চীন ভ্রমণ/রেঙ্গুনের পথে

চীন ভ্রমণ।

—X—

রেঙ্গুনের পথে

 ভোর ৬টার সময় কলিকাতা বন্দর হইতে জাহাজখানি ছাড়িল। যাঁহারা আমাকে তুলিয়া দিতে আসিয়াছিলেন তাঁহারা তীর হইতে চাদর দোলাইয়া বিদায় গ্রহণ করিলেন। আমি কখনও সমুদ্রযাত্রা করি নাই, -এই প্রথম। মনে এক অনির্ব্বচনীয় ভাব আসিল। তাহা ভয় নয়, দুঃখ নয়, আনন্দও নয়, -একরূপ অনিশ্চিত ভাব।

 যখন জাহাজ ছাড়িল, তখন আমি কেবিনে জিনিষপত্র রাখিয়া ড়েকের উপর দাঁড়াইয়াছিলাম। অত বড় প্রকাণ্ড জাহাজখানির গতি মোটেই বুঝা গেল না। কেবল এঞ্জিনের শব্দ ও জলের আন্দোলন হইতে বুঝা যাইতে লাগিল জাহাজ খানি চলিতেছে। হাইকোর্ট, ইডেন গার্ডেন, বোটানিক্যাল গার্ডেন ইত্যাদি ছাড়াইয়া জাহাজ খানি ধীরে ধীরে সাগরের দিকে অগ্রসর হইতে লাগিল। দুই তীর ব্যাপিয়া কত বাড়ী ও কল-কারখানা; সকলগুলিই বিদেশীয়দের; একটাও দেশীয় লোকদের নহে।

 কলিকাতা হইতে গঙ্গার মোহনা ৯০ মাইল দূরবর্ত্তী। জাহাজখানি ঘণ্টায় ১৫ মাইল যায়। সুতরাং ৬ ঘণ্টায় সমুদ্রে পৌঁছিবার কথা। কিন্তু তা না হইয়া আমাদের “সাগর পয়েণ্ট” পৌঁছিতে প্রায় ৯ ঘণ্টা লাগিল। তাহার কারণ, গঙ্গার মোহনায় বিস্তর চড়া আছে বলিয়া, জাহাজ আস্তে আস্তে চালাইতে হইল। বৈকালে ডায়মণ্ডহারবারের আলোক-গৃহ (Light house) ও কেল্লা দেখিলাম। এ সকল স্থানে নদীর মুখ অতিশয় প্রশস্ত-এক তীর হইতে অন্য তীর প্রায় দেখা যায় না। ইহার কিছু নিম্নে সাগর পয়েণ্ট। এই স্থানটি অতি ভয়ানক স্থান, -চোরাবালির চূড়ায় পড়িয়া এই স্থানে বিস্তর জাহাজ মারা গিয়াছে। সেই কারণ আস্তে আস্তে, সাবধানে জাহাজ চালাইতে হয়। হালকা ক্ষুদ্র নৌকা (Life-Boat) গুলি সততই জলে নামাইবার জন্য প্রস্তুত রাখিতে হয়। চোরাবালিব চড়ায় জাহাজ লাগিয়া বিপদগ্রস্থ হইলে জাহাজের আরোহীরা এই বোটে চড়িয়া প্রাণ বাঁচাইতে পারে।

 যে গঙ্গা-সাগরে তীর্থযাত্রীরা তীর্থ করিতে ও স্নান করিতে যায়,সেই সাগর দ্বীপ এই খানেই অবস্থিত। দ্বীপ ছাড়া তথায় এখন আর কিছুই দেখিবার নাই ইহার পরেই সমুদ্র আরম্ভ হইয়াছে।

