার ধারের পথে লোক আর ধরিতেছে না, তাহার ভিতরে সারি সারি গাড়ী আসিতেছে। একখানি বড় ল্যাণ্ডো গাড়ী ঘাটে আসিয়া দাঁড়াইল, তাহা হইতে তিনটি পুরুষ ও দুইটি স্ত্রীলোক নামিল, একজন চাকর তাহাদিগের কাপড় গামছা ইত্যাদি নামাইয়া লইল। স্ত্রীলোক দুইটি অবগুণ্ঠনহীনা, দেখিলে ভদ্রঘরের স্ত্রী বলিয়া বোধ হয় না, তাহারা ঘাটের সন্মুখেই দাঁড়াইয়া রহিল। ল্যাণ্ডোর পিছনে একখানি ভাড়াটিয়া গাড়ী আসিয়াছিল, তাহা হইতে একটি বিধবা স্ত্রীলোক ও দুইজন দাসী নামিয়া দূরে দাঁড়াইয়াছিলেন। পুরুষ তিনজনের মধ্যে দুইজন অতিরিক্ত মদ্যপানের জন্য স্থির হইয়া দাঁড়াইতে পারিতেছিল না, তাহাদিগকে দেখিবার জন্য ঘাটের সম্মুখে লোক জমির গিয়াছিল, স্ত্রীলোক তিনটি পথ না পাইয়া এক পাশে দাঁড়াইয়াছিলেন। তাঁহাদিগের সঙ্গে একজন দরওয়ান আসিয়াছিল, সে তাঁহাদিগকে রক্ষা করিবার জন্য তাঁহাদিগের সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইয়াছিল। কলিকাতায় ভিড়ের সময়ে পথে গাড়ী দাঁড়াইতে দেয় না, সেইজন্য তাঁহাদিগকে বাধ্য হইয়া গাড়ী হইতে নামিতে হইয়াছিল, এবং মাতালের দল সম্মুখে পড়ায় তাঁহাদিগকে বাধ্য হইয়া অপেক্ষা করিতে হইতেছিল।

 সুখের বিষয় কলিকাতায় অধিকক্ষণ ভিড় থাকিতে পায় না, একজন কনষ্টেবল আসিয়া ভিড় সরাইয়া দিল। ঘাটের লোকে স্ত্রীলোক দুইটিকে পুরুষদের ঘাটে নামিতে দিল না, তাহাদিগকে ফিরাইয়া দিয়া স্ত্রীলোকদিগের স্নানের ঘাটে যাইতে বলিল। ভাড়াটিয়া গাড়ীতে যে বিধবা রমণী দুইটি দাসী লইয়া স্নান করিতে আসিয়াছিলেন, বেশ্যা দুইটিও, তাঁহারা যেখানে স্নান করিতেছিলেন সেই স্থানে গিয়া জলে নামিল। তাহারা নানা ছলে তাঁহাদিগের সহিত আলাপ করিবার চেষ্টা করিতে লাগিল। বিধবা রমণীটি তখন স্নান করিয়া পূজা করিতেছিলেন, দাসীদ্বয় তাহাদিগের সহিত কথা কহিতে লাগিল। তাহারা যখন শুনিল যে দাসীদ্বয় দৌলতপুর হইকে আসিতেছে তখন তাহারা সাগ্রহে বলিয়া উঠিল যে তাহাদিগের ‘বাবু’ দৌলতপুরের জমিদার। দাসীরা নাম জিজ্ঞাসা করিলে, তাঁহাদিগের মধ্যে একজন বলিল “বাবুর নাম মণিলাল মিত্র।” নাম শুনিয়া রমণীর পূজায় বাধা পড়িল, তিনি ব্যস্ত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন “কি বলিলে বাছা, কি নাম বলিলে?”

 “বাবুর নাম মণিলাল মিত্র।”

 “তাহার বাড়ী কি দৌলতপুরে?”

