ঘর-পোড়া লোক (প্রথম অংশ)/চতুর্থ পরিচ্ছেদ
চতুর্থ পরিচ্ছেদ।
জমাদার ও হেদায়েৎ সেই স্থান হইতে প্রস্থান করিবার পর, দারোগা সাহেব প্রথমে এতেলা পুস্তক নিজ হস্তে গ্রহণ করিয়া, নিম্নলিখিতরূপে প্রথম এতেলা ফরিয়াদীর অসাক্ষাতেই লিখিলেন।
“আমার নাম সেখ হেদায়েৎ। আমার বাসস্থান ** গ্রাম। গত আটদিবস হইতে আমি আমার বাড়ীতে ছিলাম না, *** গ্রামে আমার কুটুম্ব * * *—র নিকট আমি আমার কোন কার্য্য উপলক্ষে গমন করিয়াছিলাম। আমার বাড়ীতে অপর কেহই নাই; কেবলমাত্র আমার যুবতী কন্যা ***— কে আমি বাড়ীতে রাখিয়া গিয়াছিলাম। অদ্য প্রাতঃকালে আমি বাড়ীতে ফিরিয়া আসিয়া, আমার কন্যাকে আমার বাড়ীতে দেখিতে পাইলাম না। পাড়া-প্রতিবাসীগণের নিকট অনুসন্ধান করিয়া জানিতে পারিলাম যে, আমাদিগের গ্রামের জমিদার গােফুর খাঁ তাঁহার পুত্র ওস্মান এবং কয়েকজন কর্ম্মচারীকে সঙ্গে লইয়া খাজানা আদায় করিবার নিমিত্ত আমাদিগের গ্রামে আগমন করেন, এবং গ্রামের এক স্থানে বসিয়া প্রজাগণকে ডাকাইয়া খাজানার তহসিল করিতে থাকেন। শুনিলাম, আমাকেও ডাকিবার নিমিত্ত তিনি একজন পাইক পাঠাইয়া দিয়াছিলেন। আমি বাড়ী ছিলাম না; সুতরাং পাইক আমাকে দেখিতে পায় নাই। সে গিয়া জমিদার মহাশয়কে কহে, “হেদায়েৎ বাড়ীতে নাই, কেবল তাহার কন্যা বাড়ীতে আছে। সে কহিল, তাহার পিতা অদ্য দুই দিবস হইল, কুটুম্ব বাড়ীতে গমন করিয়াছে।” এই কথা শুনিয়া জমিদার মহাশয় অতিশয় ক্রোধান্বিত হইলেন ও কহিলেন, “হেদায়েৎ কোন স্থানে যায় নাই। অনেক টাকা খাজানা বাকী পড়িয়াছে, আমার নিকট আসিলে খাজানা দিতে হইবে, এই ভয়ে সে লুকায়িয়া আছে। যা হ’ক তাহার কন্যাকে ধরিয়া আন, তা হইলে সে এখনই আসিয়া খাজানা মিটাইয়া দিবে।” এই আদেশ পাইয়া জমিদারের পুত্র ওস্মান কয়েকজন কর্ম্মচারীর সাহায্যে আমার কন্যাকে আমার বাড়ী হইতে তাহার অনিচ্ছা-স্বত্বে জোর করিয়া তাহাকে ধরিয়া জমিদার মহাশয়ের নিকট লইয়া যায়। জমিদার মহাশয় প্রায় দুই ঘণ্টাকাল তাহাকে সেই স্থানে বসাইয় রাখেন। যুবতী স্ত্রীলোকের এইরূপ অবমাননা দেখিয়া গ্রামস্থ সমস্ত লোক আমার কন্যাকে ছাড়িয়া দিবার নিমিত্ত জমিদার মহাশয়কে বার বার অনুরোধ করেন। তিনি কাহারও কথায় কর্ণপাত না করিয়া, সেই স্থান হইতে গমন করিবার সময় তাঁহার পুত্র ওস্মান ও অপরাপর কর্ম্মচারীর সাহায্যে আমার কন্যাকে বাঁধিয়া তাহাদিগের সঙ্গে সঙ্গে তাহাদিগের বাড়ী পর্য্যন্ত লইয়া যান। বাড়ীর ভিতর লইয়া গিয়া, তাঁহারা যে আমার কন্যার কি অবস্থা করিয়াছেন, তাহা আমি অবগত নহি। সেই পর্য্যন্ত আমার কন্যা আর প্রত্যাগমন করে নাই, বা গ্রামের কোন ব্যক্তি আর তাহাকে দেখে নাই। আমার অনুমান ও বিশ্বাস যে, জমিদার মহাশয় এবং তাহার পুত্র ওস মান আমার কন্যাকে তাহার বিনা-ইচ্ছায় তাহাদিগের বাড়ীর ভিতর অন্যায়রূপে আবদ্ধ করিয়া রাখিয়াছেন, বা তাহাকে হত্যা করিয়াছে। আমি আপন ইচ্ছায় আমার কন্যাকে পাইবার মানসে এই এজাহার দিতেছি। ইহাতে যেরূপ অনুসন্ধানের প্রয়োজন, সেইরূপ ভাবে অনুসন্ধান করিয়া আমার কন্যাকে বাহির করিতে, আজ্ঞা হয়। আমি যে এজাহার দিতেছি, গ্রামশুদ্ধ সমস্ত লোক তাহার সাক্ষী আছে। সেই স্থানে গমন করিলেই, আপনি জানিতে পারিবেন যে, আমার কথা সম্পূর্ণরূপ সত্য কি না। আমি লেখা-পড়া জানি না, আমার এজাহার যাহা আপনি লিখিয়া লইলেন, তাহা পাঠ করিয়া পুনরায় আমাকে আপনি শুনাইয়া দিলেন; আমি যেরূপ বলিয়াছি, ঠিক সেইরূপই লেখা হইয়াছে। আমি আমার এজাহার শুনিয়া, আমি এই স্থানে নিশানসহি করিলাম। ইতি—”
