ঘরে-বাইরে/১৭
নিখিলেশের আত্মকথা
আজ আমরা কলকাতায় যাব। সুখদুঃখ কেবলই জমিয়ে তুলতে থাকলে বােঝা ভারী হয়ে ওঠে। কেননা, বসে থাকাটা মিথ্যে, সঞ্চয় করাটা মিথ্যে। আমি যে এই ঘরের কর্তা এটা বানানাে জিনিস, সত্য এই যে, আমি জীবন-পথের পথিক। ঘরের কর্তাকে তাই বারে বারে ঘা লাগবে, তার পরে শেষ আঘাত আছে মৃত্যু। তােমার সঙ্গে আমার যে মিলন সে মিলন চলার মুখে— যত দূর পর্যন্ত এক পথে চলা গেল তত দূর পর্যন্তই ভালাে, তার চেয়ে বেশি টানাটানি করতে গেলেই মিলন হবে বাঁধন। সে বাঁধন আজ রইল পড়ে, এবার বেরিয়ে পড়লুম চলতে চলতে যেটুকু চোখে চোখে মেলে, হাতে হাতে ঠেকে, সেইটুকুই ভালাে। তার পরে? তার পরে আছে অনন্ত জগতের পথ, অসীম জীবনের বেগ। তুমি আমাকে কতটুকু বঞ্চনা করতে পার প্রিয়ে। সামনে যে বাঁশি বাজছে কান দিয়ে যদি শুনি তাে শুনতে পাই, বিচ্ছেদের সমস্ত ফাটলগুলাের ভিতর দিয়ে তার মাধুর্যের ঝর্না ঝরে পড়ছে। লক্ষ্মীর অমৃতভাণ্ডার ফুরােবে না বলেই মাঝে মাঝে তিনি আমাদের পাত্র ভেঙে দিয়ে কাঁদিয়ে হাসেন। আমি ভাঙা পাত্র কুড়ােতে যাব না, আমি আমার অতৃপ্তি বুকে নিয়েই সামনে চলে যাব।
মেজোরানীদিদি এসে বললেন, ঠাকুরপাে, তােমার বইগুলাে সব বাক্স ভরে গােরুর গাড়ি বােঝাই করে যে চলল তার মানে কী বলাে তাে?
আমি বললুম, তার মানে ঐ বইগুলাের উপর থেকে এখনাে মায়া কাটাতে পারি নি।
মায়া কিছু কিছু থাকলেই যে বাঁচি। কিন্তু, এখানে আর ফিরবে না নাকি?
আনাগােনা চলবে, কিন্তু পড়ে থাকা আর চলবে না।
সত্যি নাকি? তা হলে একবার এসাে, একবার দেখাে’সে কত জিনিসের উপরে আমার মায়া।
এই বলে আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলেন। তাঁর ঘরে গিয়ে দেখি ছোটো-বড়াে নানা রকমের বাক্স আর পুঁটুলি। একটা বাক্স খুলে দেখালেন, এই দেখাে ঠাকুরপাে, আমার পান সাজার সরঞ্জাম। কেয়াখয়ের গুঁড়িয়ে বােতলের মধ্যে পুরেছি, এই-সব দেখছ এক-এক টিন মসলা। এই দেখাে তাস, দশ-পঁচিশও ভুলি নি; তোমাদের না পাই আমি খেলবার লোক জুটিয়ে নেবই। এই চিরুনি তোমারই স্বদেশী চিরুনি, আর এই—
কিন্তু, ব্যাপারটা কী মেজোরানী? এ-সব বাক্সয় তুলেছ কেন?
আমি যে তোমাদের সঙ্গে কলকাতায় যাচ্ছি।
সেকি কথা!