 “তিনি দৌলতপুরের জমিদার।”

 রমণীদ্বয় ‘বাবুর’ ঐশ্বর্য্য-গৌরবের পরিচয় দিতে লাগিল। “‘বাবু’ তাহাকে কলিকাতায় বাড়ী কিনিয়া দিয়াছেন, বহুমূল্য আসবাবে তাহা সুসজ্জিত করিয়া দিয়াছেন, হীরা-মুক্তার অলঙ্কারে তাহার সর্বাঙ্গ সাজাইয়া দিয়াছেন, দাস, দাসী, গাড়ী, ঘোড়া, সমস্তই তাঁহার, এমন কি তাহার জন্য ‘বাবু বিবাহ পর্য্যন্ত করেন নাই। দাসীদ্বয় অবাক হইয়া তাহাদিগের কথা শুনিতেছিল, কিন্তু বিধবা মহিলাটী বোধ হয় তাহার অধিকাংশই শুনিতে পান নাই, কারণ তিনি তখন অবগুণ্ঠন টানিয়া দিয়া পুনরায় পূজা আরম্ভ করিয়াছিলেন। পূজা শেষ করিয়া বিধবা মহিলা জল হইতে উঠলেন, দাসীদ্বয়ও উঠিল, বেশ্যা দুইটিও পশ্চাৎ পশ্চাৎ আসিল। ঘাটের উপরে সঙ্গীত্রয় বেশ্যাদ্বয়ের জন্য অপেক্ষা করিতেছিলেন। বিধবা স্ত্রীলোকটি দূর হইতে লক্ষ্য করিয়া দেখিলেন, তাহার পর দরওয়ানকে ডাকিয়া তাহাদিগের মধ্যে একজনকে তাহার নিকটে ডাকিয়া আনিতে বললেন।

 দরওয়ান পুরুষটিকে ডাকিবামাত্র সে ব্যক্তি আশ্চর্য্যান্বিত হইয়া গেল ও সলজ্জভাবে ধীরে ধীরে বিধবার সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল, তখন রমণী হঠাৎ অবগুণ্ঠন মোচন করিয়া বলিয়া উঠিলেন, “মণিদাদা, আপনি আমাকে চিনিতে পারেন?” এই বলিয়া গলায় কাপড় দিয়া তাহাকে প্রণাম করিল। পুরুষটী আশ্চর্য্য হইয়া দুইহাত সরিয়া গেলেন, তাহার পর বলিলেন “কে আপনি আমিত চিনিতে পারিতেছি না।”

 রমণী। “একেবারেই চিনিতে পারিতেছেন না?”

 পুরুষ। কই—না?

 রমণী। আমি সুরমা।

 পুরুষটী দুই হাত পিছু হটয়া গেল,—বলিল “তুমি—সুরমা?”

 রমণী। হাঁ আমি সুরমা! মণিদাদা আপনার সঙ্গে আমার বিশেষ কাজ আছে।

 আমি আজ দু বছর বিধবা হয়েছি, বড়ই বিপদে পড়েছি। আপনি আমায় সঙ্গে করে আপনার বাসায় নিয়ে চলুন। আমার সঙ্গে লোক আছে, তাতে আপনার কোনও লজ্জা নাই।

 মণিলাল বিষম বিপদে পড়িল। কলিকাতায় তাহার বাসা নাই, সে যেখানে থাকে, সেখানে ভদ্র গৃহস্থের স্ত্রীলোক লইয়া যাওয়া যায় না। যাহাদিগকে সঙ্গে করিয়া লইয়া আসিয়াছে, তাহাদিগকেই বা ফেলিয়া যায় কোথা? বহুকাল পরে সুরমার দেখা পাইয়াছে, তাহার একটা অনুরোধ, বিশেষ সে যখন বিপদে পড়িয়াছে, এড়াইতেও তাহার মন সরিতেছে না। সুরমা তখন বলিল “আমায় আজ নিয়ে যেতেই হবে, আমি বড় বিপদে পড়েছি, মণিদাদা! আমার দেওরের সঙ্গে বিষয় নিয়ে মকদ্দমা চলছে, আমার পক্ষে কেউ নাই।”

 মণিলাল অনেকক্ষণ গুম হইয়া থাকিল, অনেকক্ষণ পরে আমত আমতা করিয়া বলিল “আমার ত এখানে বাসা নাই স্বরম, আমি পরের বাড়ী থাকি, সেখানে তোমায় নিয়ে যাব কি করে?”  সুরমা। তবে আপনি আমার সঙ্গে আসুন।

 কি উত্তর দিবে ঠিক করিতে না পরিয়া মণিলাল চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া রহিল।

