চিঠিপত্র (দশম খণ্ড, ১৯৬৭)/দীনেশচন্দ্র সেনকে লিখিত/৪১
৪১
[জানুয়ারি ১৯১৩]
প্রিয়বরেষু
আপনার চিঠিখানি পাইয়া খুসী হইলাম কিন্তু শরীর ভাল নাই জানিয়া ভাল লাগিল না।
সতীর তর্জ্জমার প্রুফ পাঠাইলেন লিখিয়াছেন, কিন্তু পাই নাই, বোধ হয় ভুলিয়াছেন। Paul Carus যে ধরণের বহি বাহির করেন তাহাতে মনে হয়না তিনি সতীর ইংরেজি অনুবাদ ছাপিতে প্রস্তুত হইবেন। আমার মনে হয় ইংলণ্ডে আপনার লেখা ছাপিবার চেষ্টা করা উচিত, কারণ, সেখানে আপনার ইংরেজি গ্রন্থটি প্রচুর সমাদর লাভ করিয়াছে। যে কেহ পড়িয়াছে সকলেই বিশেষভাবে প্রশংসা করিয়াছে। অথচ ছাপা কদর্য্য এবং ছাপার ভুল অপর্যাপ্ত। যাহাই হউক সেখানে যখন আপনার আসন প্রস্তুত হইয়াছে তখন এ দেশের দিকে না তাকাইয়া সেই দিকেই চেষ্টা করা কর্তব্য হইবে। আমার বোধহয় Everyman's Library Series এর মধ্যে যদি আপনার বই চালাইতে পারেন তবে খ্যাতি অর্থ দুইই জুটিতে পারে। তাহা[দের কাছে manuscript] পাঠাইয়া দিবেন। Ernest Rhys ঐ Series এর Editor। আমাদের কালী মোহনের সঙ্গে তাঁহার খুব ভাব হইয়াছে।
ম্যাকমিলানেরা আমার লেখাগুলি ছাপাইবার জন্য উদ্যোগী হইয়াছে। তাহার লেখাপড়া চলিতেছে। কথার কবিতা আমি এখানে বসিয়া নিজেই অনেকগুলা করিয়া ফেলিয়াছি। আমি দেখিলাম, নিজে না করিলে কোনমতেই সুবিধা হয় না। কারণ, বাংলার ভাষা ও ছন্দের সঙ্গীত ইংরেজিতে যখন আনা সম্ভব নয় তখন কেবল ভাবমাত্রটিকে অত্যন্ত সরল ইংরেজিতে তর্জ্জমা করিলে তবে তাহার ভিতরকার সৌন্দর্য্যটুকু ফুটিয়া উঠে। এই কাজটি আমার দ্বারা সহজেই হয়— কারণ সরল ইংরেজি ছাড়া আমার দ্বারা আর কিছু হওয়া সম্ভব নহে, তার পরে নিজের ভাবটুকু অন্তত নিজে যথাসম্ভব বুঝি। সেদিকে ভুল হওয়ার আশঙ্কা নাই। ভাষাটাকে অত্যন্ত না জানার একটু সুবিধা আছে। অল্প জমি একজোড়া গোরু জুতিয়াও খুব ভাল রকম চাষ দেওয়া যায়—তেমনি নিজের সঙ্কীর্ণ অধিকারের মধ্যে যেটুকু পারা যায় সেইটুকুর মধ্যেই নিজেকে আবদ্ধ রাখিয়া বারবার করিয়া সেটাকে মাজাঘষা সহজ। যাহা ক্ষমতায় কুলায় না তাহা ছাড়িয়া দিই, যেখানে বাধা পাই সেখানে ঘুরিয়া যাই— নিজের জিনিষ বলিয়াই সেটা করা সম্ভব। এমন করিয়াও যে চলনসই কিছু খাড়া করিতে পারিব তাহা মনেও করি নাই— যাহা হউক চলিয়া ত গেছে। এখন লজ্জা ভাঙিয়াছে সাহস বাড়িয়াছে। তাই অনুবাদ জমিয়া উঠিতেছে। আজ এইমাত্র শারদোৎসব শেষ করিলাম— বোধ হইতেছে এটাও চলিবে। যাহাই হউক ভাল করিয়া পারি আর না পারি নিজের কবিতা নিজে তর্জ্জমা করা ছাড়া উপায় নাই।
আপনার সেই Selection ছাপা কতদূর হইল জানিবার জন্য উৎসুক আছি।
অরুণকে এবং বৌমাকে আমার আশীর্ব্বাদ জানাইবেন। ইতি
শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
এইমাত্র সতী পাইলাম। যদি বাহুল্য অংশ ছাটিয়া ছুঁটিয়া মাজাঘষা করা যায় তবে এ জিনিষ চলিতে পারিবে। মুস্কিল এই এদেশের লোকের সময় এত অল্প যে এরূপ কাজে কাহারো রীতিমত সাহায্য পাওয়া একেবারেই অসম্ভব। যদি কোনো প্রকাশক ইহা গ্রহণ করে তবে তাহারা সম্ভবত কাহাকেও দিয়া ইহার ব্যবস্থা করিতে পারে। আজ রোটেনস্টাইনকে লিখিয়া দিলাম যদি তিনি Wisdom of the East অথবা Everyman's Library ওয়ালাদের দ্বারা আপনার এ বই মঞ্জুর করাইয়া লইতে পারেন। আগামী বসন্তে ইংলণ্ডে গিয়া আমি চেষ্টা দেখিব। আমেরিকার লোকেরা আমাদের দেশের মত— ইহারা ইংরেজ সমালোচকদের মুখ তাকাইয়া থাকে, ভালমন্দ নিজেরা বিচার করিতে সাহস করেন। অতএব সেখান হইতে আদর না পাইলে এখানে প্রকাশক পাওয়া কঠিন।