চয়নিকা (১৯৪১)/কাঙালিনী
কাঙালিনী
আনন্দময়ীর আগমনে,
আনন্দে গিয়েছে দেশ ছেয়ে।
হেরো ওই ধনীর দুয়ারে
দাঁড়াইয়া কাঙালিনী মেয়ে।
বাজিতেছে উৎসবের বাঁশি,
কানে তাই পশ্চিতেছে আসি’,
স্নান চোখে তাই তাসিতেছে
দুরাশার মুখের স্বপন।
চারিদিকে প্রভাতের আলো
নয়নে লেগেছে বড়ো ভালো
আকাশেতে মেঘের মাঝারে
শরতের কনক তপন।
কত কে-যে আসে, কত যায়,
কেহ হাসে, কেহ গান গায়,
কত বরনের বেশ ভূষা—
ঝলকিছে কাঞ্চন-রতন,—
কত পরিজন দাস দাসী
পুষ্প পাতা কত রাশি রাশি,
চোখের উপর পড়িতেছে
মরীচিকা-ছবির মতন।
হেরো তাই রহিয়াছে চেয়ে
শূন্যমনা কাঙালিনী মেয়ে।
শুনেছে সে, মা এসেছে ঘরে,
তাই বিশ্ব আনন্দে ভেসেছে,
মা’র মায়া পায়নি কখনো,
মা কেমন দেখিতে এসেছে।
তাই বুঝি আঁখি ছলছল,
বাষ্পে ঢাকা নয়নের তারা।
চেয়ে যেন মা’র মুখপানে
বালিকা কাতর অভিমানে
বলে,— মা গো এ কেমন ধারা।
এত বাঁশি এত হাসিরাশি,
এত তোর রতনভূষণ,
তুই যদি আমার জননী,
মোর কেন মলিন বসন।—
ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েগুলি,
ভাই বোন করি’ গলাগলি,
অঙ্গনেতে নাচিতেছে ওই।
বালিকা দুয়ারে হাত দিয়ে,
তাদের হেরিছে দাঁড়াইয়ে,
ভাবিতেছে নিঃশ্বাস ফেলিয়ে
—আমি তো ওদের কেহ নই।
স্নেহ ক’রে আমার জননী
পরায়ে তো দেয়নি বসন,
প্রভাতে কোলেতে ক’রে নিয়ে
মুছায়ে তো দেয়নি নয়ন।—
আপনার ভাই নেই ব’লে
ওরে কি রে ডাকিবে না কেহ।
আর কারো জননী আসিয়া
ওরে কি রে করিবে না স্নেহ।
ও কি শুধু দুয়ার ধরিয়া
উৎসবের পানে র’বে চেয়ে,
শূন্যমনা কাঙালিনী মেয়ে?
ওর প্রাণ আঁধার যখন
করুণ শুনায় বড়ো বাঁশি,
দুয়ারেতে সজল নয়ন
এ বড়ো নিষ্ঠুর হাসি রাশি।
অনাথ ছেলেরে কোলে নিবি
জননীরা আয় তোরা সব,
মাতৃহারা মা যদি না পায়
তবে আজ কিসের উৎসব।
দ্বারে যদি থাকে দাঁড়াইয়া
ম্লানমুখ বিষাদে বিরস,—
তবে মিছে সহকার-শাখা,
তবে মিছে মঙ্গল কলস।