চয়নিকা (১৯৪১)/মানস-সুন্দরী

মানস-সুন্দরী

আজ কোনো কাজ নয়,—সব ফেলে দিয়ে
ছন্দোবন্ধগ্রন্থগীত—এসো তুমি প্রিয়ে,
আজন্ম-সাধন-ধন সুন্দরী আমার,
কবিতা, কল্পনা-লতা। শুধু একবার
কাছে বসো। আজ শুধু কূজন গুঞ্জন,
তোমাতে আমাতে শুধু নীরবে ভুঞ্জন
এই সন্ধ্যা-কিরণের সুবর্ণ মদিরা,—
যতক্ষণ অন্তরের শিরা উপশিরা
লাবণ্য প্রবাহভরে ভরি’ নাহি উঠে,
যতক্ষণে মহানন্দে নাহি যায় টুটে
চেতনাবেদনাবন্ধ, ভুলে যাই সব
কী আশা মেটেনি প্রাণে, কী সংগীতরব
গিয়েছে নীরব হয়ে, কী আনন্দসুধা
অধরের প্রান্তে এসে অন্তরের ক্ষুধা

না মিটায়ে গিয়াছে শুকায়ে। এই শান্তি,
এই মধুরতা, দিক্ সৌম্য ম্লানকান্তি,
জীবনের দুঃখদৈন্য অতৃপ্তির ’পর
করুণকোমল আভা গভীর সুন্দর।
বীণা ফেলে দিয়ে এসো, মানস-সুন্দরী
দুটি রিক্তহস্ত শুধু আলিঙ্গনে ভরি’
কণ্ঠে জড়াইয়া দাও।—মৃণাল-পরশে
রোমাঞ্চ অঙ্কুরি’ উঠে মর্মান্ত হরষে,—
কম্পিত চঞ্চল বক্ষ, চক্ষু ছলছল,
মুগ্ধতনু মরি যায়, অন্তর কেবল
অঙ্গের সীমান্ত প্রান্তে উদ্ভাসিয়া উঠে,
এখনি ইন্দ্রিয়বন্ধ বুঝি টুটে টুটে।
অর্ধেক অঞ্চল পাতি বসাও যতনে
পার্শ্বে তব; সুমধুর প্রিয় সম্বোধনে
ডাকো মোরে, বলো প্রিয়ে, বলো প্রিয়তম;—
কুন্তল-আকুল মুখ বক্ষে রাখি মম
হৃদয়ের কানে কানে অতি মৃদু ভাষে
সংগোপনে ব’লে যাও যাহা মুখে আসে
অর্থহারা ভাবে-ভরা ভাষা। অয়ি প্রিয়া,
চুম্বন মাগিব যবে, ঈষৎ হাসিয়া
বাঁকায়ো না গ্রীবাখানি, ফিরায়ো না মুখ,
উজ্জ্বল রক্তিম বর্ণ সুধাপূর্ণ সুখ
রেখো ওষ্ঠাধরপুটে, ভক্ত ভৃঙ্গ তরে
সম্পূর্ণ চুম্বন এক, হাসি স্তরেস্তরে
সরসসুন্দর; নবস্ফুট পুষ্পসম
হেলায়ে বঙ্কিম গ্রীবা বৃন্ত নিরুপম
মুখখানি তুলে ধোরো; আনন্দ-আভায়
বড়ো বড়ো দুটি চক্ষু পল্লব-প্রচ্ছায়