 কাপ্তেনই জাহাজের প্রধান কর্ম্মচারী। তাঁহার আদেশ মতই সমুদ্রে জাহাজ চালান হয়; কিন্তু কোনও বন্দরের ভিতর তিনি জাহাজ চালাইতে পারেন না। তার জন্য আলাহিদা লোক আছে,—তাদের “পাইলট” (Pilot) বলে। এতক্ষণ তিনিই জাহাজ চালাইয়া আসিয়াছিলেন। এই অবধি পৌঁছাইয়া দিয়া, একখানি ছোট বোটে চড়িয়া পাইলট কলিকাতার দিকে ফিরিলেন। সাগর-তরঙ্গে বোটখানি হেলিতে-দুলিতে কলিকাতার দিকে চলিয়া গেল।

 ক্রমে বেলাভূমি রেখার মত সূক্ষ্ম হইয়া আসিল, এবং পরে একেবারে অদৃশ্য হইল। তখন কালিদাসের সেই, -“আভাতি বেলা লবণাম্বু দ্বারা নিবন্ধেব কলঙ্করেখা।” কবিতাটা মনে পড়িয়া গেল। তৎপরে আর চারি দিকে কিছুই নাই, কেবল অনন্ত নীল জলরাশি! কেবল কতকগুলি সাদা সুস্থকায় জলচর পক্ষী জাহাজের চারি দিকে উডিয়া বেড়াইতেছিল। উপরে মেঘমণ্ডিত আকাশ। পশ্চিম আকাশ রক্তিম আভায় রঞ্জিত হইয়া উঠিল। বারিধিবক্ষেও সেই আভা প্রতিফলিত হইল। ক্রমে সুর্যদেব অস্ত গেলেন। ধারণী তিমিরাবগুণ্ঠিতা হইলেন। আকাশে শত সহস্ৰ হীরক খণ্ড জ্বলিয়া উঠিল।

 নদীমুখ হইতে সমুদ্র পড়িলে ভিন্ন ভিন্ন স্থানে জলের বর্ণ পরিবর্ত্তন একটি বিচিত্র দৃশ্য। ময়লা মাটির মিশ্রণে নদী জলের রঙ ও ময়লা পাটকিলে বর্ণ। সমুদ্র জলের রঙ ঘোর নীল বর্ণ; কিন্তু নির্ম্মল ও স্বচ্ছ। নদী যেখানে সমুদ্রে মিশিয়াছে, সে স্থানের জলের রঙ পাটকিলে ও লাল, উভয় রঙের মিশ্রণে সবুজ হইয়াছে। সমুদ্রে মিশিবার সময় নদীবেগ প্রশমিত হয় বলিয়া এই স্থানে নদীজলের যত ময়লা মাটি তথায় থিতাইয়া পড়ে ও সেই কারণে চোরাবালির চড়া প্রস্তুত হয়। সুতরাং এই সকল স্থান দিয়া জাহাজের গমনাগমন অত্যন্ত বিপজ্জনক। সাগর পয়েণ্টের কাছে জাহাজ তাই সন্তর্পণে আসিল। ক্রমে পাটকিলেবর্ণ সবুজ হইয়া পরে নীল হইয়া গেল। এখন হইতে কেবল নীল জলরাশি।

 জাহাজ দিন রাত চলে। কৃষ্ণপক্ষের ঘোর অন্ধকারে অনন্ত জলরাশি ভেদ করিয়া জাহাজ সমস্ত রাত্রি চলিতে লাগিল। এমন অনিশ্চিত স্থানে কি বিদ্যার বলে, কি সাহসে যে আপনার গন্তব্য পথ ঠিক রাখিয়া জাহাজ চোখ বুজিয়া চলে, সে কথা ভাবিলেও বিস্মিত হইতে হয়।

