নিখিলেশের আত্মকথা

পঞ্চুর স্ত্রী যক্ষ্মায় ভুগে ভুগে মরেছে। পঞ্চুকে প্রায়শ্চিত্ত করতে হবে। সমাজ হিসেব করে বলেছে, খরচ লাগবে সাড়ে তেইশ টাকা।

 আমি রাগ করে বললুম, নাই-বা করলি প্রায়শ্চিত্ত, তাের ভয় কিসের?

 সে ক্লান্ত গােরুর মতাে তার ধৈর্যভারপূর্ণ চোখ তুলে বললে, মেয়েটি আছে, বিয়ে দিতে হবে। আর, বউয়েরও তাে গতি করা চাই।

 আমি বললুম, পাপই যদি হয়ে থাকে এতদিন ধরে তার প্রায়শ্চিত্ত তাে কম হয় নি।

 সে বললে, আজ্ঞে, কম কী। ডাক্তার-খরচায় জমিজমা কিছু বিক্রি আর বাকি সমস্ত বন্ধক পড়ে গেছে। কিন্তু দান-দক্ষিণে ব্রাহ্মণভােজন না হলে তাে খালাস পাই নে।

 তর্ক করে কী হবে! মনে মনে বললুম, যে ব্রাহ্মণ ভােজন করে তাদের পাপের প্রায়শ্চিত্ত কবে হবে।

 একে তাে পঞ্চু বরাবরই উপবাসের ধার ঘেঁষে কাটিয়েছে, তার উপরে এই স্ত্রীর চিকিৎসা এবং সৎকার উপলক্ষে সে একেবারে অগাধ জলে পড়ল। এই সময়ে কোনােরকম করে একটা সান্ত্বনা পাবার জন্যে সে এক সন্ন্যাসী সাধুর চেলাগিরি শুরু করলে। তাতে হল এই, তার ছেলেমেয়েরা যে খেতে পাচ্ছে না সেইটেই ভুলে থাকবার একটা নেশায় সে ডুবে রইল। বুঝে নিলে, সংসারটা কিছুই না, সুখ যেমন নেই তেমনি দুঃখটাও স্বপ্নমাত্র। অবশেষে একদিন রাত্রে ছেলেমেয়ে চারটিকে ভাঙা ঘরে ফেলে রেখে সে বৈরাগী হয়ে বেরিয়ে চলে গেল।

 এ-সব কথা আমি কিছুই জানতুম না। আমার মনটার মধ্যে তখন সুরাসুরের মন্থন চলছিল। মাস্টারমশায় যে পঞ্চুর ছেলেমেয়েগুলিকে নিজের বাসায় রেখে মানুষ করছেন সে কথাও আমাকে জানান নি। তখন তাঁর নিজের ছেলে তার বউকে নিয়ে রেঙুন চলে গেছে; ঘরে তিনি একলা, তার আবার সমস্ত দিন ইস্কুল।

 এমনি করে এক মাস যখন কেটে গেছে তখন একদিন সকালবেলায় পঞ্চু এসে উপস্থিত। তার বৈরাগ্যের ঘাের ভেঙেছে। যখন তার বড় ছেলে-মেয়ে দুটি তার কোলের কাছে মাটির উপর বসে তাকে জিজ্ঞাসা করলে ‘বাবা, তুই কোথায় গিয়েছিলি’, সব-ছােটো ছেলেটি তার কোল দখল করে বসলে, আর সেজো মেয়েটি পিঠের উপর পড়ে তার গলা জড়িয়ে ধরলে— তখন কান্নার পর কান্না, কিছুতে তার কান্না থামতে চায় না। বলতে লাগল, মাস্টার-বাবু, এগুলােকে দু-বেলা পেট ভরে খাওয়াব সে শক্তিও নেই, আবার এদের ফেলে রেখে দৌড় মারব সে মুক্তিও নেই, এমন করে বেঁধে মার কেন! আমি কী পাপ করেছিলুম!

 এদিকে যে-ব্যবসাটুকু ধরে কোনােমতে তার দিন চলছিল তার সূত্র ছিন্ন হয়ে গেছে। প্রথম দিনকতক ঐ-যে মাস্টারমশায়ের ওখানে সে বাসা পেলে সেইটেকেই সে টেনে চলতে লাগল; তার নিজের বাড়িতে নড়বার নামও করতে চায় না। শেষকালে মাস্টারমশায় তাকে বললেন, পঞ্চু, তুমি বাড়িতে যাও, নইলে তােমার ঘর-দুয়ারগুলাে নষ্ট হয়ে যাবে। আমি তােমাকে কিছু টাকা ধার দিচ্ছি, তুমি কাপড়ের ব্যবসা করে অল্প অল্প করে শােধ দিয়াে।

 প্রথমটা পঞ্চুর মনে একটু খেদ হল। মনে করলে, দয়াধর্ম বলে একটা জিনিস জগতে নেই। তারপর টাকাটা নেবার বেলায় মাস্টারমশায় যখন হ্যাণ্ডনােট লিখিয়ে নিলেন তখন ভাবলে, শােধ তাে করতে হবে এমন উপকারের মূল্য কী!