রেখো মোর মুখপানে প্রশান্ত বিশ্বাসে,
নিতান্ত নির্ভরে। যদি চোখে জল আসে
কাঁদিব দু-জনে; যদি ললিত কপোলে
মৃদু হাসি ভাসি উঠে, বসি’ মোর কোলে,
বক্ষ বাঁধি’ বাহুপাশে স্কন্ধে মুখ রাখি’
হাসিয়ো নীরবে অর্ধ-নিমীলিত আঁখি,
যদি কথা পড়ে মনে তবে কলস্বরে
ব’লে যেয়ো কথা, তরল আনন্দভরে
নির্ঝরের মতো, অর্ধেক রজনী ধরি
কত না কাহিনী স্মৃতি কল্পনালহরী
মধুমাখা কণ্ঠের কাকলি, যদি গান
ভালো লাগে, গেয়ো গান; যদি মুগ্ধ প্রাণ
নিঃশব্দ নিস্তব্ধ শান্ত সম্মুখে চাহিয়া
বসিয়া থাকিতে চাও, তাই রবো প্রিয়া।
হেরিব অদূরে পদ্মা, উচ্চতটতলে
শ্রান্ত রূপসীর মতো বিস্তীর্ণ অঞ্চলে
প্রসারিয়া তনুখানি, সায়াহ্ন-আলোকে
শুয়ে আছে; অন্ধকার নেমে আসে চোখে
চোখের পাতার মতো; সন্ধ্যাতারা ধীরে
সন্তর্পণে করে পদার্পণ, নদীতীরে
অরণ্যশিয়রে, যামিনী শয়ন তার
দেয় বিছাইয়া, একখানি অন্ধকার
অনন্ত ভুবনে। দোঁহে মোরা রবো চাহি’
অপার তিমিরে; আর কোথা কিছু নাহি,
শুধু মোর করে তব করতলখানি,
শুধু অতি কাছাকাছি দুটি জনপ্রাণী
অসীম নির্জনে; বিষণ্ণ বিচ্ছেদরাশি
চরাচরে আর সব ফেলিয়াছে গ্রাসি,

শুধু এক প্রান্তে তার প্রলয়-মগন
বাকি আছে একখানি শঙ্কিত মিলন,
দুটি হাত ত্রস্ত কপোতের মতো, দুটি
বক্ষ দুরুদুরু দুই প্রাণে আছে ফুটি,
শুধু একখানি ভয়, একখানি আশা,
একখানি অশ্রুভরে নম্র ভালোবাসা।


আজিকে এমনি তবে কাটিবে যামিনী
আলস্যবিলাসে। অয়ি নিরভিমানিনী,
অয়ি মোর জীবনের প্রথম প্রেয়সী,
মোর ভাগ্য-গগনের সৌন্দর্যের শশী,
মনে আছে, কবে কোন্ ফুল্ল যূথীবনে
বহু বাল্যকালে, দেখা হোত দুইজনে
আধো চেনা-শোনা? তুমি এই পৃথিবীর
প্রতিবেশিনীর মেয়ে, ধরার অস্থির
এক বালকের সাথে কী খেলা খেলাতে
সখি, আসিতে হাসিয়া, তরুণ প্রভাতে
নবীন বালিকা-মূর্তি, শুভ্রবস্ত্র পরি’
উষার কিরণ-ধারে সদ্যঃস্নান করি’
বিকচ কুসুমসম ফুল্ল মুখখানি,
নিদ্রাভঙ্গে দেখা দিতে, নিয়ে যেতে টানি’
উপবনে কুড়াতে শেফালি। বারে বারে
শৈশব-কর্তব্য হতে ভুলায়ে আমারে,
ফেলে দিয়ে পুঁথিপত্র, কেড়ে নিয়ে খড়ি
দেখায়ে গোপন পথ দিতে মুক্ত করি’
পাঠশালা-কারা হতে; কোথা গৃহকোণে
নিয়ে যেতে নির্জনেতে রহস্য-ভবনে

জনশূন্য গৃহছাদে আকাশের তলে;
কী করিতে খেলা, কী বিচিত্র কথা ব’লে
ভুলাতে আমারে, স্বপ্নসম চমৎকার
অর্থহীন, সত্য মিথ্যা তুমি জানো তার।
দুটি কর্ণে দুলিত মুকুতা, দুটি করে
সোনার বলয়, দুটি কপোলের ’পরে
খেলিত অলক, দুটি স্বচ্ছ নেত্র হতে
কাঁপিত আলোক, নির্মল নির্ঝর স্রোতে
চূর্ণরশ্মিসম। দোঁহে দোঁহা ভালো ক’রে
চিনিবার আগে নিশ্চিন্ত বিশ্বাসভরে
খেলাধুলা ছুটাছুটি দু-জনে সতত,
কথাবার্তা বেশবাস বিথান বিতত।
তারপরে একদিন—কী জানি সে কবে—
জীবনের বনে, যৌবন-বসন্তে যবে
প্রথম মলয় বায়ু ফেলেছে নিশ্বাস,
মুকুলিয়া উঠিতেছে শত নব আশ,
সহসা চকিত হয়ে আপন সংগীতে
চমকিয়া হেরিলাম—খেলাক্ষেত্র হতে
কখন অন্তর-লক্ষ্মী এসেছ অন্তরে
আপনার অন্তঃপুরে গৌরবের ভরে
বসি’ আছ মহিষীর মতো। কে তোমারে
এনেছিল বরণ করিয়া। পুরদ্বারে
কে দিয়াছে হুলুধ্বনি। ভরিয়া অঞ্চল
কে করেছে বরিষন নব পুষ্পদল
তোমার আনম্রশিরে আনন্দে আদরে।
সুন্দর সাহানা রাগে বংশীর সুস্বরে
কী উৎসব হয়েছিল আমার জগতে,
যেদিন প্রথম তুমি পুষ্পফুল্লপথে

