চিত্ত-মুকুর/কুলীন কামিনী
কুলীন কামিনী।
(স্থান-নদীতীর; সময়-সন্ধ্যা।)
১
কি দুখে তটিনি। তুমি হেন শুষ্ক বেশে
করুণ সঙ্গীত তুলি, শৈলময় দেশে?
ললিত লহরী হায়,
বিষাদে মিশায়ে যায়,
সরস যৌবন মরি বিশুষ্ক এমন
কোন্ দুখে বল নদি এতেক বেদন!
২
হায় জানিতাম আমি অনন্ত সংসারে
এক অভাগিনী সুধু পাষাণে বিহরে,
শুষ্ক শুধু এই প্রাণ,
গায় বিষাদের গাণ,
লুকায়ে মরম জ্বালা কাঁদি নিরজনে।
একা অনাথিনী আমি অখিল ভুবনে!
৩
তুমিও যে তটিনী রে আমারই মতন,
পাষাণে চাপিয়া বক্ষ কর সন্তরণ,
নির্দ্দয়ের পদতলে,
লুটাই নয়ন জলে,
নিষ্ঠর গিরির পদে তুমি অভাগিণী।
লুটাইছ তরঙ্গিনি দিবস যামিনী।
৪
এস সখি তুমি মম দুখের সঙ্গিনী,
এক দুখে দুই জনে সম অভাগিনী,
বসিয়া তোমার কূলে,
প্রাণের কবাট খুলে,
কাঁদিব তোমার সঙ্গে ভরিয়ে অন্তর,
যতক্ষণ থাকি এই অবনী-উপর।
৫
সখিরে বরষা এলে কিছুদিন তরে,
আদরে তুলিয়া তোরে গিরি বক্ষে ধরে,
কিন্তু সখি অনাথারে,
মুহূর্ত্তেক স্নেহ করে,
নাহি হেন প্রাণী এক এ জগতীতলে,
কে মুছাবে বল এই নয়নের জলে!
৬
সামান্যা রমণী আমি অনন্ত সংসারে,
কোন্ দুখে কাঁদি সদা কে সন্ধান করে,
মাংসভেদী তীব্র দুখে,
কি বেদনা বাজে বুকে,
কে বুঝিবে বল নদি আছে কোন জন,
বলিলে বুঝিতে পারে পরের বেদন।
৭
সমাজের মুখে ছাই শ্রবণ-বিহীন,
বিধির নয়ন নাই—হৃদয় কঠিন।
বল তবে কার পাশে
যাইব স্নেহের আশে,
হৃদয়-বিহীন নরে নাহিক বিশ্বাস,
মৃগতৃষ্ণিকায় কার সলিল প্রয়াস?
৮
প্রান্তরে প্রান্তরে কিম্বা শশ্মানে শশ্মানে,
শুদ্ধ নদী তটে শুষ্ক লতার বিতানে,
ফেলি নয়নের জল,
হই কিছু সুশীতল,
নির্দ্দয় মানব জাতী বুঝে কি কখন,
কি সুধার নির্ঝরিণি রমণীর মন?
৯
আবদ্ধ প্রেমের সিন্ধু হৃদয় ভিতরে,
উথলে নিরাশাকাশে মেঘখণ্ড হেরে,
মুছিয়া নয়ন জল
করি তায় সুশীতল,
বিষাদে তোমারি মত মিশায় লহরী,
ভেসে যায় মেঘ থাকি দৃষ্টিরোধ করি।
১০
কত দিন কত বার হৃদয়ের তার
সহসা বাজিয়া উঠে, কিন্তু স্পর্শ কার
জানি না, নিবারি তারে
ভাসে বক্ষ নেত্রাসারে,
জ্বলে উঠে হৃদয়ের নির্ব্বাণ অনল,
ক্ষত মনে ক্ষত প্রাণে পুড়ি অবিরল।
১১
এই পরিণাম হায়—সেই চির আশা!
অন্তরেই শুকাইল—সেই ভালবাসা!
কেন তবে জন্মিলাম
নাহি যদি লভিলাম
সুধাময় প্রণয়ের বিন্দু আস্বাদন!
উদ্বাহ বন্ধনে বাঁধি কেন বিড়ম্বন!
১২
নির্দ্দয় প্রাণেশ কোথা এস এক বার,
দেখে যাও প্রণয়ের অন্ত্যেষ্ঠি আমার,
বালে—পরিণয়-কালে
যে সিন্দূর দিলে ভালে,
আজি নদী-জলে সেই সিন্দূর ভাসিল,
(গণ্ডুষে তুলিয়া জলে কপাল ধুইল)।
১৩
খুলি লৌহ “কড়’’ খুলি বাহুর ভূষণ,
সধবার যত চিহ্ন করি উন্মোচন,
ড
নিক্ষেপিয়া নদী-জলে,
কহিলেক অশ্রু-জলে,
“কোথা আছ প্রাণেশ্বর দেখ একবার,
সধবার বৈধব্য হইল আবিষ্কার।”
১৪
ডুবিল নদীর জলে সুবর্ণ ভূষণ,
সিন্দুরের আভা ক্রমে হৈল অদর্শন,
তটিনী তরঙ্গ তুলে,
আঘাতি উভয় কূলে,
চলিল গাহিয়া উচ্চে “দেখ একবার
সধবার বৈধব্য হইল আবিষ্কার।”
১৫
তরুদলে পত্র কোলে নিথর পবন,
হেরিল নদীর বক্ষে ডুবিল ভূষণ,
কুসুম সৌরভ ভুলি,
গভীর সঙ্গীত তুলি,
ছুটিল নদীর সঙ্গে গাহি অনিবার,
‘‘সধবার বৈধব্য হইল আবিষ্কার।”
১৬
নির্ম্মল গগনে মেঘ সহসা ছাইল,
তটিনী ভূধর তরু আঁধারে ঢাকিল,
অনলের মত ফুটে,
বিদ্যুত চলিল ছুটে,
গম্ভীরে গম্ভীরে করি ভীষণ ঝঙ্কার,
“সধবার বৈধব্য হইল আবিষ্কার।”
১৭
ঢাকি মেঘ গরজন রমনী কহিল,
“জনমের মত দাসী বিদায় হইল,
কে আছ রমণী-কুলে
বাঁধা কৌলিন্য শৃঙ্খলে,
এস এক সঙ্গে করি শৈকতে শয়ন,”
রমণী নদীর বক্ষে হইল পতন।