 মাস্টারমশায় কাউকে বাইরের দিকে দান করে ভিতরের দিকে ঋণী করতে নিতান্ত নারাজ। তিনি বলেন, মনের ইজ্জত চলে গেলে মানুষের জাত মারা হয়।

 হ্যাণ্ডনােটে টাকা নেওয়ার পর পঞ্চু মাস্টারমশায়কে খুব বড়াে করে প্রণাম করতে আর পারলে না, পায়ের ধুলােটা বাদ পড়ল। মাস্টারমশায় মনে মনে হাসলেন, তিনি প্রণামটা খাটো করতে পারলেই বাঁচেন। তিনি বলেন, আমি শ্রদ্ধা করব, আমাকে শ্রদ্ধা করবে, মানুষের সঙ্গে এই সম্বন্ধই আমার খাটি। ভক্তি আমার পাওনার অতিরিক্ত।

 পঞ্চ কিছু ধুতি-শাড়ি কিছু শীতের কাপড় কিনে আনিয়ে চাষীদের ঘরে ঘরে বেচে বেড়াতে লাগল। নগদ দাম পেত না বটে, তেমনি কিছু বা ধান, কিছু বা পাট, কিছু বা অন্য ফসল যা হাতে হাতে আদায় করে আনত সেটা দামে কাটা যেত না। দু মাসের মধ্যেই সে মাস্টারমশায়ের এক কিস্তি সুদ এবং আসলের কিছু শােধ করে দিলে এবং এই ঋণ শােধের অংশ প্রণামের থেকে কাটান পড়ল। পঞ্চু নিশ্চয় মনে করতে লাগল, মাস্টারমশায়কে সে যে একদিন গুরু বলে ঠাউরেছিল, ভুল করেছিল; লােকটার কাঞ্চনের প্রতি দৃষ্টি আছে।

 এই রকমে পঞ্চুর দিন চলে যাচ্ছিল। এমন সময় স্বদেশীর বান খুব প্রবল হয়ে এসে পড়ল। আমাদের এবং আশেপাশের গ্রাম থেকে যে-সব ছেলে কলকাতার স্কুল-কলেজে পড়ত তারা ছুটির সময় বাড়ি ফিরে এল; তাদের অনেকে স্কুল-কলেজ ছেড়ে দিল। তারা সবাই সন্দীপকে দলপতি করে স্বদেশীপ্রচারে মেতে উঠল। এদের অনেকেই আমার অবৈতনিক স্কুল থেকে এনট্রেন্স পাস করে গেছে, অনেককেই আমি কলকাতায় পড়বার বৃত্তি দিয়েছি। এরা একদিন দল বেঁধে আমার কাছে এসে উপস্থিত। বললে, আমাদের শুকসায়র হাট থেকে বিলিতি সুতাে ব্যাপার প্রভৃতি একেবারে উঠিয়ে দিতে হবে।

 আমি বললুম, সে আমি পারব না।

 তারা বললে, কেন, আপনার লােকসান হবে?

 বুঝলুম, কথাটা আমাকে একটু অপমান করে বলবার জন্যে। আমি বলতে চাচ্ছিলুম, আমার লােকসান নয়, গরিবের লােকসান।

 মাস্টারমশায় ছিলেন, তিনি বলে উঠলেন, হাঁ, ওঁর লােকসান বৈকি, সে লােকসান তাে তােমাদের নয়।

 তারা বললে, দেশের জন্যে—

 মাস্টারমশায় তাদের কথা চাপা দিয়ে বললেন, দেশ বলতে মাটি তাে নয়, এই-সমস্ত মানুষই তাে। তা, তােমরা কোনােদিন একবার চোখের কোণে এদের দিকে তাকিয়ে দেখেছ? আর, আজ হঠাৎ মাঝখানে পড়ে এরা কী নুন খাবে আর কী কাপড় পরবে তাই নিয়ে অত্যাচার করতে এসেছ! এরা সইবে কেন, আর এদের সইতে দেব কেন?

 তারা বললে, আমরা নিজেরাও তাে দিশি নুন, দিশি চিনি, দিশি কাপড় ধরেছি।

 তিনি বললেন, তােমাদের মনে রাগ হয়েছে, জেদ হয়েছে, সেই নেশায় তােমরা যা করছ খুশি হয়ে করছ— তােমাদের পয়সা আছে, তােমরা দু পয়সা বেশি দিয়ে দেশি জিনিস কিনছ— তােমাদের সেই খুশিতে ওরা তাে বাধা দিচ্ছে না। কিন্তু ওদের তােমরা যা করাতে চাচ্ছ সেটা কেবল জোরের উপরে। ওরা প্রতিদিনই মরণ-বাঁচনের টানাটানিতে পড়ে ওদের শেষনিশ্বাস পর্যন্ত লড়ছে কেবলমাত্র কোনােমতে টিঁকে থাকবার জন্যে। ওদের কাছে দুটো পয়সার দাম কত সে তােমরা কল্পনাও করতে পার না। ওদের সঙ্গে তােমাদের তুলনা কোথায়! জীবনের মহলে বরাবর তােমরা এক কোঠায়, ওরা আর-এক কোঠায় কাটিয়ে এসেছে। আর, আজ তােমাদের দায় ওদের কাঁধের উপর চাপাতে চাও? তােমাদের রাগের ঝাল ওদের দিয়ে মিটিয়ে নেবে? আমি তাে একে কাপুরুষতা মনে করি। তােমরা নিজে যত দূর পর্যন্ত পার করাে, মরণ পর্যন্ত। আমি বুড়ােমানুষ, নেতা বলে তােমাদের নমস্কার করে পিছনে পিছনে চলতে রাজি আছি। কিন্তু ঐ গরিবদের স্বাধীনতা দলন করে তােমরা যখন স্বাধীনতার জয়পতাকা আস্ফালন করে বেড়াবে তখন আমি তােমাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াব, তাতে যদি মরতে হয় সেও স্বীকার।

