গ্রহ-নক্ষত্র (১৯১৫)/উল্কাপিণ্ড

উল্কাপিণ্ড

মেঘ নাই, ধোঁয়া নাই, কুয়াসা নাই, এমন পরিষ্কার রাত্রিতে তোমরা যদি কিছুক্ষণ আকাশের দিকে তাকাইয়া থাক, তখন হয় ত দেখিবে, ফস্ করিয়া একটা নক্ষত্র ছুটিয়া চলিল। এই রকম ঘটনাকে আমরা উল্কাপাত বলি এবং যেগুলি ঐ রকমে ছুটিয়া চলে তাহাদিগকে উল্কাপিণ্ড বলি। লোকে ইহাকে “নক্ষত্র-খসা” বলে এবং নক্ষত্র-খসাকে বড় অমঙ্গলের চিহ্ন মনে করে।

 আমি যখন খুব ছোট ছিলাম তখন আমাদের বাড়িতে এক বুড়ী ঝি ছিল; নক্ষত্র-খসা দেখিলেই সে চোখ বুঁজিয়া দুর্গা কালী প্রভৃতি দেবতাদের নাম করিত, আর পাঁচ রকম ফুলের নাম বলিত। তাহার বিশ্বাস ছিল, পাঁচ ফুলের নাম করিলে নক্ষত্র-খসিয়া জগতের অমঙ্গল করিতে পারে না।

 তোমরা বুঝিতেই পারিতেছ, সাধারণ লোকে যাহাই বলুক্, আকাশের নক্ষত্র খসিয়া কখনই মাটিতে পড়িতে পারে না। এক একটা নক্ষত্র কত বড় জিনিস তোমরা তাহা জান,—তাহাদের সকলেই এক একটা সূর্য্য, অনেকে আবার সূর্য্যের চেয়েও শত শত গুণ বড়। এই রকম একটা জিনিস যদি এই ছোট পৃথিবীতে আসিয়া পড়ে, তাহা হইলে কি ভয়ানক কাণ্ড হয় ভাবিয়া দেখ। পৃথিবী এক সেকেণ্ডে পুড়িয়া ছাই হইয়া যায় না কি?

 জ্যোতিষীরা উল্কাপাত-সম্বন্ধে কি বলেন শুন। তাঁহারা বলেন, পৃথিবী, মঙ্গল, বৃহস্পতি, শনি প্রভৃতি বড় বড় গ্রহ-উপগ্রহ ছাড়া সূর্য্যের রাজ্যে কতকগুলি খুব ছোট জড়পিণ্ড আছে। এগুলি কত ছোট তাহা জ্যোতিষীরা বলিতে পারেন না। কতকগুলি হয় ত ইটের মত কাঁকরের মত ছোট; আবার কতকগুলি হয় ত দশ মণ বিশ মণ পাথরের মত বড়। এগুলির নিজেদের আলো নাই, কিন্তু গ্রহদের মত গতি আছে। পৃথিবী যেমন একটা নির্দ্দিষ্ট পথে তিন শত পঁইষট্টি দিনে সূর্যকে ঘুরিয়া আসে, এই ছোট পিণ্ডগুলির প্রত্যেকে সেই রকম এক একটি নির্দ্দিষ্ট পথে নির্দ্দিষ্ট সময়ে সূর্য্যকে প্রদক্ষিণ করে।

 তাই বলিয়া মনে করিয়ো না, ইহাদের সকলেই দল বাঁধিয়া পাখীর ঝাঁকের মত একটা পথ ধরিয়া চলে। কতকগুলি এই রকম দল বাঁধিয়াই চলে, কিন্তু বাকিগুলি নিজেদের খেয়াল মত এক-একটা পৃথক পথ ধরিয়া ঘুরপাক্ দেয়। ইহাদের স্থান-অস্থান জ্ঞান নাই, সূর্য্যের রাজ্যের আনাচে-কানাচে থাকিয়া সূর্য্যকে ঘুরিয়া বেড়ায়। আমাদের যে-সব বড় বড় দূরবীণ আছে, তাহা দিয়াও এই ছোট পিণ্ডগুলিকে দেখা যায় না। কিন্তু এগুলি যে সত্যই সমস্ত আকাশে ছড়াইয়া আছে, জ্যোতিষীরা অন্য উপায়ে তাহা বেশ বুঝিতে পারেন।

