গ্রহ-নক্ষত্র (১৯১৫)/নীহারিকা
নীহারিকা
তোমরা বোধ হয় নীহারিকা দেখ নাই। ইহা আকাশের এক অদ্ভুত জিনিস। দূরবীণ ছাড়া এগুলিকে প্রায়ই দেখা যায় না; হঠাৎ দেখিলে মনে হয়, যেন দূরবীণের ভিতরে একখানি সাদা উজ্জ্বল মেঘ দেখা যাইতেছে। কিন্তু এগুলি যে মেঘ নয় বা দূরের নক্ষত্রদের লেপা আলো নয়, তাহা বেশ বুঝা যায়। বহু দূরে কোটি কোটি মাইল জায়গা জুড়িয়া যে বাষ্পরাশি জ্বলিতেছে, তাহাকেই আমরা উজ্জ্বল মেঘের মত দেখিতে পাই। তরল বা বাষ্পীয় জিনিদের কোনো নির্দ্দিষ্ট আকার থাকে না। নীহারিকার সর্ব্বাঙ্গে কেবল বাষ্প বা খুব ছোট ছোট জড়কণাই থাকে, এজন্য তাহাদের সকলকে একই নির্দ্দিষ্ট আকারে দেখা যায় না। কোনোটির আকার লম্বা, কোনোটি আংটির মত গোল, কোনোটি ইস্ক্রুপের পেঁচের মত। কিন্তু এই সব আকার দেখিলে স্পষ্ট বুঝা যায় যে, নীহারিকাদের দেহের বাষ্পরাশি স্থির হইয়া নাই। ঝড়ের বাতাস যেমন ছুটাছুটি করে, ইহাদের দেহের বাষ্পরাশি ও জড়পিণ্ড যেন সেই রকমেই ছুটাছুটি করিতেছে ও ঘুরপাক্ খাইতেছে।
এখানে আমরা দু’টি নীহারিকার ছবি দিলাম। প্রথমটি এন্ড্রোমিডা রাশির নীহারিকা। আকৃতি দেখিলেই বুঝিবে, যেন ইহার দেহের বাষ্পরাশি প্রচণ্ড বেগে এক গোলাকার পথে পাক্ খাইতেছে। ইহা আকাশের যে পরিমাণ জায়গা জুড়িয়া আছে, তাহাতে আমাদের সূর্য্যের রাজ্যের মত অন্ততঃ দু’হাজার রাজ্য অনায়াসে থাকিতে পারে!
দ্বিতীয় ছবিটি “কালপুরুষের” (Orion) নীহারিকার আকৃতি। কালপুরুষের কোমরের নীচে যে কয়েকটি নক্ষত্র আছে তাহাদেরি
কালপুরুষের নীহারিকা
মধ্যে এই নীহারিকাটিকে দেখা যায়। ইহাও আকাশের এক প্রকাণ্ড স্থান জুড়িয়া জ্বলিতেছে।
ভাবিয়া দেখ, আকাশের এক একটা জায়গায় নীহারিকাগুলি কি কি ভয়ানক অগ্নিকাণ্ডই করিতেছে!
আকাশে আগুনের অভাব নাই,—সূর্য্যে গ্রহ-উপগ্রহে ধূমকেতুতে উল্কাপিণ্ডে এবং নক্ষত্রে নক্ষত্রে যে কত আগুন জ্বলিতেছে, তাহা কল্পনাই করা যায় না। কাজেই নীহারিকায় আগুন আছে বলিয়া জ্যোতিষীরা আশ্চর্য্য হন না,—ইহারা তাপ ত্যাগ করিয়া জমাট বাঁধিলে যে এক একটি নক্ষত্রের সৃষ্টি করে, তাহা জানিয়াই অবাক্ হন।
তোমরা কোনো কারখানা-ঘর দেখিয়াছ কি? কুমোরের কারখানায় কুমোররা মাটি ছানিয়া কত রকমের হাঁড়ি কলসী ও পুতুল
কৃত্তিকা-মণ্ডলের নীহারিকা
প্রস্তুত করে। কাঠের কারখানায় ছুতার মিস্ত্রিরা কাঠ দিয়া কত জিনিস নির্ম্মাণ করে। জ্যোতিষীরা বলেন, নীহারিকাগুলি বিধাতার এক একটা কারখানা-ঘর। যে-সব জিনিসে সূর্য্য ও মহাসূর্য্যদের গড়া যাইতে পারে, তাহা নীহারিকাগুলিতে মজুত থাকে। তার পরে যখন ঠাণ্ডা হইয়া জমাট বাঁধিতে আরম্ভ করে তখন সেইগুলিই এক একটি সূর্য্য বা নক্ষত্রের সৃষ্টি করিতে থাকে।
বৃষ্টির জল মাটিতে পড়িলে তাহার অধিকাংশই নদী সমুদ্রে জমা হইয়া ক্রমে বাষ্প হয় এবং সেই বাষ্পই মেঘ হইয়া আবার বৃষ্টির আকারে মাটিতে পড়ে। বৃষ্টি হইতে মেঘ এবং মেঘ হইতে আবার বৃষ্টি, সৃষ্টির প্রথম হইতে চলিতেছে। জীবজন্তু গাছপালা মরিয়া মাটিতে মিশিয়া যায় এবং সেই মাটি হইতে খাদ্য সংগ্রহ করিয়া নূতন জীবজন্তু গাছপালা বাঁচে। প্রকৃতির সব কাজেই এক রকম পুরাতন হইতে নূতনের সৃষ্টি দেখা যায়। গ্রহনক্ষত্র-সূর্য্যদের জন্মমৃত্যুতে সেই নিয়মই চলে। যখন আকাশের মহাসূর্য্যগুলি তাপ ও আলো ব্যয় করিয়া মরিয়া যায়, তখন আমরা ভাবি, মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে বুঝি তাহাদের কাজ শেষ হইয়া গেল। কিন্তু তাহা হয় না,—মরা নক্ষত্রেরাই পরস্পরকে ধাক্কাধুক্কি দিয়া আবার জ্বলিয়া উঠে এবং এক একটি নূতন নক্ষত্রের জন্ম দেয়। ভাবিয়া দেখ, বিধাতার কৌশল কি সুন্দর! যাহা পুরাতন এবং সংসারের সকল কাজের অযোগ্য তাহাই মৃত্যুর ভিতর দিয়া নূতনকে জন্ম দেয় এবং তাহাতেই আমাদের এই অপূর্ব্ব সৃষ্টিথানি টিকিয়া থাকে। ইহা আশ্চর্য্য নয় কি?