 তারা প্রায় সকলেই মাস্টারমশায়ের ছাত্র, স্পষ্ট কোনাে কটু কথা বলতে পারল না; কিন্তু রাগে তাদের রক্ত গরম হয়ে বুকের মধ্যে ফুটতে লাগল। আমার দিকে চেয়ে বললে, দেখুন, সমস্ত দেশ আজ যে ব্রত গ্রহণ করেছে কেবল আপনি তাতে বাধা দেবেন?

 আমি বললুম, আমি বাধা দিতে পারি এমন সাধ্য আমার কী আছে? আমি বরং প্রাণপণে তার আনুকূল্য করব।

 এম. এ. ক্লাসের ছাত্রটি বাঁকা হাসি হেসে বললে, কী আনুকূল্য করছেন?

 আমি বললুম, দিশি মিল থেকে দিশি কাপড় দিশি সুতাে আনিয়ে আমাদের হাটে রাখিয়েছি। এমন-কি, অন্য এলাকার হাটেও আমার সুতাে পাঠাই—

 সে ছাত্রটি বলে উঠল, কিন্তু আমরা আপনার হাটে গিয়ে দেখে এসেছি, আপনার দিশি সুতাে কেউ কিনছে না।

 আমি বললুম, সে আমার দোষ নয়, আমার হাটের দোষ নয়। তার একমাত্র কারণ, সমস্ত দেশ তােমাদের ব্রত নেয় নি।

 মাস্টারমশায় বললেন, শুধু তাই নয়, যারা ব্রত নিয়েছে তারা বিব্রত করবারই ব্রত নিয়েছে। তােমরা চাও, যারা ব্রত নেয় নি তারাই ঐ সুতাে কিনে যারা ব্রত নেয় নি এমন জোলাকে দিয়ে কাপড় বােনাবে, আর যারা ব্রত নেয় নি তাদের দিয়ে এই কাপড় কেনাবে। কী উপায়ে? না, তােমাদের গায়ের জোরে আর জমিদারের পেয়াদার তাড়ায়। অর্থাৎ, ব্রত তােমাদের, কিন্তু উপবাস করবে ওরা আর উপবাসের পারণ করবে তােমরা।

 সায়ান্স্ ক্লাসের ছাত্রটি বললে, আচ্ছা বেশ, উপবাসের কোন্ অংশটা আপনারাই নিয়েছেন শুনি।

 মাস্টারমশায় বললেন, শুনবে? দিশি মিল থেকে নিখিলের সেই সুতাে নিখিলকেই কিনতে হচ্ছে, নিখিলই সেই সুতােয় জোলাদের দিয়ে কাপড় বােনাচ্ছে। তাঁতের ইস্কুল খুলে বসেছে। তার পরে বাবাজির যেরকম ব্যাবসাবুদ্ধি তাতে সেই সুতােয় গামছা যখন তৈরি হবে তখন তার দাম দাঁড়াবে কিংখাবের টুকরাের মতাে। সুতরাং সে গামছা নিজেই কিনে উনি ওঁর বসবার ঘরে পর্দা খাটাবেন; সে পর্দায় ওঁর ঘরের আবরু থাকবে না। ততদিনে তােমাদের যদি ব্রত সাঙ্গ হয় তখন দিশি কারুকার্যের নমুনা দেখে তােমরাই সব চেয়ে চেঁচিয়ে হাসবে। আর, কোথাও যদি সেই রঙিন গামছার অর্ডার এবং আদর মেলে সে ইংরেজের কাছে।

 এতদিন ওঁর কাছে আছি, মাস্টারমশায়ের এমনতরাে শান্তিভঙ্গ হতে আমি কোনােদিন দেখি নি। আমি বেশ বুঝতে পারলুম, কিছুদিন থেকে ওঁর হৃদয়ের মধ্যে একটা বেদনা নিঃশব্দে জমে আসছে— সে কেবল আমাকে ভালােবাসেন বলে। সেই বেদনাতেই ওঁর ধৈর্যের বাঁধ ভিতরে ভিতরে ক্ষয় করে দিয়েছে।

 মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র বলে উঠল, আপনারা বয়সে বড়ো, আপনাদের সঙ্গে তর্ক আমরা করব না। তা হলে এক কথায় বলুন— আপনাদের হাট থেকে বিলিতি মাল আপনারা সরাবেন না?

 আমি বললুম, না, সরাব না। কারণ, সে মাল আমার নয়।

 এম. এ. ক্লাসের ছাত্রটি ঈষৎ হেসে বললে, কারণ, তাতে আপনার লােকসান আছে?