ভয় নেই ভাই, ভয় নেই। তোমার সঙ্গেও ভাব করতে যাব না, ছোটোরানীর সঙ্গেও ঝগড়া করব না। মরতেই তো হবে, তাই সময় থাকতে গঙ্গাতীরের দেশে আশ্রয় নেওয়া ভালো। ম’লে তোমাদের সেই নেড়াবটতলায় পোড়াবে সে কথা মনে হলে আমার মরতে ঘেন্না ধরে— সেইজন্যেই তো এতদিন ধরে তোমাদের জ্বালাচ্ছি।
এতক্ষণ পরে আমার এই বাড়ি যেন কথা কয়ে উঠল। আমার বয়স যখন ছয় বছর তখন ন বছর বয়সে মেজোরানী আমাদের এই বাড়িতে এসেছেন। এই বাড়ির ছাদে দুপুরবেলায় উঁচু পাঁচিলের কোণের ছায়ায় বসে ওঁর সঙ্গে খেলা করেছি। বাগানে আমড়াগাছে চড়ে উপর থেকে কাঁচা আমড়া ফেলেছি, তিনি নীচে বসে সেগুলি কুচি-কুচি করে তার সঙ্গে নুন লঙ্কা ধনেশাক মিশিয়ে অপথ্য তৈরি করেছেন। পুতুলের বিবাহের ভোজ উপলক্ষে যে-সব উপকরণ ভাঁড়ার ঘর থেকে গোপনে সংগ্রহ করার প্রয়োজন ছিল তার ভার ছিল আমারই উপরে, কেননা ঠাকুরমার বিচারে আমার কোনো অপরাধের দণ্ড ছিল না। তার পরে যে-সব শৌখিন জিনিসের জন্যে দাদার পরে তাঁর আবদার ছিল সে আবদারের বাহক ছিলুম আমি; আমি দাদাকে বিরক্ত করে করে যেমন করে হক কাজ উদ্ধার করে আনতুম। তার পরে মনে পড়ে, তখনকার দিনে জ্বর হলে কবিরাজের কঠোর শাসনে তিন দিন কেবল গরম জল আর এলাচ-দানা আমার পথ্য ছিল; মেজোরানী আমার দুঃখ সইতে পারতেন না, কতদিন লুকিয়ে লুকিয়ে আমাকে খাবার এনে দিয়েছেন। এক-এক দিন ধরা পড়ে তাঁকে ভর্ৎসনাও সইতে হয়েছে। তার পরে বড়ো হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সুখ-দুঃখের রঙ নিবিড় হয়ে উঠেছে, কত ঝগড়াও হয়েছে; বিষয়ব্যাপার নিয়ে মাঝে মাঝে অনেক ঈর্ষা সন্দেহ এবং বিরোধও এসে পড়েছে; আবার তার মাঝখানে বিমল এসে পড়ে কখনো কখনো এমন হয়েছে যে, মনে হয়েছে বিচ্ছেদ বুঝি আর জুড়বে না। কিন্তু তার পরে প্রমাণ হয়েছে, অন্তরের মিল সেই বাইরের ক্ষতের চেয়ে অনেক প্রবল। এমনি করে শিশুকাল থেকে আজ পর্যন্ত একটি সত্য সম্বন্ধ দিনে দিনে অবিচ্ছিন্ন হয়ে জেগে উঠেছে; সেই সম্বন্ধের শাখা-প্রশাখা এই বৃহৎ বাড়ির সমস্ত ঘরে আঙিনায় বারান্দায় ছাদে বাগানে তার ছায়া ছড়িয়ে দিয়ে তার সমস্তকে অধিকার করে দাঁড়িয়েছে। যখন দেখলুম, মেজোরানী তাঁর সমস্ত ছোটোখাটো জিনিসপত্র গুছিয়ে বাক্স বোঝাই করে আমাদের বাড়ির থেকে যাবার মুখ করে দাঁড়িয়েছেন, তখন এই চিরসম্বন্ধটির সমস্ত শিকড়গুলি পর্যন্ত আমার হৃদয়ের মধ্যে যেন শিউরে উঠল। আমি বেশ বুঝতে পারলুম, কেন মেজোরানী, যিনি ন বছর বয়স থেকে আর এ পর্যন্ত কখনো একদিনের জন্যেও এ বাড়ি ছেড়ে বাইরে কাটান নি, তিনি তাঁর সমস্ত অভ্যাসের বাঁধন কেটে ফেলে অপরিচিতের মধ্যে ভেসে চললেন। অথচ সেই আসল কারণটির কথা মুখ ফুটে বলতেই চান না, অন্য কত রকমের তুচ্ছ ছুতো তোলেন। এই ভাগ্যকর্তৃক বঞ্চিত পতিপুত্রহীনা নারী সংসারের মধ্যে কেবল এই একটিমাত্র সম্বন্ধকে নিজের হৃদয়ের সমস্ত সঞ্চিত অমৃত দিয়ে পালন করেছেন, তাঁর বেদনা যে কত গভীর সে আজ তাঁর এই ঘরময় ছড়াছড়ি বাক্সপুঁটুলির মধ্যে দাঁড়িয়ে যত স্পষ্ট করে বুঝলুম এমন আর কোনোদিন বুঝি নি। আমি বুঝেছি, টাকাকড়ি, ঘর-দুয়ারের ভাগ নিয়ে, ছোটোখাটো সামান্য সাংসারিক খুঁটিনাটি নিয়ে বিমলের সঙ্গে, আমার সঙ্গে তাঁর যে বার বার ঝগড়া হয়ে গেছে তার কারণ বৈষয়িকতা নয়, তার কারণ তাঁর জীবনের এই একটিমাত্র সম্বন্ধে তাঁর দাবি তিনি প্রবল করতে পারেন নি— বিমল কোথা থেকে হঠাৎ মাঝখানে এসে একে ম্লান করে দিয়েছে— এইখানে তিনি নড়তে-চড়তে ঘা পেয়েছেন, অথচ তাঁর নালিশ করবার জোর ছিল না। বিমলও একরকম করে বুঝেছিল, আমার উপর মেজোরানীর দাবি কেবলমাত্র সামাজিকতার দাবি নয়, তার চেয়ে অনেক বেশি গভীর; সেইজন্যে আমাদের এই আশৈশবের সম্পর্কটির ’পরে তার এতটা ঈর্ষা। আজ বুকের দরজাটার কাছে আমার হৃদয় ধক্ ধক্ করে ঘা দিতে লাগল। একটা তোরঙ্গের উপর বসে পড়লুম। বললুম, মেজোরানীদিদি, আমরা দুজনেই এই বাড়িতে যেদিন নতুন দেখা দিয়েছি সেইদিনের মধ্যে আর-একবার ফিরে যেতে বড়ো ইচ্ছে করে।
মেজোরানী একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন, না ভাই, মেয়ে-জন্ম নিয়ে আর নয়। যা সয়েছি তা একটা-জন্মের উপর দিয়ে যাক, ফের আর কি সয়?