 সুরমা তাহার দরওয়ানকে গাড়ী ডাকিয়া আনিতে বলিল, গাড়ী আসিল। সুরমা মণিলালকে তাহাতে উঠিতে বলিল। কলের পুতুলটির মত মণিলাল গাড়ীতে গিয়া উঠিল, তাহার পুরুষ সঙ্গী দুইজন দৌড়িয়া আসিল, মণিলাল তাহাদিগকে বলিল “তোমরা ফিরিয়া যাও, আমি পরে যাইব।” দাসীদিগকে লইয়া সুরমা গাড়ীতে উঠিল, গাড়ী চলিয়া গেল, মণিলালের সঙ্গী ও সঙ্গিনীগণ ফ্যাল ফ্যাল করিয়া চাহিয়া রহিল।

8

গাড়ীখানি একটি প্রকাও ফটকের ভিতর প্রবেশ করিল। মণিলাল আশ্চর্য্য হইয়া চাহিয়া রহিল। ফটক পার হইয়া একটি প্রকাণ্ড বাড়ীর সম্মুখে গাড়ীখানি দাঁড়াইল। মণিলাল নামিয়া আসিলে একজন আমলা তাহাকে লইয়া গিয়া বৈটকখানায় বসাইল। সুরমার বাড়ীর সাজসজ্জা দেখিয়া মণিলাল অবাক হইয়া গেল। চারিদিকে বহুমূল্য আসবাব, প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড ঘর দাসদাসীতে পরিপূর্ণ, অবিলম্বে তাহার ডাক পড়িল, মণিলাল অন্দরে গিয়া আহার করিতে বসিল। সুরমা, তাহাকে বুলিয়া খাওয়াইল! অপরাহ্লে মণিলাল চলিয়া যাইবার জন্য ব্যস্ত হইল, সুরমাকে খবর দিয়া পাঠাইল, এবং সুরমা আসিলে বলিল “কই, কি মকদ্দমার কথা বলিবে বলিয়াছিলে?” সুরমা বলিল “কাল সকালে আমার দেওয়ান আসিবে, তখন সমস্ত কথা হইবে।” সন্ধ্যার সময়ে অভ্যাসের দোষে মণিলাল চলিয়া যাইবার জন্য ছটফট করিতে লাগিল, কিন্তু লজ্জায় কোন কথা বলতে পারিল না। সুরমার বাড়ীতে আসিয়া মণিলাল যেমন আরাম পাইয়াছিল,এমন আরাম সে বহুদিন পায় নাই। বাড়ীর লোকে যেন তাহার জন্য কাপড় জুতা জামা ঠিক করিয়া রাখিয়াছে, তাহাকে কোন অভাব বুঝিতে দিতেছে না।

 প্রভাতে উঠিয়া মণিলাল সুরমার নিকট খবর পাঠাইল, শুনিল সে পূজায় বসিয়াছে। বেলা নয়টার সময় দেওয়ান আসিলে, সুরমা মণিলালকে ডাকিয়া পাঠাইল, মণিলাল অন্দরে গিয়া মকদ্দমার কথা সমস্ত শুনিল। দ্বিপ্রহরে আহারের সময় মণিলাল সুরমাকে বাসায় ফিরিবার কথা বলিল, তাহার উত্তরে সুরমা বলিল “মণিদাদা তুমি যেখানে আছ, সেখানে তোমার আর যাওয়া হবে না।” মণিলাল মুখ হেট করিয়া রছিল, লজ্জায় আর কথা কহিতে পারিল না।

 এইরূপে এক সপ্তাহ কাটিয়া গেল, মণিলালের ফিরিয়া আসা হইল না, তাহার সঙ্গীর দল তাহার সহিত দেখা করিতে আসিয়া ফিরিয়া গেল, সুরমার আদেশে তাহার বাড়ী ঢুকিতে পাইল না। একদিন রাত্রিতে আহারের সময় সুরমা বলিল, “মণিদা, তুমি এবার বিয়ে করে সংসারী হও?” মণিলাল মুখ গুঁজিয়া রহিল, কোন উত্তর করিল না। তাহার পর হইতে প্রায় প্রতিদিনই সুরমা বিবাহের কথা পাড়িত, কিন্তু মণিলাল উত্তর দিত না। একদিন সে বলিল, “আমি বিবাহ করিব কিন্তু তুমি দিতে পারবে কি?”