 যাহারা দিক্‌বিদিক্ জ্ঞানশূন্য হইয়া ছুটাছুটি করে, তাহাদের পায়ে পায়ে বিপদ্। মনে কর, তুমি চোক বাঁধিয়া কলিকাতা, ঢাকা বা অন্য কোনো সহরের সদর রাস্তায় ছুটিয়া চলিয়াছ। এই অবস্থায় তোমার কি হয়, ভাবিয়া দেখ দেখি। হয় ত তুমি একটা ঘোড়ার গাড়ী বা গোরুর গাড়ীর সঙ্গে ধাক্কা খাও, না হয় ছাতা-মাথায় যে নিরীহ ভদ্রলোকটি চলিতেছে, তার পেটের উপরে জোরে ধাক্কা দিয়া ফেল। এলোমেলো-ভাবে যেখানে-সেখানে থাকিয়া চলা-ফেরা করে বলিয়া উল্কাপিণ্ডগুলিরও কখনো কখনো ঐ দশা হয়।

 মনে কর, পৃথিবী তাহার চাঁদটিকে কাছে লইয়া সূর্যকে ঘুরিতে চলিয়াছে, এমন সময়ে একটা উল্কাপিণ্ড পৃথিবীর রাস্তায় আসিয়া দাঁড়াইল। এই উল্কাপিণ্ডকে লইয়া পৃথিবী কি করিবে বলিতে পার কি? পৃথিবীর ভাবগতিক তোমাদের ত জানিতে বাকি নাই। ছোট জিনিসকে কাছে পাইলেই সে টানিয়া মাটিতে ফেলিতে চেষ্টা করে। তুমি যখন খুব জোরে আকাশের উপরে একটা ঢিল ফেল, তথন তাহার কি দশা হয় তোমরা দু’বেলাই দেখিতেছ। পৃথিবী ঢিলকে টানিয়া মাটির উপরে ফেলে। ছোট ছোট উল্কাপিণ্ডগুলিও যখন নিজেদের পথে ছুটিতে ছুটিতে পৃথিবীর কাছে আসিয়া পড়ে, তখন তাহাদেরও ঠিক্ ঢিলের দশাই হয়। পৃথিবী তাহাদিগকে জোরে টানিতে থাকে এবং তাহারা হু হু শব্দে বাতাস ভেদ করিয়া মাটিতে পড়িতে আরম্ভ করে।

 তোমরা আগেই শুনিয়াছ, পৃথিবীর উপরে পঞ্চাশ ষাইট্ মাইল গভীর বাতাসের আবরণ আছে, কাজেই এতটা বাতাস ভেদ করিয়া উল্কাপিণ্ডগুলিকে পৃথিবীতে নামিয়া আসিতে হয়। ইহাতে তাহাদের দশ কি হয় বলিতে পার কি? সেগুলি জ্বলিয়া উঠে এবং জ্বলিতে জ্বলিতে কিছুক্ষণ চলে, তার পরে পথের মাঝে পুড়িয়া ছাই হইয়া নিভিয়া যায়। আমরা পৃথিবী হইতে উল্কাপিণ্ডের ঐ জ্বলা-পোড়াকে হাউই বাজির মত দেখি এবং মনে মনে ভাবি বুঝি নক্ষত্র খসিয়া পড়িতেছে!

 তোমরা হয় ত ভাবিতেছ, বাতাসের ঘসা পাইয়া কেমন করিয়া উল্কাপিণ্ডের মত জিনিস জ্বলিবে? কিন্তু এই রকমে যে অনেক জিনিস জ্বলে ইহা আমাদের জানা কথা।

 কামান বা বন্দুকের মুখ হইতে যখন গোলা বা গুলি বাহির হইয়া ছুটিতে থাকে, তখন তাহা বেশ ঠাণ্ডা থাকে। তোমরা হয় ত বলিবে কামানের ভিতরকার বারুদের আগুন তাহাদিগকে গরম করে। কামানে বা বন্দুকে আগুন হয় বটে, কিন্তু সে আগুন গোলা বা গুলিকে গরম করিতে সময় পায় না। আগুন হইবা মাত্র গোলা বাতাস ভেদ করিয়া ছুটিতে আরম্ভ করে। কিন্তু বাতাসের ঘসা পাইয়া এই সকল ঠাণ্ডা গোলা শেষে এমন গরম হইয়া উঠে যে, মাটিতে পড়িলে তাহাতে হাত দেওয়া যায় না। কামানের গোলা সেকেণ্ডে দুই মাইলের বেশি যাইতে পারে না, কিন্তু উল্কাপিণ্ডগুলি চলে সেকেণ্ডে কুড়ি মাইল করিয়া। তাহা হইলে তোমরা বোধ হয় বুঝিতে পারিতেছ, বাতাসের ঘর্ষণে পথের মাঝে উল্কাপিণ্ডগুলির পুড়িয়া ছাই হইয়া যাওয়া একটুও আশ্চর্য্য নয়।