আমি বলে উঠলুম, দুঃখের ভিতর দিয়ে যে মুক্তি আসে সেই মুক্তি দুঃখের চেয়ে বড়ো।
তিনি বললেন, তা হতে পারে ঠাকুরপো, তোমরা পুরুষ-মানুষ, মুক্তি তোমাদের জন্যে। আমরা মেয়েরা বাঁধতে চাই, বাঁধা পড়তে চাই— আমাদের কাছ থেকে তােমরা সহজে ছাড়া পাবে না গাে! ডানা যদি মেলতে চাও আমাদের সুদ্ধু নিতে হবে, ফেলতে পারবে না। সেইজন্যেই তাে এই-সব বােঝা সাজিয়ে রেখেছি। তােমাদের একেবারে হালকা হতে দিলে কি আর রক্ষা আছে!
আমি হেসে বললুম, তাই তাে দেখছি, বােঝা বলে বেশ স্পষ্টই বােঝা যাচ্ছে। কিন্তু এই বােঝা বইবার মজুরি তােমরা পুষিয়ে দাও বলেই আমরা নালিশ করি নে।
মেজোরানী বললেন, আমাদের বােঝা হচ্ছে ছােটো জিনিসের বােঝা। যাকেই বাদ দিতে যাবে সেই বলবে, আমি সামান্য, আমার ভার কতটুকুই বা। এমনি করে হালকা জিনিস দিয়েই আমরা তােমাদের মােট ভারী করি।— কখন বেরােতে হবে, ঠাকুরপাে?
রাত্তির সাড়ে এগারােটায়। সে এখনাে ঢের সময় আছে।
দেখাে ঠাকুরপাে, লক্ষ্মীটি, আমার একটি কথা রাখতে হবে আজ সকাল-সকাল খেয়ে নিয়ে দুপুরবেলায় একটু ঘুমিয়ে নিয়াে, গাড়িতে রাত্তিরে তাে ভালাে ঘুম হবে না। তােমার শরীর এমন হয়েছে, দেখলেই মনে হয়, আর-একটু হলেই ভেঙে পড়বে। চলাে, এখনই তােমাকে নাইতে যেতে হবে।
এমন সময় ক্ষেমা মস্ত একটা ঘােমটা টেনে মৃদুস্বরে বললে, দারােগাবাবু কাকে সঙ্গে করে এনেছে, মহারাজের সঙ্গে দেখা করতে চায়।
মেজোরানী রাগ করে উঠে বললেন, মহারাজ চোর না ডাকাত যে দারােগা তার সঙ্গে লেগেই রয়েছে! বলে আয় গে, মহারাজ এখন নাইতে গেছেন।
আমি বললুম, একবার দেখে আসি গে, হয়তাে কোনাে জরুরি কাজ আছে।
মেজোরানী বললেন, না, সে হবে না। ছােটোরানী কাল বিস্তর পিঠে তৈরি করেছে, দারােগাকে সেই পিঠে খেতে পাঠিয়ে তার মেজাজ ঠাণ্ডা করে রাখছি।
বলে তিনি আমাকে হাত ধরে টেনে স্নানের ঘরের মধ্যে ঠেলে দিয়ে বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দিলেন। আমি ভিতর থেকে বললুম, আমার সাফ কাপড় যে এখনাে—
তিনি বললেন, সে আমি ঠিক করে রাখব, ততক্ষণ তুমি স্নান করে নাও।
এই উৎপাতের শাসনকে অমান্য করি এমন সাধ্য আমার নেই। সংসারে এ যে বড়াে দুর্লভ। থাক্ গে, দারােগাবাবু বসে বসে পিঠে খাক গে। নাহয় হল আমার কাজের অবহেলা।
ইতিমধ্যে সেই ডাকাতি নিয়ে দারােগা দু-পাঁচজনকে ধরা-পাকড়া করছেই। রােজই একটা-না-একটা নিরীহ লােককে ধরে-বেঁধে এনে আসর গরম করে রেখেছে; আজও বােধ হয় তেমনি কোন্-এক অভাগাকে পাকড়া করে এনেছে। কিন্তু পিঠে কি একলা দারােগাই খাবে? সে তাে ঠিক নয়। দরজায় দমাদম ঘা লাগালুম। মেজোরানী বাইরে থেকে বললেন, জল ঢালাে, জল ঢালাে, মাথা গরম হয়ে উঠেছে বুঝি?