লজ্জা মুকুলিত মুখে রক্তিম অধরে
বধূ হয়ে প্রবেশিলে চিরদিন তরে
আমার অন্তরগৃহে—যে গুপ্ত আলয়ে
অন্তর্যামী জেগে আছে সুখদুঃখ ল’য়ে
যেখানে আমার যত লজ্জা আশাভয়
সদা কম্পমান, পরশ নাহিকো সয়
এত সুকুমার। ছিলে খেলার সঙ্গিনী,
এখন হয়েছ মোর মর্মের গেহিনী,
জীবনের অধিষ্ঠাত্রী দেবী। কোথা সেই
অমূলক হাসিঅশ্রু, সে চাঞ্চল্য নেই,
সে বাহুল্য কথা। স্নিগ্ধদৃষ্টি সুগম্ভীর
স্বচ্ছনীলাম্বর সম; হাসিথানি স্থির,
অশ্রুশিশিরেতে ধৌত পরিপূর্ণ দেহ
মঞ্জরিত বল্লরীর মতো, প্রীতিস্নেহ
গভীর সংগীততানে উঠিছে ধ্বনিয়া
স্বর্ণ-বীণাতন্ত্রী হতে রনিয়া রনিয়া
অনন্ত বেদনা বহি’। সে অবধি প্রিয়ে,
রয়েছি বিস্মিত হয়ে তোমারে চাহিয়ে
কোথাও না পাই অন্ত। কোন্ বিশ্বপার
আছে তব জন্মভূমি। সংগীত তোমার
কত দূরে নিয়ে যাবে, কোন্ কল্পলোকে
আমারে করিবে বন্দী, গানের পুলকে
বিমুগ্ধ কুরঙ্গসম। এই-যে বেদনা,
এর কোনো ভাষা আছে? এই-যে বাসনা,
এর কোনো তৃপ্তি আছে? এই-যে উদার,
সমুদ্রের মাঝখানে হয়ে কর্ণধার
ভাসায়েছ সুন্দর তরণী, দশ দিশি
অস্ফুট কল্লোলধ্বনি চির দিবানিশি

কী কথা বলিছে কিছু নারি বুঝিবারে
এর কোনো কূল আছে? সৌন্দর্যপাথারে
যে বেদনা-বায়ু-ভরে ছুটে মনতরী,
সে বাতাসে, কতবার মনে শঙ্কা করি
ছিন্ন হয়ে গেল বুঝি হৃদয়ের পাল।
অভয় আশ্বাসভরা নয়ন বিশাল
হেরিয়া ভরসা পাই, বিশ্বাস বিপুল
জাগে মনে—আছে এক মহা উপকূল
এই সৌন্দর্যের তটে, বাসনার তীরে
মোদের দোঁহার গৃহ।

