ঘর-পোড়া লোক (মধ্যম অংশ)/প্রথম পরিচ্ছেদ
ঘর-পোড়া লোক।
(মধ্যম অংশ)
প্রথম পরিচ্ছেদ।
হোসেনের কথা শুনিয়া দারোগা সাহেব কহিলেন, “আপনি কি অবস্থা শুনিয়াছেন বলুন দেখি, আমিও শ্রবণ করি।”
দারোগা সাহেবের কথার উত্তরে হোসেন কহিল, “ওসমানের চরিত্র আপনি উত্তমরূপেই অবগত আছেন, এবং তাহার চরিত্রসম্বন্ধে আপনি যাহা, কহিলেন, তাহার একবিন্দুও মিথ্যা নহে। যে মৃতদেহ গোফুর খাঁর বাড়ীতে পাওয়া গিয়াছে, তাহা যে হেদায়েতের কন্যার মৃতদেহ, সে সম্বন্ধে আর কিছুমাত্র সন্দেহ নাই। শুনিয়াছি, সেই কন্যাটী বেশ রূপবতী ছিল। তাহার রূপের কথা ক্রমে ওসমানের কর্ণগোচর হইল। যুবতী রূপবতী স্ত্রীলোকের কথা শুনিয়া তিনি আর কোনরূপে স্থির থাকিতে পারিলেন না, তাহার নিকট ক্রমে লোকের উপর লোক পাঠাইয়া, তাহাকে কুপথগামিনী করিবার চেষ্টা করিতে লাগিলেন। ওসমানের প্রস্তাবে সে কোনরূপেই প্রথমে স্বীকৃত হয় নাই; কিন্তু অনেক চেষ্টার পর অর্থের লোভে ক্রমে সে আপন ধর্ম বিক্রীত করিতে সম্মত হইল। যে সময় হেদায়েৎ কার্য্যোপলক্ষে স্থানান্তরে গমন করিয়া ছিলেন, সেই সময় একরাত্রিতে ওসমান একখানি পাল্কী পাঠাইয়া তাহাকে আপন বাড়ীতে আনয়ন করেন। প্রায় সমস্ত রাত্রি তাহাকে আপনার বৈঠকখানায় মাখিয়া, অতি অল্পমাত্র রাত্রি অবশিষ্ট থাকিতে, সেই পাক্কী করিয়া তাহাকে পুনরায় আপন বাড়ীতে পাঠাইয়া দেন। পরদিবস রাত্রিতে পুনরায় পাল্কী করিয়া তাহাকে আপন বৈঠকখানায় আনয়ন করেন। সেই সময় গোফুর খাঁ বাড়ীতে ছিলেন না, কানপুরে ছিলেন। যে সময় ওসমান সেই স্ত্রীলোকটাকে লইয়া আপন বৈঠকখানায় আমোদপ্রমোদে উন্মত্ত ছিলেন, সেই সময় হঠাৎ গোফুর খাঁ বাড়ীতে আসিয়া উপস্থিত হন। পাছে পিতা তাঁহার এই সকল বিষয় জানিতে পারেন, এই ভয়ে ওসমান তাঁহার বৈঠকখানার সম্মুখে একটী কুঠারীর ভিতর উহাকে লুক্কায়িত ভাবে রাখিয়া দিয়া সেই গৃহের তালাবদ্ধ করিয়া দেন। তৎপরে তাহার একজন অনুচরকে কহেন যে, তাঁহার পিতা যেমন এদিক ওদিক করিবেন, বা বাড়ীর ভিতর গিয়া শয়ন করিবেন, সেই সময় সেই স্ত্রীলোকটীকে সেই গৃহ হইতে বাহিরে আনিয়া, পাল্কী করিয়া তাহার বাড়ীতে যেন পাঠাইয়া দেওয়া হয়, এবং পাঠাইবার সময় সেই স্ত্রীলোকটাকে যেন বলিয়াও দেওয়া হয় যে, বৃদ্ধ কানপুরে গমন করিলে পুনরায় তাহাকে আনয়ন করা যাইবে।