আমি বললুম, পিঠে দুজনের মতাে সাজিয়ে পাঠিয়ে। দারােগা যাকে চোর বলে ধরেছে পিঠে তারই প্রাপ্য; বেহারাকে বলে দিয়ো তার ভাগে যেন বেশি পড়ে।
যথাসম্ভব তাড়াতাড়ি স্নান সেরেই দরজা খুলে বেরিয়ে এলুম। দেখি, দরজার বাইরে মাটির উপরে বিমল বসে। এ কি আমার সেই বিমল, সেই তেজে অভিমানে ভরা গরবিনী! কোন্ ভিক্ষা মনের মধ্যে নিয়ে এ আমার দরজাতেও বসে থাকে। আমি একটু থমকে দাঁড়াতেই সে উঠে মুখ একটু নিচু করে আমাকে বললে, তােমার সঙ্গে আমার একটু কথা আছে।
আমি বললুম, তা হলে এসাে আমাদের ঘরে।
কোনাে বিশেষ কাজে কি তুমি বাইরে যাচ্ছ?
হাঁ, কিন্তু থাক্ সে কাজ, আগে তােমার সঙ্গে—
না, তুমি কাজ সেরে এসাে— তার পরে তােমার খাওয়া হলে কথা হবে।
বাইরে গিয়ে দেখি দারােগার পাত্র শূন্য, সে যাকে ধরে এনেছে সে তখনাে বসে বসে পিঠে খাচ্ছে।
আমি আশ্চর্য হয়ে বললুম, এ কী অমূল্য যে!
সে এক-মুখ পিঠে নিয়ে বললে, আজ্ঞে হাঁ। পেট ভরে খেয়ে নিয়েছি, এখন কিছু যদি না মনে করেন তা হলে যে ক’টা বাকি আছে রুমালে বেঁধে নিই।— বলে পিঠেগুলাে সব রুমালে বেঁধে নিলে।
আমি দারােগার দিকে চেয়ে বললুম, ব্যাপারখানা কী?
দারােগা হেসে বললে, মহারাজ, চোরের হেঁয়ালি তাে হেঁয়ালিই রয়ে গেছে, তার উপরে চোরাই মালের হেঁয়ালি নিয়ে মাথা ঘোরাচ্ছি।
এই বলে একটা ছেড়া ন্যাক্ড়ার পুঁটুলি খুলে এক-তাড়া নোট সে আমার সামনে ধরলে। বললে, এই মহারাজের ছ হাজার টাকা।
কোথা থেকে বেরােল?
আপাতত অমূল্যবাবুর হাত থেকে। উনি কাল রাত্রে আপনার চকুয়া কাছারির নায়েবের কাছে গিয়ে বললেন, চোরাই নােট পাওয়া গেছে। চুরি যেতে নায়েব এত ভয় পায় যেমন এই চোরাই মাল ফিরে পেয়ে। তার ভয় হল সবাই সন্দেহ করবে, এ নােট সেই লুকিয়ে রেখেছিল, এখন বিপদের সম্ভাবনা দেখে একটা অসম্ভব গল্প বানিয়ে তুলেছে। সে অমূল্যবাবুকে খাওয়াবার ছল করে বসিয়ে রেখেই থানায় খবর দিয়েছে। আমি ঘােড়ায় চড়ে গিয়েই ভাের থেকে ওঁকে নিয়ে পড়েছি। উনি বললেন, কোথা থেকে পেয়েছি সে আপনাকে বলব না। আমি বললুম, না বললে আপনি তাে ছাড় পাবেন না। উনি বললেন, মিথ্যে বলব। আমি বলি, আচ্ছা, তাই বলুন। উনি বলেন, ঝােপের মধ্যে থেকে কুড়িয়ে পেয়েছি। আমি বললুম, মিথ্যে কথা অত সহজ নয়; কোথায় ঝােপ, সেই ঝােপের মধ্যে আপনি কী দরকারে গিয়েছিলেন, সমস্ত বলা চাই। উনি বললেন, সে-সমস্ত বানিয়ে তােলবার আমি যথেষ্ট সময় পাব, সেজন্যে কিছু চিন্তা করবেন না।
আমি বললুম, হরিচরণবাবু, ভদ্রলােকের ছেলেকে নিয়ে মিছিমিছি টানাটানি করে কী হবে?
দারােগা বললেন, শুধু ভদ্রলােকের ছেলে নয়, উনি নিবারণ ঘােষালের ছেলে; তিনি আমার ক্লাস-ফ্রেণ্ড ছিলেন। মহারাজ, আমি আপনাকে বলে দিচ্ছি ব্যাপারখানা কী। অমূল্য জানতে পেরেছেন কে চুরি করেছে, এই বন্দে মাতরমের হুজুক উপলক্ষে তাকে উনি চেনেন। নিজের ঘাড়ে দায় নিয়ে তাকে উনি বাঁচাতে চান। এই-সব হচ্ছে ওঁর বীরত্ব। বাবা, আমাদেরও বয়েস একদিন তােমাদেরই মতাে ঐ আঠারাে-উনিশ ছিল, পড়তুম রিপন কলেজে; একদিন স্ট্যাণ্ডে একটা গােরুর গাড়ির গাড়ােয়ানকে পাহারাওয়ালার জুলুম থেকে বাঁচাবার জন্যে প্রায় জেলখানার সদর-দরজার দিকে ঝুঁকেছিলুম, দৈবাৎ ফসকে গেছে।— মহারাজ, এখন চোর ধরা পড়া শক্ত হল, কিন্তু আমি বলে রাখছি কে এর মূলে আছে।
আমি জিজ্ঞাসা করলুম, কে?