 উল্কাপিণ্ড যে সত্যই পুড়িতে পুড়িতে নীচে নামে, তাহাদের পাড়ার সময়ে ভাল করিয়া দেখিলে তোমরা বুঝিতে পারিবে। যে পথে উল্কাপিণ্ড নামিয়া আসে অনেক সময়ে সেখানে এক রকম আলো দেখা যায়। উল্কা নিভিয়া গেলেও কিছুক্ষণ ঐ আলো আকাশের গায়ে থাকে। জ্যোতিষীরা বলেন, গরম হইয়া পুড়িতে আরম্ভ করিলেই উল্কার দেহ হইতে বাষ্প বাহির হয় ও তাহা জ্বলিতে থাকে। কিন্তু এই বাষ্পকে উল্কারা সঙ্গে করিয়া লইয়া যাইতে পারে না, তাহা পথের মাঝেই ছড়াইয়া থাকে। কাজেই উল্কাগুলি জ্বলিয়া-পুড়িয়া নিভিয়া গেলে ঐ জ্বলন্ত বাষ্প কিছুক্ষণ তাহাদের পথকে আলো করিয়া রাখে।

 এই সব কথা শুনিয়া বোধ হয় তোমরা মনে করিতেছ, সব উল্কাই বুঝি পুড়িয়া পথের মাঝেই ছাই হইয়া যায়। কিন্তু তাহা নয়। যেগুলি আকারে বড় তাহারা বাতাসের ঘসা পাইয়া নিঃশেষে পুড়িয়া যাইবার সময় পায় না,—তাহাদের আধ্‌পোড়া দেহ কখনো কখনো ভয়ানক বেগে মাটিতে আসিয়া পড়ে এবং মাটিতে পুঁতিয়া যায়। তখন মাটি খুঁড়িয়া সন্ধান না করিলে তাহাদিগকে পাওয়া যায় না।

 কলিকাতার যাদুঘরে অর্থাৎ মিউজিয়মে তোমরা যখন যাইবে তখন খোঁজ করিয়ো,—দেখিবে, ঐ-রকম আধ্‌পোড়া উল্কাপিণ্ড সেখানে অনেক সাজানো আছে। কোন্ সময়ে কোথায় সেগুলিকে পাওয়া গিয়াছিল তাহাও লেখা আছে দেখিবে। এই পিণ্ডদের ওজন নিতান্ত অল্প নয়। এক ছটাক দু-ছটাক হইতে আরম্ভ করিয়া কোনো কোনো পিণ্ডের ওজন পঁচিশ ত্রিশ মণ পর্য্যন্ত হইতে দেখা গিয়াছে।

 কোনো জিনিসকে পোড়াইলে তাহা কোথায় যায় বলিতে পার কি? তোমরা হয় ত বলিবে তাহা নষ্ট হইয়া যায়। কিন্তু বৈজ্ঞানিকেরা বলেন, ইহারি উল্টা কথা। তাঁহাদের মতে এই ব্রহ্মাণ্ডের কোনো জিনিসেরই ক্ষয় নাই। তুমি যখন একখানি কাঠকে পোড়াইলে, তখন মনে হয় বুঝি কাঠখানি নষ্টই হইয়া গেল, কিন্তু তাহার অণু-পরমাণুর একটিও ক্ষয় পায় না। কাঠের কতক অংশ জল হইয়া আকাশে উড়িয়া যায়, নানা রকম গ্যাস হইয়া কতক বাতাসে মিশিয়া যায়, কতক ছাই হইয়া পড়িয়া থাকে। ঐ জলই জমা হইয়া হয় ত বৃষ্টির আকারে মাটিতে পড়ে এবং বাষ্পগুলিও নানা আকারে আমাদের কাছে ধরা দেয়।

