চিত্রা/প্রেমের অভিষেক
তুমি মোরে করেছ সম্রাট্! তুমি মোরে
পরায়েছ গৌরব-মুকুট! পুষ্পড়োরে
সাজায়েছ কণ্ঠ মোর; তব রাজটীকা
দীপিছে ললাটমাঝে মহিমার শিখা
অহর্নিশি! আমার সকল দৈন্য লাজ,
আমার ক্ষুদ্রতা যত, ঢাকিয়াছ আজ
তব রাজ-আস্তরণে! হৃদিশয্যাতল
শুভ্র দুগ্ধফেননিভ, কোমল শীতল,
তারি মাঝে বসায়েছ; সমস্ত জগৎ
বাহিরে দাঁড়ায়ে আছে, নাহি পায় পথ
সে অন্তর-অন্তঃপুরে! নিভৃত সভায়
আমারে চৌদিকে ঘিরি সদা গান গায়
বিশ্বের কবিরা মিলি; অমরবীণায়
উঠিয়াছে কি ঝঙ্কার! নিত্য শুনা যায়
দূর দূরান্তর হতে দেশবিদেশের
ভাষা, যুগযুগান্তের কথা, দিবসের
নিশীথের গান, মিলনের বিরহের
গাথা, তৃপ্তিহীন শ্রান্তিহীন আগ্রহের
উৎকণ্ঠিত তান!-
প্রেমের অমরাবতী,
প্রদোষ-আলোকে যেথা দময়ন্তী সতী
বিচরে নলের সনে, দীর্ঘনিঃশ্বসিত
অরণ্যের বিষাদ-মর্ম্মের; বিকশিত
পুষ্পবীথিতলে, শকুন্তলা আছে বসি
কর-পদ্মতল-লীন স্নান মুখশশি
ধ্যানরতা; পুরুরবা ফিরে অহরহ
বনে বনে, গীতস্বরে দুঃসহ বিরহ
বিস্তারিয়া বিশ্বমাঝে; মহারণ্যে যেথা,
বীণা হস্তে লয়ে, তপস্বিনী মহাশ্বেতা
মহেশ-মন্দিরতলে বসি একাকিনী
অন্তরবেদনা দিয়ে গড়িছে রাগিণী
সান্তনা-সিঞ্চিত; গিরিতটে শিলাতলে
কানে কানে প্রেমবার্ত্তা কহিবার ছলে
সুভদ্রার লজ্জারুণ কুসুমকপোল
চুম্বিছে ফাল্গুণী; ভিখারী শিবের কোল
সদা আগলিয়া আছে প্রিয়া পার্ববতীরে
অনন্ত ব্যগ্রতাপাশে; সুখদুঃখনীরে
বহে অশ্রু-মন্দাকিনী, মিনতির স্বরে
কুসুমিত বনানীরে ম্লানমুখী করে
করুণায়; বাঁশরীর ব্যথাপূর্ণ তান
কুঞ্জে কুঞ্জে তরুচ্ছায়ে করিছে সন্ধান
হৃদয়সাথীরে;—হাত ধরে’ মোরে তুমি
লয়ে গেছ সৌন্দর্যের সে নন্দনভূমি
অমৃত-আলয়ে! সেথা আমি জ্যোতিষ্মান্
অক্ষয় যৌবনময় দেবতাসমান,
সেথা মোর লাবণ্যের নাহি পরিসীমা,
সেথা মোরে অর্পিয়াছে আপন মহিমা
নিখিল প্রণয়ী; সেথা মোর সভাসদ্
রবিচন্দ্রতারা, পরি’ নব পরিচ্ছদ
শুনায় আমারে তারা নব নব গান
নব অর্থভরা; চির-সুহৃদ্সমান
সর্ব্ব চরাচর! হেথা আমি কেহ নহি,
সহস্রের মাঝে একজন,—সদা বহি
সংসারের ক্ষুদ্র ভার,—কত অনুগ্রহ
কত অবহেলা সহিতেছি অহরহ;
সেই শত সহস্রের পরিচয়হীন
প্রবাহ হইতে, এই তুচ্ছ কর্ম্মাধীন
মোরে তুমি লয়েছ তুলিয়া, নাহি জানি
কি কারণে! অয়ি মহীয়সী মহারাণী
তুমি মোরে করিয়াছ মহীয়ান্! আজি
এই যে আমারে ঠেলি চলে জনরাজি
না তাকায়ে মোর মুখে, তাহারা কি জানে
নিশিদিন তোমার সোহাগ সুধাপানে
অঙ্গ মোর হয়েছে অমর? তাহারা কি
পায় দেখিবারে-নিত্য মোরে আছে ঢাকি
মন তব অভিনব লাবণ্য বসনে?
তব স্পর্শ তব প্রেম রেখেছি যতনে,
তব সুধাকণ্ঠবাণী, তোমার চুম্বন,
তোমার আঁখির দৃষ্টি, সর্ব্ব দেহ মন
পূর্ণ করি; রেখেছে যেমন সুধাকর
দেবতার গুপ্ত সুধা যুগ যুগান্তর
আপনারে সুধাপাত্র করি; বিধাতার
পুণ্য অগ্নি জ্বালায়ে রেখেছে অনিবার
সবিতা যেমন সযতনে; কমলার
চরণ কিরণে যথা পরিয়াছে হার
সুনির্মল গগনের অনন্ত ললাট!
হে মহিমাময়ী মোরে করেছ সম্রাট!
১৪ মাঘ,
১৩০০ সাল।