আপনার নায়েব তিনকড়ি দত্ত আর ঐ কাসেম সর্দার।
দারােগা তাঁর এই অনুমানের পক্ষে নানা যুক্তি দেখিয়ে যখন চলে গেলেন আমি অমূল্যকে বললুম, টাকাটা কে নিয়েছিল আমাকে যদি বল কারাে কোনাে ক্ষতি হবে না।
সে বললে, আমি।
কেমন করে? ওরা যে বলে ডাকাতের দল—
আমি একলা।
অমূল্য যা বললে সে অদ্ভুত। নায়েব রাত্রে আহার সেরে বাইরে বসে আঁচাচ্ছিল, সে জায়গাটা ছিল অন্ধকার। অমূল্যর দুই পকেটে দুই পিস্তল, একটাতে ফাঁকা টোটা, আর-একটাতে গুলি ভরা। ওর মুখের আধখানাতে ছিল কালাে মুখোেশ। হঠাৎ একটা বুল্স্-আই লণ্ঠনের আলাে নায়েবের মুখে ফেলে পিস্তলের ফাঁকা আওয়াজ করতেই সে হাউমাউ শব্দ করে মূর্ছা গেল। দু-চারজন বরকন্দাজ ছুটে আসতেই তাদের মাথার উপর পিস্তলের আওয়াজ করে দিলে, তারা যে যেখানে পারলে ঘরের মধ্যে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলে। কাসেম সর্দার লাঠি হাতে ছুটে এল, তার লক্ষ্য করে গুলি মারতেই সে বসে পড়ল। তার পরে ঐ নায়েবকে দিয়ে লােহার সিন্দুক খুলিয়ে ছ হাজার টাকার নােটগুলাে নিয়ে আমাদের কাছারির এক ঘােড়া মাইল পাঁচ-ছয় ছুটিয়ে সেই ঘােড়াটাকে এক জায়গায় ছেড়ে দিয়ে পরদিন সকালে আমার এখানে এসে পৌচেছে।
আমি জিজ্ঞাসা করলুম, অমূল্য, এ কাজ কেন করতে গেলে?
সে বললে, আমার বিশেষ দরকার ছিল।
তবে আবার ফিরিয়ে দিলে কেন?
যাঁর হুকুমে আমি ফিরিয়ে দিলুম তাঁকে ডাকুন, তার সামনে আমি বলব।
তিনি কে?
ছােটোরানীদিদি।
বিমলকে ডেকে পাঠালুম। তিনি একখানি সাদা শাল মাথার উপর দিয়ে ফিরিয়ে গা ঢেকে আস্তে আস্তে ঘরের মধ্যে ঢুকলেন, পায়ে জুতােও ছিল না; দেখে আমার মনে হল, বিমলকে এমন যেন আর কখনাে দেখি নি— সকালবেলাকার চাঁদের মতাে ও যেন আপনাকে প্রভাতের আলাে দিয়ে ঢেকে এনেছে।
অমূল্য বিমলের পায়ের কাছে ভূমিষ্ঠ হয়ে প্রণাম করে পায়ের ধুলাে নিলে। উঠে দাঁড়িয়ে বললে, তােমার আদেশ পালন করে এসেছি দিদি। টাকা ফিরিয়ে দিয়েছি।
বিমল বললে, বাঁচিয়েছ ভাই!
