চিত্রা/আবেদন
ভৃত্য। জয় হোক্ মহারাণী! রাজরাজেশ্বরী,
দীন ভূত্যে কর দয়া!
রাণী। সভা ভঙ্গ করি’
সকলেই গেল চলি’ যথাযোগ্য কাজে
আমার সেবকবৃন্দ বিশ্বরাজ্য মাঝে,
মোর আজ্ঞা মোর মান লয়ে শীর্ষদেশে
জয়শঙ্খ সগর্ব্বে বাজায়ে। সভাশেষে
তুমি এলে নিশান্তের শশাঙ্ক সমান
ভক্ত ভৃত্য মোর? কি প্রার্থনা?
ভৃত্য। মোর স্থান
সর্ব্বশেষে, আমি তব সর্ব্বাধম দাস
মহোত্তমে! একে একে পরিতৃপ্ত আশ
সবাই আনন্দে যবে ঘরে ফিরে যায়
সেইক্ষণে আমি আসি নির্জ্জন সভায়;
একাকী আসীনা তব চরণতলের
প্রান্তে বসে’ ভিক্ষা মাগি শুধু সকলের
সর্ব্ব অবশেষটুকু!
রাণী। অবোধ ভিক্ষুক,
অসময়ে কি তোরে মিলিবে?
ভৃত্য। হাসি মুখ
দেখে চলে’ যাব। আছে দেবী, আরো আছে;—
নানা কর্ম নানা পদ নিল তোর কাছে
নানা জনে,—এক কর্ম্ম কেহ চাহে নাই-
ভৃত্য পরে দয়া করে’ দেহ মোরে তাই,—
আমি তব মালঞ্চের হব মালাকর!
রাণী। মালাকর?
ভৃত্য। ক্ষুদ্র মালাকর। অবসর
লব সব কাজে। যুদ্ধ-অস্ত্র ধনুঃশর
ফেলিনু ভূতলে; এ উষ্ণীষ রাজসাজ
রাখিনু চরণে তব,—যত উচ্চ কাজ
সব ফিরে লও দেবী! তব দূত করি
মোরে আর পাঠায়োনা, তব স্বর্ণতরী
দেশে দেশান্তরে লয়ে; জয়ধ্বজা তব
দিদিগন্তে করিয়া প্রচার, নব নব
দিগ্বিজয়ে পাঠায়োনা মোরে! পর পারে
তব রাজ্য কর্ম যশ ধন জন ভারে
অসীমবিস্তৃত,—কত নগর নগরী,
কত লোকালয়, বন্দরেতে কত তরী,
বিপণীতে কত পণ্য;—ওই দেখ দূরে
মন্দির শিখরে আর কত হর্ম্ম্যচূড়ে
দিগন্তেরে করিছে দংশন; কলোচ্ছ্বাস
শ্বসিয়া উঠিছে শূন্যে করিবারে গ্রাস
নক্ষত্রের নিত্য নীরবতা। বহু ভৃত্য
আছে হোথা, বহু সৈন্য তব, জাগে নিত্য
কতই প্রহরী! এ পারে নির্জ্জন তীরে
একাকী উঠেছে ঊর্দ্ধে উচ্চ গিরিশিরে
রঞ্জিত মেঘের মাঝে তুষারধবল
তোমার প্রাসাদ-সৌধ,—অনিন্দ্য নির্ম্মল
চন্দ্রকান্ত মণিময়। বিজনে বিরলে
হেথা তব দক্ষিণের বাতায়ন তলে
মঞ্জরিত ইন্দুমল্লী বল্লরী বিতানে,
ঘনচ্ছায়ে, নিভৃত কপোত-কলগানে
একান্তে কাটিবে বেলা; স্ফটিক প্রাঙ্গণে
জলযন্ত্রে উৎসধারা কল্লোল-ক্রন্দনে
উচ্ছসিবে দীর্ঘ দিন ছল ছল ছল-
মধ্যাহূেরে করি দিবে বেদনা-বিহ্বল
করুণা-কাতর; অদূরে অলিন্দপরে
পুঞ্জ পুচ্ছ বিস্ফারিয়া স্ফীত গর্ব্বভরে
নাচিবে ভবন শিখী-রাজহংসদল
চরিবে শৈবাল বনে করি কোলাহল
বাঁকায়ে ধবলগ্রীবা; পাটলা হরিণী
ফিরিবে শ্যামল ছায়ে; অয়ি একাকিনী,
আমি তব মালঞ্চের হব মালাকর!