 জাহাজগুলি এত বড় ও এত সুন্দর যে, এক একটা জাহাজ যেন এক একটি সহর। আমাদের জাহাজে সর্ব্বসমেত প্রায় ১২ শত লোক ছিল। সকলেরই থাকিবার নির্দিষ্ট স্থান আছে। সকল বিষয়েই সুব্যবস্থা। জাহাজখানি ৩ শত ফিট লম্বা ও ৪০ ফিট চওড়া। জাহাজের পিছনে প্রথম শ্রেণী অবস্থিত। দুই ধারে দুই সার কেবিন ও মধ্যে প্রথমশ্রেণীর বৈঠকখানা (Saloon) ও ভোজনাগার (Dining room)। জাহাজের মধ্যস্থলে এঞ্জিন (Engine) ও তাহার দুই পার্শ্বে দুই সার দ্বিতীয় শ্রেণীর কেবিন। জাহাজের সম্মুখ দিকে কতকগুলি ছোট ছোট কেবিন আছে তথায় লস্করেরা থাকে। প্রথম শ্রেণীর কেবিনগুলির উপরে প্রথম শ্রেণীর ড়েক বা পাটাতন। দ্বিতীয় শ্রেণীর কেবিনগুলির উপরে দ্বিতীয় শ্রেণীর ডেক। এই গুলি যাত্রীদের আরামের স্থান। এই সকল ডেকে কাঠ ও কেম্বিস নির্ম্মিত চেয়ার পাতিয়া যাত্রীরা বসিয়া থাকে, বা পা-চালি করিয়া বেড়ায়, বা খেলা করে, গল্প করে, বা পড়ে। আহারের সময় ছাড়া সমস্ত দিনই এইখানে থাকিতে হয়। প্রথম শ্রেণী ও দ্বিতীয় শ্রেণীর মধ্যে যে স্থান আছে এবং দ্বিতীয় শ্রেণী ও লস্করদের কেবিনের মধ্যে যে স্থান আছে, সেগুলি ডেকের যাত্রীদের (Deck passenger) জন্য। সকল ডেক গুলিরই কেম্বিসের ছাত আছে। ইহার নীচে আরও দুই তলা আছে,—সিঁড়ি দিয়া তথায় নামিতে হয়। তন্মধ্যে সকলের নীচের তলায় মাল বোঝাই হয়, ও তাহার উপর তালায় কতকগুলি ডেক-যাত্রী থাকে। দ্বিতীয় শ্রেণীর ডেকের উপর কাপ্তেনের থাকিবার কেবিন আছে ও তাহার উপর (Bridge) হাল ফিরাইবার স্থান।

 প্রথম শ্রেণীর প্রতি কেবিনে একটি বা দুইটা করিয়া শুইবার স্থান আছে। প্রত্যেকটী ৬ ফুট লম্বা ও ২॥০ ফুট চওড়া এবং প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য এক একটা পোর্সিলেনের মুখ ধুইবার টব ও তাহার আনুসঙ্গিক দ্রব্যাদি, যথা,—সাবান তোয়ালে আয়না ইত্যাদি আছে। ঘরে বিদ্যুতের আলো জ্বলে। পাইখানা ও স্নানাগার অন্য স্থানে। স্নানাগারে ১০ মিনিটের বেশী থাকিবার নিয়ম নাই। সকল লোকের ত সুবিধা দেখা চাই। দ্বিতীয় শ্রেণীর কেবিনগুলিও ঐরূপ, তবে তাহাতে তিন চারিটিী লোকের থাকিবার স্থান আছে। এই মাত্র প্রভেদ। বিছানা, কম্বল, সাবান, তোয়ালে ইত্যাদি আবশ্যকীয় দ্রব্যাদি জাহাজ হইতেই দেওয়া হয়। অনেকগুলি কেবিন লইয়া এক একটী চাকর নির্দিষ্ট আছে। তাহাকে বয় (Boy) বলে। সে যথা সময়ে বিছানা পাতে, জুতা ঝাড়ে ও খানা জোগায়। জাহাজে নাপিত আছে; কিন্তু ধোপার ব্যবস্থা নাই। কোন বন্দরে জাহাজ থামিলে কাপড় কাচাইয়া লাইতে হয়। এক দিনেই কাপড় কাচিয়া দিতে পারে; কিন্তু প্রতি কাপড় খানির জন্য দুই আনার ও বেশী দিতে হয়।