অমূল্য বললে, তােমাকে স্মরণ করেই একটি মিথ্যা কথাও বলি নি। আমার বন্দে মাতরম্ মন্ত্র রইল তােমার পায়ের তলায়। ফিরে এসে এই বাড়িতে ঢুকেই তােমার প্রসাদও পেয়েছি।
বিমলা এ কথাটা ঠিক বুঝতে পারলে না। অমূল্য পকেট থেকে রুমাল বের করে তার গ্রন্থি খুলে সঞ্চিত পিঠেগুলি দেখালে। বললে, সব খাই নি, কিছু রেখেছি— তুমি নিজের হাতে আমার পাতে তুলে দিয়ে খাওয়াবে বলে। এইগুলি জমানাে আছে।
আমি বুঝলুম, এখানে আর আমার দরকার নেই। ঘর থেকে বেরিয়ে গেলুম। মনে ভাবলুম, আমি তাে কেবল বকে বকেই মরি, আর ওরা আমার কুশপুত্তলির গলায় ছেঁড়া জুতাের মালা পরিয়ে নদীর ধারে দাহ করে। কাউকে তাে মরার পথ থেকে ফেরাতে পারি নে— যে পারে সে ইঙ্গিতেই পারে। আমাদের বাণীতে সেই অমােঘ ইঙ্গিত নেই। আমরা শিখা নই, আমরা অঙ্গার, আমরা নিবােনো, আমরা দীপ জ্বালাতে পারব না। আমার জীবনের ইতিহাসে সেই কথাটাই প্রমাণ হল, আমার সাজানাে বাতি জ্বলল না।
আবার আস্তে আস্তে অন্তঃপুরে গেলুম। বােধ হয়, আর-একবার মেজোরানীর ঘরের দিকে আমার মনটা ছুটল। আমার জীবনও এ-সংসারে কোনাে-একটা জীবনের বীণায় সত্য এবং স্পষ্ট আঘাত দিয়েছে, এটা অনুভব করা আজ আমার যে বড়াে দরকার। নিজের অস্তিত্বের পরিচয় তাে নিজের মধ্যে পাওয়া যায় না, বাইরে আর-কোথাও যে তার খোঁজ করতে হয়।
মেজোরানীর ঘরের সামনে আসতেই তিনি বেরিয়ে এসে বললেন, এই-যে ঠাকুরপাে, আমি বলি, বুঝি তােমার আজও দেরি হয়। আর দেরি নেই, তােমার খাবার তৈরি রয়েছে, এখনই আসছে।
আমি বললুম, ততক্ষণ সেই টাকাটা বের করে ঠিক করে রাখি।
আমার শােবার ঘরের দিকে যেতে যেতে মেজোরানী জিজ্ঞাসা করলেন, দারােগা যে এল, সেই চুরির কোনাে আশকারা হল নাকি?
সেই ছ হাজার টাকা ফিরে পাবার ব্যাপারটা মেজোরানীর কাছে আমার বলতে ইচ্ছে হল না। আমি বললুম, সেই নিয়েই তাে চলছে।
লােহার সিন্দুকের ঘরে গিয়ে পকেট থেকে চাবির গােছা বের করে দেখি, সিন্দুকের চাবিটাই নেই। অদ্ভুত আমার অন্যমনস্কতা! এই চাবির রিঙ নিয়ে আজ সকাল থেকে কতবার কত বাক্স খুলেছি, আলমারি খুলেছি, কিন্তু একবারও লক্ষই করি নি যে চাবিটা নেই।
মেজোরানী বললেন, চাবি কই?
আমি তার জবাব না করে বৃথা এ পকেট ও পকেট নাড়া দিলুম, দশবার করে সমস্ত জিনিসপত্র হাঁটকে খোঁজাখুঁজি করলুম। আমাদের বােঝবার বাকি রইল না যে চাবি হারায় নি, কেউ একজন রিঙ থেকে খুলে নিয়েছে। কে নিতে পারে? এ ঘরে তাে—
মেজোরানী বললেন, ব্যস্ত হােয়ো না, আগে তুমি খেয়ে নাও। আমার বিশ্বাস, তুমি অসাবধান বলেই ছােটোরানী ঐ চাবিটা বিশেষ করে তার বাক্সে তুলে রেখেছে।
আমার ভারি গােলমাল ঠেকতে লাগল। আমাকে না জানিয়ে বিমল রিঙ থেকে চাবি বের করে নেবে, এ তার স্বভাব নয়।
আমার খাবার সময় আজ বিমল ছিল না, সে তখন রান্নাঘর থেকে ভাত আনিয়ে অমূল্যকে নিজে বসে খাওয়াচ্ছিল। মেজোরানী তাকে ডাকতে পাঠাচ্ছিলেন, আমি বারণ করলুম।
খেয়ে উঠেছি এমন সময় বিমল এল। আমার ইচ্ছা ছিল, মেজোরানীর সামনে এই চাবি সরানাের কথাটার আলােচনা না হয়। কিন্তু সে আর ঘটল না। বিমল আসতেই তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ঠাকুরপাের লােহার সিন্দুকের চাবি কোথায় আছে জানিস?
বিমল বললে, আমার কাছে।
মেজোরানী বললেন, আমি তাে বলেছিলুম। চার দিকে চুরি ডাকাতি হচ্ছে, ছােটোরানী বাইরে দেখাত ওর ভয় নেই, কিন্তু ভিতরে ভিতরে সাবধান হতে ছাড়ে নি।
বিমলের মুখ দেখে মনে কেমন একটা খটকা লাগল; বললুম, আচ্ছা, চাবি এখন তােমার কাছেই থাক্, বিকেলে টাকাটা বের করে নেব।
মেজোরানী বলে উঠলেন, আবার বিকেলে কেন ঠাকুরপাে, এই বেলা ওটা বের করে নিয়ে খাজাঞ্চির কাছে পাঠিয়ে দাও।
বিমল বলল, টাকাটা আমি বের করে নিয়েছি।
চমকে উঠলুম।
মেজোরানী জিজ্ঞাসা করলেন, বের করে নিয়ে রাখলি কোথায়?
বিমল বলল, খরচ করে ফেলেছি।
মেজোরানী বললেন, ওমা, শােনাে একবার! এত টাকা খরচ করলি কিসে?
