চোখের বালি/২
মেয়ে দেখিবার কথা মহেন্দ্র প্রায় ভুলিয়াছিল, অন্নপূর্ণা ভোলেন নাই। তিনি শ্যামবাজারে মেয়ের অভিভাবক জেঠার বাড়িতে পত্র লিখিয়া দেখিতে যাইবার দিন স্থির করিয়া পাঠাইলেন।
দিন স্থির হইয়াছে শুনিয়াই মহেন্দ্র কহিল, “এত তাড়াতাড়ি কাজটা করিলে কেন কাকী! এখনো বিহারীকে বলাই হয় নাই।”
অন্নপূর্ণ কহিলেন, “সে কি হয় মহিন। এখন, না দেখিতে গেলে তাহারা কী মনে করিবে।”
মহেন্দ্র বিহারীকে ডাকিয়া সকল কথা বলিল। কহিল,“চলো তো, পছন্দ না হইলে তো তোমার উপর জোর চলিবে না।”
বিহারী কহিল, “সে কথা বলিতে পারি না। কাকীর বোনঝিকে দেখিতে গিয়া ‘পছন্দ হইল না’ বলা আমার মুখ দিয়া আসিবে না।”
মহেন্দ্র কহিল, “সে তো উত্তম কথা।”
বিহারী কহিল, “কিন্তু তোমার পক্ষে অন্যায় কাজ হইয়াছে মহিনদা। নিজেকে হালকা রাখিয়া পরের স্কন্ধে এরূপ ভার চাপানো তোমার উচিত হয় নাই। এখন কাকীর মনে আঘাত দেওয়া আমার পক্ষে বড়োই কঠিন হইবে।”
মহেন্দ্র একটু লজ্জিত ও রুষ্ট হইয়া কহিল,“তবে কী করিতে চাও।”
বিহারী কহিল, “যখন তুমি আমার নাম করিয়া তাঁহাকে আশা দিয়াছ, তখন আমি বিবাহ করিব—দেখিতে যাইবার ভড়ং করিবার দরকার নাই।”
অন্নপূর্ণাকে বিহারী দেবীর মতো ভক্তি করিত।
অবশেষে অন্নপূর্ণা বিহারীকে নিজে ডাকিয়া কহিলেন, “সে কি হয় বাছা। না দেখিয়া বিবাহ করিবে, সে কিছুতেই হইবে না। যদি পছন্দ না হয় তবে বিবাহে সম্মতি দিতে পারিবে না, এই আমার শপথ রহিল।”
নির্ধারিত দিনে মহেন্দ্র কলেজ হইতে ফিরিয়া আসিয়া মাকে কহিল, “আমার সেই রেশমের জামা এবং ঢাকাই ধুতিটা বাহির করিয়া দাও।”
মা কহিলেন, “কেন, কোথায় যাবি।”
মহেন্দ্র কহিল, “দরকার আছে মা, তুমি দাও-না, আমি পরে বলিব”
মহেন্দ্র একটু সাজ না করিয়া থাকিতে পারিল না। পরের জন্য হইলেও কন্যা দেখিবার প্রসঙ্গমাত্রেই যৌবনধর্ম আপনি চুলটা একটু ফিরাইয়া লয়, চাদরে কিছু গন্ধ ঢালে।
দুই বন্ধু কন্যা দেখিতে বাহির হইল।
কন্যার জেঠা শ্যামবাজারের অনুকুলবাবু নিজের উপার্জিত ধনের দ্বারায় তাঁহার বাগান-সমেত তিনতলা বাড়িটাকে পাড়ার মাথার উপর তুলিয়াছেন।
দরিদ্র ভ্রাতার মৃত্যুর পর পিতৃমাতৃহীনা ভ্রাতুষ্পপুত্রীকে তিনি নিজের বাড়িতে আনিয়া রাখিয়াছেন। মাসি অন্নপূর্ণা বলিয়াছিলেন,‘আমার কাছে থাক্; তাহাতে ব্যয়লাঘবের সুবিধা ছিল বটে, কিন্তু গৌরবলাঘবের ভয়ে অনুকুল রাজি হইলেন না। এমন-কি, দেখাসাক্ষাৎ করিবার জন্যও কন্যাকে কখনো মাসির বাড়ি পাঠাইতেন না, নিজেদের মর্যাদা সম্বন্ধে তিনি এতই কড়া ছিলেন!