 প্রথম শ্রেণীর ও দ্বিতীয় শ্রেণীর ভোজনাগার পৃথক পৃথক; ঠিক নির্দিষ্ট সময়ে ভোজনের ঘণ্টা পড়ে। সকাল ৯টার সময়ে প্রাতর্ভোজন (Breakfast), ১টার সময়ে জলযোগ টিফিন (Tiffin) ও সন্ধ্যা ৭টার সময়ে প্রধান ভোজন বা ডিনার (Dinner) হয়। তা’ছাড়া প্রত্যুষে ৬টার সময় ছোট হাজারী ও বৈকালে ৪টার সময় বৈকালিক বা (After-noon Tea)দেওয়া হয়। এ দুটিতে কেবল চা ও মাখন,এবং পাউরুটির টোষ্ট থাকে। তা ছাড়া সকল সময়েই প্রচুর মাংস দেয়। ডিম, মাছ, মুরগী, পায়রা, হাঁস, ভেড়া ইত্যাদি নানারূপ মাংস আধসিদ্ধ ভাবে প্রস্তুত হয়। মাংস ও মাছ বরফের ঘরে (Ice Chamber) রক্ষিত হয়। এজন্য ইহা অনেক দিন পর্য্যন্ত টাটকা জিনিষের মত থাকে। তবে কতক কতক জীবিত জন্তু ও পক্ষীও রাখা হয়! ব্রেক্-ফাষ্ট ও টিফিনে ভাত ও পাওয়া যায়। তা ছাড়া অতি উপাদেয় ফল, যেখানে যা পাওয়া যায়, উক্ত খানায় ও টীফিনের সঙ্গে দিয়া থাকে রুটী, মাখন, জ্যাম, জেলি অপর্য্যাপ্ত। তবে নিরামিষাশীর আহারের অনেকটা অসুবিধা হয়। জাহাজে বিলাতী গাঢ় দুগ্ধ (Condensed Milk) ছাড়া অন্য দুধ পাওয়া যায় না।

 পূর্ব্বেই বলিয়াছি, দিন রাত জাহাজ চলে। তখন জাহাজের লোক জন, বিস্তীর্ণ জলরাশি ও অনন্ত নীল আকাশ ছাড়া আর কিছুই দেখিতে পাওয়া যায় না। উড্ডীয়মান মৎস্য সকল জাহাজের শব্দে জল হইতে উড়িয়া খানিকদূর গিয়া আবার জলে বিলীন হয়। পথে কখন কখন অন্য জাহাজের সহিত দেখা হয়; তখন শত শত লোক উৎসুক চিত্তে, সাগ্রহ দৃষ্টিতে সেই দিকে চাহিয়া থাকে,—যেন কি এক অদ্ভুত নূতন জিনিষ। এই সময় ডেকে বসিয়াই অধিকাংশ সময় কাটে! বসিয়া বসিয়া বিরক্তি ধরিয়া যায়। একটু চলিতে ইচ্ছা হয়। তখন কেবল মাত্র একটু এদিক ওদিক পা-চালি করা চলে। দোলনা আছে দুলিতে পার, রক্ত সঞ্চালন একটু সতেজ হইবে। পুস্তকাগার আছে তাহা হইতেই পুস্ত্ক লইয়া অধিক সময় কাটান যায়। সঙ্গীতের জন্য একটী ঘরে পিয়ানো (Piano) আছে, তাতেও অনেক সময় আমোদে কাটিতে পারে। কত লোক তাস খেলে, জুয়া খেলে। সকলেই সময় কাটাইবার জন্য বাস্ত, সুতরাং লোকের সহিত আলাপ সহজেই ঘটয়া সায়। একত্রে বসিয়া দাড়াইয়া অল্প দিনের ভিতর এত আলাপ হয়,—উভয়ে যেন কত দিনের, কত পুরুষের আত্মীয়তা আছে। অন্তরের কথা অবধি বিনিময় হয়। বিদায় লইবার কালে বড়ই ব্যথা লাগে। জাহাজের উচ্চ কর্ম্ম চারীরাও প্রায়ই অতিশয় মিশুক ও অবসর কালে সকলের সহিত মিশিতে ও গল্প করিতে ভালবাসেন। এইরূপ নানা রকমে বেশ আনন্দে সময় কাটিয়া যায়।

