চয়নিকা (১৯৪১)/বধূ

বধূ

“বেলা-যে পড়ে এল, জলকে চল্।”—
পুরানো সেই সুরে কে যেন ডাকে দূরে
কোথা সে ছায়া, সখি, কোথা সে জল,
কোথা সে বাঁধাঘাট অশ্বথ-তল।
ছিলাম আনমনে একেলা এককোণে,
কে যেন ডাকিল রে “জল্‌কে চল্।”

কলসী লয়ে কাঁখে পথ সে বাঁকা,
বামেতে মাঠ শুধু সদাই করে ধূধূ,
ডাহিনে বাঁশ-বন হেলায়ে শাখা।
দিঘির কালো জলে সাঁঝের আলো ঝলে
দুধারে ঘন বন ছায়ায় ঢাকা।
গভীর থির নীরে ভাসিয়া যাই ধীরে
কোকিল ডাকে তীরে অমিয়-মাথা।
আসিতে পথে ফিরে, আঁধার তরুশিরে
সহসা দেখি চাঁদ আকাশে আঁকা।

অশথ উঠিয়াছে প্রাচীর টুটি’,
সেখানে ছুটিতাম সকালে উঠি’।
শরতে ধরাতল শিশিরে ঝলমল,
করবী থোলো থোলো রয়েছে ফুটি।
প্রাচীর বেয়ে বেয়ে সবুজে ফেলে ছেয়ে
বেগুনি ফুলে-ভরা লতিকা দুটি!
ফাটলে দিয়ে আঁখি আড়ালে বসে থাকি,
আঁচল পদতলে পড়েছে লুটি।

মাঠের পরে মাঠ মাঠের শেষে
সুদূর গ্রামখানি আকাশে মেশে।
এধারে পুরাতন শ্যামল তালবন
সঘন সারি দিয়ে দাঁড়ায়ে ঘেঁসে।
বাঁধের জল-রেখা ঝলসে যায় দেখা,
জটলা করে তীরে রাখাল এসে।
চলেছে পথখানি কোথায় নাহি জানি,
কে জানে কত শত নূতন দেশে।

হায়রে রাজধানী পাষাণ কায়া।
বিরাট মুঠিতলে চাপিছে দৃঢ়বলে,
ব্যাকুল বালিকারে নাহিকো মায়া।
কোথা সে খোলা মাঠ, উদার পথ ঘাট,
পাখির গান কই, বনের ছায়া।

কে যেন চারিদিকে দাঁড়িয়ে আছে;
খুলিতে নারি মন শুনিবে পাছে।
হেথায় বৃথা কাঁদা, দেয়ালে পেয়ে বাধা
কাঁদন ফিরে আসে আপন কাছে।

আমার আঁখিজল কেহ না বোঝে।
অবাক হয়ে সবে কারণ খোঁজে।
“কিছুতে নাহি তোষ, সে-ও তো মহাদোষ,
গ্রাম্য বালিকার স্বভাব ও-যে।
স্বজন প্রতিবেশী এত-যে মেশামেশি,
ও কেন কোণে ব’সে নয়ন বোজে।”

কেহ-বা দেখে মুখ কেহ-বা দেহ,
কেহ-বা ভালো বলে, বলে না কেহ।

ফুলের মালাগাছি বিকাতে আসিয়াছি,
পরখ করে সবে, করে না স্নেহ।

সবার মাঝে আমি ফিরি একেলা।
কেমন ক’রে কাটে সারাটা বেলা।
ইটের পর ইঁট মাঝে মানুষ কীট,
নাইকো ভালোবাসা নাইকো খেলা।


কোথায় আছ তুমি কোথায় মা গো।
কেমনে ভুলে তুই আছিস হাঁ গো।
উঠিলে নব শশী, ছাদের ’পরে বসি’
আর কি রূপকথা বলিবি না গো।
হৃদয়-বেদনায় শূন্য বিছানায়
বুঝি মা, আঁখিজলে রজনী জাগো।
কুসুম তুলি’ লয়ে প্রভাতে শিবালয়ে
প্রবাসী তনয়ার কুশল মাগো।


হেথাও ওঠে চাঁদ ছাদের পারে।
প্রবেশ মাগে আলো ঘরের দ্বারে।
আমারে খুঁজিতে সে ফিরিছে দেশে দেশে
যেন সে ভালোবেসে চাহে আমারে।

নিমেষ তরে তাই আপনা ভুলি’
ব্যাকুল ছুটে যাই দুয়ার খুলি’।
অমনি চারিধারে নয়ন উকি মারে,
শাসন ছুটে আসে ঝটিকা তুলি’।

দেবে না ভালোবাসা, দেবে না আলো।
সদাই মনে হয় আঁধার ছায়াময়
দিঘির সেই জল শীতল কালো,
তাহারি কোলে গিয়ে মরণ ভালো।
ডাক্ লো ডাক্ তোরা, বল্ লো বল্—
“বেলা যে পড়ে এল, জলকে চল্।”
কবে পড়িবে বেলা, ফুরাবে সব খেলা,
নিবাবে সব জ্বালা শীতল জল,
জানিস যদি কেহ আমায় বল্।

সংশোধন পরিবর্ধন।
শান্তিনিকেতন। ৭ কার্তিক
১১ জ্যৈষ্ঠ, ১২৯৫
—মানসী