চয়নিকা (১৯৪১)/চির-দিন

চির-দিন

কোথা রাত্রি কোথা দিন, কোথা ফুটে চন্দ্র সূর্য তারা,
কে-বা আসে, কে-বা যায়, কোথা বসে জীবনের মেলা,
কে বা হাসে কে-বা গায়, কোথা খেলে হৃদয়ের খেলা,
কোথা পথ কোথা গৃহ, কোথা পান্থ কোথা পথহারা।
কোথা খসে পড়ে পত্র জগতের মহাবৃক্ষ হতে,
উড়ে উড়ে ঘুরে মরে অসীমেতে না পায় কিনারা,
বহে যায় কাল-বায়ু অবিশ্রাম আকাশের পথে,
ঝর ঝর মর মর শুষ্ক পত্র শ্যাম পত্রে মিলে।
এত ভাঙা, এত গড়া আনাগোনা জীবন্ত নিখিলে,
এত গান এত তান এত কান্না এত কলরব—
কোথা কে-বা, কোথা সিন্ধু, কোথা ঊর্মি, কোথা তার বেলা;—
গভীর অসীম গর্ভে নির্বাসিত নির্বাপিত সব।
জনপূর্ণ সুবিজনে, জ্যোতির্বিদ্ধ আঁধারে বিলীন
আকাশ-মণ্ডপে শুধু বসে আছে এক “চির-দিন।”

কী লাগিয়া বসে আছ, চাহিয়া রয়েছ কার লাগি।
প্রলয়ের পর-পারে নেহারিছ কার আগমন।
কার দূর পদধ্বনি চিরদিন করিছ শ্রবণ,
চির-বিরহীর মতো চির রাত্রি রহিয়াছ জাগি।
অসীম অতৃপ্তি লয়ে মাঝে মাঝে ফেলিছ নিঃশ্বাস
আকাশ-প্রান্তরে তাই কেঁদে ওঠে প্রলয়-বাতাস,

জগতের উর্ণাজাল ছিঁড়ে টুটে কোথা যায় ভাগি’।
অনন্ত আঁধার মাঝে কেহ তব নাহিকো দোসর,
পশে না তোমার প্রাণে আমাদের হৃদয়ের আশ,
পশে না তোমার কানে আমাদের পাখিদের স্বর—
সহস্র জগতে মিলি রচে তব বিজন প্রবাস,
সহস্র শবদে মিলি বাঁধে তব নিঃশব্দের ঘর,
হাসি কাঁদি ভালোবাসি, নাই তব হাসি কান্না মায়া,
আসি থাকি চলে যাই, কত ছায়া কত উপছায়া।


তাই কি। সকলি মায়া? আসে থাকে আর মিলে যায়?
তুমি শুধু একা আছ, আর সব আছে আর নাই?
যুগযুগান্তর ধরে ফুল ফুটে, ফুল ঝরে তাই?
প্রাণ পেয়ে প্রাণ দিই সে কি শুধু মরণের পায়ে।
এ ফুল চাহে না কেহ? লহে না এ পুজা-উপহার?
এ প্রাণ, প্রাণের আশা, টুটে কি অসীম শূন্যতায়।
বিশ্বের উঠিছে গান, বধিরতা বসি সিংহাসনে?
বিশ্বের কাঁদিছে প্রাণ, শূন্যে ঝরে অশ্রুবারিধার?
যুগ-যুগান্তের প্রেম কে লইবে, নাই ত্রিভুবনে?
চরাচর মগ্ন আছে নিশিদিন আশার স্বপনে—
বাঁশি শুনে চলিয়াছি, সে কি হায় বৃথা অভিসার।
বোলো না সকলি স্বপ্ন সকলি এ মায়ার ছলন,
বিশ্ব যদি স্বপ্ন দেখে সে স্বপন কাহার স্বপন।
সে কি এই প্রাণহীন প্রেমহীন অন্ধ অন্ধকার।

8


ধ্বনি খুঁজে প্রতিধ্বনি প্রাণ খুঁজে মরে প্রতিপ্রাণ,
জগৎ আপনা দিয়ে খুঁজিছে তাহার প্রতিদান।
অসীমে উঠিছে প্রেম শুধিবারে অসীমের ঋণ—
যত দেয় তত পায়, কিছুতে না হয় অবদান।

যত ফুল দেয় ধরা তত ফুল পায় প্রতিদিন—
যত প্রাণ ফুটাইছে ততই বাড়িয়া উঠে প্রাণ।
যাহা আছে তাই দিয়ে ধনী হয়ে উঠে দীনহীন,
অসীমে জগতে এ কী পিরিতির আদান-প্রদান।
কাহারে পূজিছে ধরা শ্যামল যৌবন উপহারে,
নিমেষে নিমেষে তাই ফিরে পায় নবীন যৌবন।
প্রেমে টেনে আনে প্রেম, সে প্রেমের পাথার কোথা রে।
প্রাণ দিলে প্রাণ আসে,—কোথা সেই অনন্ত জীবন।
ক্ষুদ্র আপনারে দিলে, কোথা পাই অসীম আপন,
সে কি ওই প্রাণহীন প্রেমহীন অন্ধ অন্ধকারে।

—কড়ি ও কোমল