 তাহা হইলে দেখ,—যে উল্কাপিণ্ডগুলি বাষ্প হইয়া আকাশে পুড়িয়া যায়, তাহাদের এক কণাও নষ্ট হয় না। দেহের সকল অংশই বাতাসে উড়িয়া বেড়ায় এবং কখনো কখনো জমাট বাঁধিয়া ধীরে ধীরে পৃথিবীর উপরে নামিয়া আসে। মেরুপ্রদেশের বরফের উপরে উঁচু পাহাড়ের মাথায় এবং সমুদ্রের তলায় খোঁজ করিয়া বৈজ্ঞানিকেরা উল্কার দেহের ছাই-ভস্ম অনেক দেখিতে পাইয়াছেন। আমাদের চারিদিকের বাতাসে সর্ব্বদাই যে ধূলির কণা ভাসিয়া বেড়ায়, তাহাতেও উল্কাদের ছাই দেখা গিয়াছে। প্রতিদিন হাজার হাজার উল্কা পৃথিবীর বাতাসে জ্বলিয়া পুড়িয়া ছাই হয়; সুতরাং এই সব ছাইয়ের কণায় যে আমাদের আকাশ সত্যই ভরা রহিয়াছে, তাহাতে আর সন্দেহ নাই। তোমার পড়িবার টেবিলের উপরে যে বই সাজানো আছে, দু’দিন না ঝাড়িলে তাহাতে কত ধূলা জমা হয় দেখ নাই কি? ইহার পনেরো আনাই হয় ত রাস্তার ধূলা, কিন্তু তাহার সঙ্গে কিছু কিছু উল্কাপিণ্ডের ছাই মিশানো থাকা একটুও বিচিত্র নয়।

 একজন বৈজ্ঞানিক হিসাব করিয়া বলিয়াছিলেন, প্রতি দিন বা রাত্রিতে আমাদের পৃথিবীর আকাশে অন্ততঃ দুই কোটি ছোট বড় উল্কাপিণ্ড প্রবেশ করে। এই কথা যদি সত্য হয়,—ভাবিয়া দেখ, এই সব উল্কার দেহের ছাই পরিমাণে কত বেশী!

 বৎসরের মধ্যে সব রাত্রিতে একই রকমের উল্কাপাত হয় না। এপ্রিলের ২১শে এবং আগষ্ট মাসের ৯ই, ১০ই ও ১১ই তারিখে যদি আকাশটিকে পরিষ্কার পাও, তবে ঐ কয়েক তারিখের রাত্রিতে তোমরা অনেক উল্কাপাত দেখিতে পাইবে। নভেম্বর মাসটা আমাদের হেমন্তকাল। এই সময়ে আকাশ বেশ পরিষ্কার থাকে। নভেম্বরের ১২ই, ১৩ই, ১৪ই এবং ২৭শে এই চারি তারিখে রাত্রি জাগিয়া যদি তোমরা আকাশ দেখিতে পার, তাহা হইলে দেখিবে, মিনিটে মিনিটে অনেক উল্কা হাউই বাজির মত আকাশের চারিদিকে ছুটাছুটি করিতেছে।

 অনেক দিন আগে আমি নিজে যে এক উল্কাবৃষ্টি দেখিয়াছিলাম, তাহা আর জীবনে ভুলিতে পারিব না। তখন আমি তোমাদের চেয়েও ছোট। সেদিন সন্ধ্যার পর হইতে এত উল্কা পড়িতে আরম্ভ করিয়াছিল যে, বোধ হইতেছিল যেন অগ্নিবৃষ্টি হইতেছে। বোধ হয় নভেম্বর মাসের কোনো এক তারিখে এই ঘটনা হইয়াছিল। বড় হইয়া বংসরে বৎসরে উল্কাবৃষ্টি দেখিবার জন্য রাত্রি জাগিয়াছি, কিন্তু তেমনটি আর দেখিতে পাই নাই। তবুও তোমরা নভেম্বরের ঐ চারিটি দিনে আকাশ দেখিয়ো, অনেক উল্কাপাত নজরে পড়িবে। জ্যোতিষের বইতে পড়িয়াছি, ইংরাজি ১৮৬৬ সালের নভেম্বর মাসের একদিন নাকি ভয়ানক উল্কাবৃষ্টি হইয়াছিল, কিন্তু তখন আমাদের জন্মও হয় নাই, কাজেই তাহার কথা তোমাদিগকে বলিতে পারিব না।