 তবে যদি সমুদ্রে বেশী ঢেউ হয় ও জাহাজ টলে, তাহা হইলে শরীর কেমন আনচান্ করে, মাথা ঘোরে, দাঁড়াইতে কষ্ট হয় ও কাহারও কাহারাও, -বিশেষ প্রথম সমুদ্রযাত্রীর বমির বেগ আসে। (Sea-sickness) সামুদ্রিক পীড়া একেই বলে। দাঁড়াইবার যো নাই, মাথা তুলিবার যো নাই, কিছু খাইবার যো নাই, অনবরত বমির বেগ। বমি হইয়া গেলে আরাম বোধ হয়, তবে প্রায়ই কেবল মাত্র বমির বেগই আসে,—বমি হয় না; অথবা যদি কিছু উঠে, তাহা অতি বিকট পিত্ত কিম্বা অম্বল। জাহাজের মধ্যস্থল সর্ব্বাপেক্ষা কম দোলে,—তাই দ্বিতীয় শ্রেণীর ডেকের উপর হাওয়ায় মাথা করিয়া শুইয়া থাকিলে খুব আরাম বোধ হয়। খুব পাক দিলে যে কারণে বমি হয়, সামুদ্রিক পীড়াও সেইরূপ কারণে হইয়া থাকে। অনেকের মত, এরূপ অবস্থায় বমির বেগ সত্ত্বেও আহার করা উচিত। কিন্তু আমার বোধ হয়, গরম জল পান করিয়া গলায় আঙ্গুল দিয়া প্রথম বমি করিয়া ফেলাই কর্ত্তব্য; তাহাতে বিকৃত পিও ও অম্ল উঠিয়া গেলে শরীর শীঘ্র সুস্থ হয়। সামুদ্রিক পীড়া কাটিয়া যাওয়ার পর ক্ষুধা ও হজম আরও ভাল হয়, এবং শরীর আরও সুস্থ ও সবল হয়।

 অনেক প্রকার যাত্রীর সহিত একত্রে থাকিতাম; তার মধ্যে কতকগুলির কথা বিশেষ করিয়া বলি। আমাদের সঙ্গে একটি জার্ম্মাণ-বালিকা ছিলেন, তিনি তাঁহার বিধবা মায়ের সঙ্গে কলিকাতা হইতে রেঙ্গুন যাইতেছিলেন। তাঁহার পিতার সম্প্রতি মৃত্যু হইয়াছে। অথচ তাঁহাদের কাহাকেও তত বিষণ্ণ দেখিলাম না। তিনি অহরহ সামুদ্রিক পীড়ায় কাতর হইতেন। ১৭।১৮ বৎসর বয়সেও তাঁহার বালিকা সুলভ চপলতা যায় নাই। সুস্থ, সবল শরীরে ও মনের আনন্দে সারাদিন তিনি জাহাজের এদিক ওদিক ছুটী ছুটি করিয়া বেড়াইতেন। কিন্তু যাই জাহাজ একটু দুলিত, অমনি তিনি কাতর হইয়া পড়িতেন,—উঠিবার বা খাইবার শক্তি থাকিত না।