বিমল তার কোনাে উত্তর করলে না। আমিও তাকে কোনাে কথা জিজ্ঞাসা করলুম না; দরজা ধরে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলুম। মেজোরানী বিমলকে কী একটা বলতে যাচ্ছিলেন, থেমে গেলেন; আমার মুখের দিকে চেয়ে বললেন, বেশ করেছে নিয়েছে। আমার স্বামীর পকেটে বাক্সে যা-কিছু টাকা থাকত সব আমি চুরি করে লুকিয়ে রাখতুম। জানতুম সে টাকা পাঁচ ভূতে লুটে খাবে। ঠাকুরপাে, তােমারও প্রায় সেই দশা। কত খেয়ালেই যে টাকা ওড়াতে জান! তােমাদের টাকা যদি আমরা চুরি করি তবেই সে টাকা রক্ষা পাবে। এখন চলো, একটু শােবে চলো।
মেজোরানী আমাকে শােবার ঘরে ধরে নিয়ে গেলেন, আমি কোথায় চলেছি আমার মনেও ছিল না। তিনি আমার বিছানার পাশে বসে প্রফুল্লমুখে বললেন, ওলাে ও ছুটু, একটা পান দে তাে ভাই! তােরা যে একেবারে বিবি হয়ে উঠলি! পান নেই ঘরে? নাহয় আমার ঘর থেকেই আনিয়ে দে-না।
আমি বললুম, মেজোরানী, তােমার তাে এখনাে খাওয়া হয় নি?
তিনি বললেন, কোন্ কালে।
এটা একেবারে মিথ্যে কথা। তিনি আমার পাশে বসে যা-তা বকতে লাগলেন, কত রাজ্যের কত বাজে কথা। দাসী এসে দরজার বাইরে থেকে খবর দিলে, বিমলের ভাত ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে। বিমল কোনাে সাড়া দিলে না। মেজোরানী বললেন, ও কী, এখনাে তাের খাওয়া হয় নি বুঝি? বেলা যে ঢের হল এই বলে জোর করে তাকে ধরে নিয়ে গেলেন।
সেই ছ হাজার ডাকাতির সঙ্গে এই লােহার সিন্দুকের টাকা বের করে নেওয়ার যে যােগ আছে তা বুঝতে পারলুম। কী রকমের যোেগ সে কথা জানতেও ইচ্ছা করল না। কোনােদিন সে প্রশ্নও করব না।
বিধাতা আমাদের জীবনছবির দাগ একটু ঝাপসা করেই টেনে দেন। আমরা নিজের হাতে সেটাকে কিছু কিছু বদলে মুছে পুরিয়ে দিয়ে নিজের মনের মতাে একটা স্পষ্ট চেহারা ফুটিয়ে তুলব, এই তাঁর অভিপ্রায়। সৃষ্টিকর্তার ইশারা নিয়ে নিজের জীবনটাকে নিজে সৃষ্টি করে তুলব, একটা বড়াে আইডিয়াকে আমার সমস্তর মধ্য দিয়ে ব্যক্ত করে দেখাব, এই বেদনা বরাবর আমার মনে আছে।
এই সাধনাতে এতদিন কাটিয়েছি। প্রবৃত্তিকে কত বঞ্চিত করেছি, নিজেকে কত দমন করেছি, সেই অন্তরের ইতিহাস অন্তর্যামীই জানেন। শক্ত কথা এই যে, কারাে জীবন একলার জিনিস নয়; সৃষ্টি যে করবে সে নিজের চার দিককে নিয়ে যদি না সৃষ্টি করে তবে ব্যর্থ হবে। মনের মধ্যে তাই একান্ত একটা প্রয়াস ছিল যে বিমলকেও এই রচনার মধ্যে টানব। সমস্ত প্রাণ দিয়ে তাকে ভালাে যখন বাসি তখন কেন পারব না, এই ছিল আমার জোর।
এমন সময় স্পষ্ট দেখতে পেলুম, নিজের সঙ্গে সঙ্গে নিজের চার দিককে যারা সহজেই সৃষ্টি করতে পারে তারা এক জাতের মানুষ, আমি সে জাতের না। আমি মন্ত্র নিয়েছি, কাউকে মন্ত্র দিতে পারি নি। যাদের কাছে আপনাকে সম্পূর্ণ ঢেলে দিয়েছি তারা আমার আর-সবই নিয়েছে কেবল আমার এই অন্তরতম জিনিসটি ছাড়া। আমার পরীক্ষা কঠিন হল। সব চেয়ে যেখানে সহায় চাই সব চেয়ে সেখানেই একলা হলুম। এই পরীক্ষাতেও জিতব, এই আমার পণ রইল। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আমার দুর্গম পথ আমার একলারই পথ।
