নিখিলেশের আত্মকথা

ভাদ্রের বন্যায় চারি দিক টল্‌মল্‌ করছে। কচি ধানের আভা যেন কচি ছেলের কাঁচা দেহের লাবণ্য। আমাদের বাড়ির বাগানের নীচে পর্যন্ত জল এসেছে। সকালের রৌদ্রটি এই পৃথিবীর উপরে একেবারে অপর্যাপ্ত হয়ে পড়েছে নীল আকাশের ভালােবাসার মতাে।

 আমি কেন গান গাইতে পারি নে! খালের জল ঝিল্‌মিল্‌ করছে, গাছের পাতা ঝিক্‌মিক্‌ করছে, ধানের খেত ক্ষণে ক্ষণে শিউরে শিউরে চিক্‌চিকিয়ে উঠছে— এই শরতের প্রভাতসংগীতে আমিই কেবল বােবা। আমার মধ্যে সুর অবরুদ্ধ; আমার মধ্যে বিশ্বের সমস্ত উজ্জ্বলতা আটকা পড়ে যায়, ফিরে যেতে পায় না। আমার এই প্রকাশহীন দীপ্তিহীন আপনাকে যখন দেখতে পাই তখন বুঝতে পারি, পৃথিবীতে কেন আমি বঞ্চিত। আমার সঙ্গ দিনরাত্রি কেউ সইতে পারবে কেন!

 বিমল যে প্রাণের বেগে একেবারে ভরা। সেইজন্যে এই ন বছরের মধ্যে এক মুহূর্তের জন্য সে আমার কাছে পুরােনাে হয় নি। কিন্তু আমার মধ্যে যদি কিছু থাকে সে কেবল বােবা গভীরতা, সে তাে কলধ্বনিত বেগ নয়। আমি কেবল গ্রহণ করতেই পারি, কিন্তু নাড়া দিতে পারি নে। আমার সঙ্গ মানুষের পক্ষে উপবাসের মতাে। বিমল এতদিন যে কী দুর্ভিক্ষের মধ্যেই ছিল তা আজকের ওকে দেখে বুঝতে পারছি। দোষ দেব কাকে!  হায় রে—

ভরা বাদর, মাহ ভাদর,
শূন্য মন্দির মাের!

 আমার মন্দির যে শূন্য থাকবার জন্যেই তৈরি, ওর যে দরজা বন্ধ। আমার যে দেবতা ছিল মন্দিরের বাইরেই বসে ছিল, এত কাল তা বুঝতে পারি নি। মনে করেছিলুম অর্ঘ্য সে নিয়েছে, বরও সে দিয়েছে। কিন্তু শূন্য মন্দির মাের, শূন্য মন্দির মাের!

 প্রতি বৎসর ভাদ্র মাসে পৃথিবীর এই ভরা যৌবনে আমরা দুজনে শুক্লপক্ষে আমাদের শামলদহর বিলে বােটে করে বেড়াতে যেতুম। কৃষ্ণাপঞ্চমীতে যখন সন্ধ্যাবেলাকার জ্যোৎস্না ফুরিয়ে গিয়ে একেবারে তলায় এসে ঠেকত তখন আমরা বাড়ি ফিরে আসতুম। আমি বিমলকে বলতুম, গানকে বারে বারে আপন ধুয়ােয় ফিরে আসতে হয়। জীবনে মিলনসংগীতের ধুয়ােই হচ্ছে এইখানে, এই খােলা প্রকৃতির মধ্যে। এই ছল্‌ছল্‌-করা জলের উপরে যেখানে ‘বায়ু বহে পুরবৈয়াঁ’, যেখানে শ্যামল পৃথিবী মাথায় ছায়ার ঘােমটা টেনে নিস্তব্ধ জ্যোৎস্নায় কূলে কূলে কান পেতে সারা রাত আড়ি পাতছে—সেইখানেই স্ত্রীপুরুষের প্রথম চার চক্ষের মিলন হয়েছিল, দেয়ালের মধ্যে নয়। তাই এখানে আমরা একবার করে সেই আদিযুগের প্রথম-মিলনের ধুয়াের মধ্যে ফিরে আসি, যে মিলন হচ্ছে হরপার্বতীর মিলন, কৈলাসে মানসসরােবরের পদ্মবনে। আমার বিবাহের পর দু বছর কলকাতায় পরীক্ষার হাঙ্গামে কেটেছে। তার পর আজ এই সাত বছর প্রতি ভাদ্র মাসের চাঁদ আমাদের সেই জলের বাসরঘরে বিকশিত কুমুদবনের ধারে তার নীরব শুভশঙ্খ বাজিয়ে এসেছে। জীবনের সেই এক সপ্তক এমনি করে কাটল। আজ দ্বিতীয় সপ্তক আরম্ভ হয়েছে।