 সুরমা। পারব;—তুমি যেমন কনেটি চাও আমি তেমনিটি খুঁজে বার করবো।

 মণিলাল। আমি এতদিন কেন বিয়ে করিনি, তা তুমি জান সুরমা?

 সুরমা। গ্রহের দোষে।  মণিলাল। গ্রহের দোষই বল, আর বরাতের দোষই বল, একজনের দোষ বটে।

 তাহার পর মণিলালের মুখ খুলিয়া গেল। সে বলিল, “সুরমা, তোমাকে পাইনি বলে এতদিন বিয়ে করিনি, তোমাকে যদি কখনও পাই তবে বিয়ে করবো, তা নইলে এজন্মে আর নয়।” সুরমা ঘোমটা টানিয়া উঠিয়া পলাইল; আর দুই তিন দিন মণিলালের সম্মুখে বাহির হইল না। বিরক্ত হইয়া মণিলাল চলিয়া যাইতে চাহিলে সুরমা তাহার সহিত দেখা করিয়া বুঝাইয়া সুঝাইয়া তাহাকে নিরস্ত করিল। এইভাবে আরও কিছুদিন কাটিয়া গেল, সুরমা আর বিবাহের কথা পাড়িত না।

 দিন দিন উভয়ের ঘনিষ্টতা বাড়িতে লাগিল, মণিলাল অধিক সময়ই অন্দরে কাটাইত। সুরমার পূজার সময় তাহার নিকটে নীরবে বসিয়া থাকিত, রাত্রিতে তাহাকে রামায়ণ পড়িয়া শুনাইত, দিনের বেলায় দেওয়ানজীর সহিত একত্র বসিয়া কাজ করিত। মণিলালের দিন বড় সুখেই কাটিতে লাগিল। তাহাদিগের ভাবে কোন দোষ না পাইলেও লোকে নিন্দা করিতে আরম্ভ করিল, মণিলাল তাহা শুনিয়াও গ্রাহ্য করিল না। সুরমা তাহা পারিল না,—মরিল।

 একদিন রাত্রিশেষে মণিলাল দেখিল বৃদ্ধ দেওয়ান তাহার বিছানার পাশে দাঁড়াইয়া তাহাকে ডাকিতেছে, সে তাড়াতাড়ি উঠিয়া বসিল, দেওয়ান বলিলেন, “আপনি শীঘ্র আমুন, কর্ত্রীর মৃত্যুকাল উপস্থিত?” এক লম্ফে মণিলাল অন্দরে প্রবেশ করিয়া দেখিল নারায়ণের ঘরের সম্মুখে মাটিতে পড়িয়া সুরমা ছটফট করিতেছে। মণিলাল আসিতেই তাহার হাত ধরিয়া বলিল, “মণিদাদা আমি চলিলাম, আমার একটি কথা রাখিও, —বল রাখিবে?” মণিলাল তাহাকে স্পর্শ করিয়া শপথ করিল, তখন সুরমা ধীরে ধীরে বলিল, “আমি মরিলে বিবাহ করিয়া সংসারী হইও।“মণিলাল কথা কহিতে পারিল না, ঘাড় নাড়িয়া সম্মতি জানাইল। মৃত্যুর গাঢ় নীলিমায় তখন সুরমারসুবর্ণ গৌরকাস্তি ঢাকিয়া যাইতেছিল, মরণকাতরকণ্ঠে সুরমা বলিয়া উঠিল, “সে যে তাঁহার জন্যই মরিতেছে; লক্ষ্যভ্রষ্ট হইয়া ইচ্ছার বিরুদ্ধে সে যখন অপরের হস্তে পড়িয়াছিল, তখন বহু চেষ্টা করিয়া কৈশোরের আরাধ্য দেবতাকে ভুলিয়াছিল। তাহাকে সুপথে আনিয়া সংসারী করাইবার জন্যই সে তাহাকে গঙ্গাতীর হইতে আনিয়াছিল, পথ দেখাইতে গিয়া সে নিজে পথ হারাইয়াছিল। পথভ্রান্ত পুরুষের প্রায়শ্চিত্ত আছে, কিন্তু কুলনারীর নাই, তাই সে মরিয়া প্রায়শ্চিন্তু করিল।