 বৎসরের তিন শত পঁইষট্টি দিনের মধ্যে কেন চার পাঁচটি তারিখে বেশি বেশি উল্কাপাত হয়, এখন তোমাদিগকে তাহার কারণ বলিব।

 তোমাদিগকে আগেই বলিয়াছি, প্রত্যেক উল্কাপিণ্ড গ্রহদের মত এক-একটা নির্দ্দিষ্ট পথে সূর্য্যকে ঘুরিয়া আসে। ইহাদের সকলেই পৃথক্ পৃথক্ থাকিয়া একা একা চলে না, লক্ষলক্ষ কোটিকোটি উল্কাপিণ্ড পাখীর ঝাঁকের মত দল বাঁধিয়াও ঘুরিয়া আসে।

 মনে কর, পৃথিবী তাহার নিজের পথে ঘুরিতে ঘুরিতে একদিন ঐ রকম এক উল্কাপিণ্ডের ঝাঁকের কাছে উপস্থিত হইল। সে দিন কি হইবে বলিতে পার কি? লক্ষলক্ষ উল্কা সে দিন পৃথিবীকে ঘিরিয়া থাকিবে এবং পৃথিবী তাহাদিগকে টানিয়া মাটিতে ফেলিতে চেষ্টা করিবে। কাজেই সেদিন পৃথিবীতে একটা উল্কাবৃষ্টি দেখা যাইবে।

 বৎসরের বিশেষ বিশেষ দিনে কেন এত উল্কাপাত হয়, এখন বোধ হয় তোমরা নিজেরাই বলিতে পারিবে। পৃথিবী তাহার নিজের নির্দ্দিষ্ট পথে ঘুরিতে ঘুরিতে ঐ কয়েক দিনে এক একটা উল্কার ঝাঁকের ভিতরে গিয়া পড়ে, তাই এত উল্কাবৃষ্টি।

 উল্কাদের ঝাঁক কোন্ পথে ঘুরিতেছে জ্যোতিষীরা তাহা ভাল করিয়া জানেন। কাজেই ঠিক্ কোন্ তারিখে পৃথিবী ঐসব ঝাঁকের মাঝে গিয়া দাঁড়াইবে, তাহা ইঁহারা হিসাব করিয়া বলিয়া দিতে পারেন। এই হিসাব হইতেই উল্কাবর্ষণের তারিখ আমরা ঠিক্ জানিতে পারি।

 তোমাদিগকে আগেই বলিয়াছি প্রতি বৎসরে ২৭শে নভেম্বর তারিখে পৃথিবীতে একটা উল্কাবৃষ্টি হয়। এসম্বন্ধে একটা বড় আশ্চর্য্য কথা জ্যোতিষীদের কাছে শুনা যায়।

 পঞ্চাশ বৎসর আগে জ্যোতিষীরা নভেম্বর মাসে কতদিন আকাশ পর্য্যবেক্ষণ করিয়াছেন, কিন্তু কোনো বৎসরেই তাঁহারা ২৭শে তারিখে উল্কাবৃষ্টি দেখিতে পান নাই। ইংরাজি ১৮৭২ সালের ঐ তারিখে আকাশের এক নির্দ্দিষ্ট অংশ (এন্‌ড্রোমিডা-মণ্ডল) হইতে হঠাৎ অবিরাম উল্কাবৃষ্টি হইতে দেখিয়া তাঁহারা অবাক্ হইয়া গিয়াছিলেন। কোনো একটা আশ্চর্য্য ঘটনা দেখিলে আমরা যেমন তাহাতে অবাক্ হই এবং কয়েক দিনের মধ্যে তাহার কথা ভুলিয়া যাই, বৈজ্ঞানিকেরা কোনো ঘটনাকে দেখিয়া সে রকমে ভুলিয়া যান না। তাঁহারা কারণ আবিষ্কার করিবার জন্য চেষ্টা করেন এবং যত দিন ঠিক্ কারণটি জানা না যায়, তত দিন তাঁহারা নিশ্চিন্ত থাকিতে পারেন না। ২৭শে নভেম্বরের উল্কাবৃষ্টি দেখিয়া জ্যোতিষীরা নিশ্চিন্ত থাকিতে পারেন নাই। কি কারণে হঠাৎ এই ব্যাপারটি ঘটিল, ছোট বড় অনেক জ্যোতিষীই তাহার অনুসন্ধান আরম্ভ করিয়াছিলেন।