 একটি চীনে বালক ছিল সে কলিকাতার ডভেটন কলেজের ছাত্র। তার পিতা চীনেম্যান এবং মাতা ব্রহ্মদেশীয়া স্ত্রীলোক। তাহাকে দেখিয়া সঙ্গতিপন্ন লোকের ছেলে বলিয়া মনে হইল। বাড়ী যাইবার আনন্দে সে সারাপথই উৎফুল্ল। কিন্তু সে ও ঐরূপ জাহাজ দুলিলেই কাতর হইয়া পড়িত। নয়ত সারা দিন একটি ছোট বাঁশী বাজাইয়া দিন কাটাইত। তাহার বাঁশী ৰাজানর শিক্ষা ও অতি আশ্চর্য্য। এঞ্জিনের শব্দ ভেদ করিয়া অতি সুমধুর স্বরে সে যখন চীনে গানের, বর্ম্মা গানের, ইংরাজী গানের রাগ-রাগিণী আলাপ করিত, তখন জাহাজের কর্ম্মচারীরা ও যাত্রীরা মুগ্ধ হইয়া তাহার সেই মধুর সঙ্গীত শুনিতে থাকিত।

 আর ছিল,—একটি অনাথ ইংরেজ বালক। তাহার ১৭ বৎসর মাত্র বয়স। তাহার বিধবা মাতাকে যিনি বিবাহ করিয়াছিলেন, সেই পিতা তাহার মায়ের মৃত্যুর পরই ১৪ বৎসর বয়স হইতে তাহার সাহায্য বন্ধ করিয়া দিয়াছিলেন। সেই থেকে বালক টেলিগ্রামের কাজ করে। এত দিনে সে স্বচ্ছল পয়সার মুখ দেখিতেছে। অল্প বয়স হইতেই আপনার পথ দেখিতে হইতেছে বলিয়া তার প্রতিকার্য্যে স্বাধীনতা ও সুবিবেচনার ভাষা দেখিলাম। নিজের যৎসামান্য দ্রব্যাদি লইয়া সে আন্দামান দ্বীপে তারহীন টেলিগ্রাফের (Wireless Telegraphy) তত্ত্বাবধান করিতে যাইতেছে।

 একদিন সন্ধ্যাবেলা একজন শীর্ণকায় বৃদ্ধ থালাসী জাহাজের ডেকের উপর দাঁড়াইয়া নেমাজ পড়িতেছিল। কাজ হ’তে ক্ষণেক ছুটি পেয়ে যখন সে পশ্চিম আকাশের দিকে কালিঝুলি মাখা মুখ ফিরিয়ে ভাঙ্গা ভাঙ্গা সুরে স্তুতুি গানগুলি উচ্চারণ করছিল,তার প্রতি স্বর, প্রতি মুখভঙ্গি ও অঙ্গ বিক্ষেপে এক পবিত্র তন্ময় ভাব উথলে পড়ছিল।

 দ্বিতীয় দিন রাত্রে, পথে (Bessin) বেসিনের আলোক-গৃহ দেখিলাম। নিবিড় অন্ধকারের ভিতর আলোকটি দূরে ঘুরিয়া ঘুরিয়া জ্বলিতেছে। একবার পূর্ণ দীপ্তিমান, এক একবার ক্ষীণপ্রভ। অন্য সকল আলো হইতে প্রভেদ জানাইবার জন্য আলোক-গৃহের আলো এমনি ঘুরিয়া ঘুরিয়াই জ্বলে। যেন পরোপকারব্রতে ব্রতী হইয়া বিপদসঙ্কুল স্থানে দাঁড়াইয়া পথিককে পথ দেখাইতেছে।

 নিকটবর্ত্তী তীরভূমি বা পাহাড় হইতে সাবধান হইবার জন্য ও গন্তব্য পথ দেখাইবার জন্য যেরূপ আলোক-গৃহ থাকে, নিমজ্জিত চূড়া হইতে সাবধান করিবার জন্যও তদ্রূপ আলোক-জাহাজ (Light Ship) থাকে। একখানি ক্ষুদ্র জাহাজ মাঝ সমুদ্রে নাঙ্গর করিয়া তাহার উচ্চ মাস্তুলে আলো জ্বালে। পথে এইরূপ আলোক-জাহাজও অনেক জায়গায় দেথা যায়।

