চিঠিপত্র (দশম খণ্ড, ১৯৬৭)/দীনেশচন্দ্র সেন —লিখিত পত্রাবলী/৩
শ্রীযুক্ত তারাকুমার রায়ের বাসা
৯ই মাঘ, ১৩০৬।
শ্রদ্ধাভাজনেষু
আপনার নব কাব্যখানি কল্য পাইয়া সাগ্রহে আদ্যন্ত পড়িয়াছি; এই সুন্দর উপহার প্রাপ্তির সঙ্গে আমার বর্ত্তমান শোচনীয় অবস্থা স্মরণ করিয়া কণিকার “উদারচরিতানাম্” কবিতার “সূর্য্য উঠি বলে তারে, ভাল আছ ভাই” প্রভৃতি ছত্র মনে পড়িল।
“কথা” কাব্যের মধ্যে যে নৈতিক মাধুর্য্য আছে, তাহাতে কবির কাব্যকলার শ্রেষ্ঠ পরিণতি প্রদর্শিত হইয়াছে। কোশল রাজের শত্রু শিবিরে মহান আত্মসমর্পণ, একটি পূজার প্রদীপের ন্যায় শ্রীমতী দাসীর বৌদ্ধস্তূপ মূলে জীবন নির্ব্বাণ, বিগত সৌন্দর্য্য অনাথিনীর গৃহে উপগুপ্তের অপরূপ প্রতিশ্রুতি পালন, প্রজা দুঃখকাতর রাজার অভিনব প্রণালীর দণ্ড দ্বারা মহিষীকে দুঃখীর দুঃখ বুঝাইবার চেষ্টা, ভক্ত কবীরের পাপী রমণী ও তাহার চক্রান্তজনিত লোক-নিগ্রহকে প্রকৃত মাহাত্ম্য দ্বারা পরাজয় করা প্রভৃতি ভাবের সমস্ত গল্পই নৈতিক জগতের সুন্দর ও অদ্ভুত কথা। নির্ঘুম স্বার্থান্ধ সংসারে এই সন্দর্ভগুলি আরব্য উপন্যাসের গল্পের ন্যায় আশ্চর্য্য, অথচ উহা বাস্তব জগতেরই কথা, কল্পনা নহে; গল্পগুলির অনুষ্ঠান জীবন্ত মাহাত্ম্য মনুষ্যত্বের প্রকৃত সম্মান রক্ষা করিতেছে। অনেকগুলি গল্পই কাঁদিতে কাঁদিতে পড়িতে হইয়াছে, এই অশ্রুতে ক্ষণেকের তরে যেন মনের সমস্ত গ্লানি মুছিয়া গিয়াছে ও কামনাহীন সততার সৌন্দর্য্যে আত্মহারা হইয়া পড়িয়াছি। আমার দুঃখ-ক্লিষ্ট জীবনে এরূপ সুখপ্রাপ্তি বড় বিরল। বৌদ্ধ ও বৈষ্ণব উপাখ্যানগুলি প্রাচীন ভাষায় নানারূপ অলৌকিক ঘটনা ও আবর্জ্জনায় জড়িত ও তাহা সাধারণ পাঠকের অনধিগম্য, আপনি সেগুলি নূতন কবিত্ব মন্ত্রপূতঃ করিয়া সরল বাঙ্গলা পদ্যে করুণ রসের উৎস সৃষ্টি করিয়াছেন। এই পুস্তকখানি আমাদের বিদ্যালয় সমূহে প্রচলিত হইতে দেখিলে মুখী হইব, কিন্তু ইহার উন্নত ও নির্ম্মল নৈতিকতত্ত্ব বালকগণের অভিভাবকগণের পাঠের পক্ষেই বিশেষ উপযোগী। আপনার অনুপমেয় শব্দলালিত্য, শিল্পীর ন্যায় গল্পের চারুগ্রন্থন, ও উৎকৃষ্ট কবিত্ব এই কাব্যের সর্ব্বত্র সুলভ, তাহা সমালোচকগণ বিশ্লেষণ করিয়া দেখাইবেন; কিন্তু সাহিত্যিক সৌন্দর্য্যের ঊর্দ্ধে এক মহানৈতিক ব্রত উদযাপন চেষ্টায়ই বোধ হয় কবির জীবনেরও প্রকৃত সফলতা; সেই নীতি সূত্রগুলি সরস কবিত্ব কৌশলে “কণিকা”য় প্রদর্শিত হইয়াছে এবং তাহাদের অনুষ্ঠান ও দৃষ্টান্ত এই নূতন কাব্যখানিতে সঙ্কলিত হইল। এই পুস্তকের নাম কবি বিনয়সহকারে “কথা” রাখিয়াছেন, পাঠকগণ ইহা “কথামৃত” বলিয়া বুঝিতেছেন। বসন্তের প্রাক্কালে এই নির্ম্মল অধ্যাত্মরাজ্যের নূতন রাগিণী বাঙ্গলা কাব্যের সচরাচর লব্ধ সুরের এক গ্রাম ছাড়াইয়া উঠিয়াছে, এই কাব্যখানি দ্বারা বাঙ্গালা সাহিত্যের স্থান এক শ্রেণী উর্দ্ধে উন্নীত হইল, সন্দেহ নাই।
আপনার সদয় ও বহুমূল্য উপহারের জন্য আমার সসম্মান কৃতজ্ঞতা গ্রহণ করুন।
শ্রীদীনেশচন্দ্র সেন