 বায়েলার ধূমকেতুর কথা বোধ হয় তোমাদের মনে আছে। সূর্য্যের রাজ্যে আসিয়া তাহার লাঞ্ছনার সীমা ছিল না। তাহার লেজ ছিঁড়িয়া গিয়াছিল, তাহার মুণ্ড ভাঙিয়া দু’খানা হইয়াছিল; এবং শেষে ১৮৫৭ সালে সূর্য্য ও গ্রহদের টানে তাহার দেহটি পর্য্যন্ত গুঁড়া হইয়াছিল। এই ধূমকেতুটি কোন্ পথ দিয়া সূর্য্যকে ঘুরিয়া আসিত, তাহা জ্যোতিষীদের জানা ছিল। হিসাব করিতে করিতে তাঁহারা দেখিতে পাইলেন, নির্দ্দিষ্ট পথে ঘুরিতে ঘুরিতে পৃথিবী প্রতি বৎসরের ২৭শে নভেম্বর তারিখে বায়েলার ধূমকেতুর পথ ভেদ করিয়া চলিয়া যায়। ইহা দেখিয়াই এখন জ্যোতিষীরা বলিতে আরম্ভ করিয়াছেন,—ঐ দিন যে-সকল উল্কাপিণ্ড পৃথিবীর দিকে ছুটিয়া আসে, সেগুলি বায়েলারই দেহের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশ। বায়েলার এখন লেজ নাই, মাথামুণ্ড নাই, অবয়ব নাই, কিন্তু তাহার সর্ব্বাঙ্গের ক্ষুদ্র অংশগুলি রাস্তায় ছড়ানো আছে। কাজেই প্রতি বৎসর ২৭শে নভেম্বর তারিখে যখন পৃথিবী তাহার প্রকাণ্ড দেহ লইয়া ঐ রাস্তার মাঝে দাঁড়ায়, তখন বায়েলার দেহের ছোট অংশগুলি
পৃথিবী ও উল্কাপিণ্ডের পথ
ঝুপঝাপ করিয়া পৃথিবীর উপরে পড়িতে আরম্ভ করে। আমরা আকাশের তলায় দাঁড়াইয়া ইহা দেখি এবং বলি উল্কাবৃষ্টি হইতেছে।

 তোমরা উপরের কথাগুলি বুঝিতে পারিলে কিনা জানি না। যদি না বুঝিয়া থাক, পূর্ব্ব পৃষ্ঠায় একটা ছবি দিলাম। ছবিটি দেখিলে বুঝিবে।

 ছবিতে ডিমের মত যে চওড়া রাস্তাটি রহিয়াছে, তাহা বায়েলার ভ্রমণ-পথ। বায়েলার ধূমকেতুর দেহ গুঁড়া হইয়া গিয়াছে, তাই রাস্তায় সেই গুঁড়া ছড়ানো আছে। তার পরে যে গোল পথটি দেখিতেছ, তাহা পৃথিবীর পথ। এখন দেখ,—যেখানে বায়েলার পথের সহিত পৃথিবীর পথ কাটাকাটি করিয়াছে, সেখানে ২৭শে নভেম্বর তারিখে পৃথিবী হাজির হইয়াছে। এই অবস্থায় যে সত্যই হাজার হাজার উল্কাপিণ্ড পৃথিবীর চারিদিকে থাকে, তোমরা ছবি দেখিলেই তাহা বুঝিবে। কিন্তু এ রকম ছোট ছোট শিকার কাছে পাইয়া পৃথিবী কোনোমতে চুপ করিয়া থাকিতে পারে না, ঐগুলিকে টানিয়া সে মাটিতে ফেলিতে আরম্ভ করে। তাহা হইলে বুঝিতে পারিতেছ, বায়েলার দেহের হাজার হাজার ক্ষুদ্র অংশ বাতাস ভেদ করিয়া মাটিতে পড়িবার সময়ে জ্বলিয়া-পুড়িয়া উল্কাবৃষ্টির উৎপত্তি করে।

