চরিত-কথা/সুরেন্দ্রনাথ
চরিত-কথা
সুরেন্দ্রনাথ
আধুনিক রাষ্ট্রীয় কর্মজীবনে সুরেন্দ্রনাথের স্থান
সুরেন্দ্রনাথ বাঙ্গালী। কিন্তু তাঁর প্রতিভার প্রেরণা ও সুদীর্ঘ কর্ম্মজীবনের প্রভাব বাংলার সীমা অতিক্রম করিয়া, সমগ্র ভারতরাষ্ট্রকে অধিকার করিয়া আছে। আধুনিক ভারতের রাষ্ট্রীয় জীবনে আরও অনেক শক্তিশালী লোকনায়ক আছেন। ইহাঁদের মধ্যে কেহ কেহ কোনও কোনও বিষয়ে সুরেন্দ্রনাথের অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ, ইহাও অস্বীকার করা সম্ভব নহে। কিন্তু তাঁদের সকলের প্রভাব ও প্রতিষ্ঠাই আপন আপন প্রদেশেতে আবদ্ধ। লালা লাজপত্ রায়ের নাম ভারতবিশ্রুত হইলেও, কর্ম্মক্ষেত্র, প্রকৃত পক্ষে, পঞ্চনদের সীমা অতিক্রম করে নাই। পণ্ডিত মদনমোহন মালব্যও সেইরূপ কেবল এলাহাবাদ ও আগ্রার যুক্ত-প্রদেশের রাষ্ট্রীয় জীবনেই কতকটা নেতৃত্ব-মর্য্যাদা পাইয়াছেন, ভারতের অন্যান্য প্রদেশের লোকে অনেকেই তাঁর নাম জানে, কিন্তু কেহই এ পর্য্যন্ত তাঁর প্রতিভার বা কর্ম্মজীবনের প্রেরণা অনুভব করে নাই। স্যার্ ফিরোজশাহ মেহেতার আসন্নবন্ধুবর্গ যাহাই বলুন না কেন, তাঁর রাষ্ট্রীয়-নেতৃত্বও বোম্বাইএর পার্শী ও গুজরাটের বেনিয়া সম্প্রদায়েই সাক্ষাৎভাবে স্বীকৃত হয়; বোম্বাই প্রদেশের মহারাষ্ট্রীয় সমাজ, কিম্বা বাংলার কি পঞ্জাবের শিক্ষিত সম্প্রদায় এ পর্য্যন্ত তাঁহার নেতৃত্ব স্বীকার করেন নাই। তবে কন্গ্রেসে বা জাতীয় মহাসমিতিতে কিছুদিন পর্য্যন্ত যে তাঁর একটা অনন্যপ্রতিদ্বন্দ্বী প্রতাপ প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল, ইহাও অস্বীকার করা যায় না। আর ইহার হেতুও একরূপ চক্ষের উপরেই পড়িয়া আছে। জন্মাবধিই কন্গ্রেস স্যার্ ফিরোজশাহ মেহেতা, স্বর্গীয় উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, শ্রীযুক্ত এল্যান্, ও হিউম্ এবং স্যার উইলিয়াম ওয়েডার্বর্ণ, ইহাঁদের অর্থেই বিশেষভাবে পরিপুষ্ট হইরা আসিয়াছে। অনেক সময় কন্গ্রেসের অপরাপর নেতৃবর্গ কন্গ্রেসের ব্যয় সংকুলনের জন্য আপনাদের প্রতিশ্রুত চাঁদা যথাসময়ে আদায় করেন নাই বা করিতে পারেন নাই বলিয়া এই চারিজনকেই বহুদিন পর্য্যন্ত এই অনাদায় টাকার দায়ভারও বহন করিতে হয়। এ অবস্থার যাঁহাদের কার্পণ্যে বা ঔদাসীন্যে স্যার্ ফিরোজশাহ মেহেতাকে বৎসর বৎসর এত টাকার ঝুঁকি বহন করিতে হইয়াছে, তাঁহাদের পক্ষে কন্গ্রেসের কার্য্যকলাপে মেহেতা সাহেবের অভিপ্রায়ের প্রত্যক্ষ প্রতিবাদ বা প্রতিরোধ করা সম্ভব ছিল না। মেহেতা সাহেবের নিকটে কন্গ্রেসের এই দীর্ঘকালব্যাপী অন্ন-ঋণ স্মরণ করিয়াই, অপরাপর নেতৃবর্গ কন্গ্রেসের কার্য্য পরিচালনায় তাঁর অভিমত ও আবদার মানিয়া চলিয়াছেন। কন্গ্রেসের অন্যতম উত্তমর্ণ বলিয়াই কন্গ্রেস্-মণ্ডপে স্যার ফিরোজশাহ মেহেতার একটা প্রতাপ ও প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। নতুবা কন্গ্রেসের বাহিরে, দেশের সাধারণ রাষ্ট্রীর কর্ম্মাকর্ম্মের উপরে, কিম্বা ভারতের ভিন্ন ভিন্ন প্রদেশের আধুনিক-শিক্ষাপ্রাপ্ত সম্প্রদায়ের চিত্তে, মেহেতার চরিত্রের বা প্রতিভার কোনোই প্রভাব কখনই প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে বলিয়া মনে হয় না। ভারতবর্ষীয় ব্যবস্থাপক সভায়, কোনো কোনো বিষয়ের আলোচনায়, অপরাপর সভ্যগণের তুলনায়, কখনো কখনো, অসাধারণ সাহসিকতার ও বিশেষ কৃতিত্বের প্রমাণ প্রদান করিয়া, শ্রীযুক্ত গোপালকৃষ্ণ গোখেলে ভারতব্যাপী একটা খ্যাতি ও মর্য্যাদা লাভ করিয়াছেন, সত্য। আর এ খ্যাতি ও মর্য্যাদা তাঁর পাণ্ডিত্য ও চরিত্রের উপরেই যে অনেকটা প্রতিষ্ঠিত, ইহাও অতিশয় সত্য। গোখেলে সদ্বিদ্বান, ও কোনো কোনো বিদ্যায় স্বল্পবিস্তর বিশেষজ্ঞতাও তাঁর আছে। য়ুরোপীয় অর্থনীতি-শাস্ত্রে গোখেলের যে পরিমাণ অধিকার জন্মিয়াছে, ভারতের আর কোনো লোকপ্রসিদ্ধ রাষ্ট্রীয় কর্ম্মনায়কের তাহা আছে কি না সন্দেহ। যে প্রণালী অবলম্বনে ইংরেজ রাষ্ট্রনীতিকেরা বিবিধ রাষ্ট্রীয় বিষয়ের বিচার আলোচনা করিয়া থাকেন, সেই প্রণালী অবলম্বনে পরমতখণ্ডন ও স্বমত প্রতিষ্ঠায় গোখেলে একরূপ সিদ্ধহস্ত। ইংরেজের চিরাভ্যস্ত বাদ-বিদ্যায় ইংরেজিতে ইহাকে ডিবেট (Debate) বলে—লাট কার্জ্জনের মত পারদর্শী লোক ইংলণ্ডেও এখন কম। অথচ কখনো কখনো এই লাট কার্জ্জনকেই এ বিষয়ে গোখেলের নিকটে হার মানিতে হইয়াছে। আর আপনার বিচারবুদ্ধি অনুযায়ী স্বদেশের সেবাতে জীবন উৎসর্গ করিয়া, গোখেলে এ পর্য্যন্ত যে ঐকান্তিকী নিষ্ঠা সহকারে এই সেবাব্রত উদযাপন করিতে চেষ্টা করিয়া আসিয়াছেন, ভারতের অন্য কোনো লোকনায়কের মধ্যে সেরূপ ঐকান্তিকী নিষ্ঠাও দেখা যায় নাই। গোখেলের মধ্যে যে সকল গুণের সমাবেশ হইয়াছে, সে সকল গুণ এদেশের অন্য কোনো প্রসিদ্ধ লোকনায়কের মধ্যে সে মাত্রায় দেখা যায় নাই; ইহা সত্য বটে, কিন্তু তবুও গোখেলের বর্ত্তমান ভারতব্যাপী খ্যাতি যে কেবল তাঁর পাণ্ডিত্য ও চরিত্র বলেই অর্জ্জিত হইয়াছে, এমন কথাও বলা যায় না। স্বর্গীয় মহাদেব গোবিন্দ রাণাডে যদি গোখেলেকে হাতে ধরিয়া না তুলিতেন; পুনার সার্ব্বজনীন সভা যদি, রাণাডের অনুরোধে, গোখেলেকে ওয়েল্বী কমিশনের সম্মুখে আপনাদের প্রতিনিধিরূপে প্রেরণ না করিতেন; প্রথম বারে বিলাত হইতে ফিরিয়া আসিয়া, বিলাতী সংবাদপত্রে, প্লেগ-বিধানের প্রবর্ত্তন সম্বন্ধে পুনার ইংরেজ সৈন্যগণের বিরুদ্ধে যে গুরুতর অভিযোগ আনিয়াছিলেন, গোখেলে যদি জাহাজ-ঘাটেই সর্ব্বতোভাবে তার প্রত্যাখ্যান করিয়া বোম্বাইএর রাজপুরুষদিগের অনুগ্রহভাজন না হইতেন; ফিরোজশাহ মেহেতার শিষ্যত্ব ও আনুগত্য স্বীকার করিয়া, তাঁহারই প্রসাদে, যদি তিনি বোম্বাই-ব্যবস্থাপকসভার বে-সরকারি সভ্যগণের প্রতিনিধি হইয়া বড় লাটের ব্যবস্থাপকসভায় না আসিতেন; সেখানে লাট কার্জ্জন আপনার স্বভাবসিদ্ধ ঔদার্য্যগুণে যদি গোখেলের বিচারযুক্তির যথাসাধ্য খণ্ডন করিতে চেষ্টা করিয়াই, যদি তাঁর মেধার ও পাণ্ডিত্যের সম্বর্দ্ধনা না করিতেন; ভারতের রাষ্ট্রীয় কর্ম্মক্ষেত্রে তথাকথিত চরমপন্থীদিগের অভ্যুদয় হইলে, মিণ্টো ও মর্লে প্রভৃতি ভারতশাসনযন্ত্রের শীর্ষস্থানীয় রাজপুরুষেরা যদি এই নূতন রাষ্ট্রীয়-শক্তিকে সংযত ও প্রতিহত করিবার জন্য গোখেলে ও তাঁর দলের লোকনায়কগণকে লোক-চক্ষে বাড়াইয়া তুলিতে চেষ্টা না করিতেন;—এই সকল বাহিরের ঘটনাপাত না হইলে, গোখেলে যে শুদ্ধ আপনার প্রতিভার বা চরিত্রের বলে, ভারতব্যাপী এই খ্যাতি লাভ করিতে পারিতেন, ধীরভাবে সকল বিষয়ের বিশ্লেষণ করিয়া বিচার করিলে, এই সিদ্ধান্ত করা যায় না। কিন্তু এ সকল যোগাযোগ সত্ত্বেও গোখেলে যে সমগ্র ভারতের আধুনিক-শিক্ষাপ্রাপ্ত সম্প্রদায়ের নেতৃত্ব-মর্য্যাদা লাভ করিতে পারেন নাই, ইহাও স্বীকার করিতেই হইবে। কেবল এক সুরেন্দ্রনাথই এই দেশে, এই কালে, এই অনন্যপ্রতিযোগী নেতৃত্বের দাবী করিতে পারেন।
যে সকল বাহিরের ঘটনা ও অবস্থার যোগাযোগে এ দেশের অপরাপর কর্ম্মনায়কগণের প্রভাব ও প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে, সুরেন্দ্রনাথের কর্ম্মজীবনের প্রথমাবস্থায় এবং তাহার পরেও বহুদিন পর্য্যন্ত, তাঁহার ভাগ্যে সে সকল যোগাযোগ ঘটে নাই। রাজপুরুষদিগের আসন্নসংসর্গলাভ এ দেশের রাষ্ট্রীয় কর্ম্মক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠালাভের একমাত্র প্রশস্ত পথ। আর এ দেশে ধনবলে ও পদবলেই রাজপুরুষদিগের প্রসাদলাভ করিতে পারা যায়। আজ লোকে বলে, সুরেন্দ্রনাথ লক্ষপতি হইয়াছেন। কিন্তু তাঁর কর্ম্মজীবনের প্রারম্ভসময়ে সুরেন্দ্রনাথের এ ধনপরিবাদ ছিল না। গোখেলেকে রাণাডে নিজের হাতে ধরিয়া বাড়াইয়া দিয়াছিলেন। বাংলার তদানীন্তন লোকনায়কগণের মধ্যে একজনও এরূপভাবে সুরেন্দ্রনাথকে রাষ্ট্রীয় কর্ম্মক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত করিবার চেষ্টা করেন নাই। বাংলার ধনী ও পদস্থ লোকেরা আজ সুরেন্দ্রনাথের সাহায্য ছাড়া কোনো স্বাদেশিক অনুষ্ঠানে ব্রতী হইতে সাহস পান না। কিন্তু ইঁহাদের জ্যেষ্ঠেরা একদিন রাজদ্বারে লাঞ্ছিত সুরেন্দ্রনাথকে অস্পৃশ্য মনে করিয়া, তাঁহা হইতে দূরে থাকিতেন। বহুদিন পর্য্যন্ত রাজ-প্রসাদলোলুপ বৃটিশ ইণ্ডিয়ান্ এসোসিয়েশনের সভ্যগণ রাষ্ট্রীয় আন্দোলন-আলোচনায় সুরেন্দ্রনাথের সঙ্গে এক মঞ্চে উপবেশন করিতেও শঙ্কিত হইতেন। আজ সুরেন্দ্রনাথ ইংরেজরাজপুরুষদিগের দ্বারাও কিয়ৎপরিমাণে সম্বর্দ্ধিত হইতেছেন। কিন্তু একদিন তিনি এই রাজকর্ম্মচারী সম্প্রদায় নিকট লাঞ্ছিত হইয়া রাজকর্ম্ম হইতে অপসারিত হইয়াছিলেন। আর বহুদিন পর্য্যন্ত সে লাঞ্ছনার কথা এ দেশের ইংরেজরাজপুরুষেরা বিস্মৃত হন নাই। প্রত্যুত যতই সুরেন্দ্রনাথ রাষ্ট্রীয় আন্দোলন-আলোচনায় দেশের জনশক্তিকে প্রবুদ্ধ করিয়া, আপনি সেই শক্তি সাহায্যে শক্তিশালী হইয়া উঠিতেছিলেন, ততই তাঁহারা সেই প্রাচীন লাঞ্ছনার স্মৃতিকে প্রাণপণে জাগাইয়া রাখিবার জন্য চেষ্টা করিয়াছিলেন, ইহাও সকলেই জানেন। সেই রাজপুরুষেরাই, আজিকার অবস্থাধীনে, আপদ-বিপদে, প্রতিপদেই দেশের প্রজামতের পোষকতা লাভের লোভে, সুরেন্দ্রনাথের পরামর্শ গ্রহণ করিতেছেন। যে কন্গ্রেসের কাজকর্ম আজ সুরেন্দ্রনাথকে ছাড়িয়া কিছুতেই চলে না ও চলিতে পারে না; একদিন, কন্গ্রেসের জন্মকালে, তাহার জন্মদাতা ও ধাত্রীবর্গ সকলে প্রাণপণে সেই সুরেন্দ্রনাথকে তাহার বাহিরে রাখিতে চাহিয়াছিলেন, এ কথাও মিথ্যা নয়। স্বর্গীয় উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ও স্যার্ ফিরোজশাহ মেহেতা উভয়েই সুরেন্দ্রনাথকে কন্গ্রেসের কর্ম্মে আমন্ত্রণ করিতে চান নাই। হিউম সাহেবও প্রথমে তাঁহাদের মতেই মত দিয়াছিলেন। হিউম ভারত গবর্ণমেণ্টের সেক্রেটারী ছিলেন। ইংরেজ সিভিলিয়ানদের মধ্যে সুরেন্দ্রনাথের প্রতি যে অশ্রদ্ধা বহুদিন হইতেই জাগিয়াছিল, হিউমের মনেও যে তাহা ছিল না, এমন নহে। তার উপরে যখন উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ও মেহেতা প্রভৃতি কন্গ্রেসী নেতৃবর্গ সুরেন্দ্রনাথের সাহায্য গ্রহণে অনিচ্ছা প্রকাশ করিলেন, তখন হিউম যে সেই মতে সায় দিবেন, ইহা আর বিচিত্র কি? কিন্তু কন্গ্রেসের দ্বিতীয় অধিবেশনের ব্যবস্থা করিবার জন্য হিউম যখন কলিকাতায় আসিলেন এবং সুরেন্দ্রনাথকে ছাড়িয়া বাংলা দেশের লোকমতকে কন্গ্রেসে টানিয়া আনা যে একান্তই অসম্ভব, ইহা দেখিলেন ও বুঝিলেন, তখন তাঁর মত ফিরিয়া গেল এবং বন্দ্যোপাধ্যায় ও মেহেতা প্রভৃতির আপত্তি অগ্রাহ করিয়া, গুণগ্রাহী হিউম স্বয়ং সুরেন্দ্রনাথকে কন্গ্রেসের কর্ম্ম-নেতৃত্বে বরণ করিয়া লইলেন। আজ সুরেন্দ্রনাথের অনেক সহায়-সম্পদ লাভ হইয়াছে। আজ তিনি দেশের রাজপুরুষ ও রাজারাজড়ার দ্বারা সম্বর্দ্ধিত ও সম্মানিত হইতেছেন! কিন্তু একদিন তাঁহাকে নিঃসহায় ও নিঃসম্বল অবস্থায়, “শোথের শেয়ালার” মত, দেশের রাষ্ট্রীয় কর্ম্মস্রোতের ঘাটে ঘাটে ফিরিতে হইয়াছিল। আর আজ তিনি আধুনিক ভারতের রাষ্ট্রীয় ইতিহাসে যে অনন্য প্রতিযোগী প্রতিষ্ঠা লাভ করিয়াছেন, তাহা কোনো প্রকারের অনুকূল ঘটনাপাতের ফল নহে। এ কীর্ত্তি অর্জ্জনে কেহ তাঁহাকে কোনো প্রকারে সাহায্য করে নাই। ইহা সর্ব্বতোভাবেই তাঁর স্বোপার্জিত। কেবল আপনার প্রতিভা ও পুরুষকারের বলেই সুরেন্দ্রনাথ এ দেশের বর্ত্তমান রাষ্ট্রীয় কর্ম্মজীবনে এই অনন্যপ্রতিযোগী নেতৃত্ব-মর্য্যাদা লাভ করিয়াছেন। এইখানেই তাঁর বিশেষত্ব ও মহত্ত্ব।
সুরেন্দ্রনাথের চরিত্র
অশেষ প্রকারের প্রতিকূল অবস্থার ভিতর দিয়া সুরেন্দ্রনাথের কর্ম্মজীবন গড়িয়া উঠিয়াছে। আর এই সকল প্রতিকূল অবস্থাকে অতিক্রম করিয়া তাঁর এই কর্ম্মজীবন যে এমন অদ্ভুত সফলতা লাভ করিয়াছে, ইহাতে সুরেন্দ্রনাথের অসাধারণ মানসিক বলেরই প্রমাণ প্রদান করে। কিন্তু প্রকৃত পক্ষে সুরেন্দ্রনাথ বীর পুরুষ নহেন। আমরা সচরাচর যাহাকে বীরত্ব বলি, তার অন্তরালে অনেক সময় একটা ফলাফল-বিচার-বিরহিত একগুয়ামো লুকাইয়া থাকে। এই প্রকারের একগুয়ামো সুরেন্দ্রনাথের মধ্যে নাই; থাকিলে, সুরেন্দ্রনাথ যে সফলতা লাভ করিয়াছেন, তাহা কখনই পাইতেন না। সুরেন্দ্রনাথ যে খুব সাহসী পুরুষ, এমনো বলা যায় না। যে অসমসাহসিকতা অসাধ্য সাধনের প্রয়াস করিয়া, সর্ব্বস্বান্ত হইয়া, পরিণামে নিঃশেষ নিষ্ফলতা মাত্র লাভ করে, সুরেন্দ্রনাথের মধ্যে কখনো সেরূপ অসমসাহসিকতা দেখা যায় নাই। কিন্তু অবিচলিত ধৈর্য্য যে বীরত্বের লক্ষণ, আর নিন্দাস্তুতি উভয়কে সমভাবে উপেক্ষা করিয়া আপনার অভিষ্টসিদ্ধির পথে চলিবার শক্তির ভিতরে যে সাহসিকতা লুক্কায়িত থাকে, সে বীরত্ব ও সে সাহস সুরেন্দ্রনাথের মধ্যে সর্ব্বদাই দেখা গিয়াছে। যে মনের বল থাকিলে লোকে বিরোধী শক্তির আঘাতে বরং ভাঙ্গিয়া যায় কিন্তু কখনোই তাহার নিকটে নত হয় না; এই আত্মঘাতী মানসিক বল সুরেন্দ্রনাথের কখনো ছিল না। কিন্তু যে মনের বল আপনার রুচি ও প্রবৃত্তি, মান ও অপমান, আয়াস ও শ্রম-ক্লেশ, এ সকলকে অগ্রাহ করিয়া, সকল অবস্থাতেই, সেই অবস্থার সঙ্গে যথাসম্ভব সন্ধি ও সামঞ্জস্য সাধন করিয়া, আপনার লক্ষ্যের অনুসরণ করিতে পারে, সুরেন্দ্রনাথের সে মানসিক শক্তি যে পরিমাণে আছে, আমাদের আর কোনো লোকপ্রসিদ্ধ রাষ্ট্রীয় নায়কের মধ্যে তাহা নাই। যে নিগূঢ় কৌশল-সহায়ে জীব বিবিধ বিরোধী অবস্থা ও ব্যবস্থার মধ্যে পড়িয়াও, প্রাকৃতিক নির্ব্বাচনের নিয়মানুযায়ী, আত্মরক্ষায় ও আত্মচরিতার্থতা লাভে সমর্থ হয়, সুরেন্দ্রনাথ অতি আশ্চর্য্যরূপে সে কৌশলটা লাভ করিয়াছেন। এই কৌশলটী যে জীব লাভ করিতে পারে, সেই কেবল বিশ্বব্যাপী নির্ম্মম জীবন-সংগ্রামে জয়লাভ করিয়া আত্মরক্ষা ও বংশরক্ষা করিতে পারে। এই কুশলতাগুণেই সুরেন্দ্রনাথও জীবন-সংগ্রামের জয়টীকা ললাটে ধারণ করিয়া, ভারতের আধুনিক রাষ্ট্রীয় ইতিহাসে আপনার অক্ষয় কীর্ত্তি প্রতিষ্ঠা করিতে পারিয়াছেন।