 ভাদ্রের সেই শুক্লপক্ষ এসেছে সে কথা আমি তাে কিছুতেই বুঝতে পারছি নে, প্রথম তিন দিন তাে কেটে গেল; বিমলের মনে পড়েছে কি না জানি নে, কিন্তু মনে করিয়ে দিল না। সব একেবারে চুপ হয়ে গেল, গান থেমে গেছে।—

ভরা বাদর, মাহ ভাদর,
শূন্য মন্দির মাের!

 বিরহে যে মন্দির শূন্য হয় সে মন্দিরের শূন্যতার মধ্যেও বাঁশি বাজে। কিন্তু বিচ্ছেদে যে মন্দির শূন্য হয় সে মন্দির বড়াে নিস্তব্ধ, সেখানে কান্নার শব্দও বেসুরাে শােনায়!

 আজ আমার কান্না বেসুরাে লাগছে। এ কান্না আমার থামাতেই হবে। আমার এই কান্না দিয়ে বিমলকে আমি বন্দী করে রাখব, এমন কাপুরুষ যেন আমি না হই। ভালােবাসা যেখানে একেবারে মিথ্যা হয়ে গেছে সেখানে কান্না যেন সেই মিথ্যাকে বাঁধাতে না চায়! যতক্ষণ আমার বেদনা প্রকাশ পাবে ততক্ষণ বিমল একেবারে মুক্তি পাবে না।

 কিন্তু তাকে আমি সম্পূর্ণ মুক্তি দেব, নইলে মিথ্যার হাত থেকে আমিও মুক্তি পাব না। আজ তাকে আমার সঙ্গে বেঁধে রাখা নিজেকেই মায়ার জালে জড়িয়ে রাখা মাত্র। তাতে কারাে কিছুই মঙ্গল নেই, সুখ তাে নেইই। ছুটি দাও, ছুটি নাও। দুঃখ বুকের মানিক হবে যদি মিথ্যা থেকে খালাস পেতে পার।

 আমার মনে হচ্ছে, যেন এইবার আমি একটা জিনিস বুঝতে পারার কিনারায় এসেছি। স্ত্রীপুরুষের ভালােবাসাটাকে সকলে মিলে ফুঁ দিয়ে দিয়ে তার স্বাভাবিক অধিকার ছাড়িয়ে এত দূর পর্যন্ত তাকে বাড়িয়ে তুলেছি যে, আজ তাকে সমস্ত মনুষ্যত্বের দোহাই দিয়েও বশে আনতে পারছি নে। ঘরের প্রদীপকে ঘরের আগুন করে তুলেছি। এখন তাকে আর প্রশ্রয় দেওয়া যায় না, তাকে অবজ্ঞা করবার দিন এসেছে। প্রবৃত্তির হাতের পূজা পেয়ে পেয়ে সে দেবীর রূপ ধরে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু তার সামনে পুরুষের পৌরুষ বলি দিয়ে তাকে রক্তপান করাতে হবে, এমন পূজা আমরা মানব না। সাজে-সজ্জায়, লজ্জা-শরমে, গানে-গল্পে, হাসি-কান্নায়, যে ইন্দ্রজাল সে তৈরি করেছে তাকে ছিন্ন করতে হবে।