দারোগা সাহেব প্রথম এতেলা পুস্তকে এইরূপ এজাহার লিখিয়া উপযুক্তরূপ লোকজন সমভিব্যাহারে এই অনুসন্ধানে গমন করিবার নিমিত্ত প্রস্তুত হইতে লাগিলেন। তাঁহার সহিত গমন করিবার নিমিত্ত যে সকল লোকজনের উপর আদেশ হইল, তাঁহারাও আহারাদি করিয়া ক্রমে প্রস্তুত হইতে লাগিলেন।
সন্ধ্যায় একটু পূর্ব্বে দারোগা সাহেব তাঁহার লোকজন সমভিব্যাহারে হেদায়েতের গ্রামে গিয়া উপস্থিত হইলেন। হেদায়েতের সমভিব্যাহারে জমাদার সাহেব পূর্ব্বেই সেই স্থানে গমন করিয়াছিলেন। সুতরাং দারোগা সাহেব সেই স্থানে গমন করিলে তাঁহার যে সকল বিষয়ের প্রয়োজন হইবার সম্ভাবনা, তাহার সমস্তই তিনি সেই স্থানে ঠিক করিয়া রাখিয়াছিলেন; অর্থাৎ বসিবার স্থান, লোকজন, রাত্রিকালের আহারাদির বন্দোবস্ত সমস্তই ঠিক ছিল। তাহার উপর গ্রামস্থ প্রায় সমস্ত লোকই সেই স্থানে উপস্থিত ছিলেন।
দারোগা সাহেব সেই রাত্রি সেই গ্রামে আহারাদি করিয়া রাত্রিযাপন করিলেন মাত্র। কিন্তু যে বিষয় অনুসন্ধানের নিমিত্ত তিনি সেই স্থানে গমন করিয়াছিলেন, সে সম্বন্ধে কোনরূপ অনুসন্ধান করা দূরে থাকুক, গ্রামস্থ কোন ব্যক্তিকে সে বিষয়ের কোন একটী কথাও জিজ্ঞাসা করিলেন না। আহারাদি করিয়া রাত্রিকালে যখন দারোগা সাহেব শয়ন করিলেন, সেই সময় তাঁহার আদেশ গ্রহণ করিয়া, গ্রামস্থ সমস্ত লোক প্রস্থান করিলেন; কিন্তু গমন করিবার সময় দারোগা সাহেব তাহাদিগকে পরদিবস অতি প্রত্যূষে পুনরায় সেই স্থানে আসিতে কহিলেন। সমস্ত লোক গমন করিবার পর দারোগা সাহেব জমাদারের সহিত অনেকক্ষণ পর্য্যন্ত পরামর্শ করিয়া উভয়েই নিদ্রিত হইয়া পড়িলেন।
পরদিবস অতি প্রত্যূষেই দারোগা সাহেবের আদেশ প্রতিপালিত হইল। সকলে আগমন করিবার পর একে একে তিনি সমস্ত লোককেই দুই চারি কথা জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলেন। কিন্তু তাহাদিগের কোন কথা এখন তিনি কাগজ-কলমে করিলেন না; তবে দেখা গেল, সেই সকল লোক যাহা কহিল, তাহার ছত্রে ছত্রে প্রথম এতেলার সহিত মিলিয়া গেল। দারোগা সাহেব নিজের ইচ্ছামত যেরূপ ভাবে প্রথম এতেলা লিখিয়াছিলেন, গ্রামস্থ সমস্ত লোকেই যখন সেইরূপ ভাবে তাহাদের এজাহার প্রদান করিল, তখন তিনি সেই সকল বিষয় কাগজপত্রে না লিখিয়া আর স্থির থাকিতে পারিলেন না।
গ্রামের প্রধান প্রধান চারি পাঁচজনের এজাহার দারোগা সাহেব লিখিয়া লইলেন। গ্রামের কোন লোক ওস্মানের উপর সন্তুষ্ট ছিল না। সুতরাং সকলেই ওস্মান ও তাহার পিতার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য প্রদান করিল। সকলেই কহিল যে, হেদায়েতের নিকট হইতে খাজানা আদায় করিবার নিমিত্তই এই গোলযোগ। হেদায়েতের কন্যাকে আটক করিয়া রাখিলেই খাজানা আদায় হইবে, এই ভাবিয়া গোফুর খাঁ তাহাকে ধরিয়া আনিবার নিমিত্ত আদেশ প্রদান করেন। তাঁহার পুত্র ওস্মান অপর কয়েকজন লোকের সাহায্যে এই আদেশ প্রতিপালন করে। পরিশেষে উহার কন্যাকে ধরিয়া তাঁহাদিগের বাড়ীতে লইয়া যায়।