সুরেন্দ্রনাথের রজঃপ্রাধান্য
সুরেন্দ্রনাথের অন্তঃপ্রকৃতি যে খুব সাত্ত্বিক তাহা নয়। নির্ম্মলত্ব, ভাস্বরত্ব ও অনাময়ত্ব, এ সকলই সত্ত্বের লক্ষণ। সাত্ত্বিক প্রকৃতির লোকের বুদ্ধি অতীন্দ্রিয় বস্তুধারণায় তৎপর হয়; চিত্ত বিকারশূন্য ও কর্ম্ম নিষ্কাম হয়। এ সকলের কোনো লক্ষণই এ পর্য্যন্ত সুরেন্দ্রনাথের চিন্তায় ও চরিত্রে প্রকাশিত হয় নাই। তাঁর স্বদেশের সভ্যতা ও সাধনা, যুগযুগান্তব্যাপী তপস্যার ফলে, বহুদিন হইতেই সত্ত্বপ্রধান হইয়া আছে, সত্য। কিন্তু সুরেন্দ্রনাথ যে সময়ে জন্মগ্রহণ করেন, সে কালে কর্ম্মবশে এই সমাজের পুরাভ্যস্ত সাত্ত্বিকতাও ঘোর তামসিকতার দ্বারা আচ্ছন্ন হইয়া পড়িয়াছিল। সর্ব্বত্রই যুগসন্ধিকালে এইরূপ হইয়া থাকে। এইজন্য যে শিক্ষা ও সাধনায় এই সাত্ত্বিকীভাব ফুটিয়া উঠে, সুরেন্দ্রনাথ সে শিক্ষা দীক্ষা প্রাপ্ত হন নাই! সুরেন্দ্রনাথের বাল্যকালে কলিকাতা ও তন্নিকটবর্ত্তী স্থানের মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বাঙ্গালী ভদ্রলোকদিগের মধ্যে, নুতন ইংরেজী শিক্ষার প্রভাবে, স্বদেশের সনাতন ভাব ও আদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাভক্তি একেবারেই লোপ পাইতেছিল। সমগ্র দেশই তখন ঘোরতর তামসিকতার দ্বারা আচ্ছন্ন হইয়া, নিজেদের প্রাচীন সভ্যতার ও সাধনার প্রাণহীন ও অর্থশূন্য বাহ্যিক ক্রিয়াকলাপের অনুসরণেই নিযুক্ত ছিল। তার ভিতরতার সত্যের ও মহত্ত্বের অনুভূতি, সাধুসন্ন্যাসিগণের মধ্যে কচিৎ থাকিলেও, সাধারণ গৃহস্থদিগের মধ্যে একেবারে ছিল না বলিলেই হয়। তার উপরে, সুরেন্দ্রনাথের পিতা, ডাক্তার দুর্গাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, য়ুরোপীয় সভ্যতার ও সাধনার প্রবল রাজসিক আদর্শের দ্বারা একান্তই অভিভূত হইয়া পড়িয়াছিলেন। তাঁর সমসাময়িক ইংরেজীশিক্ষিত বাঙ্গালী মাত্রেরই স্বল্পবিস্তর এই দশা ঘটিয়াছিল। দুর্গাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় সুরেন্দ্রনাথকে কেবল ইংরেজী শিখাইয়াই ক্ষান্ত হন নাই। ইংরেজের চালচলন অভ্যাস ও ইংরেজের চরিত্র লাভ করিবার জন্য, তিনি অতি অল্প বয়সেই সুরেন্দ্রনাথকে ডভ্টন স্কুলে প্রেরণ করেন। এই রূপে সুরেন্দ্রনাথ একরূপ বাল্যাবধিই কলিকাতার ইংরেজ ও এংলো-ইণ্ডিয়ান্ বালকগণের সংসর্গে থাকিয়া স্কুল কালেজের শিক্ষা সমাপ্ত করেন। তার পরে, বিলাতে যাইয়া এই অদ্ভুত ব্রহ্মচর্য্য উদ্যাপন করিয়া সিভিলিয়ানী-পদ লইয়া, দেশে ফিরিয়া আসেন। আজিকালি বিলাত ও ভারত যেন এ ঘর ও ঘর হইয়া পড়িয়াছে, সত্য। কিন্তু সুরেন্দ্রনাথ যখন শিক্ষার্থী হইয়া বিলাত গমন করেন, তখন এইরূপ ছিল না। সেকালে বিলাত যাওয়া এত সহজ ছিল না বলিয়া, বিলাতপ্রত্যাগত হিন্দুদিগের নিজেদের প্রাণে একটা প্রবল অহঙ্কার এবং কোনো কোনো দিক্ দিয়া সমাজেও তাঁহাদের একটা অনন্যসাধারণ মর্য্যাদা ছিল। সে কালের বিলাত-প্রত্যাগত বাঙ্গালী হিন্দুদের সঙ্গে, তাঁহাদের প্রাচীন পৈতৃক সমাজের কোনো প্রকারের যোগাযোগ প্রায়ই থাকিত না। সমাজও তাঁহাদিগকে পতিত বলিয়া বাহিরে ফেলিয়া রাখিত। আর তাঁহারা নিজেরাও সাহেব সাজিয়া, সহধর্ম্মিণীকে গাউন পরাইয়া মেম সাজাইয়া, “নেটিভ্দের” সঙ্গে প্রমুক্তভাবে মেশামেশি করিলে কি জানি এই সদ্যলব্ধ সভ্যতার মর্য্যাদাভ্রষ্ট হইয়া পড়েন, সেই ভয়ে আপনাদের সমাজ হইতে যথাসম্ভব দূরে থাকিতে চেষ্টা করিতেন। সুরেন্দ্রনাথও প্রথম বয়সে তাহাই করিয়াছিলেন। আর বিধাতার চক্রান্তে ও তাঁর স্বদেশের সুকৃতি বলে, সুরেন্দ্রনাথের সিভিলিয়ানী-পদ যদি খসিয়া না পড়িত, তাহা হইলে আজি পর্য্যন্তও তিনি এই ভয়াবহ পরধর্ম্মের বোঝাই বহন করিয়া চলিতেন। অতএব এই সকল ঘটনাবশে সুরেন্দ্রনাথের ভাগ্যে যে স্বদেশের ও স্বজাতির সভ্যতা ও সাধনার নিগূঢ় প্রকৃতির সাক্ষাৎকার লাভ ঘটে নাই, ইহা কিছু বিচিত্র নহে।
সুরেন্দ্রনাথের প্রাণের টান্টা পুরাদমেই স্বদেশাভিমুখী হইলেও তাঁর মত, প্রকৃতি এবং ভিতরকার ভাব ও আদর্শ যে সত্যই স্বদেশী, এমন বলা যায় না। শুদ্ধ সাত্ত্বিকী প্রকৃতিই আমাদের স্বদেশী চরিত্রের চিরন্তন আদর্শ। যেমন ভিন্ন ভিন্ন লোকে সত্ত্ব, রজঃ, তমঃ এই তিন গুণের কোনও না কোনও একটা গুণ অপর দুই গুণকে অভিভূত করিয়া, তাহাদের প্রকৃতিকে বিশেষ ভাবে সাত্ত্বিক, বা রাজসিক, বা তামসিক করিয়া তোলে, সেইরূপ ভিন্ন ভিন্ন জাতির প্রকৃতিতেও গুণ বিশেষের প্রাধান্য ঘটিয়া থাকে। কোনও জাতি বা এই জন্য তামসিক, আর কেহ বা রাজসিক, আর কেহ বা সাত্ত্বিক প্রকৃতির হয়। কোনও জাতির সভ্যতা ও সাধনা রজঃ-প্রধান, আর কাহারও বা তমোপ্রধান, আর কোনও জাতির সভ্যতা ও সাধনা বা সত্ত্ব-প্রধান হইয়া থাকে। য়ুরোপের সভ্যতা ও সাধনা রজঃ-প্রধান। ভারতের সভ্যতা ও সাধনা সত্ত্ব-প্রধান। য়ুরোপের সাধনাতেও সত্ত্ব রজঃ তমঃ এই তিন গুণেরই প্রকাশ ও প্রতিষ্ঠা আছে। রজঃ-প্রধান বলিয়া য়ুরোপীয় সাধনায় তামসিকতা নাই, বা সাত্ত্বিকতা ফুটে নাই, এমন নহে। জীব সাধন-বলে কখনও কখনও এই গুণত্রয়কে অতিক্রম করিয়া যাইতে পারে বটে, কিন্তু এরূপ মুক্তলোক সর্ব্বত্রই অতি বিরল। সাধারণ মানুষের ভিতরে ভিন্ন ভিন্ন মাত্রায় সত্ত্ব, রজঃ, তমঃ সর্ব্বদাই এই গুণত্রয় বিদ্যমান থাকে। ভিন্ন ভিন্ন জাতির সাধনায় এবং সভ্যতায়ও সর্ব্বদাই এই তিন গুণ বিদ্যমান আছে। ভারতবর্ষেও অনেক তামসিক এবং রাজসিক লোক আছেন। ভারতের বহুমুখী সাধনায় রাজসিক এবং তামসিক উভয় প্রকৃতিরই যথাযোগ্য অনুশীলনেরও ব্যবস্থা আছে। কিন্তু এ সকল সত্ত্বেও ভারতের সভ্যতার ও সাধনার ঝোঁক সাত্ত্বিকতারই দিকে। শুদ্ধ সাত্ত্বিক চরিত্রই আমাদের দেশের আদর্শ চরিত্র। য়ুরোপীয় সাধনার ঝোঁক রাজসিকতারই দিকে। এই জন্য রাজসিক চরিত্রই সে দেশের আদর্শ চরিত্র। সুরেন্দ্রনাথ বাল্যাবধি য়ুরোপীয় সভ্যতা ও সাধনার ঐকান্তিক প্রভাবের ভিতরে বাড়িয়া উঠিয়াছেন বলিয়া, এই য়ুরোপীয় আদর্শের রাজসিক চরিত্রই লাভ করিয়াছেন।
আর সুরেন্দ্রনাথের প্রকৃতি ও চরিত্র শুদ্ধ সাত্ত্বিক নয়, কিন্তু একান্তই রাজসিক, ইহা কোনোই নিন্দার কথাও নহে। ফলতঃ প্রকৃত সাত্ত্বিক প্রকৃতির লোক এ সংসারে অত্যন্ত বিরল। অন্য দেশের তো কথাই নাই, আমাদিগের এই সত্ত্ব-প্রধান সভ্যতা এবং সাধনাতেও বিশুদ্ধ সাত্ত্বিক চরিত্র যেখানে সেখানে পাওয়া যায় না। সচরাচর লোকে যাহাকে সাত্ত্বিকতা বলিয়া মনে করে, অনেক সময় তাহা কেবল ঘোরতর তামসিকতারই রূপান্তর মাত্র। সত্ত্ব এবং তমঃ উভয়েরই কতকগুলি বাহিরের লক্ষণ এক প্রকারের বলিয়া অতি সহজেই এইরূপ ভ্রম হইয়া থাকে। সাত্ত্বিকতার বৃদ্ধিতে অনেক লোকের মধ্যে কখনও কখনও এমন একটা অবস্থা আসিয়া পড়ে, যাহাতে তাঁহাদিগকে সর্ব্বপ্রকারের বাহিরের কর্ম্মচেষ্টা হইতে বিরত করে। এই কর্ম্মচেষ্টাহীনতা তমোগুণেরও লক্ষণ। তবে এই সাত্ত্বিকী নিশ্চেষ্টতার অন্তরালে ভগবন্নির্ভর আর তামসিকী নিশ্চেষ্টতার অন্তরালে নিদ্রালস্য প্রভৃতি জড়গুণ বিদ্যমান থাকে। কিন্তু এ দু’য়ের প্রভেদ বুঝিতে না পারিয়া, লোকে অনেক সময় এই নিদ্রালস্য প্রভৃতি জড়ধর্ম্মসম্ভূত নিশ্চেষ্টতাকেই সাত্ত্বিকতার লক্ষণ বলিয়া ভ্রম করে। প্রত্যেক যুগসন্ধিকালে পূর্ব্বতন যুগের বিধিব্যবস্থা ও রীতি নীতি যখন লোকের একান্ত অভ্যস্ত হইয়া তমোধর্ম্মাক্রান্ত হয়, তখন, সত্ত্ব-প্রধান সমাজেও, এই জাল সাত্ত্বিকতার প্রভাব অত্যন্তই বাড়িয়া উঠে। এই জাল সাত্ত্বিকতাতেই আমাদের দেশটা এখন ছাইয়া ফেলিয়াছে। এ অবস্থায় লোক-সমাজে পুনরায় সত্য সাত্ত্বিকতার প্রভাব প্রতিষ্ঠিত করিতে হইলে,জনগণের অন্তরস্থিত রজোগুণকেই আগে বাড়াইয়া তোলা আবশ্যক হয়। সুরেন্দ্রনাথ আচরণ ও উপদেশের দ্বারা আপনার দীর্ঘ কর্ম্মজীবনে এই যুগপ্রয়োজন সাধন করিয়াই আধুনিক ভারতবর্ষের ইতিহাসে এরূপ অক্ষয় কীর্ত্তি অর্জ্জন করিতে পারিয়াছেন।
সুরেন্দ্রনাথ যখন রাষ্ট্রীয় কর্ম্মক্ষেত্রে প্রবেশ করিয়াছিলেন তখন যদি তিনি লোকচক্ষে কোনো উচ্চ সাত্ত্বিকী আদর্শ ধরিতে যাইতেন, তাহা হইলে তাহাতে দেশব্যাপী তামসিকতারই প্রভাব বাড়িয়া যাইত, প্রকৃত সাত্ত্বিকতা লোকচরিত্রে কখনই প্রতিষ্ঠা লাভ করিতে পারিত না। দেশের কল্যাণের জন্য সে সময় রজোগুণের প্রেরণারই বিশেষ প্রয়োজন ছিল। আর সমাজ প্রকৃতির এই অন্তঃপ্রয়োজনের অনুরোধে সে সময়ে সর্ব্ব প্রকারের লোকহিতব্রতই বিশেষ ভাবে রজোধর্ম্মাক্রান্ত হইয়াছিল। সুরেন্দ্রনাথ ধর্ম্মসংস্কারক নহেন। স্বদেশের ধর্ম্মজীবনে শক্তিসঞ্চার করিবার জন্য বিধাতা তাঁহাকে ডাকেন নাই। সামাজিক, এবং বিশেষভাবে রাষ্ট্রীয় বিধিব্যবস্থার সংস্কার সাধনব্রতেই ভগবান তাঁহাকে বরণ করিয়াছেন। কিন্তু তাঁহার সমসাময়িক ধর্ম্মসংস্কারকগণও তখন দেশের ধর্ম্মজীবনের মধ্যে একটা প্রবল রাজসিক ভাবই জাগাইয়া তুলিবার চেষ্টা করিয়াছিলেন। সে সময়ে এইরূপ চেষ্টারই প্রয়োজন এবং তাহাই অত্যন্ত স্বাভাবিক ছিল। অতএব কালধর্ম্মবশেই সুরেন্দ্রনাথের প্রকৃতি ও চরিত্র রাজসিক হইয়াছে। এরূপ না হইলে তিনি যে কাজ করিয়াছেন, তাহা কখনই করিতে পারিতেন না। লোভ, প্রবৃত্তি, আরম্ভ, অশম ও স্পৃহা এই সকলই রাজসিকতার প্রধান লক্ষণ। ধনমানাদি লাভ হইতে আরম্ভ করিলে, তাহা উত্তরোত্তর আরও অধিক পরিমাণে লাভ হউক, এই যে অভিলাষ তাহারই নাম লোভ। পরদ্রব্যাদিতে যে লালসা তাহাকেও লোভ বলে বটে, কিন্তু সে লোভ নিরতিশয় নিকৃষ্ট বস্তু, অতি নিম্ন অধিকারের ধর্ম্মও এই লোভকে প্রশ্রয় দেয় না। এই লোভ রাজসিক বস্তু নহে। কিন্তু ধর্ম্মানুমোদিত উপায়ে উত্তরোত্তর ধনমানাদি বৃদ্ধি করিবার যে আকাঙ্ক্ষা, তাহাই রজোগুণের লক্ষণ। নিয়ত কর্ম্ম করিবার যে ইচ্ছা, তাহারই নাম প্রবৃত্তি। কোনো বিষয় বা প্রতিষ্ঠানকে গড়িয়া তুলিবার যে উদ্যম, তাহাই আরম্ভ। ইহা করিয়া, পরে উহা করিব, এইরূপ সংকল্প-বিকল্পাত্মিকা যে বুদ্ধি,তাহাই অশম। সর্ব্বপ্রকারের সামান্য বস্তুতে যে তৃষ্ণা তাহাই স্পৃহা। এই লোভ, প্রবৃত্তি, আরম্ভ, অশম ও স্পৃহা, শাস্ত্রে এই সকলকেই রজোলক্ষণ বলিয়াছেন। সুরেন্দ্রনাথের মধ্যে এই সকল লক্ষণগুলিই বেশ ফুটিয়া উঠিয়াছে। আর এই সকলের দ্বারাই তাঁর প্রকৃতির রজো প্রাধান্য প্রমাণিত হয়। এই রাজসিকতাই সুরেন্দ্রনাথের জীবনের ও চরিত্রের একদিকে বলের ও অন্যদিকে দুর্ব্বলতার হেতু হইয়া আছে। তাঁর ভাল ও মন্দ, উৎকর্ষ ও অপকর্ষ, উভয়ই এই রাজসিক প্রকৃতি হইতে উৎপন্ন হইয়াছে।
আপনার কর্ম্মজীবনের প্রারম্ভেই সুরেন্দ্রনাথ যে ঘোর বিপাকে পতিত হন, সেরূপ বিপাকে পড়িয়া অতি অল্প লোকেই আবার মাথা তুলিয়া দাঁড়াইতে পারিত। ধন-মানের আশা করিয়াই সংসারে প্রবেশ করিয়াছিলেন, সহসা ধন-মান-পদ সকল হারাইয়া, নিরতিশয় দারিদ্র্যের মধ্যে পড়িয়া গেলেন। যাহা কিছু পৈতৃকসম্পত্তি ছিল, তাঁহার পদচ্যুতির আদেশের বিরুদ্ধে বিলাত আপীল করিতে যাইয়া, তাহাও একরূপ নিঃশেষ হইয়া গেল। পৈতৃক ভদ্রাসনের নিজের অংশটুকু মাত্র অবলম্বন করিয়া, দারিদ্র্যের বিভীষিকা মাথায় লইয়া, সুরেন্দ্রনাথ আবার কলিকাতায় আসিয়া দাঁড়াইলেন। সুরেন্দ্রনাথ রাজকর্ম্মেই জীবন অতিবাহিত করিবেন ভাবিয়া, তাহারই উপযুক্ত শিক্ষা লাভ করিয়াছিলেন; কোনো প্রকারের ব্যবসায়িক বিদ্যালাভ করেন নাই। রাজদ্বারে লাঞ্ছিত হইয়া অন্যত্র তাঁহার বিদ্যার ও যোগ্যতার উপযুক্ত কর্ম্ম লাভ করাও তখন সম্ভব ছিল না। কিন্তু পদচ্যুত এবং একরূপ হৃতসর্ব্বস্ব হইয়াও সুরেন্দ্রনাথ কিছুতেই দমিয়া গেলেন না। আপনার পুরুষকারের প্রভাবে সমুদায় প্রতিকূল অবস্থাকে উপেক্ষা করিয়া নূতন ক্ষেত্রে নূতন কর্ম্মজীবন গড়িতে আরম্ভ করিলেন। কিছু দিন পূর্ব্বে যে ব্যক্তি আসিষ্ট্যাণ্ট ম্যাজিষ্ট্রেটরূপে ইংরেজ রাজপুরুষদিগের সমকক্ষ হইয়াছিলেন, তিনিই এখন সামান্য বেতনে মেট্রোপলিটন কালেজে অধ্যাপকের কর্ম্ম গ্রহণ করিয়া আপনার জীবিকা অর্জ্জন করিতে লাগিলেন। এরূপ অবস্থায় পড়িলে অনেক লোকই একেবারে ভাঙ্গিয়া চুরিয়া যাইত। পুনরায় আপনাকে প্রতিষ্ঠিত করিবার যে শক্তি ও উদ্যম আবশ্যক, অনেক লোকেই তাহা আর সংগ্রহ করিতে পারিত না। কিন্তু দমিয়া যাওয়া কাহাকে বলে, সুরেন্দ্রনাথ ইহা একেবারেই জানেন না। জীবন-সংগ্রামে সুরেন্দ্রনাথ সময় সময় হটিয়া গিয়াছেন, কিন্তু কখনই পরাভূত হ’ন নাই। ইহা তাঁহার প্রকৃতিগত উচ্চ অঙ্গের রাজসিকতারই ফল। জীবের জীবনী-শক্তি একদিকে ব্যাঘাত পাইলে যেমন আর একদিকে আপনাকে গড়িয়া তুলিতে চেষ্টা করে, সুরেন্দ্রনাথের বলবতী কর্মস্পৃহাও এই রূপে যখনই একদিকে প্রতিকূল অবস্থার দ্বারা প্রত্যাহত হইয়াছে তখনই অপূর্ব্ব কুশলতা সহকারে, আপনার অন্তঃপ্রকৃতির প্রেরণাতেই যেন, অজ্ঞাতসারে নূতন পথে যাইয়া আত্মচরিতার্থতা লাভের চেষ্টা করিয়াছে। রাজকর্ম্মে প্রতিষ্ঠা লাভ করিবার আশায় সুরেন্দ্রনাথ প্রথম সংসারে প্রবেশ করিয়াছিলেন। সে আশা যখন অকালে সমূলে উৎপাটিত হইয়া গেল, তখন তিনি স্বদেশের রাষ্ট্রীয় জীবনের বৃহত্তর কর্ম্মক্ষেত্রে আপনাকে প্রতিষ্ঠিত করিতে কৃতসংকল্প হইয়া, সেই দিকে আপনার শরীর মনের সমুদায় শক্তি নিয়োগ করিতে আরম্ভ করিলেন।