হাসিতেছ ধীরে
চাহি’ মোর মুখে ওগো রহস্যমধুরা।
কী বলিতে চাহ মোরে প্রণয়বিধুরা
সীমন্তিনী মোর। কী কথা বুঝাতে চাও।
কিছু ব’লে কাজ নাই—শুধু ঢেকে দাও
আমার সর্বাঙ্গ মন তোমার অঞ্চলে,
সম্পূর্ণ হরণ করি’ লহ গো সবলে
আমার আমারে, নগ্ন বক্ষে বক্ষ দিয়া
অন্তর-রহস্য তব শুনে নিই প্রিয়া।
তোমার হৃদয়কম্প অঙ্গুলির মতো
আমার হৃদয়তন্ত্রী করিবে প্রহত,
সংগীততরঙ্গধ্বনি উঠিবে গুঞ্জরি’
সমস্ত জীবন ব্যাপি থরথর করি’।
নাইবা বুঝিনু কিছু, নাইবা বলিনু
নাইবা গাঁথিনু গান, নাইবা চলিনু
ছন্দোবদ্ধ পথে, সলজ্জ হৃদয়খানি
টানিয়া বাহিরে। শুধু ভুলে গিয়ে বাণী

কাঁপিব সংগীতভরে, নক্ষত্রের প্রায়
শিহরি জ্বলিব শুধু কম্পিত শিখায়,
শুধু তরঙ্গের মতো ভাঙিয়া পড়িব
তোমার তরঙ্গপানে; বাঁচিব মরিব
শুধু, আর কিছু করিব না। দাও সেই
প্রকাণ্ড প্রবাহ, যাহে এক মুহূর্তেই
জীবন করিয়া পূর্ণ, কথা না বলিয়া
উন্মত্ত হইয়া যাই উদ্দাম চলিয়া।

মানসীরূপিণী ওগো, বাসনা-বাসিনী,
আলোকবসনা ওগো, নীরবভাষিণী,
পরজন্মে তুমি কিগো মূর্তিমতী হয়ে
জন্মিবে মানবগৃহে নারীরূপ লয়ে
অনিন্দ্যসুন্দরী। এখন ভাসিছ তুমি
অনন্তের মাঝে স্বর্গ হতে মর্ত্যভূমি
করিছ বিহার, সন্ধ্যার কনকবর্ণে
রাঙিছ অঞ্চল, উষার গলিতস্বর্ণে
গড়িছ মেখলা পূর্ণ তটিনীর জলে
করিছ বিস্তার, তলতল ছলছলে
ললিত যৌবনখানি, বসন্ত বাতাসে
চঞ্চল বাসনাব্যথা সুগন্ধ নিশ্বাসে
করিছ প্রকাশ; নিষুপ্ত পূর্ণিমা রাতে
নির্জন গগনে, একাকিনী ক্লান্ত হাতে
বিছাইছ দুগ্ধশুভ্র বিরহ-শয়ন;
শরৎ-প্রত্যুষে উঠি’ করিছ চয়ন
শেফালি, গাঁথিতে মালা, ভুলে গিয়ে শেষে,
তরুতলে ফেলে দিয়ে, আলুলিত কেশে

গভীর অরণ্য ছায়ে উদাসিনী হয়ে
বসে থাকো; ঝিকিমিকি আলোছায়া লয়ে
কম্পিত অঙ্গুলি দিয়ে বিকাল বেলায়
বসন বয়ন করো বকুলতলায়;
অবসন্ন দিবালোকে কোথা হতে ধীরে
ঘনপল্লবিত কুঞ্জে সরোবর-তীরে
করুণ কপোতকণ্ঠে গাও মূলতান,
কখন অজ্ঞাতে আসি’ ছুঁয়ে যাও প্রাণ
সকৌতুকে; করি’ দাও হৃদয় বিকল,
অঞ্চল ধরিতে গেলে পালাও চঞ্চল
কলকণ্ঠে হাসি’, অসীম আকাঙ্ক্ষারাশি
জাগাইয়া প্রাণে, দ্রুতপদে উপহাসি’
মিলাইয়া যাও নভোনীলিমার মাঝে।
কখনো মগন হয়ে আছি যবে কাজে
স্খলিত-বসন তব শুভ্র রূপখানি
নগ্ন বিদ্যুতের আলো নয়নেতে হানি’
চকিতে চমকি’ চলি’ যায়—জানালায়
একেলা বসিয়া যবে আঁধার সন্ধ্যায়,—
মুখে হাত দিয়ে মাতৃহীন বালকের
মতো, বহুক্ষণ কাঁদি, স্নেহ-আলোকের
ভরে, ইচ্ছা করি, নিশার আঁধারস্রোতে
মুছে ফেলে দিয়ে যায় সৃষ্টিপট হতে
এই ক্ষীণ অর্থহীন অস্তিত্বের রেখা,
তখন করুণাময়ী দাও তুমি দেখা
তারকা আলোক-জালা স্তব্ধ রজনীর
প্রান্ত হতে নিঃশব্দে আসিয়া; অশ্রুনীর
অঞ্চলে মুছায়ে দাও, চাও মুখপানে
স্নেহময় প্রশ্নভরা করুণ নয়ানে,