 বায়েলার ধূমকেতুর সহিত উল্কাপাতের এই সম্বন্ধ জানা গেলে, জ্যোতিষীরা খুব উৎসাহিত হইয়াছিলেন এবং বৎসরের অন্য দিনে যে সকল উল্কাবৃষ্টি দেখা যায়, তাহাদেরও কারণ বাহির করিবার জন্য চেষ্টা করিয়াছিলেন। ইহাতে এখন আমরা জানিতে পারিয়াছি, বড় বড় উল্কাবৃষ্টির দিনে পৃথিবী এক একটা ধূমকেতুর রাস্তায় গিয়া হাজির হয়। তোমরা আগেই শুনিয়াছ, ধূমকেতুর দেহে পৃথিবীর মাটি-পাথরের মত জমাট জিনিস নাই, খুব ছোট উল্কাপিণ্ড লইয়াই তাহাদের দেহ। কাজেই যখন সূর্য্যকে ঘুরিবার জন্য ভয়ানক বেগে চলিতে আরম্ভ করে, তথন ইহারা নিজেদের লেজগুলিকে এবং হাড়গোড়-ভাঙা দেহকে গুছাইয়া লইয়া যাইতে পারে না। হয় ত লেজের খানিকটা বা মুণ্ডের অর্দ্ধেকটা ছোট উল্কাপিণ্ডের আকারে রাস্তার যেখানে সেখানে ছড়াইয়া থাকে। কাজেই যখন পৃথিবী জীবন্ত ধূমকেতুদের পথে হাজির হয় তখনও তাহার উপরে কিছু কিছু উল্কাপাত হয়।

 আমরা এপর্য্যন্ত ছোট উল্কাদের কথাই বলিলাম। এগুলি ছোট বলিয়াই বাতাসের ভিতর দিয়া আসিবার সময়ে জ্বলিয়া পুড়িয়া ছাইভস্ম হইয়া যায়,—ইহাদের একটিও মাটিতে পড়ে না। কিন্তু যেগুলি বড়, তাহারা পুড়িতে পুড়িতে মাটিতে পড়ে। কেবল ইহাই নয়, কখনো কখনো ভয়ানক শব্দ করিয়া ভাঙিয়া খণ্ড-বিখণ্ড হইয়া তবে মাটিতে পড়ে। পুড়িবার সময়ে ইহাদের গায়ে যে আলো দেখা যায়, তাহা নানা রঙের হয়। তোমরা হয় ত কোনো সময়ে এই রকম বড় উল্কাপাত দেখিয়া থাকিবে। দেখিলে বোধ হয় যেন, হাউই বাজি তারা কাটিয়া নীচে নামিয়া আসিতেছে। এই বইয়ের প্রথমেই বড় উল্কাপাতের একটি ছবি দিয়াছি। দেখ,—সোটি কেমন সুন্দর!

 গায়ে যত জোর আছে তাহার সবটুকু দিয়া যদি একটি ঢিল উপরে ছোড়া যায়, তাহা হইলে সেটি উপরে উঠে বটে, কিন্তু কিছু পরে নীচে নামিয়া আসে। যদি আকাশের দিকে বন্দুক ছোড়া যায়, তাহা হইলে বন্দুকের গুলিরও ঐ দশা হয়,—খুব উপরে উঠে কিন্তু একটু পরে আবার মাটিতে নামিয়া আসে। ঢিল বা বন্দুকের গুলি পৃথিবী ছাড়িয়া পলাইতে পারে না। পৃথিবীর টানের এলাকার মধ্যে যদি একটি বালির কণা থাকে, তবে তাহাকেও নিশ্চয় মাটিতে পড়িতে। হয়। এমনি পৃথিবীর টান্।

 মনে কর বড় বড় এন্‌জিনিয়ার ডাকিয়া আমরা একটা খুব বড় রকমের কামান প্রস্তুত করিলাম এবং সেটি এত জোরালো হইল যে, তাহার গোলা পৃথিবীর টানের সীমা পার হইয়া আকাশে উঠিল। এই অবস্থায় গোলাটির দশা কি হইবে বলিতে পার কি? গোলা মাটিতে পড়িবে না, কারণ পৃথিবী তাহাকে টানিতেই পারিবে না। জ্যোতিষীরা হিসাব করিয়া বলেন, ঐ রকম গোলা চাঁদের মত পৃথিবীকে ঘুরিয়া বেড়াইতে থাকিবে,—অর্থাৎ সে যেন পৃথিবীর একটি নূতন চাঁদ হইয়া দাঁড়াইবে। কিন্তু এ রকম অবস্থায় তাহার বেশি দিন থাকা চলিবে না;—সূর্য্য তাহাকে বিলক্ষণ জোরে টান দিতে আরম্ভ করিবে। কাজেই তাহাকে তখন গ্রহদের মত সূর্য্যেরই চারিদিকে ঘুরিয়া বেড়াইতে হইবে।