সুরেন্দ্রনাথের যোগসিদ্ধি
সুরেন্দ্রনাথের মধ্যে কখনো ধর্ম্মজীবনের কোনো প্রকারের বাহ্য আড়ম্বর দেখা যায় নাই। তিনি ঈশ্বর মানেন কিন্তু স্বার্থক বা নিরর্থক ঈশ্বর-প্রসঙ্গে কখনো কালাতিপাত করেন বলিয়া শুনা যায় নাই। স্বদেশের বা বিদেশের ধর্ম্মশাস্ত্রের বা তত্ত্ববিদ্যার সঙ্গে তাঁহার যে কোনো প্রকারের সাক্ষাৎ ও ঘনিষ্ঠ পরিচয় ছিল বা আছে, এমনও কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় নাই। কিন্তু পূর্ব্বজন্মের সুকৃতিবলেই হউক, আর অহেতুকী ভাগবতী-কৃপাগুণেই হউক, সুরেন্দ্রনাথ আপনার কর্ম্মজীবনের ভিতর দিয়াই যে এক প্রকারের যোগসিদ্ধি লাভ করিয়াছেন, ইহাও একেবারে অস্বীকার করা যায় না। সুরেন্দ্রনাথ রাগদ্বেষবিমুক্ত বৈরাগী পুরুষ নহেন। পুত্ত্রদারগৃহাদিতে তাঁর আসক্তি নাই এবং এ সকলের ইষ্টানিষ্টলাভে তাঁর চিত্ত বিচলিত হয় না, এমনও নহে। প্রত্যুত তাঁর মত প্রীতিশীল পতি ও সন্তানবৎসল পিতা আমাদের দেশেও সর্ব্বদা সর্ব্বত্র দেখা যায় না। কিন্তু তাঁহার কর্ম্মজীবনের আহ্বানে, নলিনীদলগত জলবিন্দুর ন্যায়, এই সকল স্নেহমমতার আসক্তি তাঁহার চিত্ত হইতে সর্ব্বদাই অনায়াসে ঝরিয়া পড়িতে দেখিয়াছি। প্রথম জীবনে নবীন পুত্ত্রশোক এবং শেষ জীবনে নিদারুণ পত্নীবিয়োগ, এ সকলের কিছুতেই ক্ষণকালের জন্যও তাঁহার স্বাদেশিক কর্ম্মচেষ্টার কোনোই ব্যাঘাত জন্মাইতে পারে নাই। ভারত-সভার প্রতিষ্ঠা-দিনে সুরেন্দ্রনাথের পুত্র-বিয়োগ হয়। বন্ধুগণ যখন তাঁহাকে সভাস্থলে আসিবার জন্য ডাকিতে যান, তখন সুরেন্দ্রনাথ নিদারুণ পুত্রশোকে অধীর হইয়া, ছিন্নমূল কদলীর ন্যায়, ধূলায় লুণ্ঠিত হইতেছিলেন। কিন্তু ভারত-সভার প্রতিষ্ঠার জন্য সভাস্থলে তাঁহার উপস্থিতি একান্ত প্রয়োজন হইয়াছে শুনিয়া, সেই শোকাহত সুরেন্দ্রনাথ তখনই শোকাবেগ সংবরণ করিয়া, চক্ষের জল ও অঙ্গের ধূলি মুছিয়া, উঠিয়া দাঁড়াইলেন। এইরূপ ধৈর্য্য ও সংযম পূর্ব্বজন্মলব্ধ যোগশক্তির প্রভাবেই প্রাকৃত জনে সম্ভব হয়। আবার বিগত কন্গ্রেসের প্রাক্কালে, এই বৃদ্ধ বয়সে, পত্নীবিয়োগবিধুর সুরেন্দ্রনাথ এক দিনের জন্যও যে আপনার দৈনন্দিন কর্ম্ম হইতে অবসর গ্রহণ করেন নাই ইহা দেখিয়াও তাঁহাকে মুক্তপুরুষ বলিয়াই মনে হয়। এই মুক্তভাব সাধনালব্ধ নহে, কিন্তু সহজসিদ্ধ। ইহাই তাঁহার কর্ম্মজীবনের মূলসূত্র। আর সেই কর্ম্মজীবনে তিনি যে অনন্যসাধারণ প্রতিষ্ঠা লাভ করিয়াছেন, এই সহজসিদ্ধ মুক্তভাবই তাহার নিগূঢ় হেতু। এই মুক্তভাব আছে বলিয়াই, সুরেন্দ্রনাথ কখনও অতীতের নিষ্ফলতার স্মৃতিকে ধরিয়া ভূতলে পড়িয়া থাকেন নাই। ইহার জন্যই তিনি নানা প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেও কখনো আত্মহারা হ’ন নাই। আর এই জন্যই সময়ে সময়ে অশেষ প্রকারের নিন্দা ও অপবাদের ভাগী হইয়াও, সুরেন্দ্রনাথ কখনই আপনার অভীষ্ট কর্ম্মপথ পরিত্যাগ করেন নাই।
সুরেন্দ্রনাথ জনপ্রিয় লোকনায়ক হইয়াও কোনো দিনই লোক-নিন্দার হাত এড়াইতে পারেন নাই। বরং সময়ে সময়ে তিনি এতটাই লোকনিন্দার ভাগী হইয়াছেন যে, অন্য লোকে সেই অপবাদ মাথায় লইয়া আবার কখনও লোক নেতৃত্বের দাবী করিতে সাহস পাইত কি না সন্দেহ। রাজকর্ম্ম হইতে অপসৃত হইয়া, নিতান্ত বিপন্ন হইয়া পড়িলে যে বিদ্যাসাগর তাঁহাকে অযাচিত আশ্রয়দান করিয়াছিলেন, সুরেন্দ্রনাথ যখন সেই বিদ্যাসাগরের মেট্রোপলিটন কালেজের প্রতিদ্বন্দ্বী সিটি কালেজে কর্ম্ম গ্রহণ করেন এবং অল্পদিন মধ্যে আপনি সেই মেট্রোপলিটন কালেজের আর একটী প্রবল প্রতিদ্বন্দী, রিপণ কালেজের, প্রতিষ্ঠা করেন তখন তাঁহার কুযশে বাংলার শিক্ষিত সমাজ মুখরিত হইয়া উঠিয়াছিল। কিন্তু সুরেন্দ্রনাথ নীরবে সেই নিন্দাবাদকে উপেক্ষা করিয়া অল্পদিন মধ্যেই জনসাধারণের চিত্তে আপনার পূর্ব্বতন প্রভাব পুনঃ প্রতিষ্ঠিত করেন। ইহার কিছু দিন পরে তাঁহার রিপণ কালেজের আইন বিভাগের অবৈধ আচার আচরণ লইয়া, একটা বিষম গোল বাধিয়া উঠে এবং এই কালেজ একেবারে উঠিয়া যাইবার আশঙ্কা পর্য্যন্ত উপস্থিত হয়। আর যে ভাবে তখন সুরেন্দ্রনাথ এই আসন্ন বিপদ হইতে আপনার কালেজটা রক্ষা করেন, তাহা লইয়াও শিক্ষিত বঙ্গসমাজের সর্ব্বত্র তাঁহার যে কুযশ রটনা হয়, সেরূপ কুযশকে ঠেলিয়া অন্য কোন লোকনায়ক স্বাদেশিক কর্ম্মক্ষেত্রে অটল ভাবে দাঁড়াইয়া থাকিতে পারিতেন কি না সন্দেহ। আর শোকে সংযম, বিপদে ধৈর্য্য, নিন্দা-অপবাদে উপেক্ষা,প্রত্যক্ষ নিষ্ফলতার মধ্যেও অসাধারণ কর্ম্মোদ্যম,এ সকলই সুরেন্দ্রনাথের পূর্ব্বজন্মসিদ্ধ যোগশক্তির প্রমাণ প্রদান করে। সুরেন্দ্রনাথের জীবনের কৃতিত্বের পশ্চাতে এই যোগশক্তিকে প্রত্যক্ষ না করিলে তাঁহার প্রকৃত মর্ম্ম ও মূল্য বোঝা অসম্ভব হইবে। সুরেন্দ্রনাথের এই সংযম, এই উপেক্ষা ও এই কর্ম্মোদ্যম, এ সকল উচ্চতম রাজসিকতারই লক্ষণ। এ সকলে সুরেন্দ্রনাথের অসাধারণ পুরুষকারেরই প্রমাণ পরিচয় প্রদান করে।
সুরেন্দ্রনাথের কর্ম্মজীবনে পুরুষকার ও দৈব
কিন্তু এ সংসারে পুরুষকার যতই কেন প্রবল হউক না, দৈবের সঙ্গে যুক্ত না হইলে, তাহা তখনই সিদ্ধিলাভে সমর্থ হয় না। সর্ব্ব বিষয়েরই সিদ্ধি দৈব ও পুরুষকারের শুভ যোগাযোগের উপরে একান্তভাবে নির্ভর করে। সুরেন্দ্রনাথ আপনার কর্ম্মজীবনে যে অসাধারণ প্রতিষ্ঠালাভ করিয়াছেন, তাহা কেবলই তাঁহার অনন্যসাধারণ পুরুষকারের ফল নহে। পুরুষকার আমাদিগের ভিতরকারই কথা। আমাদের অন্তঃপ্রকৃতিকে অবলম্বন করিয়াই তাহা প্রকাশিত হয়। কিন্তু এই পুরুষকারের দ্বারা আমাদের জীবনের বাহিরের অবস্থা ও ব্যবস্থার সৃষ্টি বা যোগাযোগ সাধিত হয় না। এ সকল যোগাযোগ দৈবই সংঘটন করিয়া থাকেন। নেপোলিয়ানের অসাধারণ পুরুষকার লোক প্রসিদ্ধ। কিন্তু ফরাসীবিপ্লবের তরঙ্গমুখে না পড়িলে, আর যে সকল আদর্শের প্রেরণায় এবং যে সকল রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক শক্তি-সংঘর্ষে সেই মহাবিপ্লবের সূচনা হয়, তাহার অনুকূলতা না পাইলে, সে অলোকসামান্য পুরুষকার কখনই স্ফূরিত হইত না এবং স্ফূরিত হইলেও কখনই আপনার সম্যক্ চরিতার্থতা লাভে সমর্থ হইত না। আর যে সকল ঘটনাসম্পাতে ও যে সকল ব্যবস্থা ও অবস্থার যোগাযোগে নেপোলিয়ানের পুরুষকার স্ফূরিত ও কৃতার্থ হইয়াছে, তাহা তাঁহার স্বকৃত নহে, কিন্তু সম্পূর্ণরূপেই দৈবকৃত। সুরেন্দ্রনাথের পুরুষকারের আত্মপ্রতিষ্ঠাতেও এই দৈবের কার্য্যই প্রত্যক্ষ রহিয়াছে।
যে সকল বিশেষ অবস্থা ও ব্যবস্থাদির যোগাযোগে সুরেন্দ্রনাথের প্রতিভা ও পুরুষকার আত্মপ্রকাশের অনুকূল এবং সময়োচিত অবসর প্রাপ্ত হয়, তাহা দৈবেরই কার্য্য। এরূপ ক্ষেত্রেও অবসর না পাইলে সুরেন্দ্রনাথের কর্ম্মজীবন যে অসাধারণ সফলতা লাভ করিয়াছে, তাহা কখনই লাভ করিতে পারিত না। ফলতঃ সুরেন্দ্রনাথের প্রতিভা অতিশয় অলোকসামান্য, কিম্বা তাঁহার পাণ্ডিত্যের গভীরতা বা প্রসার যে খুবই বেশী, তাহা নহে। তাঁহার অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ মনীষী তাঁর পূর্ব্বেও অনেক এই বাংলাদেশে জন্মিয়াছেন; তাঁর জীবনকালেও অনেক ছিলেন এবং আছেন। কৃষ্ণদাসের মত রাষ্ট্রীয় বুদ্ধি কিম্বা রাজেন্দ্রলালের মত পাণ্ডিত্য সুরেন্দ্রনাথের কখনই ছিল না। এমন কি কোনো কোনো দিক্ দিয়া শিশিরকুমারের প্রতিভাও সুরেন্দ্রনাথের প্রতিভা অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ ছিল বলিয়াই মনে হয়। অথচ সুরেন্দ্রনাথ আধুনিক ভারতবর্ষের ইতিহাসে যে অক্ষয় কীর্ত্তি অর্জ্জন করিয়াছেন, ইঁহাদের কেহই সে কীর্ত্তি অর্জ্জন করিতে সক্ষম হন নাই। ইহার প্রধান কারণ এই যে সুরেন্দ্রনাথের প্রতিভা ও পুরুষকারের সঙ্গে দৈবের যে অনুকূল যোগাযোগ স্থাপিত হইয়াছে, এ দেশের তাঁর সমসাময়িক কিম্বা অব্যবহিত পূর্ব্ববর্ত্তী অন্য কোনো লোকনায়কগণের ভাগ্যে তাহা ঘটে নাই। কৃষ্ণদাস, রাজেন্দ্রলাল, শিশিরকুমার আপন আপন শক্তি অনুসারে সকলেই স্বদেশের সেবা করিয়া গিয়াছেন। ইঁহাদের সাধনবলে বাংলার আধুনিক রাষ্ট্রীয়জীবন অনেক পরিপুষ্টিলাভ করিয়াছে। কিন্তু সত্য কথা বলিতে গেলে ভারতের ভবিষ্যৎ ইতিহাসে ইহাঁদের কাহারো নাম থাকিবে কি না সন্দেহ। পণ্ডিতসমাজে অসাধারণ প্রতিভাশালী প্রত্নতত্ত্ববিদ্ বলিয়া অনেক দিন রাজেন্দ্রলালের খ্যাতি থাকিবে। বাংলার আধুনিক রাষ্ট্রীয়জীবনের ক্রমবিকাশের ইতিহাসে কৃষ্ণদাসের এবং শিশিরকুমারের নামও কতকটা থাকিবারই কথা। ঊনবিংশ শতাব্দীর ভারতের দেশীয় সংবাদপত্রের ইতিহাসেও এই দুই বাংলা সংবাদপত্র সম্পাদকের নাম কতকটা থাকিয়া যাইবে। কারণ “হিন্দু-প্যাট্রিয়ট” ও “অমৃত-বাজার”কে উপেক্ষা করিয়া এদেশের আধুনিক সংবাদপত্রের ইতিহাস রচনা করা সম্ভব নহে। কিন্তু আধুনিক ভারতের ইংরেজী-শিক্ষাপ্রাপ্ত সম্প্রদায়ের জীবনে ও চরিত্রে সুরেন্দ্রনাথের প্রতিভা ও পুরুষকার যে শক্তিসঞ্চার করিয়াছে, কৃষ্ণদাস কিম্বা রাজেন্দ্রলাল কিম্বা শিশিরকুমার হইতে তাহা হয় নাই। সুরেন্দ্রনাথের অসাধারণ বাগ্মিতা-শক্তি ইহার একটা প্রধান কারণ বটে; কিন্তু কেবল এই বাগ্মিতা-প্রভাবেই সুরেন্দ্রনাথ এই কৃতিত্ব লাভ করিতে পারিতেন না।
সুরেন্দ্রনাথের বাগ্মিতা-শক্তি
সত্য বলিতে কি, সুরেন্দ্রনাথের বাগ্মিতাশক্তিও যে অত্যন্ত উচ্চ-অঙ্গের এমন কথাও বলা যায় কি না সন্দেহ। সুরেন্দ্রনাথের ইংরেজি-বক্তৃতার শব্দ-সম্পদ অতি অদ্ভুত, ইহা অস্বীকার করা যায় না। ভারতবর্ষের বক্তাদের ত কথাই নাই, ইংরেজবাগ্মিগণের বক্তৃতাতেও এরূপ অসাধারণ শব্দসম্পত্তি অতি অল্পই দৃষ্ট হয়। কিন্তু সুললিত শব্দযোজনায় সুরেন্দ্রনাথের বাগ্মিতা যে অনন্যসাধারণ দক্ষতালাভ করিয়াছে, চিন্তার গভীরতায় কিম্বা ভাবের মৌলিকতায় অথবা যুক্তি পরম্পরা প্রয়োগে কোনো সিদ্ধান্ত বিশেষের প্রতিষ্ঠার নিপুণতায় সেরূপ শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করে নাই। সুরেন্দ্রনাথের বাগ্মিতা বহুল পরিমাণেই ধ্বন্যাত্মক। সঙ্গীতের শক্তিও এইরূপই ধ্বন্যাত্মক। আর সঙ্গীত যেমন ধ্বন্যাত্মক স্বরগ্রামের দ্বারাই মানবের চিত্তকে বিবিধভাবাবেগে উদ্বেলিত করিয়া তুলে, সুরেন্দ্রনাথের বাগ্মিতাও সেইরূপ শক্তিশালী শব্দপ্রবাহের বলেই শ্রোতৃবর্গের চিত্তে তড়িৎ-সঞ্চার করিয়া থাকে। সঙ্গীতের স্বরগ্রাম যতক্ষণ কর্ণপটাহ আহত করিতে থাকে, ততক্ষণই যেমন তার প্রভাব চিত্তকে অভিভূত করিয়া রাখে, কিন্তু সে সুরলয় প্রবাহ যখন বন্ধ হইয়া যায় তখন তার অশরীরী স্মৃতিমাত্র পড়িয়া থাকে, কিন্তু তার মধ্যে ধরিবার ছুঁইবার বড় বেশী কিছুই থাকে না; সুরেন্দ্রনাথের বাগ্মিতার শব্দপ্রবাহও সেইরূপ ফলই উৎপাদন করে। যতক্ষণ তাঁহার কণ্ঠস্বর কানে বাজিতে থাকে, ততক্ষণই তার উন্মাদিনী উদ্দীপনা চিত্তকে চঞ্চল করিয়া রাখে, কিন্তু কর্ণের সঙ্গে সেই শব্দস্রোতের যোগ বিচ্ছিন্ন হইবার সঙ্গে সঙ্গেই সে উদ্দীপনার নেশাও ধীরে ধীরে ছুটিতে আরম্ভ করে এবং কিয়ৎক্ষণ পরে তার স্মৃতিমাত্রই জাগিয়া রহে, কিন্তু সে বক্তৃতার চিন্তাযুক্তির প্রভাব শ্রোতৃবর্গের জ্ঞান ও চরিত্রকে অধিকার করিতে সমর্থ হয় না। অতএব সুরেন্দ্রনাথ কেবল আপনার অসাধারণ বাগ্মিতাবলেই যে আধুনিক ভারতবর্ষের ইতিহাসে এই অনন্য-প্রতিদ্বন্দ্বী প্রতিষ্ঠা লাভ করিয়াছেন, এরূপ সিদ্ধান্ত করা যায় না।
আর সুরেন্দ্রনাথের বাগ্মিতার এই অদ্ভুত শব্দসম্পদও প্রকৃতপক্ষে সহজসিদ্ধ নয়। যে সকল সাহিত্যিকের শব্দসম্পদ সহজসিদ্ধ, তাঁহাদের শব্দবিন্যাসের অন্তরালে সর্ব্বদাই হয় ভাবরাজ্যের কিম্বা জ্ঞানরাজ্যের কিম্বা বাহিরের বিষয়জগতের কিম্বা সামাজিক ও ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতার একটা অসাধারণ বস্তুতন্ত্রতা বিদ্যমান থাকে। এই বস্তুতন্ত্রতা হইতেই সহজসিদ্ধ সাহিত্যিকের শব্দশক্তি উৎপন্ন হয়। যে সকল লেখক ও বক্তার শব্দসম্পদ সহজসিদ্ধ, তাঁহাদের রচনা বা বক্তৃতার প্রভাব সামরিক উদ্দীপনাতেই পর্য্যবসিত হয় না; কিন্তু পাঠক ও শ্রোতৃবর্গের জ্ঞানে ও জীবনে সর্ব্বদাই স্বল্পবিস্তর স্থায়িত্ব লাভ করিয়া থাকে। যাঁহাদের শব্দসম্পদ সহজসিদ্ধ নয় কিন্তু কঠোর সাধনালব্ধ, তাঁহাদের সাহিত্যচেষ্টা অনেকসময় বস্তুতন্ত্রতাহীন হইয়া এই স্থায়ী ফললাভে অসমর্থ হয়। সুরেন্দ্রনাথের শব্দসম্পদও সাধন-লব্ধ। তাঁহার স্মৃতি-শক্তি অসাধারণ। এই স্মৃতিবলে অনেক শব্দসম্পদশালী ইংরেজ-লেখকের গ্রন্থ তাঁহার কণ্ঠস্থ হইয়া আছে। এই সকল ইংরেজ-লেখকের শব্দসম্পদ আয়ত্ত করিয়াই সুরেন্দ্রনাথের বক্তৃতা এমন সম্পত্তিশালী হইয়াছে। আর পরধনপুষ্ট বলিয়াই সুরেন্দ্রনাথের বাগ্মিতার শব্দশক্তির পশ্চাতে সর্ব্বদা কোনও সজীব বস্তুতন্ত্রতা বিদ্যমান থাকে না এবং এই কারণেই তাহার উদ্দীপনাও স্থায়ী হয় না। কিন্তু এ সকল সত্ত্বেও প্রধানতঃ আপনার বাগ্মিতাবলেই সুরেন্দ্রনাথ আধুনিক ভারতবর্ষের রাষ্ট্রীয় চিন্তায় ও কর্ম্মজীবনে যে স্থায়ী প্রতিপত্তিলাভ করিয়াছেন, তাঁহার পুরুষকারই ইহার একমাত্র হেতু নহে, ইহার অন্তরালে দৈবপ্রভাবও প্রত্যক্ষ হয়।