কন্যাটির বিবাহ-ভাবনার সময় আসিল, কিন্তু আজকালকার দিনে কন্যার বিবাহ সম্বন্ধে ‘যাদৃশী ভাবনা যস্য সিদ্ধির্ভবতি তাদৃশী’ কথাটা খাটে না। ভাবনার সঙ্গে খরচও চাই। কিন্তু পণের কথা উঠিলেই অনুকুল বলেন,‘আমার তো নিজের মেয়ে আছে, আমি একা আর কত পারিয়া উঠিব।’ এমনি করিয়া দিন বহিয়া যাইতেছিল। এমন সময় সাজিয়া-গুজিয়া গন্ধ মাখিয়া রঙ্গভূমিতে বন্ধুকে লইয়া মহেন্দ্র প্রবেশ করিলেন।
তখন চৈত্রমাসের দিবসান্তে সূর্য অস্তোন্মুখ। দোতলার দক্ষিণ-বারান্দায় চিত্রিত চিক্বণ চীনের টালি গাঁথা; তাহারই প্রান্তে দুই অভ্যাগতের জন্য রুপার রেকাবি ফলমূলমিষ্টান্নে শোভমান এবং বরফ-জল পূর্ণ রুপার গ্লাস শীতল শিশিরবিন্দুজালে মণ্ডিত। মহেন্দ্র বিহারীকে লইয়া আলজ্জিতভাবে খাইতে বসিয়াছেন। নীচে বাগানে মালী তখন ঝারিতে করিয়া গাছে গাছে জল দিতেছিল; সেই সিক্ত মৃত্তিকার স্নিগ্ধ গন্ধ বহন করিয়া চৈত্রের দক্ষিণবাতাস মহেন্দ্রের শুভ্র কুঞ্চিত সুবাসিত চাদরের প্রান্তকে দুর্দাম করিয়া তুলিতেছিল। আশপাশের দ্বার-জানালার ছিদ্রান্তরাল হইতে একটু-আধটু চাপা হাসি, ফিসফিস্ কথা, দুটা একটা গহনার টুংটাং যেন শুনা যায়।
আহারের পর অনুকুলবাবু ভিতরের দিকে চাহিয়া কহিলেন,”চুনি, পান নিয়ে আয় তো রে।”
কিছুক্ষণ পরে সংকোচের ভাবে পশ্চাতে একটা দরজা খুলিয়া গেল এবং একটি বালিকা কোথা হইতে সর্বাঙ্গে রাজ্যের লজ্জা জড়াইয়া আনিয়া পানের বাটা হাতে অনুকুলবাবুর কাছে আসিয়া দাঁড়াইল। তিনি কহিলেন, “লজ্জা কী, মা। বাটা ঐ ওঁদের সামনে রাখো।”
বালিকা নত হইয়া কম্পিত হস্তে পানের বাটা অতিথিদের আসন-পার্শ্বে ভূমিতে রাখিয়া দিল। বারান্দার পশ্চিমপ্রান্ত হইতে সূর্যাস্ত-আভা তাহার লজ্জিত মুখকে মণ্ডিত করিয়া গেল। সেই অবকাশে মহেন্দ্র সেই কম্পান্বিতা বালিকার করুণ মুখচ্ছবি দেখিয়া লইল।
বালিকা তখন চলিয়া যাইতে উদ্যত হইলে অনুকুলবাবু কহিলেন, “একটু দাঁড়া, চুনি। বিহারীবাবু, এইটি আমার ছোটাে ভাই অপূর্বর কন্যা। সে তো চলিয়া গেছে, এখন আমি ছাড়া ইহার আর কেহ নাই।”
বলিয়া তিনি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিলেন।
মহেন্দ্রের হৃদয়ে দয়ার আঘাত লাগিল। অনাথার দিকে আর-একবার চাহিয়া দেখিল।
কেহ তাহার বয়স স্পষ্ট করিয়া বলিত না। আত্মীয়েরা বলিত, ‘এই বারোতেরো হইবে।’ অর্থাৎ চোদ্দ-পনেরো হওয়ার সম্ভাবনাই অধিক। কিন্তু অনুগ্রহপালিত বলিয়া একটি কুণ্ঠিত ভীরুভাবে তাহার নব-যৌবনারম্ভকে সংযত সম্বৃত করিয়া রাখিয়াছে।
আর্দ্রচিত্ত মহেন্দ্র জিজ্ঞাসা করিল, “তোমার নাম কী।”
অনুকুলবাবু উৎসাহ দিয়া কহিলেন, “বলো মা, তোমার নাম বলো।”
বালিকা তাহার অভ্যস্ত আদেশপালনের ভাবে নতমুখে বলিল, “আমার নাম আশালতা।”
আশা! মহেন্দ্রের মনে হইল নামটি বড়ো করুণ এবং কণ্ঠটি বড়ো কোমল। অনাথ আশা!