 মাস্টারমশায় বললেন, হাঁ, তাতে ওঁর লােকসান আছে। সুতরাং সে উনিই বুঝবেন।

 তখন ছাত্রেরা সকলে উচ্চস্বরে ‘বন্দে মাতরং’ বলে চীৎকার করে বেরিয়ে গেল।

 এর কিছুদিন পরেই মাস্টারমশায় পঞ্চুকে আমার কাছে নিয়ে এসে উপস্থিত। ব্যাপার কী?

 ওদের জমিদার হরিশ কুণ্ডু পঞ্চুকে একশাে টাকা জরিমানা করেছে।

 কেন, ওর অপরাধ কী?

 ও বিলিতি কাপড় বেচেছে। ও জমিদারকে গিয়ে হাতে পায়ে ধরে বললে, পরের কাছে ধার-করা টাকায় কাপড় কখানা কিনেছে, এইগুলাে বিক্রি হয়ে গেলেই ও এমন কাজ আর কখনাে করবে না। জমিদার বললে, সে হচ্ছে না, আমার সামনে কাপড়গুলাে পুড়িয়ে ফেল্ তবে ছাড়া পাবি। ও থাকতে না পেরে হঠাৎ বলে ফেললে, আমার তাে সে সামর্থ্য নেই, আমি গরিব; আপনার যথেষ্ট আছে, আপনি দাম দিয়ে কিনে নিয়ে পুড়িয়ে ফেলুন। শুনে জমিদার লাল হয়ে উঠে বললে, হারামজাদা, কথা কইতে শিখেছ বটে! লাগাও জুতি! এই বলে এক-চোট অপমান তাে হয়েই গেল, তার পরে একশাে টাকা জরিমানা। এরাই সন্দীপের পিছনে পিছনে চীৎকার করে বেড়ায়, বন্দে মাতরং। এরা দেশের সেবক!

 কাপড়ের কী হল?

 পুড়িয়ে ফেলেছে।

 সেখানে আর কে ছিল?

 লােকের সংখ্যা ছিল না, তারা চীৎকার করতে লাগল, বন্দে মাতরং! সেখানে সন্দীপ ছিলেন, তিনি একমুঠো ছাই তুলে নিয়ে বললেন, ভাই-সব, বিলিতি ব্যাবসার অন্ত্যেষ্টিসৎকারে তােমাদের গ্রামে এই প্রথম চিতার আগুন জ্বলল। এই ছাই পবিত্র। এই ছাই গায়ে মেখে ম্যাঞ্চেস্টারের জাল কেটে ফেলে নাগা সন্ন্যাসী হয়ে তােমাদের সাধনা করতে বেরােতে হবে।

 আমি পঞ্চুকে বললুম, পঞ্চু, তােমাকে ফৌজদারি করতে হবে।

 পঞ্চু বললে, কেউ সাক্ষি দেবে না।

 কেউ সাক্ষি দেবে না? সন্দীপ! সন্দীপ!

 সন্দীপ তার ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বললে, কী, ব্যাপারটা কী?

 এই লােকটার কাপড়ের বস্তা ওর জমিদার তােমার সামনে পুড়িয়েছে, তুমি সাক্ষি দেবে না?

 সন্দীপ হেসে বলে, দেব বৈকি। কিন্তু, আমি যে ওর জমিদারের পক্ষে সাক্ষী।

 আমি বললুম, সাক্ষী আবার জমিদারের পক্ষে কী? সাক্ষী তাে সত্যের পক্ষে।

 সন্দীপ বললে, যেটা ঘটেছে সেটাই বুঝি একমাত্র সত্য?

 আমি জিজ্ঞাসা করলুম, অন্য সত্যটা কী?

 সন্দীপ বললে, যেটা ঘটা দরকার। যে সত্যকে আমাদের গড়ে তুলতে হবে। সেই সত্যের জন্যে অনেক মিথ্যে চাই— যেমন মায়া দিয়ে এই জগৎ গড়া হচ্ছে। পৃথিবীতে যারা সৃষ্টি করতে এসেছে তারা সত্যকে মানে না, তারা সত্যকে বানায়।

 অতএব?

 অতএব, তােমরা যাকে মিথ্যে সাক্ষি বলাে আমি সেই মিথ্যে সাক্ষি দেব। যারা রাজ্য বিস্তার করেছে, সাম্রাজ্য গড়েছে, সমাজ বেঁধেছে, ধর্মসম্প্রদায় স্থাপন করেছে, তারাই তােমাদের বাঁধা সত্যের আদালতে বুক ফুলিয়ে মিথ্যে সাক্ষি দিয়ে এসেছে। যারা শাসন করবে তারা মিথ্যেকে ডরায় না, যারা শাসন মানবে তাদের জন্যেই সত্যের লােহার শিকল। তােমরা কি ইতিহাস পড় নি? তােমরা কি জান না, পৃথিবীর বড়াে বড়াে রান্নাঘরে যেখানে রাষ্ট্রযজ্ঞে পলিটিক্সের খিচুড়ি তৈরি হচ্ছে সেখানে মশলাগুলাে সব মিথ্যে?

