চয়নিকা (১৯৪১)/পুরাতন ভৃত্য

পুরাতন ভৃত্য

ভূতের মতন চেহারা যেমন, নির্বোধ অতি ঘোর।
যা-কিছু হারায়, গিন্নি বলেন, “কেষ্টা বেটাই চোর।”
উঠিতে বসিতে করি বাপান্ত, শুনেও শোনে না কানে।
ষত পায় বেত, না পায় বেতন, তবু না চেতন মানে।
বড়ো প্রয়োজন, ডাকি প্রাণপণ চীৎকার করি’ “কেষ্টা,”—
যত করি তাড়া, নাহি পাই সাড়া, খুঁজে ফিরি সারা দেশটা।
একখানা দিলে নিমেষ ফেলিতে তিনখানা ক’রে আনে,
তিনখানা দিলে একখানা রাখে, বাকি কোথা নাহি জানে।
যেখানে সেখানে দিবসে দুপুরে নিদ্রাটি আছে সাধা।
মহাকলরবে গালি দিই যবে “পাজি হতভাগা গাধা”
দরজার পাশে দাঁড়িয়ে সে হাসে, দেখে জ্ব’লে যায় পিত্ত।
তবু মায়া তাব ত্যাগ করা ভার—বড়ো পুরাতন ভৃতা।৷

ঘরের কর্ত্রী রুক্ষ-মূর্তি, বলে “আর পারি নাকো,
রহিল তোমার এ ঘর দুয়ার কেষ্টারে লয়ে থাকে॥
না মানে শাসন, বসন বাসন অশন আসন যত
কোথায় কী গেল, শুধু টাকাগুলো যেতেছে জলের মতো।
গেলে সে বাজার, সারাদিনে আর দেখা পাওয়া তার ভার,—
করিলে চেষ্টা কেষ্টা ছাড়া কি ভৃত্য মেলে না আর।”
শুনে মহারেগে ছুটে যাই বেগে, আনি তার টিকি ধ’রে,—
বলি তারে “পাজি, বেরো তুই আজই দূর করে দিনু তোরে।”
ধীরে চলে যায়, ভাবি গেল দায়;—পর-দিন উঠে দেখি
হুঁকাটি বাড়ায়ে রয়েছে দাঁড়ায়ে বেটা বুদ্ধির ঢেঁকি।
প্রসন্ন মুখ, নাহি কোনো দুখ, অতি অকাতর চিত্ত,
ছাড়ালে না ছাড়ে, কী করিব তারে, মোর পুরাতন ভৃত্য।৷

সে-বছরে ফাঁকা পেনু কিছু টাকা করিয়া দালাল গিরি।
করিলাম মন শ্রীবৃন্দাবন বারেক আসিব ফিরি’।
পরিবার তায় সাথে যেতে চায়, —বুঝায়ে বলিনু তারে—
পতির পুণ্যে সতীর পুণ্য; —নহিলে খরচ বাড়ে।
লয়ে রশারশি করি’ কশাকশি পোঁটলা পুঁটুলি বাঁধি’
বলয় বাজায়ে বাক্স সাজায়ে গৃহিণী কহিল কাঁদি’,—
“পরদেশে গিয়ে কেষ্টারে নিয়ে কষ্ট অনেক পাবে।”
আমি কহিলাম, “আরে রাম রাম, নিবারণ সাথে যাবে।”
রেলগাড়ি ধায়;—হেরিলাম হায় নামিয়া বর্ধমানে—
কৃষ্ণকান্ত অতি প্রশান্ত তামাক সাজিয়া আনে।
স্পর্ধা তাহার হেন মতে আর কত বা সহিব নিত্য।
যত তারে দুষি তবু হনু খুশী হেরি’ পুরাতন ভৃত্য।৷

নামিনু শ্রীধামে; দক্ষিণে বামে পিছনে সমুখে যত
লাগিল পাণ্ডা, নিমেষে প্রাণটা করিল কণ্ঠাগত।
জন ছয় সাথে মিলি’ একসাথে পরম বন্ধুভাবে
করিলাম বাসা, মনে হোলো আশা আরামে দিবস যাবে।
কোথা ব্রজবালা, কোথা বনমালা, কোথা বনমালী হরি,
কোথা হা হন্ত, চিরবসন্ত, আমি বসন্তে মরি।
বন্ধু যে যত স্বপ্নের মতো বাসা ছেড়ে দিল ভঙ্গ।
আমি একা ঘরে, ব্যাধি-থরশরে ভরিল সকল অঙ্গ।
ডাকি নিশিদিন সকরুণ ক্ষীণ—“কেষ্টা আয় রে কাছে,
এতদিনে শেষে আসিয়া বিদেশে প্রাণ বুঝি নাহি বাঁচে।”
হেরি তার মুখ ভ’রে ওঠে বুক, সে যেন পরম বিত্ত।
নিশিদিন ধ’রে দাঁড়ায়ে শিয়রে মোর পুরাতন ভৃত্য।৷

মুখে দেয় জল, শুধায় কুশল, শিরে দেয় মোর হাত;
দাঁড়ায়ে নিঝুম, চোখে নাই ঘুম, মুখে নাই তার ভাত।

বলে বার বার, “কর্তা তোমার কোনো ভয় নাই, শুন,
যাবে দেশে ফিরে, মা-ঠাকুরানীরে দেখিতে পাইবে পুন।”
লভিয়া আরাম আমি উঠিলাম, তাহারে ধরিল জ্বরে;
নিল সে আমার কাল-ব্যাধিভার আপনার দেহ-’পরে।
হয়ে জ্ঞানহীন কাটিল দু-দিন বন্ধ হইল নাড়ী।
এতবার তারে গেনু ছাড়াবারে, এতদিনে গেল ছাড়ি’।
বহুদিন পরে আপনার ঘরে ফিরি সারিয়া তীর্থ।
আজ সাথে নেই চিরসাথী সেই মোর পুরাতন ভৃত্য।

—চিত্রা

১২ ফাল্গুন, ১৩০১