আজ সন্দেহ হচ্ছে, আমার মধ্যে একটা অত্যাচার ছিল। বিমলের সঙ্গে আমার সম্বন্ধটিকে একটা সুকঠিন ভালাের ছাঁচে নিখুঁত করে ঢালাই করব, আমার ইচ্ছার ভিতরে এই একটা জবরদস্তি আছে। কিন্তু মানুষের জীবনটা তাে ছাঁচে ঢালবার নয়। আর, ভালােকে জড়বস্তু মনে করে গড়ে তুলতে গেলেই মরে গিয়ে সে তার ভয়ানক শােধ নেয়।
এই জুলুমের জন্যেই আমরা পরস্পরের সঙ্গে ভিতরে ভিতরে তফাত হয়ে গেছি, তা জানতেই পারি নি। বিমল নিজে যা হতে পারত তা আমার চাপে উপরে ফুটে উঠতে পারে নি বলেই নীচের তল থেকে রুদ্ধ জীবনের ঘর্ষণে বাঁধ খইয়ে ফেলেছে। এই ছ হাজার টাকা আজ ওকে চুরি করে নিতে হয়েছে। আমার সঙ্গে ও স্পষ্ট ব্যবহার করতে পারে নি, কেননা, ও বুঝেছে এক জায়গায় আমি ওর থেকে প্রবলরূপে পৃথক। আমাদের মধ্যে একরােখা আইডিয়ার মানুষের সঙ্গে যারা মেলে তারা মেলে, যারা মেলে না তারা আমাদের ঠকায়। সরল মানুষকেও আমরা কপট করে তুলি। আমরা সহধর্মিণীকে গড়তে গিয়ে স্ত্রীকে বিকৃত করি।
আবার কি সেই গােড়ায় ফেরা যায় না? তা হলে একবার সহজের রাস্তায় চলি। আমার পথের সঙ্গিনীকে এবার কোনাে আইডিয়ার শিকল দিয়ে বাঁধতে চাইব না। কেবল আমার ভালােবাসার বাঁশি বাজিয়ে বলব, তুমি আমাকে ভালােবাসাে, সেই ভালােবাসার আলােতে তুমি যা তারই পূর্ণ বিকাশ হােক, আমার ফরমাশ একেবারে চাপা পড়ুক; তােমার মধ্যে বিধাতার যে ইচ্ছা আছে তারই জয় হােক, আমার ইচ্ছা লজ্জিত হয়ে ফিরে যাক।
কিন্তু আমাদের মধ্যেকার যে বিচ্ছেদটা ভিতরে ভিতরে জমছিল সেটা আজ এমনতরাে একটা ক্ষতর মধ্যে দিয়ে বাইরে বেরিয়ে পড়েছে যে আর কি তার উপর স্বভাবের শুশ্রূষা কাজ করতে পারবে? যে আব্রুর আড়ালে প্রকৃতি আপনার সংশােধনের কাজ নিঃশব্দে করে সেই আব্রু যে একেবারে ছিন্ন হয়ে গেল! ক্ষতকে ঢাকা দিতে হয়। এই ক্ষতকে আমার ভালােবাসা দিয়ে ঢাকব; বেদনাকে আমার হৃদয় দিয়ে পাকে পাকে জড়িয়ে বাইরের স্পর্শ থেকে আড়াল করে রাখব; একদিন এমন হবে যে, এই ক্ষতর চিহ্ন পর্যন্ত থাকবে না। কিন্তু, আর কি সময় আছে? এতদিন গেল ভুল বুঝতে, আজকের দিন এল ভুল ভাঙতে, কত দিন লাগবে ভুল শােধরাতে? তার পরে? তার পরে ক্ষত শুকোতেও পারে, কিন্তু ক্ষতিপূরণ কি আর কোনাে কালে হবে?
একটা কি খট্ করে উঠল। ফিরে তাকিয়ে দেখি, বিমল দরজার কাছ থেকে ফিরে যাচ্ছে। বােধ হয় দরজার পাশে এসে এতক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিল— ঘরে ঢুকবে কি না-ঢুকবে ভেবে পাচ্ছিল না, শেষে ফিরে যাচ্ছিল। আমি তাড়াতাড়ি উঠে গিয়ে ডাকলুম, বিমল!
সে থমকে দাঁড়ালাে, তার পিঠ ছিল আমার দিকে। আমি তাকে হাত ধরে ঘরের মধ্যে নিয়ে এলুম।
ঘরে এসেই মেঝের উপর পড়ে মুখের উপর একটা বালিশ আঁকড়ে ধরে তার কান্না। আমি একটি কথা না বলে তার হাত ধরে মাথার কাছে বসে রইলুম।
কান্নার বেগ থেমে গিয়ে উঠে বসতেই, আমি তাকে আমার বুকের কাছে টেনে নেবার চেষ্টা করলুম। সে একটু জোর করে আমার হাত ছাড়িয়ে নিয়ে হাঁটু গেড়ে আমার পায়ের উপর বার বার মাথা ঠেকিয়ে প্রণাম করতে লাগল। আমি পা সরিয়ে নিতেই সে হাত দিয়ে আমার পা জড়িয়ে ধরে গদ্গদ স্বরে বললে, না না না, তােমার পা সরিয়ে নিয়ে না— আমাকে পুজো করতে দিয়াে।
আমি তখন চুপ করে রইলুম। এ পূজায় বাধা দেবার আমি কে! যে পূজা সত্য সে পূজার দেবতাও সত্য— সে দেবতা কি আমি যে আমি সংকোচ করব?