“অনুচর ওসমানের প্রস্তাবে সম্মত হন, এবং কহেন যে, একটু অবকাশ পাইলেই তিনি তাহাকে তাহার বাড়ীতে পাঠাইয়া দিবেন। অনুচর ওসমানের প্রস্তাবে সম্মত হইলেন বটে, কিন্তু কার্য্যে তাহা করিয়া উঠিলেন না। পরদিবস প্রাতঃকালে ওসমান তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলে, তিনি মিথ্যা কথা কহিলেন। তিনি যে তাহাকে পাঠাইতে ভুলিয়া গিয়াছিলেন, এ কথা না বলিয়া, কহিলেন যে, গত রাত্রিতেই তাহাকে তাহার বাড়ীতে পাঠাইয়া দেওয়া হইয়াছে। অনুচর যে তাহার কোনরূপ অভিসন্ধি বশতঃ এইরূপ মিথ্যা কথা কহিলেন, তাহা নহে; মনে করিলেন, উহাকে পাঠাইয়া দেওয়া হয় নাই, এই কথা জানিতে পারিলে, পাছে ওসমান তাহার উপর অসন্তুষ্ট হন। এই ভয়ে তিনি মিথ্যা কথা কহিলেন। তখন তিনি মনে মনে স্থির করিলেন যে, যেরূপ উপায়ে হউক, এখনই তাহাকে তাহার বাড়ীতে পাঠাইয়া দিবেন। সেই সময় ওমান অপর একটী কার্য্যোপলক্ষে তাঁহাকে স্থানান্তরে প্রেরণ করেন। তিনিও সেই কার্য্যোপলক্ষে এ দিকের কার্য্য একবারে ভুলিয়া যান। অথচ ওসমানের বিশ্বাস যে, সেই স্ত্রীলোকটী তাহার বাড়ীতে গমন করিয়াছে; সুতরাং সেই স্ত্রীলোকটী গৃহের ভিতর যে বন্ধ আছে, এ কথা আর কাহারও মনে হয় নাই, বা সেই ঘর খুলিবারও কোন প্রয়োজন উপস্থিত হয় নাই। এইরূপে অনাহারে এবং তৃষ্ণায় উহার মৃত্যু ঘটে। পরিশেষে আপনি বাড়ীর সমস্ত স্থান অনুসন্ধান করিতে করিতে, যখন সেই ঘরের দরজা খোলেন, তখন সেই মৃতদেহ বাহির হইয়া পড়ে। এই ব্যাপার দেখিয়া তখন ওসমানের সমস্ত কথা স্মরণ হয়, এবং বুঝিতে পারেন যে, তাহার অনুচরের মিথ্যা কথার নিমিত্ত তাহার কি সর্বনাশ ঘটিল! গোফুর খাঁ ইহার ভাল মন্দ কিছুই জানেন না; সুতরাং এই অবস্থা দেখিয়া তিনি একবারে হতজ্ঞান হইয়া পড়েন। আমি যতদুর শুনিয়াছি, ইহাই প্রকৃত ঘটনা। আমি অকপটে আপনার নিকট যাহা বলিলাম, তাহা কিন্তু এখন অন্যরূপ ঘটনা হইয়া পড়িয়াছে।” দারোগা। ইহাই যদি প্রকৃত ঘটনা হয়, তাহা হইলে এখন যেরূপ ঘটনার প্রমাণ পাওয়া যাইতেছে, তাহা কি?
হোসেন। তাহা যে কি, তাহা আপনি আপন মনে বেশ অবগত আছেন, আপনি আমাকে জিজ্ঞাসা করিতেছেন কেন?
দাবোগা। এই মোকদ্দমার যেরূপ প্রমাণ হইয়াছে, তাহা আপনি সমস্ত অবগত হইতে পারিয়াছেন কি?
হোসেন। তাহা সমস্তই জানিতে না পারিলে, আর আপনার নিকট আসিব কেন?