 জগতে অনেক খিচুড়ি পাকানাে হয়েছে, এখন—

 না গাে, তােমরা খিচুড়ি পাকাবে কেন, তোমাদের টুঁটি চেপে ধরে খিচুড়ি গেলাবে। বঙ্গবিভাগ করবে, বলবে তােমাদের সুবিধার জন্যেই। শিক্ষার দরজা এঁটে বন্ধ করতে থাকবে, বলবে তােমাদেরই আদর্শ অত্যুচ্চ করে তােলবার সদভিপ্রায়ে। তােমরা সাধু হয়ে অশ্রুপাত করতে থাকবে, আর আমরা অসাধু হয়ে মিথ্যে দুর্গ শক্ত করে বানাব। তােমাদের অশ্রু টিঁকবে না, কিন্তু আমাদের দুর্গ টিকবে।

 মাস্টারমশায় আমাকে বললেন, এ-সব তর্ক করবার কথা নয়, নিখিল। আমাদের ভিতরেই এবং সকলের মূলেই যে একটি বিরাট সত্য আছে এ কথা যে লােক নিজের ভেতর থেকেই উপলব্ধি না করতে পারে সে লােক কেমন করে বিশ্বাস করবে যে, সেই অন্তরতম সত্যকেই সমস্ত আবরণ মােচন করে প্রকাশ করাই মানুষের চরম লক্ষ্য, বাইরের জিনিসকে স্তূপাকার করে তােলা লক্ষ্য নয়।

 সন্দীপ হেসে উঠে বললে, আপনার এ কথা মাস্টারমশায়ের মতাে কথাই হয়েছে। এসব কেবল বইয়ের পাতায় দেখা যায়, চোখের পাতায় দেখছি বাইরের জিনিসকে স্তূপাকার করে তােলাই মানুষের চরম লক্ষ্য। আর, সেই লক্ষ্যকে যারা বড়াে রকম করে সাধন করেছে তারা ব্যাবসার বিজ্ঞাপনে প্রতিদিন বড়াে অক্ষরে মিথ্যা কথা বলে, তারা রাষ্ট্রনীতির সদর-খাতায় খুব মােটা কলমে জাল হিসাব লেখে, তাদের খবরের কাগজ মিথ্যার বােঝাই জাহাজ, আর মাছি যেমন করে সান্নিপাতিক জ্বরের বীজ বহন করে তাদের ধর্মপ্রচারকেরা তেমনি করে মিথ্যাকে ছড়িয়ে ছড়িয়ে বেড়ায়। আমি তাদেরই শিষ্য— আমি যখন কংগ্রেসের দলে ছিলুম তখন আমি বাজার বুঝে আধ সের সত্যে সাড়ে-পনেরাে সের জল মেশাতে কিছুমাত্র লজ্জা করি নি। আজ আমি সে দল থেকে বেরিয়ে এসেছি, আজও আমি এই ধর্মনীতিকেই সার জেনেছি যে, সত্য মানুষের লক্ষ্য নয়, লক্ষ্য হচ্ছে ফললাভ।

 মাস্টার-মশায় বললেন, সত্যফল-লাভ।

 সন্দীপ বলল, হাঁ, সেই ফসল মিথ্যের আবাদে তবে ফলে। পায়ের নীচের মাটি একেবারে গুঁড়িয়ে ধুলাে করে দিয়ে তবে সেই ফসল ফলে। আর, যা সত্য, যা আপনি জন্মায়, সে হচ্ছে আগাছা, কাঁটাগাছ; তার থেকেই যারা ফলের আশা করছে তারা কীটপতঙ্গের দল।

 এই বলেই সন্দীপ বেগে বেরিয়ে চলে গেল। মাস্টারমশায় একটু হেসে আমার দিকে চেয়ে বললেন, জান নিখিল? সন্দীপ অধার্মিক নয়, ও বিধার্মিক। ও অমাবস্যার চাঁদ; চাঁদই বটে, কিন্তু ঘটনাক্রমে পূর্ণিমার উলটো দিকে গিয়ে পড়েছে।

 আমি বললুম, সেইজন্যে চিরদিনই ওর সঙ্গে আমার মতের মিল নেই, কিন্তু ওর প্রতি আমার স্বভাবের আকর্ষণ আছে। ও আমার অনেক ক্ষতি করেছে, আরাে করবে, কিন্তু ওকে আমি অশ্রদ্ধা করতে পারি নে।

 তিনি বললেন, সে আমি ক্রমে বুঝতে পারছি। আমি অনেক দিন আশ্চর্য হয়ে ভেবেছি সন্দীপকে এতদিন তুমি কেমন করে সহ্য করে আছ। এমন-কি, এক-এক দিন আমার সন্দেহ হয়েছে, এর মধ্যে তােমার দুর্বলতা আছে। এখন দেখতে পাচ্ছি, ওর সঙ্গে তােমার কথারই মিল নেই, কিন্তু ছন্দের মিল রয়েছে।

 আমি কৌতুক করে বললুম, মিত্রে মিত্রে মিলে অমিত্রাক্ষর। হয়তাে আমাদের ভাগ্যকবি ‘প্যারাডাইস লস্ট’এর মতাে একটা এপিক লেখবার সংকল্প করেছেন।

 মাস্টারমশায় বললেন, এখন পঞ্চুকে নিয়ে কী করা যায়।

 আমি বললুম, আপনি বলেছিলেন, যে বিঘে-কয়েক জমির উপর পঞ্চুর বাড়ি আছে সেটাতে অনেক দিন থেকে ওর মৌরসি স্বত্ব জন্মেছে, সেই স্বত্ব কাঁচিয়ে দেবার জন্যে ওর জমিদার অনেক চেষ্টা করেছে। ওর সেই জমিটা আমি কিনে নিয়ে সেইখানেই ওকে আমার প্রজা করে রেখে দিই।

 আর, ওর একশাে টাকার জরিমানা?