দেশকালের যথাযোগ্য যোগাযোগ ব্যতীত এ জগতে কি সাংসারিক কি পারমার্থিক কোনো প্রকারের সাধনাতেই লোকে সিদ্ধি লাভ করিতে পারে না। আর দৈবকৃপায় সুরেন্দ্রনাথের কর্ম্মজীবনে এই যোগাযোগ ঘটিয়াছিল বলিয়াই তিনি এতটা সফলতা লাভ করিতে পারিয়াছেন। সুরেন্দ্রনাথ আজি পর্য্যন্তও তাঁর স্বদেশের প্রাণবস্তুর সংস্পর্শ লাভ করিতে পারিয়াছেন কি না সন্দেহ। তাঁর কর্ম্মজীবনের প্রথমে যে তিনি এই প্রাণস্রোতের একান্ত বাহিরে পড়িয়াছিলেন, ইহা অস্বীকার করা অসম্ভব। কিন্তু তাঁর সমসামরিক ইংরেজিশিক্ষিত স্বদেশবাসিগণের সকলেরই এই অবস্থা ছিল। সেকালে ইংরেজিশিক্ষিত বাঙ্গালীগণ ইংরেজিতেই কথাবার্ত্তা ও পত্র ব্যবহার করিতেন, ইংরেজি ধরণেই চিন্তা করিতেন, ইংরেজি সাহিত্যের অলঙ্কারাদি অবলম্বনেই নিজেদের ভাবাঙ্গসাধনের চেষ্টা করিতেন। ইংরেজসমাজের আদর্শে নিজেদের সমাজকে এবং ইংলণ্ডের রাষ্ট্রতন্ত্রের অনুযায়ী আপনাদের রাষ্ট্রীয় জীবনকে গড়িয়া তুলিবার জন্য ইঁহারা সকলেই স্বল্পবিস্তর লালায়িত ছিলেন। এই অবস্থায় যে সুরেন্দ্রনাথের ইংরেজি-শব্দ-সম্পদ-পুষ্ট, ইংরেজি-অলঙ্কার-ভূষিত, ইংরেজি ভাবে অনুপ্রাণিত, য়ুরোপীয় ইতিহাসের দৃষ্টান্তে উদ্দীপিত বাগ্মিতা তাঁহার স্বদেশের ইংরেজিশিক্ষিত সম্প্রদায়ের প্রাণকে মাতাইয়া তুলিয়াছিল, ইহাই কিছুই বিচিত্র নহে।
ইংরেজি-শিক্ষা, স্বাধীনচিন্তা ও ব্যক্তিত্বাভিযান
ইংরেজিশিক্ষা এদেশের শিক্ষিত সম্প্রদায়ের প্রাণে একটা প্রবল ব্যক্তিত্বাভিমান জাগাইতেছিল। অষ্টাদশ ও উনবিংশ খৃষ্ট শতাব্দীর য়ুরোপীয় সাধনা এই ব্যক্তিত্বাভিমানকেই সত্য স্বাধীনতার আদর্শ বলিয়া গ্রহণ করিয়াছিল, প্রাচীন যুগের য়ুরোপীর সাধনায় এই ব্যক্তিত্ববোধ— ইংরেজিতে যাহাকে sense of personality বলে—ভাল করিয়া ফুটিয়া উঠে নাই। গ্রীসীয় সাধনা জনসমাজকে অঙ্গীরূপে এবং সেই সমাজান্তর্গত ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তিকে অঙ্গরূপেই দেখিয়াছিল। অঙ্গীকে ছাড়িয়া যেমন অঙ্গের কোনই সার্থকতা নাই ও থাকা সম্ভবে না, সেইরূপ সমাজকে ছাড়িয়াও সমাজান্তর্গত ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তির কোনো স্বতন্ত্র সার্থকতা যে আছে বা থাকিতে পারে, গ্রীসীয় সাধনার এই জ্ঞান পরিস্ফুট হয় নাই। সুতরাং গ্রীসে যে সকল ব্যক্তি সমাজ-জীবনের পরিপুষ্টিসাধনে একান্ত অসমর্থ হইত, তাহাদিগের বাঁচিয়া থাকারও কোনো প্রয়োজন ছিল না। সমাজের ঐকান্তিক আনুগত্যই সে দেশে প্রত্যেক ব্যক্তির একমাত্র ধর্ম্ম বলিয়া পরিগণিত হইত। যেমন গ্রীসে সেইরূপ প্রাচীন ইহুদীরও কোনো প্রকারের ব্যক্তিত্ববোধ জাগিতে পায় নাই। ইহুদীয় সাধনা জনসমাজের সমষ্টিগত সার্থকতাই উপলব্ধি করিয়াছিল। ব্যষ্টিভাবে সমাজের অন্তর্গত ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তিরও যে একটা নিজস্ব লক্ষ্য ও সার্থকতা আছে, এই জ্ঞান ইহুদীয় চিন্তাতে ভাল করিয়া ফুটিয়া উঠে নাই। প্রথম যুগের খৃষ্টীয় সাধনা এক দিকে ইহুদীয় এবং অন্যদিকে গ্রীসীয় ও রোমক সাধনার উপরেই প্রতিষ্ঠিত হয়। সুতরাং রোমক ব্যবহার-তত্ত্বের প্রভাবে এই নূতন খৃষ্টীয় সাধনায় কিয়ৎ-পরিমাণে পাপ-পুণ্যের দণ্ড-পুরস্কারসম্বন্ধে একটা ব্যক্তিত্ববোধ জাগিলেও বহুদিন পর্য্যন্ত প্রকৃত ব্যক্তিত্ব-মর্য্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয় নাই। ইহুদীয় সমাজতন্ত্র এবং গ্রীসীয় ও রোমক রাষ্ট্রতন্ত্রের স্থানে নূতন খৃষ্টীয় সঙ্ঘ প্রতিষ্ঠিত হইয়া খৃষ্টীয়ান জনমণ্ডলীর ব্যক্তিত্বাভিমানকে এখানেও চাপিয়া রাখিতে লাগিল। ইহুদীয় ও গ্রীসে যেমন সমাজান্তর্গত ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তিকে একান্তভাবেই সমাজশক্তির ও রাষ্ট্রশক্তির অধীন করিয়া রাখিয়াছিল, প্রথম যুগের খৃষ্টীয় সাধনাও সেইরূপই খৃষ্টীয়ান জনসাধারণকে একান্তভাবেই Churchএর বা খৃষ্টীয় সঙ্ঘের অধীন করিয়া রাখে। প্রভুশক্তির রূপান্তর ও নামান্তর হইল মাত্র, কিন্তু জনমণ্ডলীর ঐকান্তিক পরাধীনতার কোনই পরিবর্ত্তন হইল না। এইরূপে যেমন প্রাচীন গ্রীক ও রোমক তন্ত্রে, সেইরূপ নূতন খৃষ্টীয় তন্ত্রেও জনগণের ব্যক্তিত্ব-মর্য্যাদার প্রতিষ্ঠা হয় নাই। বহু শতাব্দ ব্যাপিয়া একদিকে পৌরহিত্য-প্রধান রোমক খৃষ্টীয় সঙ্ঘ ও অন্যদিকে স্বেচ্ছাচারী প্রজারঞ্জনবিমুখ খৃষ্টীয়ান ভূপতিবর্গ, উভয়ে মিলিয়া য়ুরোপীয় জনমণ্ডলীর অন্তর্বাহ্য সর্ব্বপ্রকারের স্বাধীন চেষ্টাকে একান্তভাবে অবরুদ্ধ করিয়া, তাহাদের প্রাণগত ব্যক্তিত্ব ও মনুষ্যত্বকে নিতান্ত নির্জীব করিয়া রাখিয়াছিলেন। ধর্ম্মের প্রামাণ্যবিচারে স্বাভিমতের এবং রাষ্ট্রীয়-শাসন-ব্যাপারে লোকমতের কোনই অধিকার ও মর্য্যাদা ছিল না। রোমক সঙ্ঘের প্রধান পুরোহিত বা পোপ একদিক দিয়া লোকের ধর্ম্মজীবনে আপনাকে ঈশ্বরের সাক্ষাৎ প্রতিনিধি বলিয়া প্রতিষ্ঠিত করিয়াছিলেন। অন্যদিকে খৃষ্টীয়ান রাজন্যবর্গও জনগণের সাংসারিক কর্ম্মজীবনে ঐশ্বরিক মর্য্যাদার দাবী করিয়া তাহাদিগকে নিজেদের পদানত করিয়া রাখিয়াছিলেন। ষোড়শ খৃষ্টীয় শতাব্দীতে রোমান ক্যাথালিক পৌরহিত্যের অতিপ্রাকৃত প্রভুত্বের প্রতিবাদ করিয়া মার্টিন লুথার খৃষ্টীয় জগতে ধর্ম্মের প্রামাণ্যবিচারে জনগণের স্বাভিমতের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত করেন। তখন হইতেই খৃষ্টীয় সমাজে স্বাধীন চিন্তার বা Free Thoughtএর উন্মেষ হইতে আরম্ভ করে। মার্টিন লুথার রোমক সঙ্ঘের অধিপতি পোপের অতিপ্রাকৃত প্রভুত্বের দাবীই অগ্রাহ্য করেন; কিন্তু খৃষ্টীয় ধর্ম্মশাস্ত্র বাইবেলের অতিপ্রাকৃত প্রামাণ্য অস্বীকার করেন নাই। বাইবেলের প্রামাণ্য স্বীকার করিয়া তিনি প্রত্যেক খৃষ্টীয়ান্ সাধক ও যজমানকে, ভগবৎ প্রেরণাধীন হইয়া, আপনাদের ধর্ম্মগ্রন্থের যথাযথ মর্ম্মনির্দ্ধারণের অধিকার প্রদান করেন। রোমক খৃষ্টীয়মণ্ডলী মধ্যে অতিপ্রাকৃত শাস্ত্র এবং সেই শাস্ত্রের মর্ম্মনির্দ্ধারণের জন্য অতিপ্রাকৃত শক্তিসম্পন্ন গুরুরই কেবল প্রতিষ্ঠা ছিল, কিন্তু সাধারণ খৃষ্টীয় সাধক ও সাধনার্থী জনমণ্ডলীর স্বাভিমতের কোনোই স্থান ছিল না। মার্টিন লুথার যে সংস্কৃত খৃষ্টধর্ম্মের প্রচার করেন, তাহাতে শাস্ত্র ও স্বাভিমতেরই প্রতিষ্ঠা হয়, কিন্তু সদ্গুরুর কোনো স্থান হয় নাই। ধর্ম্মশাস্ত্র মাত্রেই প্রাচীন কালের ধর্ম্মজীবন ও আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতার বিবরণ লিপিবদ্ধ হইয়া আছে। সুতরাং এই সকল শাস্ত্রের প্রকৃত মর্ম্ম উদ্ঘাটন করিতে হইলে দীর্ঘকালব্যাপী তপস্যার বলে তাহার অনুরূপ আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা অর্জ্জন করা আবশ্যক হয়। সর্ব্বপ্রকারের গভীর আধ্যাত্মিক-অভিজ্ঞতাবিহীন প্রাকৃত জনের পক্ষে কেবল ব্যাকরণের ব্যুৎপত্তির কিম্বা লৌকিক ন্যায়ের যুক্তির বলে অলৌকিক আধ্যাত্মিক সম্পদসম্পন্ন ধর্ম্মপ্রবর্ত্তকগণের উপদেশের প্রকৃত মর্ম্ম উদ্ঘাটন করা একান্তই অসম্ভব। সে অদ্ভুত চেষ্টা সর্ব্বদাই বন্ধ্যার পুত্ত্রশোকের ব্যথার ন্যায় কল্পিত ও অলীক হইবেই হইবে। কেবল সন্তানবতী রমণীই যেমন আপনার অন্তরের বাৎসল্য-রসের অভিজ্ঞতার দ্বারা অপরের মাতৃ-স্নেহের প্রকৃত মর্ম্ম নির্দ্ধারণ করিতে পারেন; সেইরূপ অনন্যসাধারণ সাধন-সম্পদ-সম্পন্ন সদ্গুরুগণই নিজেদের গভীর আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতার দ্বারা পুরাতন শাস্ত্রের প্রকৃত মর্ম্ম উদ্ঘাটন করিতে সমর্থ হন। প্রত্যেক বিদ্যার শাস্ত্রই, বহুকালব্যাপীসাধনা দ্বারা যাঁহারা সেই বিস্তাকে প্রকৃতভাবে অধিগত করিয়াছেন, সেইরূপ অধ্যাপক ও আচার্য্যগণের শিক্ষার সত্যাসত্যের সাক্ষ্য দেয়; আর এই সকল অধ্যাপক এবং আচার্য্যগণও নিজেদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা বলে আপনাদের বিদ্যাসম্বন্ধীয় শাস্ত্রের সত্যাসত্য নির্দ্ধারণে সমর্থ হন। অতএব ধর্ম্মশাস্ত্রের মর্ম্ম উদ্ঘাটনে সদ্গুরুর প্রামাণ্য ও প্রয়োজন নাই, এ কথা বলিলে চলিবে কেন? অথচ মার্টিন লুথার-প্রবর্ত্তিত Protestant খৃষ্টীয় সাধনা ধর্ম্মসাধনে যেমন শাস্ত্রের ও স্বাভিমতের সেইরূপ সদ্গুরুরও যে একটা সঙ্গত স্থান ও অধিকার আছে, ইহা অস্বীকার করে। ইহার ফলে প্রথমে ধর্ম্মশাস্ত্রের মর্ম্মনির্দ্ধারণে প্রাকৃত জনের অসংস্কৃত বিচারবুদ্ধি এবং লৌকিক ন্যায়ের ইন্দ্রিয়-প্রত্যক্ষ অনুমান ও উপমান এই প্রমাণদ্বয়ই একমাত্র কষ্টিপাথর হইয়া দাঁড়ায় এবং ক্রমে প্রাকৃত বুদ্ধি বিচারের প্রাবল্য হেতু শাস্ত্রের প্রামাণ্যমর্য্যাদাটুকুও একেবারে নষ্ট হইয়া যায়! এই রূপেই য়ুরোপে অষ্টাদশ ও উনবিংশ খৃষ্ট শতাব্দীর স্বাধীনচিন্তার বা Free Thought এর এবং যুক্তিবাদের বা Rationalismএর প্রতিষ্ঠা হয়। এই স্বাধীনচিত্তা ও যুক্তিবাদ প্রবল হইয়াই য়ুরোপীয় লোকচরিত্রে একটা অসংযত ও অসঙ্গত ব্যক্তিত্বাভিমান জাগাইয়া তুলে। এই ব্যক্তিত্বাভিমানই ফরাসী বিপ্লবের তরঙ্গ-মুখে সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতার নামে আত্মপ্রতিষ্ঠার ও আত্মচরিতার্থতালাভের চেষ্টা করে। আমার বুদ্ধি যাহা সত্য বলে তাহাই কেবল সতা, সত্যের আর কোনো বাহিরের প্রামাণ্য নাই, আমার সংজ্ঞান বা Conscience যাহাকে ভাল বলে তাহাই ভাল,—ইহার উপরে ভালমন্দের আর কোনো উচ্চতর বিচারক নাই—এই বস্তুকেই অষ্টাদশ ও উনবিংশ খৃষ্ট শতাব্দীর য়ুরোপীয় সাধনা স্বাধীন চিন্তার আদর্শ বলিয়া গ্রহণ করে। এই স্বাধীন চিন্তার প্রভাবেই য়ুরোপে স্বাধীনতার নামে একটা অসঙ্গত ও অসংযত ব্যক্তিত্বাভিমান জাগিয়া উঠে, এবং ইহার ফলে ক্রমে সমাজের গ্রন্থি শিথিল, ধর্ম্মের প্রভাব ম্লান এবং আধ্যাত্মিক জীবনের শক্তি ও সত্য ক্ষয় পাইতে আরম্ভ করে।
আধুনিক ভারতে ধর্ম্ম ও সমাজসংস্কার
ইংরেজিশিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের নব্যশিক্ষিত সম্প্রদারের উপরেও এই য়ুরোপীয় স্বাধীনচিন্তার ও যুক্তিবাদের প্রভাব অত্যন্ত প্রবল হইয়া উঠে এবং তাঁহাদের প্রাণে স্বাধীনতার নামে একটা অসংযত ব্যক্তিত্বাভিমান জাগিয়া আমাদের বর্ত্তমান ধর্ম্ম ও সমাজসংস্কারের সূত্রপাত করে। এই ধর্ম্ম ও সমাজসংস্কার-চেষ্টার বহুবিধ ভ্রম-ত্রুটী এবং অসম্পূর্ণতাসত্ত্বেও আধুনিক ভারতের ব্যক্তিগত ও সামাজিক জীবনগঠনের জন্য তাহা যে একান্তই প্রয়োজন ছিল, কিছুতেই এ কথা অস্বীকার করা যায় না। পূর্ব্বসংস্কারবর্জ্জিত না হইলে কেহ এ জগতে সত্যের সাধনা করিতে পারে না। এই সংস্কারবর্জ্জনের নামই চিত্তশুদ্ধি। কি ব্যক্তি কি সমাজ উভয়েরই আত্মচরিতার্থতালাভের জন্য এই চিত্তশুদ্ধির আবশ্যক হয়। ‘নেতি’র ভিতর দিয়াই ‘ইতি’তে যাইতে হয়। ব্যতিরেকী পন্থার পরেই অন্বয়ী পন্থার প্রতিষ্ঠা। ইহাই আমাদিগের প্রাচীন বেদান্তের শিক্ষা। ইংরেজ মনীষী কার্লাইল, Through Eternal Nay to Eternal Yea, এই সূত্রে অমাদের এই প্রাচীন উপদেশেরই পুনরাবৃত্তি করিয়াছেন। সমাজের সকল অযৌক্তিক বন্ধন ছেদন করিতে উদ্যত হইয়া, ধর্ম্মের শাস্ত্রবদ্ধ সকল অনুশাসন অগ্রাহ্য করিয়া, কেবল আপনার ব্যক্তিগত বিচারবুদ্ধি ও সংজ্ঞানের উপরে দাঁড়াইতে যাইয়া, আমাদিগের দেশের আধুনিক শিক্ষা-প্রাপ্ত সম্প্রদায় এই নেতি বা “না”-এর পথ ধরিয়াই, নিজেদের ও সমাজের চিত্তশুদ্ধিসাধনের চেষ্টা করিয়াছিলেন। আধুনিক বাঙ্গালী শিক্ষিত সমাজ যেরূপ আগ্রহ সহকারে যতটা স্বার্থত্যাগ স্বীকার করিয়া এই নূতন ধর্ম্ম ও সমাজসংস্কারের পথ ধরিয়া চলিয়াছিলেন, ভারতের আর কোনো প্রদেশের লোকে সেরূপ করেন নাই। আর এই সাধনবলেই আধুনিক স্বাধীনতার আদর্শ বাংলা দেশে যতটা ফুটিয়া উঠিয়াছে ভারতের আর কোথাও সেরূপ ফুটিরা উঠে নাই।
বাংলার স্বাধীনতার ও স্বদেশ-চর্য্যার আদর্শ
ফলতঃ যে যাহাই বলুন না কেন বাংলার নিকট হইতেই যে ভারতের অপরাপর প্রদেশবাসিগণ বহুল পরিমাণে এই আধুনিক স্বাধীনতার ও স্বদেশচর্য্যার উদ্দীপনা লাভ করিয়াছেন, ইহা অস্বীকার করা যায় না। সমগ্র ভারত যখন নিদ্রিত, কেবল বাংলাই তখন জাগিয়া উঠিয়াছিল। ব্রিটিশ ভারতের অন্য কোন প্রদেশে যখন ব্যক্তিগত বা রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষার সঞ্চার হয় নাই, বাঙ্গালী তখনও এই মুক্তিমন্ত্রসাধনে নিযুক্ত ছিল। আর এই জন্যই বাংলার স্বাধীনতার আদর্শের পূর্ণতা ও সজীবতা বাঙ্গালীর স্বাদেশিকতার ধর্ম্মপ্রাণতা ও একনিষ্ঠা এবং বাংলার রাষ্ট্রীয় জীবনের শক্তি ও শুদ্ধতা, এ সকল এ পর্য্যন্ত ভারতের অন্য কোন প্রদেশে দেখা যায় নাই। অন্যান্য প্রদেশের ধর্ম্মসংস্কার-চেষ্টা একদিকে নূতনকেও নিঃসঙ্কোচে আলিঙ্গন করিতে সমর্থ হয় নাই এবং অন্যদিকে পুরাতনের সনাতন প্রাণ-বস্তুকে অবলম্বন করিয়া তাহাকেও সজীব ও সময়োপযোগী করিয়া তুলিতে পারে নাই। কিন্তু নূতনের কুযুক্তি এবং পুরাতনের কুসংস্কারের মধ্যে একটা খিচুড়ী পাকাইবারই চেষ্টা করিয়াছে। সমাজ-সংস্কারচেষ্টাতেও অন্যান্য প্রদেশে এইরূপ অসঙ্গতিদোষ দেদীপ্যমান রহিয়াছে। সমাজ-সংস্কার করিতে যাইয়া বাংলা আপনার বিচার-বুদ্ধির অনুযায়ী শুদ্ধ শ্রেয়ের পথই ধরিতে চাহিয়াছে, প্রেয়ের পথে চলিবার জন্য ব্যস্ত হয় নাই, কিন্তু অন্যান্য প্রদেশের সমাজ সংস্কারের চেষ্টাতে ন্যায়ের প্রেরণা অপেক্ষা সুখের প্রলোভনই বলবত্তর হইয়া আছে। সত্যের আনুগত্য অপেক্ষা সুবিধার অন্বেষণই তাহাতে বেশী। অন্যান্য প্রদেশের রাষ্ট্রীয় চেষ্টার মধ্যেও এখনও পর্য্যন্ত একটা সঙ্কীর্ণ প্রাদেশিকতা বিদ্যমান রহিয়াছে। কিন্তু বাংলার রাষ্ট্রীয় আদর্শ চিরদিনই সমগ্র ভারতের মৌলিক একত্বের উপরে আপনাকে গড়িয়া তুলিতে চেষ্টা করিয়াছে। সেই রূপ ভারতের অন্যান্য প্রদেশে প্রকৃত স্বাধীনতার অদর্শও ফুটিয়া উঠে নাই, কেবল বাংলা দেশেই তাহা ফুটিয়াছে। আর অন্যান্য প্রদেশের স্বাদেশিকতাও একদিকে ভারতের সনাতন সভ্যতা এবং সাধনার উপরেও প্রতিঠিত হয় নাই, আর অন্যদিকে আধুনিক জগতের শ্রেষ্ঠতম মানব-হিতৈষা ও বিশ্ব-কল্যাণ-কামনার সঙ্গেও যুক্ত হয় নাই। এই স্বাদেশিকতা কোথাও বা একটা অন্ধ, অযৌক্তিক স্থবির ও গতানুগতিক রক্ষণশীলতার, আর কোথাও বা একটা শ্রেয়-জ্ঞানশূন্য প্রেয়-সন্ধিৎষু বিজাতীয় পরজাতিবিদ্বেষেরই নামান্তর ও রূপান্তর মাত্র হইয়া আছে। অনেক স্থলেই এই স্বাদেশিকতার সঙ্গে বিশ্ব-কল্যাণ-কামনার যথোপযোগ্যসঙ্গতি প্রতিষ্ঠিত হয় নাই। কেবল বাংলা দেশেই আধুনিক স্বাদেশিকতার বা Nationalismএর সত্য ও পূর্ণ আদর্শ অনেকটা ফুটিয়া উঠিয়াছে। আর ইহার কারণ এই যে ইদানীন্তন কালে বাঙ্গালী শিক্ষিত সমাজ স্বাধীনতার ও স্বাদেশিকতার যে উন্নত শিক্ষা লাভ করিয়াছেন, ভারতের অন্য কোন প্রদেশবাসিগণ এ পর্য্যন্ত সে শিক্ষা লাভ করিবার অবসর পান নাই। বাংলার এই আধুনিক স্বাধীনতার ও স্বাদেশিকতার আদর্শকে ফুটাইয়া তুলিবার জন্য নানা দিকে নানা লোক নানা চেষ্টা করিয়াছেন সত্য; কিন্তু এই নূতন সাধনার প্রথম যুগের প্রধান দীক্ষাগুরু ও শিক্ষাগুরু তিনজন,—রামমোহন, কেশবচন্দ্র ও সুরেন্দ্রনাথ।