 বলা বাহুল্য, আজ পর্য্যন্ত ঐ রকম অদ্ভুত কামান প্রস্তুত করিয়া কেহই গোলা ছুড়িতে পারে নাই। কারণ গোলার গতি সেকেণ্ডে সাত বা আট মাইল না হইলে তাহা কখনই পৃথিবী ছাড়িয়া পলাইতে পারে ন। আজকালকার খুব ভাল কামানের গোলা সেকেণ্ডে দুই মাইলের বেশি দৌড়িতে পারে না।

 এখনকার অবস্থা যাহা হউক না কেন, পৃথিবীতে এমন একটি সময় ছিল যখন সত্যই আট দশ মাইল বেগে মাটি-পাথর ও নানা আকরিক বস্তু আকাশের উপরে উঠিত এবং পৃথিবীর টানের সীমা পার হইয়া যাইত। তোমরা ইহা শুনিয়া বোধ হয় বিস্মিত হইতেছ, কিন্তু কথাটি একবারে অসম্ভব নয়। জ্যোতিষীরা বলেন, এখন পৃথিবীতে যেমন বিসুভিয়স্, এট্‌না প্রভৃতি কয়েকটি মাত্র আগ্নেয়গিরি আছে, অতি প্রাচীনকালের অবস্থা এরকম ছিল না। তখন পৃথিবী খুব গরম ছিল; এজন্য অসংখ্য আগ্নেয় পর্ব্বত মাটি, পাথর, লোহা, তামা প্রভৃতি জিনিস জোরে জোরে আকাশের উপর দিকে ছুড়িত। এই সব জিনিসের মধ্যে কতকগুলি পৃথিবীর আকর্ষণের সীমা পারও হইয়া যাইত। কাজেই তখন তাহারা পৃথিবীতে আর ফিরিতে পারিত না,—আমাদের সেই কামানের গোলার মত, ছোট গ্রহের আকারে সেগুলি সূর্য্যকে ঘুরিয়া বেড়াইত। জ্যোতিষীরা বলেন, ঐ-সব বড় বড় আগ্নেয়-পর্ব্বতের চিহ্ন এখন পৃথিবীতে না থাকিলেও, তাহারা যে মাটি-পাথর এবং ধাতুপিণ্ড গোলার মত ছাড়িয়াছিল, তাহা আজও আাকাশে আছে এবং দিবা-রাত্রি সূর্য্যকে ঘুরিয়া বেড়াইতেছে। পৃথিবী নিজের পথে আপন মনে চলিতে চলিতে যখন এইগুলি কাছে পায় তখন তাহাদিগকে আর ছাড়িতে চায় না,—জোরে টানিয়া মাটিতে ফেলিতে সুরু করে। জ্যোতিষীরা বলেন, মাটি-পাথরের বড় বড় পিণ্ডগুলি যখন এই রকমে বাতাস ভেদ করিয়া আসিবার সময়ে জ্বলিয়া উঠে, আমরা তখনি তাহাদিগকে বড় বড় উল্কাপাতের মত দেখি।

 পৃথিবীর নানা জায়গায় উল্কাপিণ্ডের যে-সব অংশ কুড়াইয়া পাওয়া গিয়াছে, সেগুলিতে কি কি জিনিস আছে, বৈজ্ঞানিকেরা পরীক্ষা করিয়া দেখিয়াছেন; কিন্তু পরীক্ষায় তাহাতে একটিও নূতন দ্রব্য ধরা পড়ে নাই। পৃথিবীর লোহা, তামা, প্রভৃতি ধাতু এবং মাটি-পাথর-বালি প্রভৃতি অ-ধাতু জিনিসই পাওয়া গিয়াছে। উল্কাপিণ্ডগুলি যে এককালে সত্যই পৃথিবীর উপরকার বস্তু ছিল, ইহা দেখিয়াও কতকটা বুঝা যায় না কি?