 সে জরিমানার টাকা কিসের থেকে আদায় হবে? জমি যে আমার হবে।

 আর, ওর কাপড়ের বস্তা?

 আমি আনিয়ে দিচ্ছি। আমার প্রজা হয়ে ও যেমন ইচ্ছে বিক্রি করুক, দেখি ওকে কে বাধা দেয়।

 পঞ্চু হাত জোড় করে বললে, হুজুর, রাজায় রাজায় লড়াই— পুলিসের দারােগা থেকে উকিল ব্যারিস্টার পর্যন্ত শকুনি-গৃধিনীর পাল জমে যাবে; সবাই দেখে আমােদ করবে, কিন্তু মরবার বেলায় আমিই মরব।

 কেন, তাের কী করবে?

 ঘরে আমার আগুন লাগিয়ে দেবে, ছেলেমেয়ে সুদ্ধু নিয়ে পুড়ব।

 মাস্টারমশায় বললেন, আচ্ছা, তাের ছেলেমেয়েরা কিছুদিন আমার ঘরেই থাকবে; তুই ভয় করিস নে। তাের ঘরে বসে তুই যেমন ইচ্ছে ব্যবসা কর, কেউ তাের গায়ে হাত দিতে পারবে না। অন্যায়ের কাছে তুই হার মেনে পালাবি, এ আমি হতে দেব না। যত সইব বােঝা ততই বাড়বে।

 সেইদিনই পঞ্চুর জমি কিনে রেজেস্ট্রি করে আমি দখল করে বসলুম। তার পর থেকে ঝুটোপুটি চলল।

 পঞ্চর বিষয়সম্পত্তি ওর মাতামহের। পঞ্চু ছাড়া তার ওয়ারেশ কেউ ছিল না, এই কথাই সকলের জানা। হঠাৎ কোথা থেকে এক মামী এসে জুটে জীবনস্বত্বের দাবি করে তার পুঁটুলি, তার প্যাট্‌রা, হরিনামের ঝুলি এবং একটি প্রাপ্তবয়স্ক বিধবা ভাইঝি নিয়ে পঞ্চুর ঘরের মধ্যে উপস্থিত।

 পঞ্চু অবাক হয়ে বললে, আমার মামী তাে বহুকাল হল মারা গেছে।

 তার উত্তর, প্রথম পক্ষের মামী মারা গেছে বটে, কিন্তু দ্বিতীয় পক্ষের তাে অভাব হয় নি।

 কিন্তু মামার মৃত্যুর অনেক পরে যে মামী মরেছে দ্বিতীয় পক্ষের তাে সময় ছিল না।

 স্ত্রীলোেকটি স্বীকার করলে দ্বিতীয় পক্ষটি মৃত্যুর পরের নয়, মৃত্যুর পূর্বের। সতীনের ঘর করবার ভয়ে বাপের বাড়ি ছিল, স্বামীর মৃত্যুর পরে প্রবল বৈরাগ্যে সে বৃন্দাবন চলে যায়। কুণ্ডু-জমিদারের আমলারা এ-সব কথা কেউ কেউ জানে, বােধ করি প্রজাদেরও কারাে কারাে জানা আছে, আর জমিদার যদি জোরে হাঁক দেয় তবে বিবাহের সময়ে যারা নিমন্ত্রণ খেয়েছিল তারাও বেরিয়ে আসতে পারে।

 সেদিন দুপুরবেলা পঞ্চুর এই দুর্‌গ্রহ নিয়ে যখন আমি খুব ব্যস্ত আছি এমন সময় অন্তঃপুর থেকে বিমলা আমাকে ডেকে পাঠালেন।

 আমি চমকে উঠলুম; জিজ্ঞাসা করলুম, কে ডাকছে?

 বললে, রানীমা।

 বড়ােরানীমা?

 না, ছােটোরানীমা।

 ছােটোরানী! মনে হল, একশাে বছর ছােটোরানী আমাকে ডাকে নি। বৈঠকখানা-ঘরে সবাইকে বসিয়ে রেখে আমি অন্তঃপুরে চললুম। শোবার ঘরে বিমলাকে দেখে আরাে আশ্চর্য হলুম যখন দেখা গেল, সর্বাঙ্গে বেশি নয় অথচ বেশ একটু, সাজের আভাস আছে। কিছুদিন এই ঘরটার মধ্যেও যত্নের লক্ষণ দেখি নি, সব এমন এলােমেলাে হয়ে গিয়েছিল যে মনে হত যেন ঘরটা সুদ্ধ অন্যমনস্ক হয়ে গেছে। ওরই মধ্যে আগেকার মতাে আজ একটু পারিপাট্য দেখতে পেলুম।

 আমি কিছু না বলে বিমলার মুখের দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে রইলুম। বিমলার মুখ একটু লাল হয়ে উঠল; সে ডান হাত দিয়ে তার বাঁ হাতের বালা দ্রুত বেগে ঘােরাতে ঘােরাতে বলল, দেখাে, সমস্ত বাংলাদেশের মধ্যে কেবল আমাদের এই হাটটার মধ্যেই বিলিতি কাপড় আসছে, এটা কি ভালাে হচ্ছে?