পরযুগের যুগ-আদর্শ ও রাজা রামমোহন
বাংলার এবং বস্তুতঃ সমগ্র ভারতবর্ষেরই, আধুনিক ধর্ম্মজীবন ও কর্ম্মজীবনের প্রথম গুরু রাজা রামমোহন। ইংরেজি শিক্ষায় ইংরেজের শাসনে, য়ুরোপীয় সভ্যতা ও সাধনার সংস্পর্শে এদেশে যে অভিনব আদর্শ ফুটিতে আরম্ভ করে, রামমোহনের অলোকসামান্য প্রতিভাই সম্যক্রূপে তাহার সাক্ষাৎকার লাভ করিয়া, সেই আদর্শকে স্বদেশের পুরাতন সভ্যতা ও সাধনার সঙ্গে মিলাইয়া, কিরূপে তাহার পূর্ণতা সাধন করিতে হইবে, ইহা দেখাইয়া গিয়াছে। রাজা রামমোহন কিরূপে সমাজজীবনের সকল বিভাগে এই নূতন যুগধর্ম্মকে প্রতিষ্ঠিত করিতে হইবে, তাহার পথ দেখাইয়া গিয়াছেন। তিনি আপনার জীবনে ও উপদেশাদিতে যে সর্ব্বাঙ্গসুন্দর স্বাদেশিকতার আদর্শকে ফুটাইয়া তুলিবার চেষ্টা করিয়াছিলেন, ধীরে ধীরে, নানা দিক্ দিয়া, ঋজু কুটিলভাবে, বিগত শত বৎসর ধরিয়া, দেশের শ্রেষ্ঠজনেরা নিজ নিজ শক্তিসাধ্য অনুসারে সেই আদর্শেরই সাধনা করিয়া আসিয়াছেন। এই শতাব্দব্যাপী সাধনার বলে সেই আদর্শ ক্রমে ক্রমে স্ফুটতর হইয়া উঠিয়াছে সত্য; কিন্তু এখনও সম্যকরূপে আয়ত্ত হয় নাই।
কিন্তু রামমোহন সম্পূর্ণ যোগ-আদর্শ প্রত্যক্ষ এবং প্রকাশিত করিয়াও আপনার কর্ম্মজীবনে বিশেষভাবে তার তত্ত্বাঙ্গ বা theoretic sideই ফুটাইয়া তুলিয়াছিলেন। পূর্ব্বতন যুগের সঞ্চিত কর্ম্মক্ষয় ও তাহার প্রাণহীন সংস্কার ও অর্থহীন কর্ম্মজঞ্জাল পরিষ্কার করিবার চেষ্টাতেই তাঁহার সমুদায় সময় ও শক্তি নিয়োজিত হয়। রামমোহনের শিক্ষা সমাজজীবনের সকল অঙ্গকেই অধিকার করিয়াছেন সত্য। একদিকে যেমন ধর্ম্মের তত্ত্বাঙ্গ ও সাধনাঙ্গ, উভয় অঙ্গকেই তিনি সুশোভিত ও সুসংস্কৃত করিয়া, প্রাচীন ঋষিপন্থা অবলম্বনেই তাহাকে সত্যোপেত ও সময়োপযোগী করিয়া তুলিতে চেষ্টা করিয়াছিলেন, সেইরূপ অন্যদিকে সমাজজীবনেও যে সকল অহিতাচার পুঞ্জীকৃত হইয়া উঠিয়াছিল, তাহারও সংস্কারসাধনে সময়োচিত যত্ন করিতে ত্রুটী করেন নাই। আর দেশের রাষ্ট্রীয় জীবনেও যাহাতে প্রজাসাধারণের স্বত্ব-স্বাধীনতার সম্প্রসারণ হয়, রাজা রামমোহন সে দিকেও যথাযোগ্য যত্ন করিয়াছিলেন। কিন্তু তাঁহার কর্ম্মজীবনের এই ব্যাপকতা ও বহুমুখীনতা সত্ত্বেও রামমোহন বিশেষভাবে ধর্ম্মসংস্কারক বলিয়াই প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছেন। কোনও একান্ত ধর্ম্মপ্রাণ সমাজে কোনও নূতন আদর্শের প্রতিষ্ঠা করিতে হইলে, সর্ব্বাদৌ তাহাকে ধর্ম্মের ভিতর দিয়াই ফুটাইয়া তুলিতে হয়, নতুবা সে আদর্শ সে সমাজের মর্ম্মকে স্পর্শ করিতে পারে না। এই জন্য রাজা রামমোহন নবযুগের সর্ব্বাঙ্গীন আদর্শের সাক্ষাৎকার লাভ করিলেও তাঁহার কর্ম্মের ঝোঁক সে ধর্ম্মের সংস্কারকার্য্যের উপরেই বেশি পড়িয়াছিল, ইহা কিছুই আশ্চর্য্য নহে।
রাজার স্বাধীনতার আদর্শ
স্বাধীনতাই রাজা রামমোহনের শিক্ষা ও সাধনার মূলমন্ত্র ছিল। ধর্ম্মের তত্ত্বাঙ্গে ও সাধনাঙ্গে এই দুই দিকেই রাজা বিশেষভাবে এই স্বাধীনতার আদর্শকে গড়িয়া তুলিতে চেষ্টা করেন। কিন্তু একদিক দিয়া অষ্টাদশ শতাব্দীর যুরোপীয় সাধনার স্বাধীনতার আদর্শের সঙ্গে রাজার আদর্শের যোগ ও মিল থাকিলেও, ইহা সর্ব্বতোভাবেই সেই আদর্শ অপেক্ষা শ্রেষ্ঠতর ও পূর্ণতর ছিল। আর স্বদেশের সনাতন সভ্যতা ও সাধনার সঙ্গে রাজার যে গভীর আধ্যাত্মিক যোগ ছিল, তাহাই তাঁহার স্বাধীনতার আদর্শের এই শ্রেষ্ঠত্বের মূল কারণ। রাজা বৈদান্তিক সাধনের একান্ত পক্ষপাতী ছিলেন। এইজন্য বৈদান্তিক মুক্তির আদর্শের সঙ্গে রাজা রামমোহনের স্বাধীনতার আদর্শের অতি নিগূঢ় যোগ ছিল। বেদান্ত মার্গ অবলম্বন করিয়া,ইদং প্রত্যয়বাচক সর্ব্ববিধ অনাত্ম-বস্তুর ঐকান্তিক অধীনতা হইতে, অহং প্রত্যয় বাচক আত্ম-বস্তুকে মুক্ত করাই রাজা রামমোহনের শিক্ষা ও সাধনার মূলমন্ত্র ছিল। তাঁহার ধর্ম্মের শিক্ষা ও সামাজিক শিক্ষা সকলই এই আদর্শের অনুযায়ী ছিল। রাজার বহুমুখী সাধনার প্রত্যেক ও সকল বিভাগের সঙ্গেই একটা অতি গভীর ও ঘনিষ্ঠ মোক্ষসম্পর্ক ছিল। আর এই মোক্ষ-সম্বন্ধই রাজার আদর্শকে আধুনিক য়ুরোপীয় সাধনার সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনের আদর্শ হইতে পৃথক্ করিয়া রাখিয়াছে। রাজার দেশ-প্রচলিত কর্ম্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ তাঁহার এই বৈদান্তিক আদর্শের উপরেই প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল। কিন্তু বেদান্ত সিদ্ধান্তের একান্ত পক্ষপাতী হইয়াও রাজা সম্পূর্ণরূপে শঙ্কর বেদান্তের মায়াবাদ গ্রহণ করেন নাই। অন্যদিকে বৈষ্ণব সিদ্ধান্তের সগুণ ব্রহ্মবাদকেও একান্তভাবে গ্রহণ করেন নাই। কিন্তু শঙ্কর সিদ্ধান্ত ও রামানুজ সিদ্ধান্তের মধ্যে একটা সামঞ্জস্য স্থাপনের চেষ্টা করিয়া, ভারতের প্রাচীন ঋষিপন্থার সঙ্গে আধুনিক য়ুরোপের উচ্চতম সামাজিক আদর্শের একটা অপূর্ব্ব সঙ্গতিসাধন করিতে চাহিয়াছিলেন। ব্রাহ্ম সমাজের পরবর্ত্তী আচার্য্যগণের ন্যায়, রামমোহন কি তত্ত্ববিচারে কি ধর্ম্মসাধনে একান্তভাবে শাস্ত্রগুরুর অধিকার ও প্রামাণ্য অগ্রাহ্য করেন নাই। কিয়ৎ-পরিমাণে মার্টিন লুথারের মত রাজা রামমোহনও শাস্ত্রনির্দ্ধারণে প্রত্যেক ব্যক্তির নিজের বিচারবুদ্ধি প্রয়োগের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করিয়াছিলেন বটে, কিন্তু পরবর্ত্তী ব্রাহ্ম আচার্য্যগণের ন্যায় শাস্ত্রের প্রামাণ্য ও অধিকার একেবারে অস্বীকার করেন নাই। আবার অন্যদিকে লুথারের ন্যায় রাজা শাস্ত্রার্থনির্দ্ধারণে সদ্গুরুর প্রয়োজন অগ্রাহ্য করিয়া, কেবলমাত্র স্বানুভূতির উপরেই শাস্ত্রোপদেশের সত্যাসত্য নির্ণয়ের ভারও অর্পণ করেন নাই। এইজন্যই প্রোটেস্ট্যাণ্ট সিদ্ধান্তে শাস্ত্র ও স্বানুভূতির—Scripture এবং Private Judgmentএর মধ্যে যে সামঞ্জস্য প্রতিষ্ঠা হয় নাই, রাজা আপনার সিদ্ধান্তে, শাস্ত্রার্থ বিচারে, সদ্গুরুর যথাযোগ্য স্থান ও অধিকার প্রদান করিয়া, অতি সহজেই সেই সামঞ্জস্য প্রতিষ্ঠা করিতে পারিয়াছেন। আর এই রূপেই রাজা রামমোহন তত্ত্ববিচারে ও ধর্ম্মসাধনে ভারতের প্রাচীন এবং য়ুরোপের আধুনিক সাধনার উচ্চতম আদর্শের মধ্যে একটা অতি সুন্দর সঙ্গতি স্থাপন করিয়াছিলেন।
রাজার সামাজিক সিদ্ধি
যেমন তত্ত্ববিচারে ও ধর্ম্মসংস্কারে, সেইরূপ আপনার সামাজিক সিদ্ধান্তেও রাজা রামমোহন প্রাচীন ভারতের ও আধুনিক য়ুরোপের সাধনার মধ্যে একটা অতি সুন্দর সঙ্গতি স্থাপন করিয়াই আমাদিগের বর্ত্তমান যুগ-আদর্শকে সামাজিক জীবন সম্বন্ধেও একই সঙ্গে স্বাদেশিক ও সার্ব্বজনীন করিয়া তুলিবার চেষ্টা করেন। সমাজ-জীবনের শৈশবে জগতের সর্ব্বত্রই সমাজের কর্ম্ম-বিভাগ বংশ মর্য্যাদার অনুসরণ করিয়া চলে। যে যে বংশে জন্মগ্রহণ করে, সেই বংশের পুরুষানুক্রমিক কর্ম্ম ও অধিকারই সমাজ-জীবনে তার নিজেরও কর্ম্ম ও অধিকার হয়। যখন পিতা বা পিতৃব্য বা তাঁহাদের অভাবে জ্যেষ্ঠ ভ্রাতাই প্রত্যেক শিশুর একমাত্র দীক্ষাগুরু ও শিক্ষাগুরু ছিলেন, পরিবারের বাহিরে যখন বাল্যশিক্ষার কোনো বিশেষ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয় নাই, তখন কোনো ব্যক্তির পক্ষে পৈত্রিক ব্যবসায় পরিত্যাগ করিয়া, ব্যবসায়ান্তর গ্রহণে জীবিকা উপার্জ্জন করা একান্ত অসাধ্য না হইলেও, নিতান্তই দুঃসাধ্য ছিল, সন্দেহ নাই। সে অবস্থায় ব্যক্তিবিশেষের কুলধর্ম্মই সমাজ-দেহে তাহার বিশেষ স্থান ও কর্ম্ম নির্দ্ধারণ করিত। আর সে সময়ে জনগণের কর্ম্ম ও অধিকারভেদ জন্মগত হইলেও প্রকৃত পক্ষে গুণ-কর্ম্ম-বিভাগের উপরেই প্রতিষ্ঠিতও ছিল। সমাজবিজ্ঞানের এই ঐতিহাসিক তত্ত্বকে লক্ষ্য করিয়াই ভগবান্ শ্রীকৃষ্ণ বলিয়াছেন:—
চাতুর্ব্বর্ণ্যম্ ময়া সৃষ্টম্ গুণকর্ম্মবিভাগশঃ।
এই সাধারণ সমাজতত্ত্বের উপরেই হিন্দুর বর্ণ-বিভাগ প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু হিন্দু এই স্বাভাবিক কর্ম্মবিভাগের সঙ্গে আশ্রম চতুষ্টয়কে যুক্ত করিয়া এই বর্ণভেদের ভিতর দিয়াই যে অভেদ শিক্ষারও ব্যবস্থা করিয়াছিলেন, জগতের আর কোনো জাতি সমাজ-জীবনের শৈশবে ও কৈশোরে সেরূপ ব্যবস্থা করিতে পারেন নাই। সুতরাং এই আশ্রমধর্ম্মই প্রাচীন হিন্দু সাধনার সমাজতত্ত্বের বিশেষত্ব। কিন্তু কালক্রমে এই বর্ণাশ্রম ধর্ম্মও যখন সামাজিক উন্নতি ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতার সহায় না হইয়া তাহার অন্তরায়ই হইয়া উঠিতে লাগিল, যখন ব্রাহ্মণ ব্রহ্ম-স্বভাবসুলভ সত্ত্বগুণ, ক্ষত্রিয় ক্ষত্রপ্রকৃতিসুলভ রজোগুণ হারাইয়াও কেবল জন্মের দোহাই দিয়াই ব্রাহ্মণত্বের বা ক্ষত্রিয়ত্বের অধিকার ও মর্য্যাদা দাবী করিতে লাগিলেন, তখন সমাজের ও ব্যক্তির উভয়ের কল্যাণার্থে প্রাচীন কুলধর্ম্মকে অতিক্রম করাই আবশ্যক হইয়া উঠিল। এই জন্যই গীতায় ভগবান্ প্রথমে বর্ণাশ্রমের সম্পূর্ণ সমর্থন করিয়াও শেষে, গূহ্যাদপি গূহ্যতম যে ধর্ম্মতত্ত্ব তাহার অভিব্যক্তি করিয়া বলিলেন:—
সর্ব্বধর্ম্মান পরিত্যজ্য মামেকং শরণং ব্রজ।
অহং ত্বাং সর্ব্বপাপেভ্যো মোক্ষয়িষ্যামি মা শুচ॥
অতএব বর্ণাশ্রমপ্রধান হিন্দুর সমাজতত্ত্বেও সর্ব্বকর্ম্মন্যাসপূর্ব্বক,মহাজনপন্থা অবলম্বন করিয়া, এই বর্ণাশ্রমের অধিকার অতিক্রম করিবারও প্রশস্ত পথ প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে। আর ইহাই প্রকৃত পক্ষে-হিন্দুর সমাজতত্ত্বের ও সমাজনীতির শেষ শিক্ষা ও শ্রেষ্ঠতম সিদ্ধান্ত। রাজা এই সিদ্ধান্তের উপরেই আপনার সামাজিক সিদ্ধান্তের প্রতিষ্ঠা করিয়া ইহার সঙ্গে আধুনিক য়ুরোপীয় সাধনার শ্রেষ্ঠতম ও উচ্চতম সামাজিক সিদ্ধান্তের সঙ্গতি সাধন করিয়াছিলেন। কর্ম্মসাধনই সামাজিক জীবনের উপজীব্য। কর্ম্মের ভিতর দিয়া ব্রহ্মকে লাভ করাই, সমাজ-জীবনের লক্ষ্য। এই লক্ষ্য লাভের জন্য প্রথমে ঐকান্তিক সমাজানুগত্য, তৎপরে সমাজের এই আনুগত্য স্বীকার করিয়াও ভগবানে সমাজবিধি-নির্দ্দিষ্ট সর্ব্ব প্রকারের কর্ম্মার্পণ, তার পরে মহাজনপদ আশ্রয় করিয়া এই সমাজানুগত্য বর্জ্জন ও নিষ্কাম কর্ম্মযোগ সাধন,—এই ত্রিপাদেতে হিন্দুর কর্ম্মসিদ্ধান্ত পূর্ণতা প্রাপ্ত হইয়াছে। কিন্তু মধ্য-যুগের হিন্দুয়ানী নিষ্কাম কর্ম্ম বলিতে ঐহিক ও পারলৌকিক সর্ব্ববিধ ফলভোগ বাসনা পরিত্যাগ করিয়া, লোক সংগ্রহার্থে বর্ণাশ্রম-বিহিত কর্ম্মানুষ্ঠানই বুঝিয়া আসিয়াছে। এখনও অনেকে নিষ্কাম কর্ম্ম বলিতে ইহাই বুঝেন। রামমোহন মধ্যযুগের হিন্দুয়ানীর আশ্রম-বিরহিত সুতরাং ধর্ম্মহীন বর্ণভেদের উপরে প্রতিষ্ঠিত কর্ম্মজীবনের সংস্কার সাধনার্থে, প্রাচীন ঋষিপন্থা অবলম্বন করিয়াই, লোক-শ্রেয়কে একমাত্র প্রকৃত নিষ্কাম কর্ম্ম বলিয়া ব্যাখ্যা করেন। এইরূপে তিনি প্রাচীন হিন্দু কর্ম্মতত্ত্বকে একদিকে সত্যোপেত ও বস্তুতন্ত্র এবং অন্যদিকে সত্যভাবে স্বদেশী ও সার্ব্বজনীন করিয়া তুলিবার চেষ্টা করেন। কি তত্ত্ববিচারে ও ধর্ম্মসাধনে কিম্বা সামাজিক সিদ্ধান্ত প্রতিষ্ঠায় ও সমাজ সংস্কারে, রামমোহন কোনো বিষয়েই আপনাকে স্বদেশের শাস্ত্র ও সাধনা, সংস্কার ও সিদ্ধান্ত হইতে একান্ত ভাবে বিচ্ছিন্ন করেন নাই।
কিন্তু এই উন্নত, উদার, একই সঙ্গে স্বদেশী ও সার্ব্বজনীন যুগ-আদর্শ সাধনের যোগ্যতা এবং অধিকার তখনো দেশের লোকের জন্মায় নাই। রাজা আদর্শটাই দেখাইয়া দেন, কিন্তু সেই আদর্শ যেরূপ ক্ষেত্রে সাধন করিয়া আয়ত্ত করা সম্ভব, তখনও সে অনুকূল ক্ষেত্রের প্রতিষ্ঠা হয় নাই। আর একদিক দিয়া কেশবচন্দ্র এবং অন্যদিকে সুরেন্দ্রনাথ এই অনুকূল ক্ষেত্র গঠনের বিশেষ সাহায্য করিয়াছেন।
কেশবচন্দ্র