 কালিদাসের ঋতুসংহার কাব্যের উপর বরাবর আমার একটা ঘৃণা আছে। পৃথিবীর সমস্ত ফুলের সাজি, সমস্ত ফলের ডালি কেবলমাত্র প্রেয়সীর পায়ের কাছে পড়ে পঞ্চশরের পূজার উপচার জোগাচ্ছে, জগতের আনন্দলীলাকে এমন করে ক্ষুন্ন করতে মানুষ পারে কী করে! এ কোন্ মদের নেশায় কবির চোখ ঢুলে পড়েছে। যে-মদ এতদিন পান করছি তার রঙ এত লাল নয়, কিন্তু তার নেশা তাে এমনিই তীব্র। এই নেশার ঝোঁকেই আজ সকাল থেকে গুন্‌গুন্ করে মরছি—

ভরা বাদর, মাহ ভাদর,
শূন্য মন্দির মাের!

 শূন্য মন্দির! বলতে লজ্জা করে না! এত বড়াে মন্দির কিসে তােমার শূন্য হল! একটা মিথ্যাকে মিথ্যা বলে জেনেছি, তাই বলে জীবনের সমস্ত সত্য আজ উজাড় হয়ে গেল!


 শােবার ঘরের শেলফ্ থেকে একটা বই আনতে আজ সকালে গিয়েছিলুম। কত দিন দিনের বেলায় আমার শােবার ঘরে আমি ঢুকি নি। আজ দিনের আলােতে ঘরের দিকে তাকিয়ে বুকের ভেতরটা কেমন করে উঠল। সেই আন্‌লাটিতে বিমলের কোঁচানাে শাড়ি পাকানাে রয়েছে, এক কোণে তার ছাড়া শেমিজ আর জামা ধোবার জন্যে অপেক্ষা করছে। আয়নার টেবিলের উপর তার চুলের কাঁটা, মাথার তেল, চিরুনি, এসেন্সের শিশি, সেইসঙ্গে সিদুরের কৌঁটোটিও। টেবিলের নীচে তার ছােট্ট সেই একজোড়া জরি-দেওয়া চটিজুতাে— একদিন যখন বিমল কোনােমতেই জুতাে পরতে চাইত না সেই সময়ে আমি ওর জন্যে আমার এক লক্ষৌয়ের সহপাঠী মুসলমান বন্ধুর যােগে এই জুতাে আনিয়ে দিয়েছিলুম। কেবলমাত্র শােবার ঘর থেকে আর ঐ বারান্দা পর্যন্ত এই জুতাে পরে যেতে সে লজ্জায় মরে গিয়েছিল। তার পরে বিমল অনেক জুতো ক্ষয় করেছে, কিন্তু এই চটিজোড়াটি সে আদর করে রেখে দিয়েছে। আমি তাকে ঠাট্টা করে বলেছিলুম, যখন ঘুমিয়ে থাকি লুকিয়ে আমার পায়ের ধুলো নিয়ে তুমি আমার পুজো কর— আমি তোমার পায়ের ধুলো নিবারণ করে আজ আমার এই জাগ্রত দেবতার পুজো করতে এসেছি। বিমল বললে, যাও! তুমি অমন করে বোলো না, তা হলে কখনো ও জুতো পরব না।— এই আমার চির-পরিচিত শোবার ঘর; এর একটি গন্ধ আছে যা আমার সমস্ত হৃদয় জানে, আর বোধ হয় কেউ তা পায় না। এই-সমস্ত অতি ছোটো ছোটো জিনিসের মধ্যে আমার রসপিপাসু হৃদয় তার কত যে সূক্ষ্ম সূক্ষ্ম শিকড় মেলে রয়েছে তা আজ যেমন করে অনুভব করলুম তেমন আর কোনোদিন করি নি। কেবল মূল শিকড়টি কাটা পড়লেই সে প্রাণ ছুটি পায় তা তো নয়, ঐ চটিজোড়াটি পর্যন্ত তাকে টেনে ধরতে চায়। সেইজন্যেই তো লক্ষ্মী ত্যাগ করলেও তার ছিন্ন পদ্মের পাপড়িগুলোর চারি দিকে মন এমন করে ঘুরে ঘুরে বেড়ায়। দেখতে দেখতে হঠাৎ কুলুঙ্গিটার উপর চোখ পড়ল। দেখি আমার সেই ছবি তেমনিই রয়েছে, তার সামনে অনেক দিনের শুকনো কালো ফুল পড়ে আছে। এমনতরো পূজার বিকারেও ছবির মুখে কোনো বিকার নেই। এ ঘর থেকে এই শুকিয়ে যাওয়া কালো ফুলই আজ আমার সত্য উপহার! এরা যে এখনো এখানে আছে তার কারণ এদের ফেলে দেওয়ারও দরকার নেই। যাই হোক, সত্যকে আমি তার এই নীরস কালো মূর্তিতেই গ্রহণ করলুম— কবে সেই কুলুঙ্গির ভিতরকার ছবিটারই মতো নির্বিকার হতে পারব?