নয়ন চুম্বন করো, স্নিগ্ধ হস্তখানি
ললাটে বুলায়ে দাও, না কহিয়া বাণী
সান্ত্বনা ভরিয়া প্রাণে কবিরে তোমার
ঘুম পাড়াইয়া দিয়া কখন আবার
চলে যাও নিঃশব্দ চরণে।
সেই তুমি
মূর্তিতে দিবে কি ধরা। এই মর্ত্যভূমি
পরশ করিবে রাঙা চরণের তলে?
অন্তরে বাহিরে বিশ্বে শূন্যে জলে স্থলে
সর্ব ঠাঁই হতে, সর্বময়ী আপনারে
করিয়া হরণ—ধরণীর এক ধারে
ধরিবে কি এক-খানি মধুর মুরতি।
নদী হতে লতা হতে আনি’ তব গতি
অঙ্গে অঙ্গে নানা ভঙ্গে দিবে হিল্লোলিয়া,
বাহুতে বাঁকিয়া পড়ি গ্রীবায় হেলিয়া
ভাবের বিকাশভরে? কী নীল বসন
পরিবে সুন্দরী তুমি। কেমন কঙ্কণ
ধরিবে দু-খানি হাতে। কবরী কেমনে
বাঁধিবে, নিপুণ বেণী বিনায়ে যতনে।
কচি কেশগুলি পড়ি শুভ্র গ্রীবা-’পরে
শিরীষ কুসুম সম সমীরণভরে
কাঁপিবে কেমনে। শ্রাবণে দিগন্তপারে
যে-গভীর স্নিগ্ধদৃষ্টি ঘন মেঘভারে
দেখা দেয়—নব নীল অতি সুকুমার,
সে দৃষ্টি না জানি ধরে কেমন আকার,
নারীচক্ষে। কী সঘন পল্লবের ছায়,
কী সুদীর্ঘ কী নিবিড় তিমির-আভায়
মুগ্ধ অন্তরের মাঝে ঘনাইয়া আনে

সুখবিভাবরী। অধর কী সুধাদানে
রহিবে উন্মুখ, পরিপূর্ণ বাণীভরে
নিশ্চল নীরব। লাবণ্যের থরে থরে
অঙ্গখানি কী করিয়া মুকুলি বিকশি’
অনিবার সৌন্দর্যেতে উঠিবে উচ্ছ্বসি
নিঃসহ যৌবনে।

জানি, আমি জানি, সখি,
যদি আমাদের দোঁহে হয় চোখোচোখি
সেই পরজন্ম-পথে,—দাঁড়াব থমকি,
নিদ্রিত অতীত কাঁপি উঠিবে চমকি
লভিয়া চেতনা।—জানি মনে হবে মম
চির-জীবনের মোর ধ্রুবতারাসম
চির-পরিচয় ভরা ঐ কালো চোখ।
আমার নয়ন হতে লইয়া আলোক,
আমার অন্তর হতে লইয়া বাসনা,
আমার গোপন প্রেম করেছে রচনা
এই মুখখানি। তুমিও কি মনে মনে
চিনিবে আমারে। আমাদের দুইজনে
হবে কি মিলন। দুটি বাহু দিয়ে বালা
কখনো কি এই কণ্ঠে পরাইবে মালা
বসন্তের ফুলে। কখনো কি বক্ষ ভরি
নিবিড় বন্ধনে, তোমারে, হৃদয়েশ্বরী,
পারিব বাঁধিতে। পরশে পরশে দোঁহে
করি বিনিময়, মরিব মধুর মোহে
দেহের দুয়ারে। জীবনের প্রতিদিন
তোমার আলোক পাবে বিচ্ছেদবিহীন,
জীবনের প্রতিরাত্রি হবে সুমধুর

