চয়নিকা (১৯৪১)/বৈষ্ণব কবিতা

বৈষ্ণব-কবিতা

শুধু বৈকুণ্ঠের তরে বৈষ্ণবের গান?
পূর্বরাগ অনুরাগ মান অভিমান,
অভিার প্রেমলীলা বিরহ মিলন,
বৃন্দাবন-গাথা; এই প্রণয়-স্বপন
শ্রাবণের শর্বরীতে কালিন্দীর কূলে,
চারি চক্ষে চেয়ে দেখা কদম্বের মূলে
শরমে সম্ভ্রমে,—এ কি শুধু দেবতার।
এ সংগীত-রসধারা নহে মিটাবার
দীন মর্ত্যবাসী এই নরনারীদের

প্রতি রজনীর আর প্রতি দিবসের
তপ্ত প্রেম-তৃষা?
এ গীত-উৎসব মাঝে
শুধু তিনি আর ভক্ত নির্জনে বিরাজে;
দাঁড়ায়ে বাহির দ্বারে মোরা নরনারী
উৎসুক শ্রবণ পাতি’ শুনি যদি তারি
দুয়েকটি তান,—দূর হতে তাই শুনে’
তরুণ বসন্তে যদি নবীন ফাল্গুনে
অন্তর পুলকি’ উঠে; শুনি’ সেই সুর
সহসা দেখিতে পাই দ্বিগুণ মধুর
আমাদের ধরা;—মধুময় হয়ে উঠে
আমাদের বনচ্ছায়ে যে-নদীটি ছুটে,
মোদের কুটীর প্রান্তে যে-কদম্ব ফুটে,
বরষার দিনে;—সেই প্রেমাতুর তানে
যদি ফিরে চেয়ে দেখি মোর পার্শ্বপানে
ধরি’ মোর বামবাহু রয়েছে দাঁড়ায়ে
ধরার সঙ্গিনী মোর, হৃদয় বাড়ায়ে
মোর দিকে, বহি’ নিজ মৌন ভালোবাসা;
ওই গানে যদি বা সে পায় নিজ ভাষা,—
যদি তার মুখে ফুটে পূর্ণ প্রেম-জ্যোতি,
তোমার কি তাঁর, বন্ধু, তাহে কার ক্ষতি।

সত্য ক’রে কহ মোরে হে বৈষ্ণব কবি,
কোথা তুমি পেয়েছিলে এই প্রেমচ্ছবি,
কোথা তুমি শিখেছিলে এই প্রেমগান
বিরহ-তাপিত। হেরি কাহার নয়ান
রাধিকার অশ্রু আঁখি পড়েছিল মনে।
বিজন বসন্তরাতে মিলন-শয়নে

কে তোমারে বেঁধেছিল দুটি বাহুডোরে,
আপনার হৃদয়ের অগাধ সাগরে,
রেখেছিল মগ্ন করি’। এত প্রেমকথা
রাধিকার চিত্তদীর্ণ তীব্র ব্যাকুলতা
চুরি করি’ লইয়াছ কার মুখ, কার
আঁখি হতে। আজ তার নাহি অধিকার
সে সংগীতে? তারি নারী হৃদয়-সঞ্চিত
তার ভাষা হতে তারে করিবে বঞ্চিত
চিরদিন?

আমাদেরি কুটীর-কাননে
ফুটে পুষ্প, কেহ দেখ দেবতা-চরণে
কেহ রাখে প্রিয়জন তরে—তাহে তাঁর
নাহি অসন্তোষ। এই প্রেম-গীতি হার
গাঁথা হয় নরনারী-মিলন-মেলায়,
কেহ দেয় তাঁরে, কেহ বঁধুর গলায়।
দেবতারে যাহা দিতে পারি, দিই তাই
প্রিয়জনে—প্রিয়জনে যাহা দিতে পাই
তাই দিই দেবতারে, আর পাব কোথা।
দেবতারে প্রিয় করি, প্রিয়েরে দেবতা।

বৈষ্ণব কবির গাঁথা প্রেম-উপহার
চলিয়াছে নিশিদিন কত ভাবে ভার
বৈকুণ্ঠের পথে। মধ্য-পথে নরনারী
অক্ষয় সে সুধারাশি করি কাড়াকাড়ি
লইতেছে আপনার প্রিয় গৃহতরে
যথাসাধ্য যে যাহার; যুগে যুগান্তরে
চিরদিন পৃথিবীতে যুবকযুবতী
নরনারী এমনি চঞ্চল মতিগতি।

দুই পক্ষে মিলে একেবারে আত্মহারা
অবোধ অজ্ঞান সৌন্দর্যের দস্যু তারা
লুটে-পুটে নিতে চায় সব। এত গীতি,
এত ছন্দ, এত ভাবে উচ্ছ্বাসিত প্রীতি,
এত মধুরতা দ্বারের সম্মুখ দিয়া
বহে যায়—তাই তারা পড়েছে আসিয়া
সবে মিলি’ কলরবে সেই সুধাস্রোতে।
সমুদ্রবাহিনী সেই প্রেমধারা হতে
কলস ভরিয়া তারা লয়ে যায় তীরে
বিচার না করি’ কিছু, আপন কুটীরে
আপনার তরে। তুমি মিছে ধরো দোষ,
হে সাধু পণ্ডিত, মিছে করিতেছ রোষ।
যাঁর ধন তিনি ওই অপার সন্তোষে
অসীম স্নেহের হাসি হাসিছেন ব’সে।

শাহাজাদপুর
১৮ আষাঢ়, ১২৯৯
—সোনার তরী