 এমন সময় হঠাৎ পিছন থেকে বিমল ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ল। আমি তাড়াতাড়ি চোখ ফিরিয়ে নিয়ে শেল্‌ফের দিকে যেতে যেতে বললুম, আমিয়েল্‌স্‌ জর্নাল বইখানা নিতে এসেছি। এই কৈফিয়তটুকু দেবার কী যে দরকার ছিল তা তো জানি নে। কিন্তু এখানে আমি যেন অপরাধী, যেন অনধিকারী, যেন এমন কিছুর মধ্যে চোখ দিতে এসেছি যা লুকানো বা লুকিয়ে থাকবারই যোগ্য। বিমলের মুখের দিকে আমি তাকাতে পারলুম না, তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গেলুম।

 বাইরে আমার ঘরে বসে যখন বই পড়া অসম্ভব হয়ে উঠল, যখন জীবনের যা-কিছু সমস্তই যেন অসাধ্য হয়ে দাঁড়ালো— কিছু দেখতে বা শুনতে, বলতে বা করতে লেশমাত্র আর প্রবৃত্তি রইল না— যখন আমার সমস্ত ভবিষ্যতের দিন সেই একটা মুহূর্তের মধ্যে জমাট হয়ে, অচল হয়ে আমার বুকের উপর পাথরের মতো চেপে বসল— ঠিক সেই সময়ে পঞ্চু একটা ঝুড়িতে গােটাকতক ঝুনাে নারকেল নিয়ে আমার সামনে রেখে গড় হয়ে প্রণাম করলে।

 আমি জিজ্ঞাসা করলুম, একি পঞ্চু, এ কেন?

 পঞ্চু আমার প্রতিবেশী জমিদার হরিশ কুণ্ডুর প্রজা, মাস্টারমশায়ের যােগে তার সঙ্গে আমার পরিচয়। একে আমি তার জমিদার নই, তার উপরে সে গরিবের একশেষ; ওর কাছ থেকে কোনাে উপহার গ্রহণ করবার অধিকার আমার নেই। মনে ভাবছিলুম, বেচারা বােধ হয় আজ নিরুপায় হয়ে বক্‌শিশের ছলে অন্নসংগ্রহের এই পন্থা করেছে।

 পকেটের টাকার থলি থেকে দুটো টাকা বের করে যখন ওকে দিতে যাচ্ছি তখন ও জোড়-হাত করে বললে, না হুজুর, নিতে পারব না।

 সেকি পঞ্চু?

 না, তবে খুলে বলি। বড়াে টানাটানির সময় একবার হুজুরের সরকারি বাগান থেকে আমি নারকেল চুরি করেছিলুম। কোন্ দিন মরব, তাই শােধ করে দিতে এসেছি।

 আমিয়েল্‌স্‌ জর্নাল পড়ে আজ আমার কোনাে ফল হত না। কিন্তু পঞ্চুর এই এক কথায় আমার মন খােলসা হয়ে গেল। একজন স্ত্রীলােকের সঙ্গে মিলন-বিচ্ছেদের সুখ-দুঃখ ছাড়িয়ে এ পৃথিবী অনেক দূর বিস্তৃত। বিপুল মানুষের জীবন; তারই মাঝখানে দাঁড়িয়ে তবেই যেন নিজের হাসিকান্নার পরিমাপ করি!