 তিন দিন দুই রাত্রি ক্রমাগত জাহাজ চালাইয়া তৃতীয় দিন সন্ধ্যার সময় এলিফেণ্ট পয়েণ্টের (Elephant Point) আলোক-গৃহ দেখা গেল। কলিকাতা হইতে রেঙ্গুন ৭৬০ মাইল হইবে। আমাদের জাহাজখানি মেল অর্থাৎ ডাক লইয়া আসিতেছে, তাই অপেক্ষাকৃত শীঘ্র আসিয়া পৌঁছিল। অন্য ষ্টীমারে পৌছিতে আরও এক দিন দেরি হয়।

 সকল স্থানেই জমির সন্নিকটবর্ত্তী হইলেই কতকগুলি চিহ্ন দ্বারা বেলাভূমি দেখিতে পাইবার বহু পূর্ব্বে জমি যে নিকটে আছে, তাহা বেশ বুঝা যায়। সমুদ্রজলের ঘোর নীল রঙ সবুজ হইয়া উঠে। জমির দ্রব্যাদি ও গাছপালা জলে ভাসিতে দেখা যায়। নদীতে বিচরণকারী পাখী সকল উড়িয়া আসিয়া চারিদিকে বেড়ায়।

 সন্ধার সময় আমরা ইরাবতীর মোহনায় প্রবেশ করিলাম। জাহাজের মাস্তুলে রাজার ডাকের (Royal Mail) নিশান উড়াইয়া দেওয়া হইল। নদীর মধ্যে প্রবেশ করিবার সময় জাহাজ বাঁশী বাজাইয়া হুঙ্কার করিল। সকলেরই মনে আনন্দ হইল। নূতন দেশের নূতন হাওয়া আমাদের গায়ে লাগিতে লাগিল। ক্ষুদ্রকায় তৃতীয়ার চাঁদ শুকতারার সঙ্গে লাল সন্ধ্যাকাশে দেখা দিল। বৃহস্পতিও উদয়োন্মুখ। অগণ্য তারাদল ইরাবতীবক্ষে ও ব্রহ্মদেশের সমতল ভূমির উপর উদয় হইল।

 ওই ব্রহ্মদেশ ও এই ইরাবতী নদী ভারতবর্ষেরই পাশে, সংস্কৃত নামে অভিহিত। গৌতম বুদ্ধের প্রবর্ত্তিত “সর্ব্বজীবে দয়াধর্ম্ম” এখানেও প্রচলিত। ইহারা আমাদের প্রতিবাসী ও কত নিকট আত্মীয়।  তাই আমাদের আসতে দেখে কতকগুলি সাদা সাদা সুস্থাকায় পক্ষী মধুর স্বরে ডাকতে ডাকতে জাহাজ প্রদক্ষিণ করে আমাদের যেন সম্ভাষণ করতে এলো। অমন সুস্থ শরীর,—এমন উন্মুক্ত স্থানে না থাকলে হয় না। স্বরও কি তেমনি 'আনন্দ-ব্যজ্ঞক! যেন ব’লছিল, “আয় পথিক! আয় বিদেশী! -আয় তোরা, আমাদেরই আপনার লোক। এ তোদেরই ঘর-বাড়ি। পথশ্রমে কাতর হ’য়েছিস্। মুখ হাত পা ধো। পর ভেবে যেন সঙ্কুচিত হোসনে।”

 খানিক অগ্রসর হইয়া জাহাজ নঙ্গর করিল। কলের তরীখানি ইরাবতীর স্রোতে দুলিতে লাগিল। একটী বাঙ্গালী বাৰু চাকরী উপলক্ষে রেঙ্গুন যাইতেছিলেন। তিনি পুলকে গলা ছাড়িয়া সুকণ্ঠে গাহিতে লাগিলেন,—

“জলধি র’য়েছে স্থির,
ধূ-ধূ করে সিন্ধু-তীর,
প্রশান্ত সুনীল নীর নীল শূন্যে মিশাইয়া।”