 আমি জিজ্ঞাসা করলুম, কী করলে ভালাে হয়?

 ঐ জিনিসগুলাে বের করে দিতে বলাে-না।

 জিনিসগুলাে তাে আমার নয়।

 কিন্তু, হাট তাে তােমার।

 হাট আমার চেয়ে তাদের অনেক বেশি যারা ঐ হাটে জিনিস কিনতে আসে।

 তারা দিশি জিনিস কিনুক-না।

 যদি কেনে তাে আমি খুশি হব, কিন্তু যদি না কেনে?

 সে কী কথা! ওদের এত বড় আস্পর্ধা হবে? তুমি হলে—

 আমার সময় অল্প, এ নিয়ে তর্ক করে কী হবে? আমি অত্যাচার করতে পারব না।

 অত্যাচার তাে তােমার নিজের জন্যে নয়, দেশের জন্যে—

 দেশের জন্যে অত্যাচার করা দেশের উপরেই অত্যাচার করা। সে কথা তুমি বুঝতে পারবে না।

 এই বলে আমি চলে এলুম। হঠাৎ আমার চোখের সামনে সমস্ত জগৎ যেন দীপ্যমান হয়ে উঠল। মাটির পৃথিবীর ভার যেন চলে গেছে, সে যে আপনার জীবপালনের সমস্ত কাজ করেও আপনার নিরন্তর বিকাশের সমস্ত পর্যায়ের ভিতরেও একটি অদ্ভুত শক্তির বেগে দিনরাত্রিকে জপমালার মতাে ফেরাতে ফেরাতে যুগে যুগে আকাশের মধ্যে ছুটে চলেছে, সেইটে আমি আমার রক্তের মধ্যে অনুভব করলুম। কর্মভারের সীমা নেই, অথচ মুক্তিবেগেরও সীমা নেই। কেউ বাঁধবে না, কেউ বাঁধবে না, কিছুতেই বাঁধবে না। অকস্মাৎ আমার মনের গভীরতা থেকে একটা বিপুল আনন্দ যেন সমুদ্রের জলস্তম্ভের মতাে আকাশের মেঘকে গিয়ে স্পর্শ করলে।

 নিজেকে বার বার জিজ্ঞেস করলুম, হঠাৎ তােমার এ হল কী?

 প্রথমটা স্পষ্ট উত্তর পাওয়া গেল না; তার পরে পরিষ্কার বুঝলুম, এই কয়দিন যে বন্ধন দিনরাত আমার মনের ভিতরে এমন পীড়া দিয়েছে আজ তার একটা মস্ত ফাঁক দেখা গেল। আমি ভারি আশ্চর্য হলুম, আমার মনের মধ্যে কোনাে ঘাের ছিল না। ফোটোগ্রাফের প্লেটে যেরকম করে ছবি পড়ে আমার দৃষ্টিতে বিমলার সমস্ত কিছু তেমনি করে অঙ্কিত হল। আমি স্পষ্ট করে দেখতে পেলুম, বিমলা আমার কাছ থেকে কাজ আদায় করবার জন্যে বিশেষ করে সাজ করেছে। আজকের দিনের পূর্ব পর্যন্ত আমি কখনােই বিমলাকে এবং বিমলার সাজকে তফাত করে দেখি নি। আজ ওর বিলিতি খোঁপার চূড়াকে কেবলমাত্র চুলের কুণ্ডলী বলেই দেখলুম; শুধু তাই নয়, একদিন এই খোঁপা আমার কাছে অমূল্য ছিল— আজ দেখি এ সস্তা দামে বিকোবার জন্যে প্রস্তুত।

 সন্দীপের সঙ্গে আমার দেশ নিয়ে পদে পদে বিরোধ হয়, কিন্তু সে সত্যকার বিরোধ। কিন্তু বিমলা দেশের নাম করে যে কথাগুলো বলছে সে কেবলমাত্র সন্দীপের ছায়া দিয়ে গড়া, আইডিয়া দিয়ে নয়; এই ছায়ার যদি বদল হয় ওর কথারও বদল হবে। এই সমস্তই আমি খুব স্বচ্ছ করে দেখলুম, লেশমাত্র কুয়াশা কোথাও ছিল না।