 পঞ্চু আমার মাস্টারমশায়ের একজন ভক্ত। কেমন করে এর সংসার চলে তা আমি জানি। রােজ ভােরে উঠে একটা চাঙারিতে করে পান দোক্তা, রঙিন সুতাে, ছােটো আয়না, চিরুনি প্রভৃতি চাষার মেয়েদের লােভনীয় জিনিস নিয়ে হাঁটুজল ভেঙে বিল পেরিয়ে সে নমঃশূদ্রদের পাড়ায় যায়। সেখানে এই জিনিসগুলাের বদলে মেয়েদের কাছ থেকে ধান পায়। তাতে পয়সার চেয়ে কিছু বেশিই পেয়ে থাকে। যেদিন সকাল সকাল ফিরতে পারে সেদিন তাড়াতাড়ি খেয়ে নিয়ে বাতাসাওয়ালার দোকানে বাতাসা কাটতে যায়। সেখান থেকে বাড়ি ফিরে এসে শাঁখা তৈরি করতে বসে; তাতে প্রায় রাত দুপুর হয়ে যায়। এমন বিষম পরিশ্রম করেও বছরের মধ্যে কেবল কয়েক মাস ছেলেপুলে নিয়ে দু-বেলা দুমুঠো খাওয়া চলে। তার আহারের নিয়ম এই যে, খেতে বসেই সে এক-ঘটি জল খেয়ে পেট ভরায়, আর তার খাদ্যের মস্ত একটা অংশ হচ্ছে সস্তা দামের বীজে-কলা। বছরে অন্তত চার মাস তার এক-বেলার বেশি খাওয়া জোটে না।

 আমি এক সময়ে একে কিছু দান করতে চেয়েছিলুম। মাস্টারমশায় আমাকে বললেন, তোমার দানের দ্বারা মানুষকে তুমি নষ্ট করতে পার, দুঃখ নষ্ট করতে পার না। আমাদের বাংলাদেশে পঞ্চু তো একলা নয়। সমস্ত দেশের স্তনে আজ দুধ শুকিয়ে এসেছে। সেই মাতার দুধ তুমি তো অমন করে টাকা দিয়ে বাইরে থেকে জোগাতে পারবে না।

 এই-সব কথা ভাববার কথা। স্থির করেছিলুম, এই ভাবনাতেই প্রাণ দেব। সেদিন বিমলকে এসে বললুম, বিমল, আমাদের দুজনের জীবন দেশের দুঃখের মূল-ছেদনের কাজে লাগাব।

 বিমল হেসে বললে, তুমি দেখছি আমার রাজপুত্র সিদ্ধার্থ। দেখো, শেষে আমাকে ভাসিয়ে চলে যেয়ো না।

 আমি বললুম, সিদ্ধার্থের তপস্যায় তাঁর স্ত্রী ছিলেন না, আমার তপস্যায় স্ত্রীকে চাই।

 এমনি করে কথাটা হাসির উপর দিয়েই গেল। আসলে বিমল, স্বভাবত, যাকে বলে ‘মহিলা’। ও যদিও গরিবের ঘর থেকে এসেছে, কিন্তু ও রানী। ও জানে, যারা নীচের শ্রেণীর তাদের সুখদুঃখ ভালো-মন্দর মাপকাঠি চিরকালের জন্যই নীচের দরের। তাদের তো অভাব থাকবেই, কিন্তু সে অভাব তাদের পক্ষে অভাবই নয়। তারা আপনার হীনতার বেড়ার দ্বারাই সুরক্ষিত। যেমন, ছোটো পুকুরের জল আপনার পাড়ির বাঁধনেই টিঁকে থাকে। পাড়িকে কেটে বড়ো করতে গেলেই তার জল ফুরিয়ে পাঁক বেরিয়ে পড়ে। যে আভিজাত্যের অভিমানে খুব ছোটো ছোটো ভাগ্যের মধ্যে ভারতবর্য খুব ছোটো ছোটো গৌরবের আসন ঘের দিয়ে রেখেছে, যাতে করে ছোটো ভাগের হীনতার গণ্ডির মধ্যেও নিজের মাপ অনুযায়ী একটা কৌলীন্য এবং স্বাতন্ত্রের গর্ব স্থান পায়, বিমলের রক্তে সেই অভিমান প্রবল। সে ভগবান মনুর দৌহিত্রী বটে। আমার মধ্যে বোধ হয় গুহক এবং একলব্যের রক্তের ধারাটাই প্রবল; আজ যারা আমার নীচে রয়েছে তাদের নীচ বলে আমার থেকে একেবারে দূরে ঠেলে রেখে দিতে পারি নে। আমার ভারতবর্ষ কেবল ভদ্রলোকেরই ভারতবর্ষ নয়। আমি স্পষ্টই জানি, আমার নীচের লোক যত নাবছে ভারতবর্ষই নাবছে, তারা যত মরছে। ভারতবর্ষই মরছে।