রাজা যে উন্নত ও উদার ভূমিতে যাইয়া দাঁড়াইয়া এই অভিনব যুগ-আদর্শ প্রত্যক্ষ ও প্রতিষ্ঠা করিরাছিলেন, সমাজের সাধারণ চিন্তা ও ভাবকে সেই ভূমিতে লইয়া যাইতে হইলে, সর্ব্বাদৌ তাহার সর্ব্ববিধ পূর্ব্ব-সংস্কার নষ্ট করা আবশ্যক ছিল। প্রত্যেক গঠন কার্য্যের পূর্ব্বেই কতকটা ভাঙ্গা আবশ্যক হয়। রাজাও যে কিছু ভাঙ্গেন নাই এমন নহে। কিন্তু তিনি ভাঙ্গার সঙ্গে সঙ্গেই আবার গড়িয়া তুলিবারও চেষ্টা করিয়াছিলেন। প্রত্যেক যুগ-সন্ধি কালে নূতনকে গড়িয়া তুলিবার জন্য প্রচলিত ও পুরাতনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম ঘোষণা করা প্রয়োজন হয়। কিন্তু যুগ প্রবর্ত্তক মহাপুরুষেরা কেবল এই সংগ্রাম ঘোষণা করিয়াই ক্ষান্ত হ’ন না। কোথায়, কিরূপে এই সংগ্রামের শান্তি হইবে, কোন্ সূত্র ধরিয়া পুরাতনের ও নূতনের মধ্যে সামঞ্জস্য ও সঙ্গতি সাধন করিতে হইবে, তাঁহাদের সম্যক্ দৃষ্টি ইহাও প্রত্যক্ষ করিয়া থাকে। সুতরাং তাঁহারা পুরাতনের অপূর্ণতাকে পরিপূর্ণ করিয়াই, নূতনকেও আপনার সফলতার দিকে প্রেরণ করেন এবং নূতনের অভিষেক দিয়াই পুরাতনকেও সার্থক করিয়া তুলেন। কিন্তু যাঁহারা এই সকল মহাপুরুষের অনুবর্ত্তী হইয়া সমাজ-ক্ষেত্রকে তাঁহাদের প্রকাশিত যুগ-আদর্শের প্রতিষ্ঠার উপযোগী করিয়া গড়িয়া তুলিতে ব্রতী হ’ন, কোথাও তাঁহাদের এই মহাজন-প্রতিভাসুলভ সম্যক্ দর্শন থাকে না। থাকিলে, তাঁহারা যে বিশেষ কার্যে ব্রতী হ’ন, সেই কার্য্যের সফলতারই ব্যাঘাত জন্মাইয়া দেয়। ফলতঃ প্রাকৃতজনের মধ্যে সম্যক দর্শন সচরাচর সংস্কার কার্য্যের গতি-বেগকে একান্তভাবে কমাইয়া দিয়া তাহাদিগের কর্ম্মোদ্যমকে বহুল পরিমাণে নষ্ট করিয়া ফেলে। এই জন্যই সংস্কারকের পক্ষে কর্ম্মোৎসাহের যতটা প্রয়োজন সম্যক্-দৃষ্টির ততটা প্রয়োজন নাই। একদেশদর্শিতা বেগবতী সংস্কারচেষ্টার জন্য একান্তই আবশ্যক। অতএব রাজ্য যে সমুন্নত যুগ-আদর্শ প্রকাশিত করেন, সেই আদর্শের যথাযোগ্য প্রতিষ্ঠার উপযোগী করিয়া সমাজক্ষেত্রকে গড়িয়া তুলিবার জন্য কেশবচন্দ্রের প্রথম বয়সের অপেক্ষাকৃত একদেশদর্শিনী সংস্কার-চেষ্টারই একান্ত প্রয়োজন ছিল। পরবর্ত্তীকালে, রাজার শিক্ষার অনুসরণ করিয়া, ক্রমে ক্রমে আমাদের স্বদেশী-সমাজে প্রাচীন ভারতের ও আধুনিক য়ুরোপের শ্রেষ্ঠতম আদর্শের মধ্যে যে উদার ও উন্নত সামঞ্জস্য প্রতিষ্ঠিত হইবেই হইবে, তাহারই প্রয়োজনে, কেশবচন্দ্রের দৈবীপ্রতিভা, তাঁর প্রথম বয়সে, স্বল্পবিস্তর একদেশদর্শী ধর্ম্ম ও সমাজ-সংস্কার কার্য্যে ব্রতী হইয়াছিল। কি ব্যক্তি, কি সমাজ, সকলেরই সত্যলাভের জন্য প্রথমে সর্ব্ববিধ পূর্ব্বসংস্কার-বর্জিত হওয়া প্রয়োজন। শাস্ত্রের প্রামাণ্য, সদ্গুরুর মর্য্যাদা, সমাজবিধানের ধর্ম্মপ্রাণতা, এ সকলকে স্বল্পবিস্তর অস্বীকার না করিলে, মানসক্ষেত্র কদাপি সম্পূর্ণ সংস্কার-বর্জ্জিত ও নির্ম্মল হইতে পারে না। এই সর্ব্বগ্রাসী সন্দেহ ও অসত্যবোধ হইতেই ক্রমে খাঁটি ও সরল বিশ্বাস এবং সত্য আস্তিকবুদ্ধির সঞ্চার হয়। “নেতি” “নেতি” বলিয়াই “ইতিতে” পৌঁছিতে হয়। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে “নেতি” “নেতি” বলিয়া একেবারে পরমতত্ত্ব বা ব্রহ্মতত্ত্বশূন্য করিয়াই, পরে ব্রহ্মের সঙ্গে ব্রহ্মাণ্ডের একত্ব প্রতিষ্ঠা করিয়া, সর্ব্বং খল্বেদং ব্রহ্ম,—এই মহাসত্যে উপনীত হইতে হয়। কেশবচন্দ্রের সমাজ ও ধর্ম্মসংস্কারচেষ্টা রাজার আদর্শের অনুসরণ করিতে যাইয়া, প্রথমে এই “নেতি”র পথ ধরিয়াই চলিয়াছিল। এ পথ সংগ্রামের পথ, সন্ধির পথ নহে। এ পথ শক্তির পথ, সংযমের পথ নহে। ইহা আত্মপ্রতিষ্ঠার পথ, আত্মবিলোপের পথ নহে। এ পথ ইংরেজিতে যাহাকে Independence বা অনধীনতা বলে তারই পথ; সত্য-স্বাধীনতার পথ নহে। এ পথে যাইয়া একপ্রকারের ফ্রিডমে (Freedom) পৌঁছান যায়, কিন্তু উপনিষদ যাহাকে স্বারাজ্য বলিয়াছেন, সে বস্তু লাভ হয় না। এ পথ Rightsএর পথ, স্বত্বের পথ; Reconciliationএর পথ বা সামঞ্জস্য ও শান্তির পথ নহে। কেশবচন্দ্র প্রথম বয়সে, ধর্ম্ম ও সমাজসংস্কার-ব্রতে ব্রতী হইয়া, এই স্বত্বের পথ ধরিয়াই চলিয়াছিলেন। শাস্ত্রের প্রাচীন অধিকারের বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত বিচার-বিবেচনার স্বত্ব-প্রতিষ্ঠা; গুরুর প্রাচীন অধিকারের বিরুদ্ধে অসংস্কৃত ও অসিদ্ধ স্বাভিমতের স্বত্ব-প্রতিষ্ঠা; সমাজের বিধি-নিষেধাদির বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত রুচি ও প্রবৃত্তির স্বত্ব-প্রতিষ্ঠা; ইহাই কেশবচন্দ্রের প্রথম জীবনের কর্ম্মচেষ্টার মূল সূত্র ছিল। ধর্ম্মের ও নীতির আবরণের দ্বারা সুসজ্জিত হইলেও কেশবচন্দ্রের প্রথম জীবনের সমাজ ও ধর্ম্ম-সংস্কারপ্রয়াস সর্ব্ব বিষয়ে এই ব্যক্তিগত Rights বা স্বত্বকেই জাগাইয়া তুলিতে চেষ্টা করিরাছিল। আর কেশবচন্দ্র ধর্ম্মসাধনে ও সমাজশাসনে যে ব্যক্তিগত অনধীনতার আদর্শকে জাগাইয়া তুলিয়া দেশের নব্যশিক্ষিত সম্প্রদায়ের মধ্যে একটা নূতন শক্তির সঞ্চার করেন, সুরেন্দ্রনাথ সেই আদর্শকেই রাষ্ট্রীয় জীবনে প্রতিষ্ঠিত করিতে যাইয়া আপনার অনন্যপ্রতিযোগী ঐতিহাসিক কীর্ত্তি অর্জ্জন করিয়াছেন।
আধুনিকযুগে কেশবচন্দ্রের পূর্ব্বেই আমাদের দেশে এই ধর্ম্ম ও সমাজসংস্কারের সূত্রপাত হইয়াছিল। একদিকে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ধর্ম্মসংস্কারে, অন্যদিকে ডেভিড্ হেয়ার এবং ডি, রোজেরিওর শিষ্যগণ সমাজ-সংস্কারে অষ্টাদশ-খৃষ্ট-শতাব্দীর ব্যক্তিত্বাভিমানী অনধীনতার বা Independence এর আদর্শকে ফুটাইয়া তুলিতে চেষ্টা করেন। কেশবচন্দ্রের বিশেষত্ব এই যে তিনি একদিকে আপনার কর্ম্মজীবনে এই দুই সংস্কার-স্রোতকে একীভূত করিয়া, জীবনের সকল বিভাগে এই অনধীনতার আদর্শকে গড়িয়া তুলিতে চেষ্টা করেন এবং অন্য দিকে এতাবৎকাল পর্য্যন্ত কার্য্যতঃ যে ধর্ম্ম ও সমাজ-সংস্কার-চেষ্টা ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তির নিজ নিজ জীবনের বিচ্ছিন্ন কর্ম্মোদ্যমের ভিতর দিয়াই প্রকাশিত হইতেছিল, কেশবচন্দ্র সেই সকল বিচ্ছিন্ন শক্তিকেন্দ্রকে একত্রিত করিয়া, দলবদ্ধ হইয়া, এই সংস্কারকার্যে প্রবৃত্ত হ’ন। মহর্ষি প্রাচীন শাস্ত্র ও গুরুর প্রভুত্বই কেবল অস্বীকার করেন, কিন্তু প্রত্যেক ধর্ম্মার্থীকে আপনার স্বাভিমত কিম্বা সংজ্ঞানের (Conscience) উপরে একান্তভাবে প্রতিষ্ঠিত করিবার জন্য কোনও চেষ্টা করেন নাই। কলিকাতা ব্রাহ্মসমাজ শাস্ত্রগুরু বর্জ্জন করিয়া, উপাসকগণের ধর্ম্মজীবন ও কর্ম্মজীবন পরিচালনায় শাস্ত্র-গুরুর প্রাচীন অধিকার মহর্ষির উপরেই অর্পণ করেন। প্রত্যেক সাধনার্থীকে আপন আপন স্বাভিমত ও সংজ্ঞানের উপরে প্রতিষ্ঠিত করিয়াই কেশবচন্দ্র প্রথম জীবনে ব্রাহ্মসমাজে এক প্রকারের সাধারণতন্ত্র গড়িয়া তুলিতে প্রবৃত্ত হ’ন। ধর্ম্ম সাধনে ব্যক্তিবিশেষের অসঙ্গত প্রভুত্বের প্রতিবাদ করিয়াই কেশবচন্দ্রের ভারতবর্ষীয় ব্রাহ্মসমাজের প্রতিষ্ঠা হয়। আর ধর্ম্ম ও সমাজ-সংস্কারে কেশবচন্দ্র যে কাজ করেন, আমাদের আধুনিক রাষ্ট্রীয় জীবনে সুরেন্দ্রনাথও ঠিক সেই কাজটীই করিয়াছেন।
সুরেন্দ্রনাথের পূর্ব্বে আধুনিক রাষ্ট্রীয় জীবন
সুরেন্দ্রনাথের কর্ম্মজীবনের সূচনার বহুদিন পূর্ব্ব হইতেই এ দেশের ইংরেজিশিক্ষিত সম্প্রদায়ের মধ্যে অল্পে অল্পে যে রাষ্ট্রীয় আদর্শ ও আকাঙ্ক্ষা জাগিয়া উঠিতেছিল, তাহাকে মূর্তিমন্ত করিয়াই সুরেন্দ্রনাথ আমাদের রাষ্ট্রীয় কর্ম্মক্ষেত্রে আসিয়া দণ্ডায়মান হ’ন। ব্রিটিশ শাসনের প্রথমাবধিই বাংলার এবং বিশেষতঃ কলিকাতার সমাজের সম্ভ্রান্ত লোকেরা বে-সরকারী ইংরেজ প্রবাসীদিগের সঙ্গে মিলিত হইয়া, সময়ে সময়ে, বিশেষ বিশেষ রাষ্ট্রীয় বিধি-ব্যবস্থা সম্বন্ধে আপনাপন মতামত ব্যক্ত করিয়া তাহার পরিবর্ত্তন বা-সংশোধনের চেষ্টা করিতেন। সময় সময় রাজপুরুষগণ নিজেরাই উপযাচক হইয়া বিশেষ বিশেষ শাসনব্যবস্থা সম্বন্ধে ইঁহাদিগের অভিপ্রায় জানিতে চাহিতেন। বোধ হয় সুরেন্দ্রনাথের জন্মের পূর্ব্বেই কলিকাতার ব্রিটিশ ইণ্ডিয়ান্ এসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠা হয়। প্রসন্নকুমার ঠাকুর, জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়, রমানাথ ঠাকুর, দিগম্বর মিত্র, কালীপ্রসন্ন সিংহ, রাজেন্দ্রলাল মিত্র, কৃষ্ণদাস পাল, সে’কালের বাংলার মনীষীবর্গ সকলেই, ব্রিটিশ ইণ্ডিয়ান্-এসোসিয়েশনভুক্ত ছিলেন। সেকালে ইঁহারাই আপনাদের বিচার-বুদ্ধির অনুযায়ী রাষ্ট্রীয় বিধি-ব্যবস্থাদির আলোচনা করিতেন এবং সময়ে সময়ে দেশের অভাবঅভিযোগের কথা রাজপুরুষদিগের গোচরে প্রেরণ করিতেন। রাজপুরুষেরাও ইহাঁদিগকেই জনমণ্ডলীর স্বাভাবিক অধিনায়ক বা Natural Leaders বলিয়া গ্রহণ করিয়া ইঁহাদিগের মতামতের প্রতি যথাযোগ্য মর্য্যাদা প্রদর্শন করিতেন। ব্রিটিশইণ্ডিয়ান্ সভা সর্ব্বদা জমীদারদেরই সভা ছিল। বাংলার, বিশেষতঃ কলিকাতা ও তন্নিকটবর্ত্তী স্থানের জমীদারগণের স্বত্বস্বার্থরক্ষার জন্যই এই সভার জন্ম হয়। ইহার সভ্য এবং অধিনায়ক সকলেই জমীদারশ্রেণীভুক্ত ছিলেন। কৃষ্ণদাস পাল জমীদার ছিলেন না বটে, কিন্তু জমীদারী স্বত্বস্বার্থের পরিপোষক এবং জমীদার-সমাজের মুখপাত্ররূপেই তিনি দেশের তদানীন্তন রাষ্ট্রীয় জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। ব্রিটিশ-ইণ্ডিয়ান সভা জমীদারদিগের সভা হইলেও প্রয়োজনমত আপনাদের বিচার-বুদ্ধি অনুযায়ী দেশের সাধারণ প্রজাবর্গের রাষ্ট্রীয় স্বত্বস্বার্থসংরক্ষণে একেবারে উদাসীন ছিলেন না। কিন্তু তাঁহাদের বিচার অলোচনায় জনসাধারণের ত কথাই নাই, শিক্ষিত ভদ্র সম্প্রদায়ের পক্ষেও সাক্ষাৎভাবে যোগদান করিবার অধিকার ও অবসর ছিল না। ব্রিটিশইণ্ডিয়ান্ সভার নেতৃবর্গ জমীদারী স্বত্ব-স্বার্থের সঙ্গে মিলাইয়া যতটা সম্ভব দেশের সাধারণ লোকের স্বত্ব-স্বার্থ রক্ষা করিবার চেষ্টা করিতেন। কিন্তু জনসাধারণের সঙ্গে এক যোগে কোনো রাষ্ট্রীয় কর্ম্ম সাধনের প্রবৃত্তি ও প্রয়াস তাঁহাদের ছিল না। সুতরাং দেশের রাষ্ট্রশক্তিকে জাগাইয়া, সংহত লোকমতের দুর্জ্জয় শক্তি প্রয়োগে, রাজপুরুষদিগের স্বেচ্ছাচারকে নিয়ন্ত্রিত করিবার জন্য এ পর্য্যন্ত কোনো চেষ্টাই হয় নাই। অথচ দেশের শিক্ষিত ও শিক্ষার্থী সম্প্রদায়ের প্রাণে একটা বলবতী আত্মপ্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা জাগিয়া উঠিতেছিল।
আধুনিক স্বদেশাভিমান ও স্বাদেশিকতা
ফলতঃ যে ইংরেজি শিক্ষার প্রভাবে আমাদিগের শিক্ষিত সম্প্রদায়ের ভিতরে একটা অসংযত ও অসঙ্গত ব্যক্তিত্বাভিমান জাগিয়া প্রাচীন সমাজের শাসন ও পুরাগত ধর্ম্মের বিশ্বাসকে ভাঙ্গিয়া তাহাদিগকে ধর্ম্মদ্রোহী ও সমাজদ্রোহী করিয়া তুলে, তাহাতেই আবার তাঁহাদিগের প্রাণে এক নূতন স্বদেশাভিমানেরও সঞ্চার হয়। আমাদের সে’কালের ধর্ম্ম ও সমাজ-সংস্কার-চেষ্টা বহুলপরিমাণে য়ুরোপীয় আদর্শের অনুসরণ করিয়াই চলিয়াছিল সত্য। কিন্তু ইহা সত্ত্বেও যে এই সকল সংস্কারচেষ্টার অন্তরালে একটা প্রবল স্বদেশাভিমানও জাগিয়া উঠিতেছিল ইহাও অস্বীকার করা যায় না। য়ুরোপীয় সমাজের তুলনায় আমাদের নিজেদের সমাজ-জীবন অতিশয় হীন, এবং য়ুরোপের যুক্তিবাদের তৌলদণ্ডে আমাদিগের ধর্ম্মবিশ্বাস ও ধর্ম্মসাধনা অত্যন্ত ভ্রান্ত ও কুসংস্কারপূর্ণ বলিয়াই বোধ হইত। আর এই হীনতাবোধ সর্ব্বদাই আমাদিগের স্বদেশাভিমানে অত্যন্ত আঘাত করিত। এই বেদনার উত্তেজনাতেই, আমরা তখন এতটা দিক্বিদিক্ জ্ঞানশূন্য হইয়া আমাদের ধর্ম্মের ও সমাজের সংস্কারসাধনে নিযুক্ত হইয়াছিলাম। আমাদের এই সংস্কার-চেষ্টা যদি সর্ব্বতোভাবে খৃষ্টীয়ানী পন্থা অনুসরণ করিয়া চলিতে পারিত তাহা হইলে সেই চেষ্টার ফলে আমাদিগের মধ্যে কোনো প্রকারের সত্য স্বাদেশিকতা ফুটিয়া উঠিতে পারিত না। কিন্তু যে ব্যক্তিত্বাভিমান বা Individualism এবং যুক্তিবাদ বা Rationalism, আমাদিগকে নিজেদের সমাজের ও ধর্ম্মের অনুশাসনকে অগ্রাহ্য করিতে প্রণোদিত করে, তাহারই প্রভাবে আমাদিগের পক্ষে খৃষ্ট-ধর্ম্মে বিশ্বাস স্থাপন এবং য়ুরোপীয় সমাজবিধানের বশ্যতাগ্রহণও একান্তই অসাধ্য করিয়া তুলে। স্বদেশের বেদপুরাণাদিকে মনুষ্য-প্রতিভা-রচিত এবং সাধারণ মানব-বুদ্ধি-সহজ ভ্রম-কল্পনা-প্রসূত বলিয়া, প্রামাণ্য-মর্য্যাদা নষ্ট করিয়া, খৃষ্টীয়ানের বাইবেলকে ঈশ্বরপ্রণীত ও অভ্রান্ত বলিয়া গ্রহণ করিবার আর কোনো পথ রহিল না। শ্রীকৃষ্ণের অবতারত্ব উড়াইয়া দিয়া, যীশু খৃষ্টের অবতারত্বে বিশ্বাস করা অসাধ্য হইল। অথচ এইরূপ অবস্থাতেও যখন খৃষ্টীয়ান ধর্ম্ম-প্রচারকেরা হিন্দু-ধর্ম্মের উপরে নিজেদের ধর্ম্মের আত্যন্তিক শ্রেষ্ঠত্বের দাবী সপ্রমাণ করিতে যাইয়া প্রতিবাদী ধর্ম্মের মত ও বিশ্বাসের সিদ্ধান্ত ও সাধনার হীনতা প্রমাণ করিতে অগ্রসর হইলেন, তখন তাঁহাদের এই অযথা নিন্দাবাদের ফলেই,—যে স্বদেশের ধর্ম্মকে এককালে আমরা হীন বলিয়া বর্জ্জন করিয়াছিলাম, তাহারই সম্বন্ধে ক্রমে আমাদিগের প্রাণে একটা প্রবল শ্রেষ্ঠত্বাভিমান জাগিয়া উঠিল। মানুষ এ জগতে নিজের প্রাণের মধ্যে যে ভাব লইয়া অপর মানুষের নিকটে যায়, তাহার প্রাণেও অলক্ষিতে সেই ভাবেরই সঞ্চার করে। প্রেম এই জন্য প্রেমকে ফোটায়। ঘৃণা ঘৃণাকেই বাড়াইয়া দেয়। একের অহঙ্কার-অভিমান, অপরের অহঙ্কারঅভিমানে আঘাত করিয়াই তাহাকে জাগাইয়া তুলে। মানব-প্রকৃতির এই নিয়মবশে খৃষ্টীয়ান ধর্ম্ম-প্রচারকদিগের অসঙ্গত ধর্ম্মাভিমান আমাদিগের অন্তরে স্বদেশের ধর্ম্মসম্বন্ধেও একটা প্রবল শ্রেষ্ঠত্বাভিমান জাগাইয়া দিল। যাঁহারা একদা স্বদেশের প্রচলিত ধর্ম্মের সংস্কারকার্য্যে ব্রতী হইয়া স্বদেশবাসিগণের নিকটে নিয়তই সেই ধর্ম্মের ভ্রমপ্রমাদের ব্যাখ্যা করিতেছিলেন, এখন তাঁহারাই আবার জগতের অপরাপর ধর্ম্মের সঙ্গে তুলনা করিয়া আপনাদের প্রাচীন ধর্ম্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপাদনে যত্নবান্ হইলেন। এইরূপে রাজা রামমোহন রায়, মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, মহাত্মা রাজনারায়ণ বসু, ইঁহারা সকলেই একদিকে যেমন প্রচলিত ক্রিয়াবহুল হিন্দুধর্ম্মের সংস্কারের চেষ্টা করেন সেইরূপ অন্যদিকে, বিদেশীয় প্রতিবাদিগণের সমক্ষে এই ধর্ম্মেরই সনাতন-তত্ত্ব ও চিরন্তন আদর্শের অনন্যসাধারণ শ্রেষ্ঠত্বও প্রতিপন্ন করেন। আপনাদিগের পুরাতন ধর্ম্মের যে শ্রেষ্ঠত্বাভিমান এইভাবে আমাদিগের মধ্যে ক্রমে জাগিয়া উঠে তাহারই উপরে সর্ব্বপ্রথমে আমাদের আধুনিক স্বাদেশিকতার বা Nationalismএর মূল ভিত্তি স্থাপিত হয়।