 আমার সেই শোবার ঘরের ভাঙা খাঁচাটির ভিতর থেকে যখন সেই হেমন্ত-মধ্যাহ্নের খোলা আলোর মধ্যে বেরিয়ে এলুম তখন একদল শালিখ আমার বাগানের গাছের তলায় অকস্মাৎ কী কারণে ভারি উত্তেজনার সঙ্গে কিচিমিচি বাধিয়েছে; বারান্দার সামনে দক্ষিণে খোওয়া-ফেলা রাস্তার দুই ধারে সারি সারি কাঞ্চনগাছ অজস্র গোলাপি ফুলের মুখরতায় আকাশকে অভিভূত করে দিয়েছে; অদূরে মেঠো পথের প্রান্তে শূন্য গোরুর গাড়ি আকাশে পুচ্ছ তুলে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে; তারই বন্ধনমুক্ত জোড়া গোরুর মধ্যে একটা ঘাস খাচ্ছে, আর-একটা রৌদ্রে শুয়ে পড়ে আছে আর তার পিঠের উপর একটা কাক ঠোকর মেরে মেরে কীট উদ্ধার করছে— আরামে গোরুটার চোখ বুজে এসেছে। আজ আমার মনে হল, বিশ্বের এই যা-কিছু খুব সহজ অথচ অত্যন্ত বৃহৎ আমি তারই স্পন্দিত বক্ষের খুব কাছে এসে বসেছি, তারই আতপ্ত নিশ্বাস ঐ কাঞ্চনফুলের গন্ধের সঙ্গে মিশে আমার হৃদয়ের উপরে এসে পড়েছে। আমার মনে হল, আমি আছি এবং সমস্তই আছে এই দুইয়ে মিলে আকাশ জুড়ে যে সংগীত বাজছে সে কী উদার, কী গভীর, কী অনির্বচনীয় সুন্দর।

 তার পরে মনে পড়ল, দারিদ্র্য এবং চাতুরীর ফাঁদে আটকা-পড়া পঞ্চু; সেই পঞ্চুকে যেন দেখলুম আজ হেমন্তের রৌদ্রে বাংলার সমস্ত উদাস মাঠ বাট জুড়ে ঐ গোরুটার মতো চোখ বুজে পড়ে আছে— কিন্তু আরামে নয়, ক্লান্তিতে, ব্যাধিতে, উপবাসে। সে যেন বাংলার সমস্ত গরিব রায়তের প্রতিমূর্তি। দেখতে পেলুম, পরম আচারনিষ্ঠ ফোঁটা-কাটা স্থূলতনু হরিশ কুণ্ডু; সেও ছোটো নয়, সেও বিরাট, সে যেন বাঁশবনের তলায় বহুকালের বদ্ধ পচা দিঘির উপর তেলা সবুজ একটা অখণ্ড সরের মতো এ পার থেকে ও পার পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে ক্ষণে ক্ষণে বিষবুদ্‌বুদ্‌ উদ্‌গার করছে।

 যে প্রকাণ্ড তামসিকতা এক দিকে উপবাসে কৃশ, অজ্ঞানে অন্ধ, অবসাদে জীর্ণ, আর-এক দিকে মুমূর্ষুর রক্তশোষণে স্ফীত হয়ে আপনার অবিচলিত জড়ত্বের তলায় ধরিত্রীকে পীড়িত করে পড়ে আছে, শেষ পর্যন্ত তার সঙ্গে লড়াই করতে হবে— এই কাজটা মুলতবি হয়ে পড়ে রয়েছে শত শত বৎসর ধরে। আমার মোহ ঘুচুক, আমার আবরণ কেটে যাক, আমার পৌরুষ অন্তঃপুরের স্বপ্নের জালে ব্যর্থ হয়ে জড়িয়ে পড়ে থাকে না যেন। আমরা পুরুষ, মুক্তিই আমাদের সাধনা; আইডিয়ালের ডাক শুনে আমরা সামনের দিকে ছুটে চলে যাব, দৈত্যপুরীর দেয়াল ডিঙিয়ে বন্দিনী লক্ষ্মীকে আমাদের উদ্ধার করে আনতে হবে— যে মেয়ে তার নিপুণ হাতে আমাদের সেই অভিযানের জয়পতাকা তৈরি করে দিচ্ছে সেই আমাদের সহধর্মিণী। আর, ঘরের কোণে যে আমাদের মায়াজাল বুনছে তার ছদ্মবেশ ছিন্ন করে তার মোহমুক্ত সত্যকার পরিচয় যেন পাই, তাকে আমাদের নিজেরই কামনার রসে রঙে অপ্সরী সাজিয়ে তুলে যেন নিজের তপস্যাভঙ্গ করতে না পাঠাই। আজ আমার মনে হচ্ছে, আমার জয় হবে— আমি সহজের রাস্তায় দাঁড়িয়েছি। সহজ চোখে সব দেখছি। আমি মুক্তি পেয়েছি, আমি মুক্তি দিলুম। যেখানে আমার কাজ সেইখানেই আমার উদ্ধার।

 আমি জানি, বেদনায় বুকের নাড়ীগুলা আবার এক-এক দিন টন্ টন্ করে উঠবে। কিন্তু সেই বেদনাকেও আমি এবার চিনে নিয়েছি। তাকে আমি আর শ্রদ্ধা করতে পারব না। আমি জানি, সে কেবলমাত্রই আমার; তার দাম কিসের! যে দুঃখ বিশ্বের সেই তো আমার গলার হার হবে। হে সত্য, বাঁচাও, আমাকে বাঁচাও; কিছুতেই আমাকে ফিরে যেতে দিয়ো না ছলনার ছদ্মস্বর্গলোকে। আমাকে একলা-পথের পথিক যদি কর সে পথ তোমারই পথ হোক; আমার হৃৎপিণ্ডের মধ্যে তোমার জয়ভেরী বেজেছে আজ।