 বিমলকে আমার সাধনার মধ্যে পাই নি। আমার জীবনে আমি বিমলকে এতই প্রকাণ্ড করে তুলেছি যে, তাকে না পাওয়াতে আমার সাধনা ছোটো হয়ে গেছে। আমার জীবনের লক্ষ্যকে কোণে সরিয়ে দিয়েছি বিমলকে জায়গা দিতে হবে বলে। তাতে করে হয়েছে এই যে, তাকেই দিন-রাত সাজিয়েছি, পরিয়েছি, শিখিয়েছি, তাকেই চিরদিন প্রদক্ষিণ করেছি— মানুষ যে কত বড়াে, জীবন যে কত মহৎ, সে কথা স্পষ্ট করে মনে রাখতে পারি নি।

 তবু এর ভিতরেও আমাকে রক্ষা করেছেন আমার মাস্টারমশায়— তিনিই আমাকে যতটা পেরেছেন বড়াের দিকে বাঁচিয়ে রেখেছেন, নইলে আজকের দিনে আমি সর্বনাশের মধ্যে তলিয়ে যেতুম। আশ্চর্য ঐ মানুষটি। আমি ওঁকে আশ্চর্য বলছি এইজন্যে যে, আজকের আমার এই দেশের সঙ্গে কালের সঙ্গে ওঁর এমন একটা প্রবল পার্থক্য আছে! উনি আপনার অন্তর্যামীকে দেখতে পেয়েছেন, সেইজন্যে আর-কিছুতে ওঁকে ভােলাতে পারে না। আজ যখন আমার জীবনের দেনা-পাওনার হিসাব করি তখন এক দিকে একটা মস্ত ঠিক-ভুল, একটা বড়াে লােকসান ধরা পড়ে, কিন্তু লােকসান ছাড়িয়ে উঠতে পারে এমন একটি লাভের অঙ্ক আমার জীবনে আছে সে কথা যেন জোর করে বলতে পারি।

 আমাকে যখন উনি পড়ানাে শেষ করেছেন তার পূর্বেই পিতৃবিয়ােগ হয়ে আমি স্বাধীন হয়েছি। আমি মাস্টারমশায়কে বললুম, আপনি আমার কাছেই থাকুন, অন্য জায়গায় কাজ করবেন না।

 তিনি বললেন, দেখাে, তােমাকে আমি যা দিয়েছি তার দাম পেয়েছি। তার চেয়ে বেশি যা দিয়েছি তার দাম যদি নিই তা হলে আমার ভগবানকে হাটে বিক্রি করা হবে।

 বরাবর তাঁর বাসা থেকে রৌদ্রবৃষ্টি মাথায় করে চন্দ্রনাথবাবু আমাকে পড়াতে এসেছেন, কোনমতেই আমাদের গাড়ি-ঘােড়া তাঁকে ব্যবহার করাতে পারলুম না। তিনি বলতেন, আমার বাবা চিরকাল বটতলা থেকে লালদিঘি পর্যন্ত হেঁটে গিয়ে আপিস করে আমাদের মানুষ করেছেন, শেয়ারের গাড়িতেও কখনাে চাপেন নি, আমরা হচ্ছি পুরুষানুক্রমে পদাতিক।