বহুবিধ মানসিক, সামাজিক, এবং রাষ্ট্রীয় শক্তির সাহায্যে নবোদিত স্বাদেশিকতা উত্তরোত্তর বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। যে ইংরেজি শিক্ষার অনুপ্রাণনে এই নূতন স্বাদেশিকতার উৎপত্তি হয়, সেই শিক্ষারই বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে, একদিকে দেশের নবশিক্ষিত সম্প্রদায়ের এবং অন্যদিকে ইংরেজ রাজপুরুষ ও ব্যবসায়িগণের মধ্যে নানাবিষয়ে একটা প্রবল প্রতিযোগিতা জন্মিতে আরম্ভ করে। এই প্রতিযোগিতা নিবন্ধন একদিকে এক অভিনব স্বদেশপ্রীতি এবং অন্যদিকে একটা বিজাতীয় পরজাতিবিদ্বেষও জাগিয়া উঠে। তদানীন্তন বাংলা সাহিত্যের ভিতর দিয়া এই নুতন স্বজাতি-বাৎসল্য ও পরজাতি-বিদ্বেষ দুই-ই মুখরিত হইয়া উঠে। এই সময়েই বঙ্কিমচন্দ্র “বঙ্গদর্শনের” প্রতিষ্ঠা করেন। নব্যশিক্ষিত বাঙ্গালী সমাজে বঙ্গদর্শন স্বদেশের প্রাচীন গৌরবস্তুতি জাগাইয়া, এই নবজাত স্বদেশ-প্রীতিকে বাড়াইয়া তুলিতে আরম্ভ করে। হেমচন্দ্র, নবীনচন্দ্র, গোবিন্দচন্দ্র, রঙ্গলাল, সত্যেন্দ্রনাথ, জ্যোতিরিন্দ্র, মনোমোহন, প্রভৃতির কবিপ্রতিভা, নানা দিকে ও নানা ভাবে এই স্বদেশাভিমানকে ফুটাইয়া তুলে। হেমচন্দ্রের “ভারতসঙ্গীত”; সত্যেন্দ্রনাথের “গাও ভারতের জয়, হোক্ ভারতের জয়, ভয় কি ভয় গাও ভারতের জয়”; গোবিন্দচন্দ্রের “কতকাল পরে, বল ভারতরে” এবং প্রাচীন স্মৃতিবাহিনী “যমুনা লহরী”; মনোমোহনের “দিনের দিন সবে দীন”;—এই সময়েই এই সকল জাতীয় সঙ্গীত প্রচারিত হয়। দীনবন্ধুর “নীলদর্পণ” ইহার পূর্ব্বেই রচিত হইয়াছিল। উপেন্দ্রনাথের “শরৎসরোজিনী” ও “সুরেন্দ্র-বিনোদিনী” নীলদর্পণের মর্ম্মঘাতিনী উদ্দীপনাতে নূতন ইন্ধন সংযোগ করিয়া দেয়। নবপ্রতিষ্ঠিত বঙ্গ-রঙ্গমঞ্চ পুনঃ পুনঃ এই সকল নাটকের অভিনয় করিয়া ইহাদিগের শিক্ষা ও উদ্দীপনাকে জনসাধারণের মধ্যে ছড়াইয়া দেয়। এই সময়েই নবীনচন্দ্রের “পলাশীর যুদ্ধ” প্রকাশিত হইয়া দেশের নবজাত স্বদেশ-প্রীতিকে আধুনিক রাষ্ট্রীয় ইতিহাসের সঙ্গে যুক্ত করিয়া দেয়। “ভারত মাতা” প্রভৃতি নূতন গীতি-নাট্য এই অভিনব স্বদেশ-প্রীতিকে এক নূতন দেবভক্তির আকারে ফুটাইয়া তুলিতে চেষ্টা করে। এই স্বজাতি-প্রেম ও স্বদেশ-ভক্তির সুরধুনী-স্রোত যখন শিক্ষিত বঙ্গসমাজের প্রাণকে স্পর্শ করিয়া তাহাদের মধ্যে এক নূতন চেতনার সঞ্চার করিতে আরম্ভ করে, তখন এই স্বাদেশিকতার তরঙ্গ-মুখে, এই নূতন দেশচর্য্যার পুরোহিতরূপে, সুরেন্দ্রনাথ স্বদেশের রাষ্ট্রীয় কর্ম্মক্ষেত্রে আসিয়া দণ্ডায়মান হ’ন। আর দৈবকৃপায় দেশ-কাল-পাত্রের এরূপ শুভ-যোগাযোগ ঘটিয়াছিল বলিয়াই, তাঁহার কর্ম্মজীবন এমন অন্যসাধারণ সফলতা লাভ করিয়াছে।
সুরেন্দ্রনাথের স্বাদেশিকতার শিক্ষা
কোনো দেশে যখনি কোনো নূতন ভাব ও আদর্শ ফুটিতে আরম্ভ করে, তখন সর্ব্বাদৌ তাহা উদারমতি, বিষয় বুদ্ধিবিহীন, উদ্যমশীল যুবকমণ্ডলীর চিত্তকেই আকর্ষণ করিয়া থাকে। আমাদিগের দেশের এই নবজাত স্বদেশ-প্রেমও সর্ব্ব প্রথমে শিক্ষার্থী যুবকগণের চিত্তকে অধিকার করে এবং তাহাদের যৌবনস্বভাবসুলভ কল্পনা ও ভাবুকতাকে আশ্রয় করিয়াই বাড়িয়া উঠে। আর এই জন্য এই অভিনব স্বাদেশিকতা প্রথমেই কোনো প্রকারের বস্তুতন্ত্রতাও লাভ করিতে পারে নাই। বঙ্কিমচন্দ্র ও তাঁহার সহযোগী সাহিত্যিকগণ বঙ্গদর্শনের সাহায্যে দেশের শিক্ষিত সমাজের মধ্যে স্বজাতির প্রাচীন গৌরবস্তুতি জাগাইয়া কিয়ৎপরিমাণে তাঁহাদের নুতন স্বাদেশিকতাকে একটা ঐতিহাসিক ভিত্তির উপরে গড়িয়া তুলিবার চেষ্টা করেন, সত্য। কিন্তু বঙ্গদর্শন প্রাচীন ভারতের শিল্প ও সাহিত্যের এবং সাধারণ সভ্যতার ও সাধনার লুপ্তগৌরবের উদ্ধারে যে পরিমাণে মনোনিবেশ করিয়াছিল, তাহার পূর্ব্বতন রাষ্ট্রীয় জীবনের আলোচনায় সে পরিমাণে মনোনিবেশ করে নাই। বিশেষতঃ দেশের আধুনিক রাষ্ট্রীয় আশা ও আকাঙ্ক্ষার বিচার-আলোচনা কখনই প্রকাশ্যভাবে বঙ্গদর্শনে স্থান প্রাপ্ত হয় নাই। “কমলাকান্তের দপ্তরে” লেখকের অসাধারণ শ্লেষালঙ্কারে আচ্ছাদিত হইয়া, আধুনিক ভারতের অনেক রাষ্ট্রীয় চিন্তা ও আদর্শেরই গভীর আলোচনা রহিয়াছে, সত্য; কিন্তু অতি অল্প লোকেই সে সময়ে “কমলাকান্তের” সুমধুর বিদ্রুপাত্মক সুরসিকতার নিগূঢ় মর্ম্ম-উদ্ঘাটনে সমর্থ হইয়াছিলেন। নব্যশিক্ষাভিমানী লোকেও কেবল তাঁহার অপূর্ব্ব সাহিত্যরসটুকুই আস্বাদন করিতেন, লেখকের অদ্ভুত কৌতুককুশলতা এবং অসাধারণ শব্দসম্পদ দেখিয়াই মুগ্ধ হইতেন, কিন্তু এ সকল ছলাকলার অন্তরালে যে গভীর সমাজতত্ত্ব ও রাষ্ট্রতত্ত্ব লুকাইয়াছিল, তাহার সন্ধানলাভ করেন নাই। এই সকল কারণে, বঙ্গদর্শন নানাদিক্ দিয়া আমাদিগের নবজাত স্বাদেশিকতাকে পরিপুষ্ট করিয়াও, বিশেষভাবে ইহাকে বস্তু তন্ত্র করিয়া তুলিতে পারে নাই। সুরেন্দ্রনাথই প্রথমে এই স্বাদেশিকতার মধ্যে এক অভিনব এবং উন্মাদিনী ঐতিহাসিকী উদ্দীপনার সঞ্চার করেন।
চল্লিশ বৎসর পূর্ব্বে আমাদিগের মধ্যে স্বদেশের ইতিহাসের জ্ঞান ছিল না বলিলেও, অত্যুক্তি হয় না। ইংরেজি বিদ্যালয়ে কিয়ৎ পরিমাণে ভারতবর্ষের ইতিহাস পড়া হইত বটে, কিন্তু সে সকল ইতিহাস ইংরেজেরই রচিত ছিল। সেকালে য়ুরোপেও ইতিহাস বলিতে লোকে কেবল কতকগুলি রাজার নাম এবং তাঁহাদের যুদ্ধবিগ্রহাদির বিবরণই বুঝিত। ইতিহাস যে সমাজ-বিজ্ঞানের অঙ্গ, ঐতিহাসিক ঘটনার অন্তরালে যে মানব-প্রকৃতির আশা ও আকাঙ্ক্ষা এবং তাহার আত্মচরিতার্থতা-লাভের প্রয়াস ও প্রতিষ্ঠা বিদ্যমান থাকে, এক যুগের ইতিহাস যে পরবর্ত্তী যুগের জনমণ্ডলীর কর্ম্মজীবনের উদ্দীপনার ও শিক্ষার মূল সূত্রগুলি আপনার পশ্চাতে তাহাদিগের জন্য রাখিয়া যায়, এ সকল কথা সে কালের য়ুরোপীয় ঐতিহাসিকেরাও ভাল করিয়া ধরেন নাই। ঐতিহাসিক আলোচনার এই পদ্ধতি তখনো ভাল করিয়া প্রতিষ্ঠিত হয় নাই। সুতরাং আমরা চল্লিশ বৎসর পূর্ব্বে স্কুলকলেজে যে সকল ইতিহাস পাঠ করিতাম, তাহার ভিতরে কোনো উন্নত আদর্শ কিম্বা কর্ম্মের উদ্দীপনা আছে, ইহা অনুভব করিতে পারি নাই। আর এই কারণেই যদিও ভারতবর্ষের ও ইংলণ্ডের—আর বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করিয়া প্রাচীন গ্রীস্, রোম ও মধ্যযুগের য়ুরোপখণ্ডের—ইতিহাসও পাঠ করিতাম, কিন্তু এ সকল আমাদিগের প্রাণে কোনো প্রকারের সজীব স্বদেশ-প্রেমের কিম্বা উদার মানব-প্রেমের সঞ্চার করিতে পারিত না। সুরেন্দ্রনাথ স্বদেশের রাষ্ট্রীয় কর্ম্মক্ষেত্রে প্রবেশ করিয়াই সর্ব্বপ্রথমে আমাদের নব্যশিক্ষিত সম্প্রদায়ের সমক্ষে প্রত্যেক জাতির ইতিহাসই যে সেই জাতির স্বদেশভক্তির আলম্বন ও প্রতিষ্ঠা এই সত্য প্রচার করিলেন।
সুরেন্দ্রনাথ দ্বিতীয় বার বিলাত হইতে ফিরিয়া আসিয়াই ৺আনন্দমোহন বসু মহাশয়ের একযোগে সর্ব্বপ্রথমে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী যুবকবৃন্দকে লইয়া এক ছাত্র-সভার প্রতিষ্ঠা করেন। এই ছাত্রসভাই তাঁহার স্বাদেশিক কর্ম্মের প্রথম ও প্রধান কেন্দ্র হইয়া উঠে। যে অলোকসামান্য বাগ্মিতা-শক্তির প্রভাব ক্রমে সমগ্র ভারতের নব্যশিক্ষিত সম্প্রদায়ের চিত্তকে অধিকার করিয়া তাঁহার অন্যপ্রতিযোগী ঐতিহাসিক প্রতিপত্তির প্রতিষ্ঠা করিয়াছে, কলিকাতার এই ছাত্রসভাতেই তাহা সর্ব্বপ্রথমে স্ফূরিত হয়। এই ছাত্রসভায় সুরেন্দ্রনাথ “শিখ-শক্তির অভ্যুদয়”—The Rise of the Shikh Power,—সম্বন্ধে যে অগ্নিময়ী বক্তৃতা প্রদান করেন, তাহার স্মৃতি, সেই বক্তৃতা যাঁহারা শুনিয়াছিলেন—তাঁহাদিগের চিত্ত হইতে কখনই লুপ্ত হইবে না। শিখধর্ম্মের উৎপত্তি, শিখ খালসার প্রতিষ্ঠা, প্রথমে মোগল এবং পরে ব্রিটিশ প্রভুশক্তির সঙ্গে, শিখ খালসার যুদ্ধ-বিগ্রহের কথা, সেকালের স্কুলপাঠ্য ভারত ইতিহাসের মধ্যেও ছিল। সুরেন্দ্রনাথ এই বক্তৃতায় যে সকল ঘটনার উল্লেখ করেন, তাহা যে একেবারে অজ্ঞাত ছিল এমন নহে। কিন্তু সেই সকল পূর্ব্বপরিচিত ঘটনার অন্তরালে স্বরাষ্ট্র-প্রীতির যে শক্তিশালিনী উদ্দীপনা বিদ্যমান ছিল, সুরেন্দ্রনাথের তড়িতসঞ্চারিণী বাগ্মী প্রতিভাই সর্বপ্রথমে আমাদের নিকট তাহা ফুটাইয়া তুলে। সেই হইতেই এদেশের নব্যশিক্ষিত সম্প্রদায়ের মানসচক্ষে আধুনিক ভারতবর্ষের ইতিহাসের এক অভিনব মর্ম্ম ও উন্মাদিনী উদ্দীপনা প্রকাশিত হইতে আরম্ভ করে। ছত্রপতি মহারাজা শিবাজি আধুনিক ভারতক্ষেত্রে যে এক বিশাল হিন্দুরাষ্ট্র-প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন, তাহার মর্য্যাদাজ্ঞান তখনো আমাদের জন্মায় নাই। সুতরাং সে সময়ে মহারাষ্ট্র ইতিহাসের উদ্দীপনা আমাদিগের নবজাগ্রত স্বাদেশিকতাকে স্পর্শ করে নাই। আমাদের এই নূতন স্বাদেশিকতা তখন একটা কল্পিত বিশ্বজনীনতার ভাব অবলম্বন করিয়া ফুটিয়া উঠিয়াছিল। একটা স্বদেশাভিমান মাত্র আমাদের চিত্তকে তখন অধিকার করিয়াছিল। হিন্দু বলিয়া কোনো গৌরবাভিমান তখনো আমাদের মধ্যে জন্মায় নাই। হিন্দুধর্ম্মের প্রচলিত প্রাণহীন কর্ম্মকাণ্ডে আমাদের পুরুষানুগত বিশ্বাস একেবারে ভাসিয়া গিয়াছিল। জাতিভেদ-প্রপীড়িত হিন্দুসমাজের প্রতিও গভীর অশ্রদ্ধা জন্মিয়াছিল। এই সকল কারণে ছত্রপতি মহারাজা শিবাজি ভারতে যে মহা হিন্দুরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন, তাহার প্রকৃত মর্ম্ম ও উন্নত মর্য্যাদা উপলব্ধি করিবার অধিকার আমাদের ছিল না। অন্য পক্ষে বাবা নানক প্রবর্ত্তিত ধর্ম্মে একদিকে যেমন কোনো প্রকারের কর্ম্মবাহুল্য ছিল না, অন্য দিকে সেইরূপ গুরুগোবিন্দ-প্রতিষ্ঠিত সমাজতন্ত্রে জাতিবর্ণগত কোনো বৈষম্যও ছিল না। শিখ খালসা বহুল পরিমাণে ইংলণ্ডের পিউরিট্যান (Puritan) সাধারণ-তন্ত্রের বা Commonwealthএর অনুরূপ ছিল। আর এই জন্যই আমাদের ইংরেজিশিক্ষা য়ুরোপীয় সাধনায় অভিভূতচিত্তকে শিখ ইতিহাসের উদ্দীপনাতে এমন প্রবলভাবে অধিকার করিতে পারিয়াছিল। টডের রাজস্থান ইহার অনেক পূর্ব্বেই রচিত হইয়াছিল বটে এবং রঙ্গলালের পদ্মিনীর উপাখ্যানের ভিতর দিয়া রাজপুত-সমাজের অলৌকিক স্বদেশচর্য্যার উদ্দীপনা বাংলা সাহিত্যেও প্রবেশ করিয়াছিল, সত্য; কিন্তু পদ্মিনীর উপাখ্যান যে একান্তই “পৌরাণিকী” কাহিনীর উপরে প্রতিষ্ঠিত নহে, এই জ্ঞান তখনো খুব পরিপুষ্ট হয় নাই। সুরেন্দ্রনাথের মুখে শিখ ইতিহাসের ব্যাখ্যা শুনিয়া আমাদের নব্যশিক্ষিত সম্প্রদায়ের চক্ষু রাজপুতনার কীর্ত্তিকাহিনীর উপরেও গিয়া পড়িল। এইরূপে সুরেন্দ্রনাথই সর্ব্ব প্রথমে আমাদের নিকটে ভারতের আধুনিক ইতিহাসে এক নূতন প্রাণতার প্রতিষ্ঠা করেন।
যেমন ভারতের ইতিহাস পড়িয়াও আমরা এতাবৎ কাল পর্য্যন্ত তাহা হইতে প্রকৃত পক্ষে কোনো প্রকারের সত্য স্বাদেশিকতার উদ্দীপনা সংগ্রহ করিতে পারি নাই, সেইরূপ য়ুরোপীয় ইতিহাস পড়িয়াও তাহার ভিতরে যে রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতার প্রেরণা আছে, তাহাও ভাল করিয়া ধরিতে পারি নাই। সুরেন্দ্রনাথের বাগ্মী প্রতিভাই আমাদের সমক্ষে আধুনিক য়ুরোপীয় ইতিহাসের রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতার আদর্শকেও উজ্জ্বল করিয়া ধরে। ম্যাট্সিনির দৈবী প্রতিভা, গ্যারীবল্ডীর স্বদেশ-উদ্ধার-কল্পে অদ্ভুত কর্ম্মচেষ্টা, যুন-ইতালী (Young Italy) সম্প্রদায়ের এবং নব্য আয়র্লণ্ডের (New Ireland) আত্মোৎসর্গপূর্ণ দেশচর্য্যা, এ সকলের কথা সুরেন্দ্রনাথই সর্ব্ব প্রথমে এদেশে প্রচার করেন এবং তাঁহার এই সকল ঐতিহাসিক শিক্ষাকে আশ্রয় করিয়া পূর্ব্বে আমাদের যে স্বদেশাভিমান বহুল পরিমাণে কবি-কল্পনা ও পৌরাণিকী কাহিনী অবলম্বন করিয়াই ফুটিয়া উঠিতেছিল, তাহাই এখন স্বদেশের এবং বিদেশের ইতিহাসের দৃষ্টান্ত ও শিক্ষার দ্বারা অনুপ্রাণিত হইয়া, কিয়ৎ পরিমাণে সত্যোপেত ও বস্তুতন্ত্র হইয়া উঠিল।
সুরেন্দ্রনাথের রাষ্ট্রীয় কর্ম্ম-জীবনের ব্যাপকতা