দুই বন্ধু পথে বাহির হইয়া আসিয়া গাড়ি ছাড়িয়া দিল। মহেন্দ্র কহিল, “বিহারী, এ মেয়েটিকে তুমি ছাড়িয়ে না।”
বিহারী তাহার স্পষ্ট উত্তর না করিয়া কহিল, “মেয়েটিকে দেখিয়া উহার মাসিমাকে মনে পড়ে; বোধ হয় অমনি লক্ষ্মী হইবে।”
মহেন্দ্র কহিল, “তোমার স্কন্ধে যে বোঝা চাপাইলাম, এখন বোধ হয় তাহার ভার তত গুরুতর বোধ হইতেছে না।”
বিহারী কহিল, “না, বোধ হয় সহ করিতে পারিব।”
মহেন্দ্র কহিল, “কাজ কী এত কষ্ট করিয়া। তোমার বোঝা নাহয় আমিই স্কন্ধে তুলিয়া লই। কী বল।”
বিহারী গম্ভীরভাবে মহেন্দ্রের মুখের দিকে চাহিল। কহিল, “মহিনদা, সত্য বলিতেছ? এখনো ঠিক করিয়া বলো। তুমি বিবাহ করিলে কাকী ঢের বেশি খুশি হইবেন— তাহা হইলে তিনি মেয়েটিকে সর্বদাই কাছে রাখিতে পারিবেন।”
মহেন্দ্র কহিল, “তুমি পাগল হইয়াছ? সে হইলে অনেক কাল আগে হইয়াযাইত।”
বিহারী অধিক আপত্তি না করিয়া চলিয়া গেল, মহেন্দ্রও সোজা পথ ছাড়িয়া দীর্ঘ পথ ধরিয়া বহু বিলম্বে ধীরে ধীরে বাড়ি গিয়া পৌছিল।
মা তখন লুচি-ভাজা ব্যাপারে ব্যস্ত ছিলেন, কাকী তখনে তাঁহার বোনঝির নিকট হইতে ফেরেন নাই।
মহেন্দ্র এক নির্জন ছাদের উপর গিয়া মাদুর পাতিয়া শুইল। কলিকাতার হর্ম্যশিখরপুঞ্জের উপর শুক্লসপ্তমীর অর্ধচন্দ্র নিঃশব্দে আপন অপরূপ মায়ামন্ত্র বিকীর্ণ করিতেছিল। মা যখন খাবার খবর দিলেন, মহেন্দ্র অলস স্বরে কহিল, “বেশ আছি, এখন আর উঠিতে পারি না।”
মা কহিলেন, “এইখানেই আনিয়া দিই-না?”
মহেন্দ্র কহিল, “আজ আর খাইব না, আমি খাইয়া আসিয়াছি।”
মা জিজ্ঞাসা করিলেন, “কোথায় খাইতে গিয়াছিলি।”
মহেন্দ্র কহিল, “সে অনেক কথা, পরে বলিব।”
মহেন্দ্রের এই অভূতপূর্ব ব্যবহারে অভিমানিনী মাতা কোনো উত্তর না করিয়া চলিয়া যাইতে উদ্যত হইলেন।
তখন মুহূর্তের মধ্যে আত্মসম্বরণ করিয়া অনুতপ্ত মহেন্দ্র কহিল, “মা, আমার খাবার এইখানেই আনো।”
মা কহিলেন, “ক্ষুধা না থাকে তো দরকার কী।”
এই লইয়া ছেলেতে মায়েতে কিয়ৎক্ষণ মান-অভিমানের পর মহেন্দ্রকে পুনশ্চ আহারে বসিতে হইল।