 আমি বললুম, না-হয় আমাদের বিষয়কর্মসংক্রান্ত একটা কাজ নিন।

 তিনি বললেন, না বাবা, আমাকে তােমাদের বড়ােমানুষির ফাঁদে ফেলাে না, আমি মুক্ত থাকতে চাই।

 তাঁর ছেলে এখন এম. এ. পাস করে চাকরি খুঁজছে। আমি বললুম, আমার এখানে তার একটা কাজ হতে পারে। ছেলেরও সেই ইচ্ছে খুব ছিল। প্রথমে সে তার বাবাকে এই কথা জানিয়েছিল, সেখানে সুবিধে পায় নি। তখন লুকিয়ে আমাকে আভাস দেয়। তখনই আমি উৎসাহ করে চন্দ্রনাথবাবুকে বললুম। তিনি বললেন, না, এখানে তার কাজ হবে না।— তাকে এত বড়াে সুযােগ থেকে বঞ্চিত করাতে ছেলে বাপের উপর খুব রাগ করেছে। সে রেগে পত্নীহীন বুড়াে বাপকে একলা ফেলে রেঙ্গুনে চলে গেল।

 তিনি আমাকে বার বার বলেছেন, দেখে নিখিল, তােমার সম্বন্ধে আমি স্বাধীন, আমার সম্বন্ধে তুমি স্বাধীন, তােমার সঙ্গে আমার এই সম্বন্ধ। কল্যাণের সম্বন্ধকে অর্থের অনুগত করলে পরমার্থের অপমান করা হয়।

 এখন তিনি এখানকার এন্‌ট্রেন্স স্কুলের হেডমাস্টারি করেন। এতদিন তিনি আমাদের বাড়িতে পর্যন্ত থাকতেন না, এই কিছুদিন থেকে আমি প্রায় সন্ধেবেলায় তাঁর বাসায় গিয়ে রাত্রি এগারােটা দুপুর পর্যন্ত নানা কথায় কাটিয়ে আসছিলুম। বােধ হয় ভাবলেন, তাঁর ছােটো ঘর এই ভাদ্র মাসের গুমটে আমার পক্ষে ক্লেশকর, সেইজন্যেই তিনি নিজে আমার এখানে আশ্রয় নিয়েছেন। আশ্চর্য এই, বড়ােমানুষের ’পরেও তাঁর গরিবের মতােই সমান দয়া, বড়ােমানুষের দুঃখকেও তিনি অবজ্ঞা করেন না।

 বাস্তবকে যত একান্ত করে দেখি ততই সে আমাদের পেয়ে বসে— আভাসমাত্রে সত্যকে যখন দেখি তখনই মুক্তির হাওয়া গায়ে লাগে। বিমল আজ আমার জীবনে সেই বাস্তবকেই এত বেশি তীব্র করে তুলেছে যে, সত্য আমার পক্ষে আজ আচ্ছন্ন হবার জো হয়েছে। তাই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে কোথাও আমার দুঃখের আর সীমা খুঁজে পাচ্ছি নে। তাই আজ আমার এতটুকু ফাঁককে লােকলােকান্তরে ছড়িয়ে দিয়ে শরতের সমস্ত সকাল ধরে গান গাইতে বসেছি—

এ ভরা বাদর, মাহ ভাদর,
শূন্য মন্দির মাের!

 যখন চন্দ্রনাথবাবুর জীবনের বাতায়ন থেকে সত্যকে দেখতে পাই তখন ও গানের মানে একেবারেই বদলে যায়, তখন—

বিদ্যাপতি কহে কৈসে গােয়াঁয়বি
হরি বিনে দিনরাতিয়া?

 যত দুঃখ, যত ভুল, সব যে ঐ সত্যকে না পেয়ে। সেই সত্যকে জীবনে ভরে না নিয়ে দিন-রাত এমন করে কেমনে কাটবে? আর তাে পারি নে, সত্য, তুমি এবার আমার শূন্য মন্দির ভরে দাও!