মাধুর্যে তোমার। বাজিবে তোমার সুর
সর্ব দেহে মনে। জীবনের প্রতি সুখে
পড়িবে তোমার শুভ্র হাসি, প্রতি দুখে
পড়িবে তোমার অশ্রুজল, প্রতি কাজে
র’বে তব শুভহস্ত দুটি, গৃহমাঝে
জাগায়ে রাখিবে সদা সুমঙ্গল জ্যোতি।
এ কি শুধু বাসনার বিফল মিনতি,
কল্পনার ছল। কার এত দিব্য জ্ঞান,
কে বলিতে পারে মোরে নিশ্চয় প্রমাণ—
পূর্বজন্মে নারীরূপে ছিলে কি না তুমি
আমারি জীবন-বনে সৌন্দর্যে কুসুমি’
প্রণয়ে বিকশি’। মিলনে আছিলে বাঁধা
শুধু এক ঠাঁই, বিরহে টুটিয়া বাধা
আজি বিশ্বময় ব্যাপ্ত হয়ে গেছ প্রিয়ে,
তোমারে দেখিতে পাই সর্বত্র চাহিয়ে।
ধূপ দগ্ধ হয়ে গেছে, গন্ধ বাষ্প তার
পূর্ণ করি ফেলিয়াছে আজি চারিধার।
গৃহের বনিতা ছিলে—টুটিয়া আলয়
বিশ্বের কবিতারূপে হয়েছ উদয়,—
তবু কোন্ মায়া-ভোরে চির সোহাগিনী
হৃদয়ে দিয়েছ ধরা, বিচিত্র রাগিণী
জাগায়ে তুলিছ প্রাণে চিরস্মৃতিময়।
তাই তো এখনো মনে আশা জেগে রয়
আবার তোমারে পাব পরশবন্ধনে।
এমনি সমস্ত বিশ্ব প্রলয়ে সৃজনে
জ্বলিছে নিবিছে, যেন খদ্যোতের জ্যোতি,
কখনো বা ভাবময়, কখনো মুরতি।

রজনী গভীর হোলো, দীপ নিবে আসে;
পদ্মার সুদূর পারে পশ্চিম আকাশে
কখন-যে সায়াহ্নের শেষ স্বর্ণ-রেখা
মিলাইয়া গেছে, সপ্তর্ষি দিয়েছে দেখা
তিমিরগগনে, শেষ ঘট পূর্ণ ক’রে
কখন বালিকা বধূ চলে গেছে ঘরে।
হেরি’ কৃষ্ণপক্ষ রাত্রি একাদশী তিথি
দীর্ঘপথ, শূন্যক্ষেত্র, হয়েছে অতিথি
গ্রামে গৃহস্থের ঘরে পান্থ পরবাসী,—
কখন্‌ গিয়েছে থেমে কলরবরাশি
মাঠপারে, কৃষি-পল্লী হতে নদীতীরে
বৃদ্ধ কৃষাণের জীর্ণ নিভৃত কুটীরে
কখন জ্বলিয়াছিল সন্ধ্যা-দীপখানি,
কখন নিভিয়া গেছে—কিছুই না জানি।
কী কথা বলিতেছিনু কী জানি, প্রেয়সী,
অর্ধ-অচেতনভাবে মনোমাঝে পশি’
স্বপ্নমুগ্ধমতো। কেহ শুনেছিলে সে কি
কিছু বুঝেছিলে, প্রিয়ে, কোথাও আছে কি
কোনো অর্থ তার। সব কথা গেছি ভুলে’,
শুধু এই নিদ্রাপূর্ণ নিশীথের কূলে
অন্তরের অন্তহীন অশ্রু-পারাবার
উদ্বেলিয়া উঠিয়াছে হৃদয়ে আমার
গভীর নিঃস্বনে।
এসো সুপ্তি, এসো শান্তি,
এসো প্রিয়ে, মুগ্ধ মৌন সকরুণ কান্তি,
বক্ষে মোরে লহ টানি’,—শোয়াও যতনে
মরণ- সুস্নিগ্ধ শুভ্র বিস্তৃতি শয়নে।

শিলাইদহ। বোট।
৪ পৌষ, ১২৯৯
—সোনার তরী