রাণী। ওরে তুই কর্ম্মভীরু অলস কিঙ্কর,
কি কাজে লাগিবি?
ভৃত্য। অকাজের কাজ যত,
আলস্যের সহস্র সঞ্চয়। শত শত
আনন্দের আয়োজন। যে অরণ্যপথে
কর তুমি সঞ্চরণ বসন্তে শরতে
প্রত্যুষে অরুণোদয়ে- শ্লথ অঙ্গ হতে
তপ্ত নিদ্রালসখানি সিগ্ধ বায়ুস্রোতে
করি দিয়া বিসর্জ্জন—সে বন-বীথিকা
রাখিব নবীন করি; পুষ্পাক্ষরে লিখা
তব চরণের স্তুতি প্রত্যহ উষায়
বিকশি উঠিবে তব পরশ তৃষায়
পুলকিত তৃণপুঞ্জতলে। সন্ধ্যাকালে
যে মঞ্জু মালিকাখানি জড়াইবে ভালে
কবরী বেষ্টন করি,আমি নিজ করে
রচি’ সে বিচিত্র মালা সান্ধ্য যূথীস্তরে,
সাজায়ে সুবর্ণ পাত্রে তোমার সম্মুখে
নিঃশব্দে ধরিব আসি অবনত মুখে,—
যেথায় নিভৃত কক্ষে, ঘন কেশ পাশ,
তিমির নির্ঝরসম উন্মুক্ত-উচ্ছ্বাস
তরঙ্গ-কুটিল, এলাইয়া পৃষ্ঠ পরে,
কনক মুকুর অঙ্কে, শুভ্র পদ্ম করে
বিনাইবে বেণী। কুমুদ সরসী কূলে
বসিবে যখন, সপ্তপর্ণ তরুমূলে
মালতী দোলায়-পত্রচ্ছেদ-অবকাশে
পড়িবে ললাটে চক্ষে বক্ষে বেশবাসে
কৌতূহলী চন্দ্রমার সহস্র চুম্বন;—
আনন্দিত তনুখানি করিয়া বেষ্টন
উঠিবে বনের গন্ধ বাসনা-বিভোল
মৃদু মন্দ সমীরের মত। অনিমেষে
যে প্রদীপ জ্বলে তব শয্যা শিরোদেশে
সারা সুপ্তনিশি, সুরনরস্বপ্নাতীত
নিদ্রিত অঙ্গপানে স্থির অকম্পিত
নিদ্রাহীন আঁখি মেলি -সে প্রদীপখানি
আমি জালাইয়া দিব গন্ধতৈল আনি।
শেফালির বৃন্ত দিয়া রাঙাইব, রাণী,
বসন বাসন্তী রঙে; পাদপীঠখানি
নব ভাবে নব রূপে শুভ আলিম্পনে
প্রত্যহ রাখিব অঙ্কি কুঙ্কুমে চন্দনে
কল্পনার লেখা! নিকুঞ্জের অনুচর,
আমি তব মালঞ্চের হব মালাকর!
রাণী। কি লইবে পুরস্কার?
ভৃত্য। প্রত্যহ প্রভাতে
ফুলের কঙ্কণ গড়ি, কমলের পাতে
আনিব যখন,—পদ্মের কলিকাসম
ক্ষুদ্র তব মুষ্টিখানি করে ধরি মম
আপনি পরায়ে দিব, এই পুরস্কার।
প্রতি সন্ধ্যাবেলা, অশোকের রক্তকান্তে
চিত্রি’ পদতল, চরণ-অঙ্গুলি-প্রান্তে
লেশমাত্র রেণু-চুম্বিয়া মুছিয়া লব
এই পুরস্কার!
রাণী। ভৃত্য, আবেদন তব
করিনু গ্রহণ। আছে মোর বহু মন্ত্রী
বহু সৈন্য বহু সেনাপতি,বহু যন্ত্রী
কর্ম্মযন্ত্রে রত,—তুই থাক্ চিরদিন
স্বেচ্ছাবন্দী দাস, খ্যাতিহীন কর্ম্মহীন!
রাজসভা বহিঃপ্রান্তে রবে তোর ঘর-
তুই মোর মালঞ্চের হবি মালাকর!
২২ অগ্রহায়ণ,
১৩০২।