এইরূপে সুরেন্দ্রনাথ যে স্বদেশ-প্রীতিকে আশ্রয় করিয়া আপনার রাষ্ট্রীয় কর্ম্ম-জীবনের প্রতিষ্ঠা করেন, প্রথমাবধি সমগ্র ভারতবর্ষই তাহার উপজীব্য ছিল। বাঙালীর প্রকৃতির এবং বাংলার ইতিহাসের বিশেষত্ব হইতেই আমাদিগের স্বদেশপ্রীতির এই অপূর্ব্ব উদারতার উৎপত্তি হইয়াছে। এই আধুনিক স্বাদেশিকতা এ পর্য্যন্ত বাংলা, মহারাষ্ট্র ও পাঞ্জাব, এই তিন প্রদেশেই বিশেষভাবে ফুটিয়া উঠিয়াছে। কিন্তু বাংলার স্বাদেশিকতার আদর্শ যতটা উদার ও উন্নত, মহারাষ্ট্রের কিম্বা পাঞ্জাবের স্বাদেশিকতার আদর্শ ততটা উদার ও উন্নত নহে। ইংরেজ এদেশে না আসিলে ভারতরাষ্ট্রে মারাঠা ও শিখ, ইঁহারাই সম্ভবতঃ মোগলের উত্তরাধিকারী হইয়া দেশের শাসন-শক্তিকে অধিকার করিয়া বসিতেন। ব্রিটিশপ্রভুশক্তির প্রতিষ্ঠায় তাঁহাদের সে আশা নির্ম্মূল হইলেও তাহার স্মৃতি শিখ বা মারাঠার চিত্ত হইতে একেবারে লুপ্ত হয় নাই। আর এই কারণে পাঞ্জাবের কিম্বা মহারাষ্ট্রের স্বাদেশিকতার মধ্যে একটা প্রাদেশিক পক্ষপাতিত্ব লুকাইয়া আছে। বাংলায় সেরূপ কোনো ঐতিহাসিক স্মৃতি নাই বলিয়াই, বাঙালীর স্বাদেশিকতার কোনো প্রাদেশিক আশ্রয়ও নাই। অন্যদিকে বাঙালীর প্রকৃতিও শিখ বা মারাঠার প্রকৃতির মত নহে। শিখ খাল্সা ভারতমাতার বাহুতেই বল সঞ্চার করিয়াছে, কিন্তু বিশেষ ভাবে তাঁহার বাণীশক্তি অধিকার করিতে পারে নাই। অন্যদিকে মারাঠা ও বাঙালী ইহাদের বুদ্ধি-বল ভারতের অপরাপর জাতির বুদ্ধিবল হইতে শ্রেষ্ঠ হইলেও বাঙালীর বুদ্ধিতে ও মারাঠার বুদ্ধিতে প্রভেদও বিস্তর। মারাঠার বুদ্ধি কার্য্যকরী, ইংরাজিতে ইহাকে practical বলে। বাঙালীর বুদ্ধি ভাবময়ী, ইংরাজিতে ইহাকে idealistic বলা যায়। কার্য্যকরী বুদ্ধি ফলসন্ধিৎসু; কর্ম্মাকর্ম্মের আসন্ন ফল লক্ষ্য করিয়া চলে। ভাবময়ী বুদ্ধি সত্যসন্ধিৎসু; কর্ম্মাকর্ম্মের প্রত্যক্ষ ফলাফলকে অগ্রাহ্য করিয়া ভাবরাজ্যে ও তত্ত্বাঙ্গে তাঁহার কি পরিণাম ঘটিবে, তাহাই কেবল দেখে। কার্য্যকরী বুদ্ধি আদর্শকে উপেক্ষা করিয়া বাস্তবকে ধরিতে চাহে; ভাবমন্ত্রী বুদ্ধি বাস্তবকে উপেক্ষা করিয়া আদর্শেতেই আত্মসমর্পণ করে। দেশচর্য্যায় কার্য্যকরী বুদ্ধির প্রেরণা প্রাদেশিকতাকে বাড়াইয়া তোলে এবং স্বদেশ-ভক্তিকে সঙ্কীর্ণ ও সাম্প্রদায়িক করিয়া ফেলে। ভাবময়ী বুদ্ধি দেশচর্য্যা ও দেশভক্তিকে সর্ব্ব প্রকারের প্রাদেশিকতা ও সাম্প্রদায়িকতা হইতে যথাসম্ভব মুক্ত করিয়া উদার ও সার্ব্বজনীন করিতে চাহে। রাষ্ট্রীয় জীবনে কার্য্যকরী বুদ্ধি আসন্নফলসন্ধিৎসু politician এর বা রাজনীতিকের সৃষ্টি করে। আর ভাবময়ী বুদ্ধি দূরদর্শী ও সমাদর্শী নীতিজ্ঞ বা Statesmanএরই সৃষ্টি করিয়া থাকে। মহারাষ্ট্রের ও বাংলার কর্ম্ম-জীবনের তুলনায় এই দুই জাতীয় মানববুদ্ধির ভেদাভেদের বিলক্ষণ পরিচয় পাওয়া যায়।
আর বাঙালীর প্রকৃতির গুণে এবং আধুনিক বাংলার ইতিহাসের কোনো বিশেষ রাষ্ট্রীয় গৌরবস্মৃতির অভাবে, আমাদিগের বর্ত্তমান স্বাদেশিকতা যেমন সমগ্র ভারতবর্ষকে আশ্রয় করিয়া ফুটিয়া উঠিয়াছে, সেইরূপ বাঙালী কর্ম্মনায়ক সুরেন্দ্রনাথের রাষ্ট্রীয় কর্ম্মজীবনও সমগ্র ভারতরাষ্ট্রকে লক্ষ্য করিয়াই গড়িতে আরম্ভ করে। সুরেন্দ্রনাথের পূর্ব্বে ভারতের ভিন্ন ভিন্ন প্রদেশের রাষ্ট্রীয় কর্ম্মচেষ্টা প্রাদেশিক শাসনের ভালমন্দ লইয়াই বিব্রত এবং প্রাদেশিক জীবনের সঙ্কীর্ণ সীমার মধ্যেই আবদ্ধ ছিল। কবি-কল্পনাতে এবং সংবাদপত্রেই কেবল ভারতের রাষ্ট্রীয় একত্ব-বোধের কতকটা প্রমাণ পাওয়া যাইত, নতুবা এক প্রদেশের সুখ-দুঃখ অন্য প্রদেশের চিত্তকে বিক্ষুব্ধ করিত কি না সন্দেহ। কলিকাতার ব্রিটিশ-ইণ্ডিয়ান-সভা, পুনার সার্ব্বজনিক্ সভা ও মাদ্রাজের মহাজন-সভা, এ সকলই প্রাদেশিক প্রতিষ্ঠান ছিল। সুরেন্দ্রনাথের প্রেরণায় ও উদ্যোগে যে ভারতসভার বা Indian Associationএর জন্ম হয়, তাহাই সর্ব্ব প্রথমে এই প্রাদেশিকতাকে অতিক্রম করিয়া, সমগ্র ভারতের রাষ্ট্রীয় কর্ম্ম ও চিন্তাকে এক সূত্রে গাঁথিয়া তুলিতে চেষ্টা করে। সমগ্র ভারতবর্ষকে এক বিশাল কর্ম্মজালে আবদ্ধ করিবার আকাঙ্ক্ষা লইয়াই ভারতসভার জন্ম হয় এবং অল্প দিন মধ্যেই উত্তর ভারতের বড় বড় সহরে শাখা সভা সকল গঠিত হইতে আরম্ভ করে। এইরূপে প্রয়াগে, কাণপুরে, মীরাটে ও লাহোরে শাখা-ভারতসভার প্রতিষ্ঠা হয়। আজ কংগ্রেস সমগ্র ভারতবর্ষের রাষ্ট্রীয় শক্তিকে সংহত করিবার জন্য যে চেষ্টা করিতেছে, চৌত্রিশ বৎসর পূর্ব্বে সুরেন্দ্রনাথের প্রতিষ্ঠিত ভারত-সভাই প্রকৃত পক্ষে সর্ব্ব প্রথমে সেই চেষ্টার সূত্রপাত করে। যে স্বদেশাভিমানকে আশ্রয় করিয়া ভারত-সভা দেশের রাষ্ট্রশক্তিকে বাড়াইয়া ও গড়িয়া তুলিতেছিল, কংগ্রেসের জন্ম নিবন্ধন যদি তাহা একান্ত বহির্মুখীন হইয়া না পড়িত, তাহা হইলে আমাদের রাষ্ট্রীয় জীবনে আজ প্রজাশক্তি কতটা পরিমাণে যে সংহত ও সুপ্রতিষ্ঠিত হইতে পারিত ইহা এখন কল্পনা করাও সুকঠিন।
ফলতঃ কংগ্রেসের জন্মের পূর্ব্ব হইতেই সুরেন্দ্রনাথ প্রভৃতি ভারতসভার কর্ম্মনায়কগণ একটা বিরাট জাতীয়-সমিতি গঠন করিবার চেষ্টা করেন। এই আদর্শের অনুসরণেই নানা স্থানে শাখা ভারত-সভার প্রতিষ্ঠা হয়। আর কংগ্রেসের জন্মের সঙ্গে চতুর রাষ্ট্রনীতিক্ লাট ডফ্রিণেরও যে কতকটা সম্বন্ধ ছিল, ইহা এখন সকলেই জানেন। সুতরাং সুরেন্দ্রনাথ দেশে যে বিপুল প্রজাশক্তি জাগাইয়া তুলিতেছিলেন, তাহার প্রতি লক্ষ্য করিয়াই যে কংগ্রেসের জন্ম হয় নাই, এ কথা বলাও কঠিন। বোম্বাইয়ে গোপনে গোপনে যখন কংগ্রেসের প্রথম অধিবেশনের আয়োজন হইতেছিল, সে সময়ে সুরেন্দ্রনাথ ও আনন্দমোহন ভারতসভার তত্ত্বাবধানে কলিকাতায় একটা জাতীয় সম্মিলনের ব্যবস্থা করেন এবং কংগ্রেসের অধিবেশনের সমকালেই কলিকাতার আলবার্ট হলে জাতীয়-সমিতির বা National Conference এর অধিবেশন হয়। সুরেন্দ্রনাথ কংগ্রেসের সংবাদ রাখিতেন কি না, জানি না। কিন্তু এই কন্ফারেন্সে দেশের নানাস্থান হইতে যে সকল লোক সমবেত হইয়াছিলেন, তাঁরা যে কংগ্রেসের কথা কিছুই শুনেন নাই, ইহা জানি। ইঁহারা সকলেই এই National Conferenceকে ভারতের রাষ্ট্রীয় একতার এবং ভবিষ্যৎ প্রজাশক্তির আধার বলিয়া বরণ করিয়াছিলেন। আর কংগ্রেস যদি সহসা এই স্থানটা পূর্ণ করিতে অগ্রসর না হইত, তাহা হইলে আজ সুরেন্দ্রনাথের এই National Conference আমাদিগের রাষ্ট্রীয় জীবনের শ্রেষ্ঠতম শক্তিকেন্দ্র হইয়া উঠিত সন্দেহ নাই। কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠাতা ভারত-গবর্ণমেণ্টের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান সেক্রেটারী এল্যান্ ও হিউম। ইহার পৃষ্ঠপোষক কলিকাতার প্রবীণতম ব্যারিষ্টার উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, বোম্বাইএর প্রধানতম কৌন্সিলী ফিরোজসা মেহেতা, মাদ্রাজের প্রসিদ্ধ উকীল সুব্রহ্মণ্য আয়ার। কংগ্রেস এই রূপে প্রথম হইতেই অসাধারণ পদ-বল ও ধনবলের উপরেই প্রতিষ্ঠা লাভ করে। সুরেন্দ্রনাথের কর্ম্ম চেষ্টার অন্তরালে তখন এ দু’য়ের কিছুই ছিল না। সুতরাং কংগ্রেস যে সুরেন্দ্রনাথের প্রতিষ্ঠিত National Conferenceকে সহজেই আত্মসাৎ করিয়া ফেলিল, ইহা কিছুই আশ্চর্য্য নহে। আর ইহাতে প্রকৃত পক্ষে আমাদের রাষ্ট্রীয় জীবনের ক্ষতি হইয়াছে, না লাভ লইয়াছে বলা কঠিন নহে। কংগ্রেস যতটা রাতারাতি বাড়িয়া উঠিয়াছিল, সুরেন্দ্রনাথের কন্ফারেন্সের পক্ষে তাহা সম্ভব হইত না। অন্যদিকে সুরেন্দ্রনাথের এই কর্ম্ম-চেষ্টা যদি কংগ্রেসের দ্বারা এইরূপে ব্যাহত না হইত, তাহা হইলে দেশে আজ যে প্রভূত শক্তিশালী রাষ্ট্রীয় জীবন ও লোকমত গড়িয়া উঠিত, কংগ্রেস তাহা যে কেবল গড়িয়া তুলিতে পারে নাই তাহা নহে, কিন্তু সাক্ষাৎভাবে তাহার ব্যাঘাতই জন্মাইয়াছে। কংগ্রেস দেশের অনেক কল্যাণ সাধন করিয়াছে সত্য, কিন্তু সুরেন্দ্রনাথ ভারতের জেলায় জেলায় লোকমত সংগঠনের জন্য যে সকল রাষ্ট্রীয় সভার প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন ও করিতেছিলেন সে গুলির শক্তিহরণ করিয়া কংগ্রেস দেশের প্রকৃত রাষ্ট্রীয় জীবনকে যে দুর্ব্বল করিয়াছে ইহাও অস্বীকার করা সম্ভব নহে। কংগ্রেসের প্রধান কীর্ত্তি দুটী—এক লাট ক্রসের ১৮৯১ সালের ইণ্ডিয়া কাউন্সিলস্ অ্যাক্ট, আর অন্য লাট মর্লের আধুনিক কাউন্সিল সংস্কার। কিন্তু দেশের জেলায় জেলায় যে সকল রাষ্ট্রীয় সভা গড়িয়া উঠিতেছিল তাহাকে নষ্ট করিয়া দেশের কংগ্রেস দেশের যে ক্ষতি করিয়াছে এ সকলের কিছুতেই সেই ক্ষতি পূরণ করিতে সমর্থ হয় নাই ও হইবে না। ফলতঃ কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের আধুনিক রাষ্ট্রীয় কর্ম্মচেষ্টায় সুরেন্দ্রনাথের অনন্যপ্রতিযোগী অধিনায়কত্ব লাভের পথ একেবারে বন্ধ হইয়া যায়। তখন হইতে সুরেন্দ্রনাথ কিয়ৎ পরিমাণে কংগ্রেসের অর্থশালী নেতৃবর্গের মুখাপেক্ষী হইয়া, আপনি প্রথমে যে পথে চলিয়া দেশের প্রজাশক্তিকে জাগাইয়া তুলিতেছিলেন, সে পথ অনেকটা পরিত্যাগ করিয়া, বহুল পরিমাণে আপনার কর্ম্মজীবনের সম্পূর্ণ সফলতারও ব্যাঘাত উৎপাদন করেন।
কিন্তু ইহাতে যে দেশের কোনো সাংঘাতিক ক্ষতি হইয়াছে, এমনও বলিতে পারি না। সুরেন্দ্রনাথের প্রথম জীবনের কর্ম্মচেষ্টা সময়োপযোগী হইয়াছিল মাত্র, সম্পূর্ণরূপে তাঁহার স্বদেশের প্রাচীন সভ্যতার ও সাধনার কিম্বা তাঁহার স্বদেশী লোকপ্রকৃতির অনুযায়ী হয় নাই। সমাজসংস্কারে কেশবচন্দ্র যেমন প্রথম জীবনে বহুল পরিমাণে বিদেশীয় আদর্শের অনুসরণ করিয়া সমাজের মধ্যে একটা প্রচণ্ড বিরোধই জাগাইয়া তুলিয়াছিলেন, কিন্তু কোথায় যে সেই বিরোধের সঙ্গতি ও মীমাংসা হইবে, তাহার নিগূঢ় সন্ধান ও সঙ্কেত ধরিতে পারেন নাই; সুরেন্দ্রনাথও সেইরূপ ইংলণ্ডের দৃষ্টান্তের অনুসরণ করিয়া শাসনসংস্কার করিতে যাইয়া, শাসক ও শাসিতের মধ্যে বিরোধই জাগাইয়া তুলেন, কিন্তু কোন্ পথে যাইয়া শাসিতেরা যে প্রকৃত পক্ষে আত্মচরিতার্থতা লাভ করিতে সমর্থ হইবে, আর কোন্ সূত্র ধরিয়াই বা এ দেশের শাসক ও শাসিতের মধ্যে যে বিরোধ জাগিয়াছে, তাহার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হইতে পারে, এ পর্য্যন্ত সুরেন্দ্রনাথ সে সন্ধান এবং সঙ্কেত প্রাপ্ত হন নাই। সুরেন্দ্রনাথ ইংরেজের নিকট হইতেই রাষ্ট্রনীতির যাবতীয় শিক্ষালাভ করিয়াছেন, আর ইংলণ্ডের ইতিহাসে যে পথে স্বেচ্ছাচারী রাজশক্তিকে সংযত করিয়া ক্রমে প্রজাশক্তি স্বপ্রতিষ্ঠিত হইয়া বর্ত্তমান প্রজাতন্ত্রশাসনপ্রণালীকে গড়িয়া তুলিয়াছে, সেই পথই সুরেন্দ্রনাথের সুপরিচিত। সুরেন্দ্রনাথের অলোকসামান্য মেধা আছে, কিন্তু চিন্তার মৌলিকতা নাই। যেটা যেমন আছে বা হইয়াছে, তিনি তাহাকে সেইরূপ ভাবেই ধরিতে পারেন, কিন্তু যে মানসিক শক্তি চারি দিকের বিষয় ও বস্তুর পর্য্যবেক্ষণ দ্বারা কোনো নূতন তত্ত্বের আবিষ্কার করিতে পারে, সে শক্তি সুরেন্দ্রনাথের নাই। সুতরাং স্বদেশের রাষ্ট্রীয় জীবনের সংস্কার ও বিকাশ সাধনে ব্রতী হইয়া সুরেন্দ্রনাথ ইংরেজ-রাষ্ট্রনীতির চিরাভ্যন্ত পথ ধরিয়াই চলিতে আরম্ভ করেন। নিজেদের সভ্যতা, সাধনা ও প্রকৃতির অনুযায়ী নূতন পথের প্রতিষ্ঠা করিতে পারেন নাই। ইংরেজের ভাষা যে তাঁর স্বদেশের লোকে বুঝিতে পারে না, ইংরেজের ভাব যে তারা ধরিতে পারে না, ইংরেজের পথ যে তাদের একেবারেই অপরিচিত, ইংরেজের প্রকৃতি যে তাহাদের প্রকৃতি হইতে একান্তই ভিন্ন, এ সকল কথা সুরেন্দ্রনাথ এখনও ভাল করিয়া বুঝেন কি না সন্দেহ। আর স্বদেশের সভ্যতার ও সাধনার, স্বদেশের লোকপ্রকৃতি ও সমাজ প্রকৃতির সঙ্গে সুরেন্দ্রনাথের চিন্তার এবং আদর্শের কোন জীবন্ত যোগ স্থাপিত হয় নাই বলিয়া তাঁহার দীর্ঘজীবনব্যাপী রাষ্ট্রীয় কর্ম্মোদ্যম কেবলমাত্র একটা অসম্বদ্ধ, অনির্দ্দিষ্ট, প্রবল রাষ্ট্রীয় অভাববোধকেই জাগাইয়াছে; কিন্তু এখনোও দেশের রাষ্ট্রীয় জীবনের কোনো অঙ্গকেই গড়িয়া তুলিতে পারে নাই। এইরূপ অভাববোধ হইতে উন্মাদিনী বিপ্লবশক্তির সৃষ্টি হইতে পারে, কিন্তু কখনই দূরদর্শিনী রাষ্ট্রনীতির প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয় না।
ফলতঃ সুরেন্দ্রনাথ যে পথ ধরিয়া দেশের রাষ্ট্রীয় জীবন গড়িয়া তুলিতে চাহিয়াছিলেন, তাহার সঙ্গে এদেশের কি হিন্দু কি মুসলমান কোনো সম্প্রদায়েরই প্রাণগত যোগ প্রতিষ্ঠিত হওয়া অসম্ভব। এদেশের হিন্দু ও মুসলমান দুই জাতিরই ধর্ম্মভাব অত্যন্ত প্রবল। ধর্ম্মই তারা বোঝে, ধর্ম্মের নামেই তারা মাতে, ধর্ম্মের সঙ্গে যার যোগ নাই, এমন কোনো কিছু তাহাদের প্রাণকে স্পর্শ করিতে পারে না। ইহাই এদেশের জনগগের বিশেযত্ত্ব। অথচ সুরেন্দ্রনাথ এবং তাঁহার সমসাময়িক রাষ্ট্রীয় কর্ম্মনায়কগণ সকলেই স্বজাতির রাষ্ট্রীয় জীবনে জনশক্তিকে প্রতিষ্ঠিত করিবার জন্য সচেষ্ট হইয়াও কখনই এই সর্ব্বজনবিদিত বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য করিয়া চলেন নাই। তাঁহাদের রাষ্ট্রীয় আদর্শ এবং রাষ্ট্রনীতি আজি পর্য্যন্ত মোক্ষসম্পর্কবিহীন হইয়া পড়িয়াছে। সুতরাং তাঁহাদের সর্ব্বপ্রকারের রাষ্ট্রীর আন্দোলন ও আলোচনা দেশের মুষ্টিমেয় নব্য শিক্ষিতসম্প্রদায়ের উপরেই যাহা কিছু আধিপত্য বিস্তার করিতে পারিয়াছে, কিন্তু এ পর্য্যন্ত জনমণ্ডলীর চিত্তকে স্পর্শ করিতেও সক্ষম হয় নাই। কিন্তু যাঁহারা ক্রমে ক্রমে নূতন পথ ধরিয়া, নূতন মন্ত্র সাধন করিয়া, দেশের জনমণ্ডলীর চিত্তে এক নব শক্তির সঞ্চার করিতে আরম্ভ করিয়াছেন, তাঁহারা সকলেই সাক্ষাৎভাবে বা পরোক্ষভাবে নিজেদের স্বাদেশিক উদ্দীপনার জন্য সুরেন্দ্রনাথের প্রথম জীবনের শিক্ষা-দীক্ষার নিকট চিরঋণী রহিয়াছেন। আজ দেশে যে নুতন আদর্শ ফুটিয়া উঠিতেছে ও জনগণের চিত্তে যে নূতন শক্তির সঞ্চার হইতেছে তাহা কোনো কোনো দিকে সুরেন্দ্রনাথের আদর্শের এবং কর্ম্মচেষ্টার বিরোধী হইলেও যে সুরেন্দ্রনাথের শিক্ষা-দীক্ষার শ্রেষ্ঠতম ফল, ইহা অঙ্গীকার করা যায় না। সুরেন্দ্রনাথের অশেষ প্রকারের ত্রুটী দুর্ব্বলতা সত্ত্বেও তিনি যে কাজটী করিয়াছেন তাহা না করিলে আমাদের বর্ত্তমান জাতীয় জীবন যে ভাবে গড়িয়া উঠিতেছে, কখনই সে ভাবে গড়িয়া উঠিতে পারিত না। তিনি এই জাতীয় জীবনের গঠনে যে কাজটী করিয়াছেন, সে কাজ অপর কেহ করেন নাই, এবং করিতে পারিতেনও না। আর এই জন্যই আধুনিক ভারতের জাতীয় জীবনের ইতিহাসে সুরেন্দ্রনাথের স্মৃতি এমন অক্ষয় প্রতিষ্ঠালাভ করিয়াছে।