দারোগা। আপনি আমাকে যে সহস্র মুদ্রা প্রদান করিলেন, তাহার পরিবর্তে আমি এখন যে কোন উপকার করিতে পারিব, তাহা বোধ হয় না।
হোসেন। মনে করিলে এখনও বিস্তর উপকার করিতে পারেন।
দারোগা। এরূপ অবস্থায় আমার দ্বারা আর কি উপকার হইবার সম্ভাবনা আছে, বলুন। আমি বিবেচনা করিয়া দেখি, সেই উপকার করিতে আমি কত দুর সমর্থ।
হোসেন। সময় মত বলিব। তখন আপনার যতদুর সাধ্য, সেইরূপ উপকার করিবেন; কিন্তু এখন যাহাতে অন্য কোন সাক্ষীর যোগাড় না হয়, তাহা করিলেই যথেষ্ট হইবে। আরও একটী বিষয়ের অনুরোধের নিমিত্ত আমি আপনার নিকট আসিয়াছি। যে সমস্ত ব্যক্তি আমাদিগের বিপক্ষে সাক্ষ্য প্রদান করিয়াছে, তাহারা ওসমানের জ্বালায় সবিশেষ জ্বালাতন হইয়া, এইরূপে আমাদিগের সর্বনাশ করিতে বসিয়াছে। তাহারা যে কথা বলিয়াছে, পুনরায় যে তাহার অন্যথাচরণ করিবে, তাহা আমার
বোধ হয় না। তথাপি অর্থ প্রলোভনে আমরা একবার চেষ্টা করিয়া দেখিব, যদি কোনরূপে কৃতকার্য্য হইতে পারি। আপনি তাহাতে প্রতিবন্ধকতাচরণ করিবেন না, ইহা আমার একটী প্রধান অনুরোধ।
দারোগা। তাহা কিরূপে হইবে? সাক্ষিগণ একবার যেরূপ কথা বলিয়াছে, এখন যদি তাহার অন্যথাচরণ করে, তাহা হইলে তাহাদিগকে সম্পূর্ণরূপে বিপদে পড়িতে হইবে, তাহা কি তাহারা জানে না? বিশেষতঃ একথা যদি তাহারা আমাকে জিজ্ঞাসা করে, তাহা হইলে আমি কখনই বলিতে পারিব না যে, “তোমরা পূর্বে যেরূপ বলিয়াছ, এখন অনায়াসেই তাহার বিপরীত বলিতে পার।” আর সাক্ষীগণ যদি এখন অন্যরূপ বলে, তাহা হইলে তাহাদিগের ত বিপদ হইবেই; তদ্ব্যতীত আমাদিগের উপরও নানারূপ সন্দেহ উপস্থিত হইবে, আর হয় ত আমাকেও বিপদাপন্ন হইতে হইবে।
হোসেন। যাহাতে আপনাকে বিপদাপন্ন হইতে হইবে, এরূপ কার্যে আমি কখনই হস্তক্ষেপ করিব না। আর যাহা কিছু করিতে হইবে, আপনার সহিত পরামর্শ করিয়া, এবং সেই বিষয়ে আপনার মত লইয়া সেই কার্য্য করিব। আপনার অমতে কোন কার্য্য করিব না।
এই বলিয়া হোসেন, সেই দিবস দারোগা সাহেবের নিকট হইতে বিদায় গ্রহণ করিলেন।
হোসেন চলিয়া গেলে, দারোগা সাহেব মনে মনে স্থির করিলেন, যাহা কিছু পাইয়াছি, তাহা গ্রহণ করিয়াছি। আরও যদি কিছু পাই, তাহাও লইব। অধিকন্তু হোসেনের সাহায্যে সেই স্ত্রীলোকটীকেও পুনরায় আনাইয়া লইব। কিন্তু আসল কার্য্য কোনরূপেই ছাড়িব না; যাহাতে গোফুর এবং ওসমানকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলাইতে পারি, বিধিমতে তাহার চেষ্টা করিব।